অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ৬, ২০২৫
২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ৬, ২০২৫
২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নবী হোসেন নবীন -
কান্তু কবিরাজ

কান্তু লেখা পড়ায় অমনোযোগী হলেও দুষ্টুমিতে ছিল খুবই পাকা। তার বালকসুলভ দুষ্টুমির সাথে মাঝে মাঝে এমন সব আজগুবি কর্মকাণ্ড করে বসত যার দরুন বাল্য বয়সেই নিজ গ্রামসহ আশপাশের আট দশটি গ্রামে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। একবার সে খেলতে গিয়ে মস্ত বড় এক গোখরো সাপের ঘাড়ে খপ করে ধরে ফেলে। সাপটি তার পুরো হাত পেঁচিয়ে নেয়। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে রব পড়ে যায়। চতুর্দিক হতে লোকজন দা-লাঠি নিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু এলে কী হবে সাপ তো আর মারা যাচ্ছে না, কারণ সাপ যে তার পুরো হাত প্যাঁচিয়ে রেখেছে। সে নিজেও এখন বুঝতে পারছে সাপ ধরা যত সহজ ছেড়ে দেওয়া তত কঠিন মেরে ফেলা আরও কঠিন। সবাই যখন তার জীবন বাঁচাতে মহাব্যস্ত ঠিক তখন সে করে বসে আরেক কাণ্ড দৌড়ে গিয়ে নামে এক পুকুরে। পুকুরে নেমে সে গলা অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে রইল। চারদিকে তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। যেন ক্রিকেট ম্যাচে শেষ বলে ছক্কার প্রয়োজনের চেয়েও বেশি টান টান উত্তেজনা। ঘণ্টাখানেক পর সব উত্তেজনার অবসান ঘটায় সে নিজেই। সে যখন বুঝতে পারল যে সাপটি তার হাতের প্যাঁচ ছেড়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে তখন সে ধীরে ধীরে পানির উপরে উঠে আসে। মানুষ তার বিপদে কোনো সাহায্য করতে না পারলেও এবার তাকে কাঁধে নিয়ে নাচতে শুরু করল।

আরেক দিনের ঘটনা।

হাসুর বউয়ের নাকের নোলক হারানো গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে অবশেষে পাশের গ্রাম থেকে এক কবিরাজকে ডেকে আনা হলো। কবিরাজ নাকি বাটি চালান দিয়ে হারানো জিনিস খুঁজে বের করতে পারে। কবিরাজকে উঠানের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে বসতে দেওয়া হলো। ততক্ষণে উৎসুক জনতা এসে উঠানে ভিড় জমিয়েছে। আগে থেকে জানা না থাকলে মনে হবে এটি একটি বিয়েবাড়ি। হাসুর সাথে কিছুক্ষণ কানাকানির পর কবিরাজ বলল, আপনাদের মাঝে কি কেউ তুলারাশি আছেন?

এমন সময় ভিড় ঠেলে কান্তু এসে বলল, আমি তুলারাশি।

কবিরাজ কান্তুর হস্তরেখা পরীক্ষা করে বলল, চলবে।

কবিরাজ তার লাল কাপড়ের থলে থেকে একটি পিতলের বাটি বের করে কান্তুকে কিছু পরামর্শ দিয়ে বাটি ও কান্তুর শরীরে কয়েকবার ফুঁক দিলেন। অবশেষে কান্তুকে বলে দিলেন বাটি থেকে কখনও হাত উঠাবে না। যদি বাটি পুকুরে গিয়ে নামে তবুও না। বাটি যে দিকে যারে তুমিও সে দিকে যাবে। বাটি যেখানে গিয়ে থামবে তুমিও সেখানে গিয়ে থামবে। এর উলটো করলে তোমার অনেক ক্ষতি হবে। কান্তু মাথা নেড়ে সবকিছু মেনে নিল। এবার কবিরাজ কান্তুর হাত ধরে বাটির মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে বলল যারে বাটি সেথায়, নোলক আছে যেথায়। বাটি চলতে শুরু করল। আম বাগান, পুকুর পাড় দিয়ে বাটি চলছে তো চলছেই। উৎসুক জনতাও কান্তুর পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক এদিক সেদিন দৌড়ানোর পর অবশেষে বাটি ফিরে এসে ঠিক কবিরাজের মাথার উপর থামল। কবিরাজসহ উপস্থিত সবাই অবাক। এটা কী করে হয়? কেউ কেউ বলাবলিও শুরু করে দিল আজকাল কবিরাজরাও জ্বিন-ভূতের দ্বারা অনেক জিনিস চুরি করে থাকে। কবিরাজ মনে হয় এমন ঘটনার মুখোমুখি আর কোনোদিন হয়নি। সে কী বলবে তাও খোঁজে পাচ্ছিল না। শেষে এ ছেলে তুলারাশি নয় বলে নিজের অর্জিত সুনাম সুখ্যাতি সব হারিয়ে শুধু জীবনটা নিয়ে পালাল। সেদিন হতে কান্তুর নামের সাথে কবিরাজ শব্দটি যুক্ত হয়ে কান্তু কবিরাজ হয়ে যায়।

কান্তু নিজেও নামটা উপভোগ করে। তাকে কবিরাজ বলে ডাকলে খুব খুশি হয়। নাম কি আর শুধু শুধু ধীরে ধীরে সে কামও শুরু করে দেয়। প্রথমে ঝাঁড়-ফুঁক দিয়ে সে তার কবিরাজি পেশা শুরু করে। আস্তে আস্তে  তাবিজ কবজ দেওয়া, জিন-ভূত ছাড়ানো, অর্শ্ব রোগের চিকিৎসা, জণ্ডিসের চিকিৎসা, অর্ধাঙ্গ রোগের চিকিৎসা এমন কী জিন-ভূতের দ্বারা কামরূপ কামাক্ষা থেকে দুর্লভ গাছের শিকড়বাকড় এনে আরও জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করতে থাকে। এভাবে তার সুনাম-সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় তার আর্থিক অবস্থাও বদলে যায়। এখন অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ প্রাইভেট কার নিয়ে তার চিকিৎসা নিতে আসে। সে নিজেও এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা এখন তার অধীনে চাকরি করে। তার ভিজিট এখন একজন নামকরা ডাক্তারের চেয়েও বেশি। চা-স্টলের আড্ডাতেও কান্তু কবিরাজ এখন নিয়মিত প্রসঙ্গ। লোকেরা বলে থাকে কবিরাজ ভালো হলে রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়, ওষুধ লাগে না। এতদিন কবিরাজি চিকিৎসাকে যারা অপচিকিৎসা বলে মনে করত তারাও এখন কান্তু কবিরাজ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মন্তব্য করতে দশবার ভেবে নেয়। কারণ তার নামে কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বললে তার পক্ষে জবাব দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই। তাই রাস্তা-ঘাটে অপমানিত হওয়ার ভয়ে কেউ কিছু বলেও না।

একদিন পাশের গ্রাম হিজলতলা থেকে কয়েকজন লোক এল তার সাথে দেখা করতে। তাদের একজন বলল তার বাবা দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছে। তাকে অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কান্তু বলল তার আগামী এক মাসের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। যেতে হলে আগামী মাসের এক তারিখ যেতে হবে। এক মাসের কথা শোনে রোগীর ছেলে কেঁদে উঠল। বলল, এক মাস হয়তো আমার বাবার বাঁচবেনই না। আপনি আমাদের প্রতি একটু করুণা করুন।

লোকটির সাথে আরও যে দুজন লোক ছিল তাঁরা তাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে কী জানি  চুপি চুপি বলল অমনি সে রাজি হয়ে গেল। তাঁরা তাকে গাড়িতে করে সাথে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে একটু আড়ালে গিয়ে ফোনে কারও সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিল। রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখল একজন আধমরা মানুষ উত্তর শিয়রে অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। সে এত দুর্বল যে নাক ও ঠোঁটের মাছি পর্যন্ত তাড়াতে পারছে না। তাকে দেখে কান্তু কবিরাজ বলল, এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা খুব সহজ কাজ নয়। জিনের মাধ্যমে কামরূপ-কামাক্ষা থেকে ওষুধ আনতে হবে। এতে অনেক খরচ হবে। রোগীর ছেলে-মেয়েরা সবাই সমস্বরে কেঁদে উঠল। রোগীর বড় ছেলে তমিজের সাথে যে দুজন লোক তার বাড়িতে গিয়েছিল এবারও তারা এগিয়ে এল। তারা কান্তুকে আশ্বস্ত করে বলল যে রোগীর সন্তানের টাকাপয়সা দিতে না পারলে তারা সাহায্য করবে। তারা রোগীর চিকিৎসা শুরু করার জন্য তাকে অনুরোধ করল। কান্তু বলল চিকিৎসার বিনিময়ে আমি কোনো টাকাপয়সা নিই না। খুশি হয়ে যে যা হাদিয়া দেয় তাই গ্রহণ করি মাত্র। কিন্তু এই রোগীর চিকিৎসার জন্য জিন ডাকতে হবে। জিনের কাছ থেকে জানতে হবে রোগের কারণ ও প্রতিকার কী। এ জন্য জিনকে একটি লাল রঙের ষাঁড় দিতে হবে। রোগীর পূর্বোক্ত স্বজন দুজন জানতে চাইল ষাঁড় কোথায় দিতে হবে। কবিরাজ বলল, ষাঁড় শনিবার কিংবা মঙ্গলবারে বাজার থেকে কিনতে হবে। গভীর রাতে দুটি নদী যেখানে এসে মিলিত হয়েছে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। সেখানে পানির নিচে প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে গভীর রাতে জিনদের আড্ডা বসে। ষাঁড় সেই আড্ডাখানায় পৌঁছে দিতে হবে। রোগীর স্বজনেরা ভেবে দেখল এ কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই তারা বাধ্য হয়ে ষাঁড়ের মূল্য বাবদ এক লাখ টাকা কান্তুর হাতে তুলে দিল। ততক্ষণে রাত বারোটা বেজে গেছে। কান্তুর একজন সহযোগী গিয়ে রোগীর বাড়িতে হাজির হলো। কান্তুর  সহযোগীর নাম কাদু।

কান্তু তাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলো। তার পর কাদু রোগীর বড় ছেলে তমিজের সাথে কথা বলল। জিন ডাকতে হবে তার জন্য একটা আলাদা রুম দরকার। তমিজ বাড়ির একটা রোম থেকে মহিলা ও শিশুদের বের করে দিয়ে খালি করে দিলো রুমের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে কবিরাজ জিকে বসতে দেওয়া হলো। কাদু উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বলল, আপনাদের যাদের কোনো প্রয়োজন নেই তারা দয়া করে চলে যান। আর যদি কেউ থাকতে চান তবে কোনো দিয়াশলাই, ম্যাচ লাইটার, টর্চ লাইট এমনকি কোনো আলো উৎস সাথে রাখতে পারবেন না। যদি রাখেন আর এর দ্বারা যদি রোগীর কোনো ক্ষতি হয় তার দায়দায়িত্ব আপনাদের, আমার ওস্তাদের নয়।

এই বলে কাদু সবার কাছ থেকে ম্যাচ, দিয়াশলাই, টর্চলাইট নিয়ে একটি ব্যাগে ভরে তার কাছে রেখে দিল। সব শেষে ঘরের বিদ্যুৎ বোর্ডের কাটআউট খুলে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো ঘরের দরজা জানালা সব আগে থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঘরে এখন কবরের অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কাদু আবার সবার উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা কেউ পাটিতে আসবেন না। যে যেখানে আছেন সেখানেই বসে পড়ুন। কেউ দাঁড়াবেন না। লোকেরা তাই করল। এবার কান্তু কবিরাজ তার মন্ত্র পড়া শুরু করল। মন্ত্রের ভাষা বাংলা না হিন্দি কেউ তা বুঝতে পারল না।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন : ৭ম সংখ্যা (মার্চ-২০২৫ : বিশেষ ঈদ সংখ্যা)

Read Next

রোকে ডালটন-এর দুটি কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *