অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৪, ২০২৫
২১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৪, ২০২৫
২১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মো. রায়হান পারভেজ -
মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ

‘পুলিশপ্রধান তাঁর বাহিনীসহ সবার আগে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ কমান্ডের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল।’ —জেনারেল রাও ফরমান আলী

কল্পনা করুন, এমন এক পরিস্থিতি যেখানে আপনার চারপাশে আক্রমণের জন্য ঘিরে আছে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত বিদেশি শত্রুবাহিনী, সেখানে আপনার ভরসা হিসেবে আছে শুধু পুরাতন আমলের থ্রি নট থ্রি রাইফেল। একটি ফুলকে বাঁচানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আপনি সেই রাইফেল নিয়ে মোকাবেলা করলেন শত্রুর এবং শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও প্রতিহত করলেন আগ্রাসী শত্রুর ধ্বংসলীলা। কল্পনায় নয়, ঠিক বাস্তবেই এমন একটি দৃশ্যপট চিত্রায়িত হয়েছে একাত্তরের মার্চের ২৫ তারিখের ভয়াল সেই কালরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ বইতে লেখকের রংতুলির আঁচড়ে সেই প্রতিরক্ষার চিত্রপট আমাদের মানসপটে যেন ভেসে ওঠে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুল সুতোয় গেঁথে যেমন বানানো হয় মালা, ঠিক তেমনি আলোচ্য গ্রন্থটি গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন লেখকের টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে। ক্রিকেট খেলায় ব্যাটিং দলের উদ্বোধনী জুটি ভালো নৈপুণ্য প্রদর্শন করলে যেমন পুরো খেলার শক্ত ভিত তৈরি হয়ে যায় ঠিক তেমনি এই গ্রন্থের নামভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া প্রথম প্রবন্ধ ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’-এ মো. মনিরুজ্জামান বিপিএম, পিপিএম (বার) ঐতিহাসিক পটভূমি ব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐ রাতের সময়ানুক্রমিক বর্ণনা এবং রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পরিচয় প্রদান করে নতুন প্রজম্মের কাছে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের সাতকাহন তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে।

‘একাত্তরের স্মৃতিকথা’ প্রবন্ধে রাজারবাগ খালার বাসায় অবস্থান করা সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর স্মৃতিচারণ পাঠককে করেছে আবেগাপ্লুত। পরবর্তী প্রবন্ধ ’২৫ মার্চ’-এ সেই রাত্রিতে রাজারবাগে বোনের বাসায় অবস্থান করা প্রখ্যাত চিত্রকর মুস্তাফা মনোয়ারের রাজারবাগ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বীভৎসতার বর্ণনায় শিউরে উঠেছে পাঠক। প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের রচিত প্রবন্ধ ‘স্বাধীনতার সাহসী সৈনিকদের স্মরণে’-এ কিছু তরুণের তাড়া খাওয়ার বর্ণনা পাঠককে একদিকে করেছে রোমাঞ্চিত, অন্যদিকে মনে জন্ম দিয়েছে অদম্য সাহস। সেই কালরাত্রিতে রাজারবাগের পার্শ্ববর্তী চামেলীবাগে অবস্থানরত শাহীন রেজা নূরের প্রবন্ধটি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে পাঠককে দেখিয়ে দেয় থ্রি নট থ্রি দিয়েও এভাবে লড়াই করা যায় যদি সঙ্গী হয় দেশপ্রেম।

লালমনিরহাট জেলা পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার প্রবন্ধ ‘কালরাতে থানা ফাঁড়ির প্রতিরোধ’ পাঠককে জানান দিয়েছে সেই রাতে ঢাকায় অবস্থানরত সকল থানা ফাঁড়ির সদস্যদের মানসিক দৃঢ়তা। প্রথম প্রতিরোধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সার্জেন্ট মো. মর্ত্তুজা হোসেন ‘রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সক্রিয় প্রতিরোধ’ প্রবন্ধে শুনিয়েছেন দ্বিতীয় জীবন পাওয়ার গল্প। ‘একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ’, ‘মনে পড়ে ৭১’, ‘মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি’, ‘কালো মেঘের মাঝে উঁকি দেয়া সূর্য’, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের কথা’, ‘মরণ সাগর পাড়ে’, ‘রক্তাক্ত রাজারবাগ’, ‘স্মৃতির রাজারবাগ’, ‘অগ্নিস্মৃতির একাত্তর’, ‘আমার স্বাধীনতা’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘আমার যুদ্ধের সঙ্গী সেই বেতারযন্ত্র’, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’, ‘গল্পটা প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের’— প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের প্রতিটি স্মৃতিচারণ যেন এক একটি শিকল ভাঙার গান, নিটোল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার এক একটি বীজমন্ত্র, নিপীড়নের বিরুদ্ধে অগ্রণী লড়াইয়ের ভুবনমাতানো কলের গান, বাঙালির চিরায়ত স্বাধীনতা স্বপ্নের আকাশে রাঙানো উজ্জ্বল রামধনু। আলোচ্য গ্রন্থটি সমাদৃত হওয়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করার কারণ তো এখানেই নিহিত।

কোনো শোভিত রাজমুকুটে যেমন হীরার টুকরো রাখলে সেই মুকুটটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়, তেমনি এই গ্রন্থটিতে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ কনস্টেবল, সাব ইন্সপেক্টর, ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর, রিজার্ভ অফিসে কর্মরত সদস্য, সুবেদার, আর্মড অফিসার, ওয়্যারলেস অপারেটর, গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন ক্যাপ্টেন, পুলিশ লাইনসের বীরাঙ্গনা সুইপার, রাজারবাগের তৎকালীন এডিশনাল এসপির সাবলীল ও প্রাণবন্ত সাক্ষাৎকার গ্রন্থটির উৎকর্ষ সাধনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সবকিছু ছাপিয়ে এই গ্রন্থটিতে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার সুবিধার্থে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ সম্পর্কিত মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার গোপন দলিল, অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা এবং রাজারবাগ এলাকার ওয়্যারলেস কথোপকথনের বাংলায় রূপান্তর গ্রন্থটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে।

নিন্দুকেরা বলবে— গ্রন্থটিতে ছবির উপস্থিতি নেই বললেই চলে, যদি রাজারবাগ এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ সম্পর্কিত কিছু আলোকচিত্র গ্রন্থটিতে যুক্ত করা যেত তবে গ্রন্থটির কদর অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটনার এমন নিখুঁত এবং ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠকমনের কল্পনার গণ্ডি অনেক প্রশস্ত করে সেই প্রতিরোধের চিত্রকল্প মনের ক্যানভাসে গেঁথে দিয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হওয়া চলচ্চিত্রের সংখ্যা কম নয়, তার মধ্যে অনেকগুলোই নিজ শিল্পগুণে অর্জন করে নিয়েছে খ্যাতি। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আইকন এবং ‘মানবিক পুলিশ’ ধারণাটির ফেরিওয়ালা হাবিবুর রহমান আলোচ্য গ্রন্থটি সম্পাদনায় মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করেছেন। তাতে বলাই যায় গ্রন্থটির লেখাকে উপজীব্য করে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে যদি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভবপর হয় তবে তা এদেশীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্থান করে দেওয়ার যোগ্য দাবিদার হবে।

মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ

সম্পাদনা : হাবিবুর রহমান বিপিএম, পিপিএম

প্রকাশক : বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০০৮

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২০০

৩ নম্বর ওয়ার্ড, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন থেকে

rayhan.pervej@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

One Comment

  • I’m extremely impressed together with your writing talents as smartly as with the layout on your weblog. Is this a paid subject or did you modify it yourself? Anyway keep up the nice high quality writing, it is rare to look a nice blog like this one nowadays!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *