কিছু ছবি এতটাই প্রতীকী হয়ে ওঠে যে সেগুলো আসলেই অসাধারণ। অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট (Gustav Klimt) এর আঁকা এলিজাবেথ লেডেরারের (Elisabeth Lederer) প্রতিকৃতিটি তেমনই একটি । গত কয়েক দশক ধরে জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে থাকা এই চিত্রকর্মটি এখন সোথেবি এর নিলামে রেকর্ড পরিমাণ অর্থে বিক্রি হয়েছে ।
এলিজাবেথ লেডেরারের প্রতিকৃতি
এলিজাবেথ লেডেরারের প্রতিকৃতিকেন এটি এত মূল্যবান? চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের এই হৃদয়গ্রাহী চিত্রকর্মটি আধুনিক শিল্পের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজ । শিল্পীর সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পৃষ্ঠপোষকদের একজন তরুণী উত্তরাধিকারী এবং কন্যা এলিজাবেথ লেডেরারের বিখ্যাত প্রতিকৃতিটি ১৯১৪-১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এঁকেছিলেন । ছবিতে চীনা ঢিলা গাঊনে আবৃত বা সুন্দর ভাঁজে সাজানো এলিজাবেথ লেডেরারকে দেখা যাচ্ছে । এই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উত্তেজনাপূর্ণ জটিল প্রতিকৃতিটি গত ১৮ই নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ২৩৬.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে (১৮০ মিলিয়ন পাউন্ড) বিক্রি হয়েছে, যেটি দুই বছর আগে ১৯১৭-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের Lady with a Fan চিত্রকর্মের মূল্যকে ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ১০৮ মিলিয়ন ডলার (৮২ মিলিয়ন পাউন্ড) বিক্রি হওয়ার রেকর্ড ভেঙে দেয় । ফলে, এটি ইউরোপে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিত্রকর্মে পরিণত হয় । এছাড়া, এলিজাবেথ লেডেরারের ভাই রোনাল্ড ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে গুস্তাভ ক্লিম্টের আরেকটি বিখ্যাত Portrait of Adele Bloch-Bauer 1 চিত্রকর্ম নিলামের পরিবর্তে ব্যক্তিগতভাবে ১৩৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছিলেন, যেটি ব্যাপকভাবে ’সোনার নারী’ নামে পরিচিত (Woman in Gold) ।
যাই হোক, চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের এই মনোরম এলিজাবেথ লেডেরার চিত্রকর্মটি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আঁকা কৃতি চিত্রকর অ্যান্ডি ওয়ারহলের দুর্দান্ত মেরিলিন মনরোর প্রতিকৃতি Shot Sage Blue Marilyn কে ছাড়িয়ে যায়, যেটি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে নিউ ইয়র্কের ক্রিস্টি’স হাউজে ১৯৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল । এই পর্যন্ত নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামী শিল্পকর্ম হচ্ছে জগদ্বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা Salvator Mundi, যেটি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ৪৫০.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল । কিন্তু এলিজাবেথ লেডেরারের চিত্রকর্মটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে উত্যক্ত করার তীব্রতা আসলে কি? প্রায় দুই মিটার লম্বা ২০ বছর বয়সী উত্তরাধিকারীর প্রতিকৃতিতে কি এমন আছে যে অদ্ভুত লম্বা দেহটি ঝলমলে সাদা রেশমের তৈরি কোকুন-সদৃশ (Cocoon-like) গাঊনের সুরক্ষিত আবরণে (Chrysalis) এক স্বর্গীয় পরী হয়ে উঠেছে, যার দাম এতটাই চড়া?
এলিজাবেথের প্রতিকৃতিটিতে চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের তথাকথিত ‘স্বর্নযুগ’ এর সুপরিচিত চিত্রকর্মের প্রকাশ্য ঐশ্বর্যের অভাব রয়েছে বলে মনে হতে পারে, যে যুগে শিল্পী প্রথম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তার ’পোর্ট্রেট অফ অ্যাডেল ব্লোচ-বাউয়ার’ এবং ১৯০৭-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ’দ্য কিস’ এর মত ঝলমলে কাজ তৈরি করেছিলেন । যেখানে সেই জাঁকজমকপূর্ণ মাস্টারপিসগুলো ভিয়েনা বিচ্ছিন্নতার (চিত্রশিল্পী ক্লিম্ট যে প্রভাবশালী শৈল্পিক স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছিলেন যা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন) মায়াজালের সাথে ঝলমল করে । শিল্পীর জীবনের শেষ বছরগুলোতে (গুস্তাভ ক্লিম্ট পঞ্চান্ন বছর বয়সে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন) তৈরি এলিজাবেথ লেডেরারের গীতিমূলক উপমাটি আরো মানসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ তীব্রতার সাথে স্পন্দিত হয় । ক্যানভাসের নান্দনিক ঐশ্বর্য যদি আরো গোপন থাকে, তাহলে তা প্রচুর ।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া অধিগ্রহণ বা দখলের পর নাৎসি কর্মকর্তারা চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিম্টের অঙ্কিত এলিজাবেথ লেডেরারের চিত্রকর্মটিসহ তার বিশাল সংগ্রহকে বাজেয়াপ্ত করে । এলিজাবেথ লেডেরারের প্রতিকৃতিটি আগুনে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এলিজাবেথের ভাই এরিকের কাছে এটি ফেরৎ দেওয়া হয়, যিনি চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের বন্ধু ও সহশিল্পী এগন শিয়েলের আঁকা এবং চিত্রকর্মের প্রায়শই বিষয়বস্তু ছিলেন । এই বিস্ময়কর এলিজাবেথ লেডেরারের চিত্রকর্মটি এরিকের জীবনের বেশিরভাগ সময়েই তার দখলে ছিল, যতক্ষণ না তিনি ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর দুই বছর আগে এটি বিক্রি করে দেন । ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে এলিজাবেথ লেডেরারের চিত্রকর্মটি বাজারে আসে । তখনই এটি এস্তি লডার প্রসাধনী কোম্পানির কোটিপতি উত্তরাধিকারী লিওনার্ড এ লডারের ব্যক্তিগত শিল্প সংগ্রহের অংশ হয়ে ওঠে । যিনি চিত্রকর্মটিকে নিউ ইয়র্কের পঞ্চম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে প্রদর্শন করেছিলেন অল্প সময়ের জন্য । লিওনার্ড এ লডার বিরানব্বই বছর বয়সে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মারা যান । গত কয়েক দশক ধরে জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকা এই অনুপম সুন্দর প্রতিকৃতিটি এক অর্থে তার সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে পুনরায় আলোচনায় ফিরে আসার জন্য । মূল্য যাই হোক না কেন, মনোমুগ্ধকর এই চিত্রকর্মটি অবশেষে তার গোপন রহস্য প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত । অনন্য সৌন্দর্যের অধিকারী চিত্রকর্মটির গল্পটি সত্য এবং প্রতীকীবাদকে একটি সমৃদ্ধ চাক্ষুষ পর্দাতে রূপান্তরিত করে, যার গুপ্ত কৌশল চিত্রকলার পৃষ্ঠের ভিতরে এবং বাইরেও বিস্তৃত । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে গৃহীত ভিয়েনার অন্যতম ধনী ইহুদি পরিবারের অগাস্ট লেডেরার এবং সেরেনা লেডেরারের কন্যা এলিজাবেথ লেডেরারের আকর্ষণীয় প্রতিকৃতির উজ্জ্বল উত্থানকে স্বর্ণযুগের শেষ গৌরবময় নিঃশ্বাস (হাঁপান) হিসেবে পড়া যেতে পারে, যেখান থেকে এটি উদ্ভূত হয়েছিল । পূর্ব এশীয় প্রভাবশালী শিল্প ও সাহিত্যের মূল উপাদান বা মোটিফের বিস্তৃত বিন্যাস- যা তরুণীকে স্বর্গীয় নীলের এক ঝলমলে কালজয়ী পর্যায়ে প্রদক্ষিণ করে এবং তার অন্ধকার চোখের প্রেরণাদায়ক প্রশান্তি আমাদের সময় ও স্থান অতিক্রম করে ইউরোপীয় ইতিহাসের ত্বরান্বিত অস্থিরতা থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় ।
চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিম্ট পূর্বে যে সোনার সাহসের উপর নির্ভর করতেন, তা এতটা অদৃশ্য হয়ে যায়নি বরং এক ধরণের বিপরীত মধ্যযুগীয় রসায়ন-শাস্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত ও উদ্দীপক রঙের নির্ভীকতায় রূপান্তরিত হয়েছে যা অভিব্যক্তিবাদের সাহসিকতার সীমানায় অবস্থিত । আরো ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই অদ্ভুত প্রতিকৃতিটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে জটিল বিবরণে ভরা । এলিজাবেথ লেডেরারের বিস্তৃত পোশাক এবং গাঊনের নকশার মধ্যে শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট আকৃতি বা কাঠামোর এক মোহনীয় ষড়যন্ত্র বুনেছেন । এগুলো পূর্ব এশীয় শিল্পকলা এবং অণুবীক্ষণিক চিকিৎসা চিত্রকল্পের জগৎ থেকে সারগ্রাহীভাবে আঁকা প্রতীক ও রূপের রূপরেখার প্রতিধ্বনি করে । যেখানে শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট ভিয়েনায় বসবাস করতেন, সেই বৈজ্ঞানিক বৃত্তের মধ্যে এটি আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল । এলিজাবেথ লেডেরারের পোশাকের উপর ড্রাগনগুলো কিং রাজবংশের (Qing Dynasty) বস্ত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে এই প্রাণীগুলো মহাজাগতিক কর্তৃত্ব এবং সম্রাটের ঐশ্বরিকভাবে অনুমোদিত কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে । এলিজাবেথের উরুর চারপাশে তাদের ধীর, বৃত্তাকার চলাচল, শৈলীযুক্ত বা নান্দনিক ঢেউ থেকে উঠে আসা ইত্যাদি এলিজাবেথকে উপাদান এবং অতিপ্রাকৃত প্রাণীদের প্রতিপালক হিসেবে প্রায় পৌরাণিক উপস্থিতি দিয়েছে । এলিজাবেথ লেডেরারের সৌন্দর্যকে কাল্পনিক ভাষায় অমর করে শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট কেবল তার পৃষ্ঠপোষকদের তোষামোদ করছেন না । তিনি আসলে, একটি নতুন যুগের জন্য ইতালীয় চিত্রশিল্পী স্যান্ড্রো বোটিচেলির চিত্রকর্ম ‘শুক্র গ্রহের জন্ম’কে নতুন রূপে উপস্থাপন বা পুনর্নবীকরণ করেছেন (Reinventing Sandro Botticelli’s Birth of Venus) । গুস্তাভ ক্লিম্টের জীবনের শেষ দিকের আঁকা এলিজাবেথ লেডেরারের চিত্রকর্মটি তার ‘স্বর্ণযুগে’ আঁকা চিত্রকর্মগুলোর চেয়ে আলাদা । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তার তৈরি চিত্রকর্ম Danaë, The Kiss এবং Portrait of Adele Bloch-Bauer 1 সহ এই ধরনের কাজগুলোতে দেখা যায় কোষীয় আকারগুলো এমন এক অস্পষ্ট ভাষায় মিশে যেতে শুরু করে যা কেবল গুস্তাভ ক্লিম্টই তৈরি করতে পারতেন । সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতীকগুলোকে জৈবিক উৎপত্তি এবং রক্তরেখার ইঙ্গিতের সাথে মিলিয়ে তিনি এমন একটি প্রতিকৃতি তৈরি করেন যা প্রাচীন পুরাণ এবং আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান স্তরের উপর কাজ করে । আরো উল্লেখযোগ্যভাবে, বংশ এবং পরিচয়ের এই সূক্ষ্ম উল্লেখগুলো বহু বছর পরে নাৎসি শাসনামলে এলিজাবেথ লেডেরারের সাথে কি ঘটেছিল তার উপর এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে । এলিজাবেথ লেডেরার তার ইহুদি বংশধরের কারণে অস্ট্রিয়ায় চরম দুর্দশার মুখে পড়ে ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ এবং বিপদের মুখোমুখি হতে থাকেন । নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার জন্য এক অসাধারণ পদক্ষেপ হিসেবে তিনি মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে, গুস্তাভ ক্লিম্ট একজন অ-ইহুদি শিল্পী যিনি তার বহু প্রেমের সম্পর্কের জন্য পরিচিত, আসলে তিনি তার জৈবিক পিতা ছিলেন । এলিজাবেথ লেডেরারের মা সেরেনা লেডেরার একটি শপথপত্রে স্বাক্ষর করে তার মেয়ের বানোয়াট দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন । কর্তৃপক্ষ এই কল্পকাহিনী গ্রহণ করে এবং এলিজাবেথকে একটি সংশোধিত মর্যাদা দেয় যা তাকে সুরক্ষিত করে ।
চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট তার এই রহস্যময় চিত্রকর্মের গঠন বা কাঠামো বা ফ্রেমের ভেতরে এবং বাইরে এলিজাবেথের এক অসাধারণ রূপান্তর, পুনর্জন্ম এবং রূপান্তরিত বেঁচে থাকার গল্প তুলে ধরেছেন । গুস্তাভ ক্লিম্ট এলিজাবেথের জন্য যে সূক্ষ্ম পোশাক বুনেছিলেন তার গঠনকে সংজ্ঞায়িত করে এমন সূক্ষ্ম আকারের আঁটসাঁট আভাস থেকে এক ঐন্দ্রজালিক অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং তরুণীর শরীরের গঠন যেন অলৌকিকভাবে একটি প্রজাপতির আকৃতির সাথে মিলে যাচ্ছে (ক্লিম্টের শিল্পে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক মোটিফ), যা তার রেশমী গুটি বা খোল (Silken chrysalis) থেকে মুক্তি পেয়েছে । মেয়েটির রঙিন গাঊন তার পিছনে মার্জিতভাবে পড়ে আছে এবং হঠাৎ করেই তার মসৃণ প্রিজম-ঘটিত ডানার (Prismatic wings) মত চেহারা চমৎকারভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে । চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্টের শেষের মাস্টারপিসটি (এলিজাবেথ লেডেরার) এই মুহূর্তে যে আশ্চর্যজনক পরিমাণ অঙ্কের আয় করেছে তার যোগ্য কি না, শিল্পীর এই প্রতিকৃতির অবিরাম পুনর্জন্মমূলক প্রতিভার শক্তি, নির্মাণশৈলী এবং অমূল্যতা নিয়ে সন্দেহ করার কিছুই নেই ।