অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুন ২৫, ২০২৫
১১ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুন ২৫, ২০২৫
১১ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাখাওয়াত হোসেন -
বরফ গলা নদী- আমার প্রিয়তম বই

বাংলা সাহিত্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের উপন্যাসটা রবীন্দ্রনাথ লিখেননি, মানিক লিখেননি। বিভূতি, শরৎ কিংবা আমার লেখালিখির জগতে প্রবেশের দরজা যাকে বলি, ওই হুমায়ূন আহমেদও লিখেননি। ওই উপন্যাসটা লিখেছিলেন জহির রায়হান। একটা টকটকে লাল স্বাধীনতা আনতে যেয়ে হারিয়ে যাওয়া আমাদের অসংখ্য রত্নের একটা মূল্যবান রত্ন। তিনি লিখেছিলেন ওই বই, যা আমি অদ্যাবধি অসংখ্যবার পড়েও কখনো পছন্দের তালিকায় শ্রেষ্ঠত্বের স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে নামাতে পারিনি। বইটার নাম, বরফ গলা নদী।
‘বরফ গলা নদী’ আমাদের পরিচিতি চিরাচরিত রোমান্টিক ধারার আগপিছু না মাড়িয়েও আমার পড়া প্রবল রোমান্টিক একটা উপন্যাস। ‘বরফ গলা নদী’ সাসপেন্স তৈরী করার কোনোরকম এফোর্ট ছাড়াই আমার পড়া ওই পর্যায়ের উৎকণ্ঠা ও আগ্রহ জমানো উপন্যাস, যা প্রথমবার পড়তে যেয়ে শেষে কী হয়েছিল জানার জন্য তুমুল গতি নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দৌড়াতে হয়েছিল আমায়। ‘বরফ গলা নদী’র গল্প কোনোরকম অতিরঞ্জন ছাড়াই বাংলা সাহিত্যের মারাত্মক ট্র্যাজেডি গল্পগুলোর একটা। সোসাইটি ও রাষ্ট্রের শ্রেণী বিষয়ক সম্মিলিত সকল ধ্যান-ধারণার উপর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও গালমন্দে ভর্তি একটা উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে এরচেয়ে সাটল ওয়েতে, পরিমিত ব্যবহারে ‘গতানুগতিক ধারার গল্প হওয়ার বিশাল বড়ো ঝুঁকি’ নিয়ে এত চমৎকার হৃদয়গ্রাহী গল্প বলেছিল কিনা কোনো সাহিত্যিক- আমার জানা নাই।
ক্রমাগত লিনিয়ার উপন্যাস পড়তে পড়তে বিরক্ত হওয়া আমার জন্য ‘বরফ গলা নদী’ ছিল একটা ধাক্কা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বরফ গলা নদী শুরু হচ্ছে উল্টো দিক থেকে। গল্পকার কখনই তার গল্পের শেষদিকটা প্রথমে উন্মোচন করেন না। অনেকে শেষের কোনো গন্ধও রাখেন না। কারণ অনেক গল্পকার গল্প শেষ হওয়ার আগ অবধি জানেনই না, কোথায় গল্প শেষ হবে। বরফ গলা নদী এইসব গতানুগতিক ধারা ভেঙে গল্প বলা আরম্ভ করছে মাহমুদের একটা ভঙ্গুর অবস্থা দিয়ে।
আমরা প্রথম পৃষ্ঠায় জানতে পারি, মাহমুদের একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে। অনেক রাত ঘুমায়নি সে। সে আছে একটা বাড়ির বিছানায়। তার পাশে আছে লিলি। লিলির সাথে মাহমুদের সম্পর্ক কী আমরা জানি না। আমরা জানি না, লিলি কেন মাহমুদকে ঘুম পাড়াতে চায়। কেন ওকে ঘুম পাড়িয়ে আজিমপুর গোরস্থানে যায়। আমরা চিনতে পারি না মনসুর কে। সে কেন লিলির বাড়ি এসে অপরাধী মুখ করে বসে থাকে। তার সাথে মাহমুদের কী সম্পর্ক? সবচেয়ে বড়ো কথা, মাহমুদের সমস্যাটা কী?
বরফ গলা নদী মূলত ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস। পুরো উপন্যাসটা তিন ভাগে ভাগ করা। ফার্স্ট পার্ট, সেকেন্ড পার্ট এবং থার্ড পার্ট। যেহেতু সিনেমা নয়, যেকোনো সাহিত্যিক তার এই গল্প বলার জন্য সিরিয়াল মেইনটেইন করবেন- স্বাভাবিক। কিন্তু জহির রায়হান করেননি। হয়ত নিজেও নির্মাতা বলেই করেননি। তিনি গল্পটা বলেছেন সিরিয়াল উল্টে। প্রথমেই আমরা পড়ছি সেকেন্ড পার্ট, তারপর পড়ছি ফার্স্ট পার্ট। সর্বশেষ পড়ছি থার্ড পার্ট।
এই তিন ভাগ উল্টে বলার কাজটা কিন্তু খামখেয়ালী করে করা যায় না। গল্পকারকে একটা ক্ষুদ্র চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। তাকে প্রথমেই পুরো গল্পটা মাথায় লিখে ফেলতে হয়। সমাপ্তি সহ। তারপর তাকে তিন ভাগে ভাগ করতে হয় পুরো গল্প। এবং খুবই সতর্ক থেকে দ্বিতীয় পার্টের ওই অংশটা বেছে নিতে হয়, যেখানে গল্প বলা জারি আছে কিন্তু ওতে পাঠক জানতে পারছে না কিছুই। অথবা পাঠক তা জানতে পারছে, যা জানার ফলে তাকে পৃষ্ঠা উল্টে যেতে হবে ক্রমাগত। যা জানার জন্য তাকে জানতে হবে উপসংহার।
‘বরফ গলা নদী’ আমাকে প্রবল অনুপ্রেরণা দিয়েছে গল্প বলার ধরণের উপর। আমি আমার গল্প পার্ট পার্ট করে বলতে শিখেছি এই উপন্যাস পড়ে। জেনেছি কিভাবে গল্প সবচেয়ে কম শব্দে বলা যায়, কোন কোন কৌশল অবলম্বন করলে গল্প মনোযোগ ধরে রাখে। খুব কম বয়সে পড়া উপন্যাস কিন্তু আমি জানি পরবর্তীতে, এখনো এবং ভবিষ্যতেও এই উপন্যাস আমাকে প্রবল অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে, কিভাবে মাত্র ছিয়ানব্বই একটা পৃষ্ঠার বইয়ে এতগুলো চরিত্রের সাথে পাঠকের চোখ ও মন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলা যায়। অনুপ্রেরণা দেবে মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যে ‘হিমু’ পরবর্তী আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র। হিমুর সাথে আমি রিলেট করতে পারি না কিন্তু মাহমুদের আদ্যোপান্ত আমার পরিচিত।
‘বরফ গলা নদী’ আরম্ভ হয় মাহমুদের একটা প্রশ্ন দিয়ে। প্রশ্নটা সে করে লিলিকে। প্রশ্নটা হলো- আমি যদি মারা যেতাম, তুমি কী করতে লিলি?
অধ্যায়টার নাম, ‘উপসংহারের আগে’। এই পুরো অধ্যায়ে মাহমুদ ঘুমায় এবং জেগে উঠে প্রশ্ন করে। প্রচুর প্রশ্ন। সমস্ত প্রশ্ন মৃত্যু সম্পর্কিত। মাহমুদ জানতে চায়, মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়। এই অসুস্থ মাহমুদকে ঘিরে উপসংহারের আগেই লিলি একটা চমৎকার সংসারের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করে। আর পাঠকের মাথায় জাগিয়ে দিয়ে যায় দু’টো প্রশ্ন। উপসংহারে কি ওদের মিলন হয়েছে? এবং ‘উপসংহারের আগে’রও আগে মাহমুদের কী হয়েছিল?
মাহমুদ যখন ঘুমায়, লিলি যখন স্বপ্ন দেখে, মনসুর যখন বিদায় নেয়- তখন বরফ গলা নদী বলতে আরম্ভ করে তারও আগের গল্প। যা মূলত ফার্স্ট পার্ট। এই পার্টের নাম- ‘তারও আগে যা ঘটেছিল’। এই অধ্যায় শুরু হচ্ছে মরিয়ম ও লিলিকে দিয়ে। ওরা দু’জন বান্ধবী। আর লিলি যাচ্ছে মরিয়মের বাসায়। বাসায় যাওয়ার পথটা বড্ড নোংরা, লিলি নাক ঢেকে হাঁটে, মরিয়ম অভ্যস্ত পায়ে নাক ঢাকা ছাড়াই হাঁটে। এই বাসায় যাওয়ার ছোট্ট একটা বর্ণনা ও দুয়েকটা সংলাপ দিয়েই জহির রায়হান কৌশলে জানিয়ে দিয়েছেন মরিয়মরা সমাজের কোন শ্রেণীতে অবস্থান করে এবং লিলি কোথায়।
লিলিকে আমরা মোটামুটি চিনি। আমরা তখনো জানি না, মরিয়ম কে। আমরা আস্তে আস্তে জানতে পারি মরিয়ম মাহমুদের বোন। মাহমুদ, মরিয়ম, হাসিনা, খোকন, দুলু। আমরা ধীরে ধীরে পরিচিত হই বাবা হাসমত আলী ও মা সালেহা বিবির সাথে। আমরা একাত্ম হই একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে, অংশ হই তাদের জীবনের। মাত্র দশ পৃষ্ঠার পর আমরা হাঁটতে শুরু করি মরিয়মের সাথেও।
মরিয়ম টিউশনি করাতে যায় এক ধনী পরিবারে। ছাত্রীর বড়ো বোনের দেবরের পরিচয় পাই আমরা। তার নাম মনসুর। ‘বরফ গলা নদী’ শুরু করেছি আমরা যার অপরাধী কণ্ঠস্বর ও ক্ষণিক উপস্থিতি দিয়ে। আমরা আন্দাজ করতে পারি, মনসুর একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবে খুব তাড়াতাড়ি। আর তা হয়ও। অনেক পরে মরিয়মের সাথে মনসুরের বিয়ে হয়। ওই বিয়েতে মাহমুদ খুব একটা সন্তুষ্ট থাকে না। কারণ বড়োলোকদের সে ঘৃণা করে।
জহির রায়হান তার উপন্যাসে মাহমুদকে যে সন্তর্পণে এঁকেছেন, তার তুলনা হয় না। একটা যুবক, যে পরিবারটাকে পাগলের মতো ভালোবাসে অথচ জানে না কিভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। যে তার পরিবারটাকে পৃথিবীর সমস্ত সুখ কিনে দিতে চায় অথচ যার টাকা নাই। যে চায় তার বোনগুলোকে নিজ অর্থে নিজ দায়িত্বে বিয়ে দিতে, কিন্তু তার চাওয়া অসহায় আত্মসমর্পণ করে পিতা মাতার ভারী চোখগুলোর পায়ে।
একটা দৃশ্য আছে- যেখানে মাহমুদ কিছু চুলের ফিতে আর মাথার কাঁটা বক্সে করে এনে উপহার দেয় দুই বোনকে। দেওয়ার আগে দু’জনকে আয়োজন করে বসায় সামনে। ছোটোবোনের আহ্লাদিপনায় বিরক্ত হওয়ার ভান করে কিংবা সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়। শান্ত স্বরে বলে- দুর্ঘটনাবশত হোক আর যেমন করে হোক, তোমরা আমার বোন, তোমাদের প্রতি আমার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে। উপহার পাওয়ার পর সমবয়সী বোন মরিয়মকে তার বান্ধবী লিলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা, জিজ্ঞেস করার সময় এমন একটা ভান করা যেন- তেমন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই এই প্রশ্ন করার পেছনে। যেন- সে যে আচমকা তাদের বাড়ি আসা লিলির সৌন্দর্য দেখে তব্দা খেয়েছে, কেউ বুঝতে পারছে না।
কি মারাত্মক সুন্দর একটা দৃশ্য, কি পরিমিত বর্ণনা, কি অসম্ভব সুন্দর লেখার ধরণ! জহির রায়হান এমন কারিগরি তার এই উপন্যাসের প্রতিটা পৃষ্ঠায় রেখেছেন। আর মাহমুদ একটা মুহূর্তের জন্যও বের হয়নি তার চরিত্র ছেড়ে। অথচ গল্পে তার চরিত্রের মারাত্মক একটা মোড় আছে। মানসিকভাবে চরম শক্ত, কম কথা বলা, ভয়ংকর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন রাগী এই ছেলেটা গল্পের এক পর্যায়ে নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে দূর্বল হয়, নিজের রাগটা পরিণত হয় অপরিসীম বেদনায় আর প্রথম দেখায় সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ কিংবা কথাবার্তার ধারেকাছে না গিয়ে চলে যাওয়া ভীষণ চাপা এই ছেলেটা একটা সময় পর লিলির হাত ধরে কাতর স্বরে বলে- আমি যদি মারা যেতাম, তুমি কী করতে লিলি?
মাহমুদ চরিত্রটার এই চরম উত্থান-পতন জহির রায়হান মাত্র ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠায় এতটাই রিয়েলস্টিকভাবে দেখিয়েছেন যে, পাঠক হিসেবে আমার একবারের জন্যও মনে হয় নাই- বরফ গলা নদী শুরু করেছি আমি যে মাহমুদকে দিয়ে এবং শেষ করছি যে মাহমুদকে দিয়ে, সেই মাহমুদের সাথে মাঝখানের মাহমুদের ইমোশনাল মিল নাই। তারা তিনজন ভিন্ন মানুষ। অথচ একজনই। জহির রায়হান হয়ত হেসেখেলে ‘বরফ গলা নদী’ লিখেছেন কিন্তু চরিত্রগুলো যেভাবে প্রাণ পেয়েছে এই উপন্যাসে, বর্তমান সময়ের বহু রাইটার বহু সাধ্য-সাধনা করেও ক্যারেক্টার ডেভেলাপমেন্টের এই লেভেলে পৌঁছুতে পারে না।
কী নেই বরফ গলা নদীতে?
মরিয়মকে ধরা যাক। এই মেয়েটির সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই উপন্যাসের ‘মুনা’র বেশ মিল। ভয়াবহ শক্ত মানুষ। যার একটা ভুল অতীত আছে। যে ওই ভুল অতীতকে পেছনে রেখে সামনে পা বাড়িয়েছে। সংসারের হাল ধরেছে। যে প্রেমে পড়েছে আরোও একবার। এই মরিয়মের জন্য আমার কষ্ট হয়। গল্পের একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, দ্বিতীয়বারও যে খড়কুটো আঁকড়ে ধরেছিল মরিয়ম, সেই খড়কুটোও আলগা হয়ে যাচ্ছে তার। এমন জীবন কেন হয়? এমন একটা জীবন কেন হয় মানুষের?
আমরা কিশোরী হাসিনার চঞ্চলতার সঙ্গে মিশে যাই, আমরা জেনে ফেলি তার গোপন প্রেম, তার গোপন চিঠি, তার সাতরঙে রাঙা লাজুক হাসি। বরফ গলা নদীর রোমান্টিকতা আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। সেটা মরিয়মের প্রথম ভুল প্রেম হোক, মনসুরের সঙ্গে তার ম্যাচিউরড সম্পর্ক হোক, হোক হাসিনার চাঞ্চল্য ভরা প্রেম কিংবা মাহমুদ ও লিলির অদ্ভুত ওই প্রেম। এমন প্রেমের নমুনা বাংলা সাহিত্যে আর কয়টা আছে যেখানে কেউ কাউকে ভালোবাসি বলা ছাড়াই সাত জন্মের সুতোয় বাঁধা পড়ে।
উপন্যাসটা শুরু ও শেষ হয় মাহমুদ ও লিলির আলিঙ্গন দিয়ে- আমরা পাঠকরা জানতে পারি তাদের প্রবল প্রেম, একজনের আরেকজনের প্রতি চরম মায়া অথচ মাঝখানের অধ্যায়ে তাদের দু’জনের মধ্যে দেখা হচ্ছেই মাত্র দুয়েকবার। প্রথম হাঁটা হয় মরিয়মের বিয়ের পরদিন। গলিতে লিলিকে এগিয়ে দিতে যেয়ে মাহমুদ যেখানে বলে- বিয়ে জিনিসটা ওর কাছে ফার্স মনে হয়। কতগুলো লোক এলো, খাওয়া দাওয়া করল, হাত তুলে মুনাজাত করল আর একটা মেয়ের জীবন আরেকটা ছেলের জীবনের সঙ্গে চিরতরে গেঁথে গেল। কোনো মানে হয়?
লিলি হাসতে হাসতে তাকিয়েছিল তার দিকে। মাহমুদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তীব্র দৃষ্টি। যা সবকিছু অস্বীকার করতে চায়। প্রথা, সোসাইটি, সিস্টেম, বৈষম্য, শ্রেণী ব্যবধান- সবকিছুর উপর ক্ষেপা এক যুবক! যে নিজের মাকে জিজ্ঞেস করে- মনসুর যদি বড়োলোক না হতো, প্রচুর টাকাপয়সা খরচ না করে তোমাদের জন্য এটা ওটা কিনে না দিতো, তোমরা কি মরিয়মকে বিয়ে দিতে রাজি হতে? যা আদতে সত্য। যা আদতে রুঢ় কিন্তু বাস্তব। মাহমুদ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ রুক্ষ চরিত্র। কিন্তু ঠসঠসা নয়। মাহমুদের জীবন দর্শন অপটিমিস্টিক নয়, নিহিলিজম ধাঁচ ঘেষা মানুষ সে। তার সঙ্গে পরিচয় সুখকর হওয়ার কথা নয় কিন্তু অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তাভাবনা নিয়েও এই চরিত্রটাকে এত আপন এত রিলেটেবল মনে হয় আমার।
জহির রায়হান ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার উপন্যাসজুড়ে বিভিন্ন ইমোশনে টলটল করে একেকটা চরিত্র এঁকে সবগুলোকে জড়ো করেছেন আশি পৃষ্ঠায়। দ্বিতীয় প্রেমের জুয়ায় চোখ বুজে ঝাঁপ দেওয়া মরিয়ম জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেয়ে বাড়ি এসেছে তখন। হাসিনা তার প্রথম প্রেমের চিঠিটা লিখে ফেলেছে এক রাতে। মাহমুদ নিজের দারিদ্রতা ও শ্রেণীবৈষম্যের কয়লায় জ্বলতে থাকা ফ্রাস্টেশন আরেকদফা ঝেড়ে ফেলেছে মরিয়মের উপর। হাসমত আলী ও সালেহা বিবি তাদের ফাঁড় ধরা, জল টুপ টুপ করে পড়া ভঙ্গুর বাড়িটার সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, বাড়ি মেরামত করার কথা। সবগুলো চরিত্র জড়ো হয়েছে এক বাড়িতে, জহির রায়হান তারপর আচমকা বাড়িটা ভেঙে দিলেন।
শৈশবে আমি বহু ধাক্কা খেয়েছি, বহু বই পড়ে। ‘বরফ গলা নদী’ আমাকে যে ধাক্কা দিয়েছিল, আমি তা ভুলতে পারি না। আমি এই ধাক্কা এখনো খাই। এখনো এই বই পড়তে গিয়ে আশি পৃষ্ঠার পরে সম্ভাব্য বিপদটা অনুমান করে আমার হাঁসফাঁস লাগে। আমি পড়ি আর শিখি, হ্যাঁ… মাহমুদকে নিয়ে জহির রায়হান রোমান্টিক ও ট্র্যাজেডির বাইরে রাষ্ট্র, সোসাইটি, ধর্ম, নিহিলিজম, শ্রেণীবিভাজন ইত্যাদির যে গল্প সাটল ওয়েতে বলার চেষ্টা করেছেন, ওটা স্বীকার করেই আমি শিখি- একজন ক্ষ্যাপাটে যুবক, যদি আচমকা জানতে পারে তার আমূল পরিবার বিল্ডিং ধ্বসে মরে থেঁতলে গেছে- তবে কী করবে? কী কী কাজ করবে সে? কী কী বলবে?
‘বরফ গলা নদী’র এই জায়গায় এসে আমার মনে হয়েছে জহির রায়হান আর গল্প লিখছেন না। মাহমুদ কোনো আঁকা চরিত্র নয়। মাহমুদ কী করেছে বাড়ি ভাঙার সংবাদ পেয়ে একটু বর্ণনা দিই। সে ভোর হবার একটু আগে প্রেসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেছে। গলিতে প্রচুর শোরগোল, ভীড়। সে তখনো জানে না কী হয়েছে। সে সামনে আগায়, লোকজন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে- আপনি বাড়িতে ছিলেন না? কোথায় ছিলেন? ইত্যাদি।
আশপাশের হা-হুতাশ দেখে প্রথমবার মাহমুদের শরীর শিরশির করে উঠে। তার হাত পা ভেঙে আসে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাও পায় না সে। যত বাসার সামনে যায়, ভীড় তত সরে যায়। তাকে জায়গা দেওয়া হয়। সকলের ধারণা ছিল, মাহমুদ বাড়ির ভগ্নস্তুপের সামনে এসে তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়বে। কিন্তু সে তা করে না। সে নিশ্চল তাকিয়ে থাকে। তারপর থপ করে বসে পড়ে। সকাল হয়। তখনও সে বসে। ফায়ারবিগ্রেড ছোটাছুটি করে একটা থেঁতলানো লাশ বের করে আনে। মরিয়মের লাশ। একনজর তাকিয়েই মাহমুদ অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেয়। হাসিনার লাশটাও বের করা হয়। তার গলা ভেঙে গেছে। কিন্তু ঠোঁটে হাসি। মাহমুদ ভাবে- এ বয়সে যদি মারা যেতে হলো তবে জন্মেছিল কেন এই মেয়ে?
ছোট্ট দুলুর লাশটা বের করার সময় ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ আফসোস করে বলে উঠেছিল- আহা বাচ্চাটা। মাহমুদ দাঁতে দাঁত চেপে খেঁকিয়ে উঠে- বাচ্চা নয়, কুত্তার বাচ্চা। নইলে কেউ এমনে মরে? পরক্ষণে তার মনে হয়, সে যদি রাতে বাসায় থাকত, তারও এমন অবস্থা হতো। তারও লাশ বের করে আনা হতো। সে কোথায় যেত? মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? কি অদ্ভুত অথচ প্রাসঙ্গিক ক্ষোভ!
মাহমুদকে একজন পুলিশ অফিসার রিপোর্টের জন্য বিরক্ত করে। যারা মারা গেছে তাদের সাথে মাহমুদের সম্পর্ক নিয়ে রিপোর্ট করা হবে। মাহমুদ চিৎকার করে উঠে- রিপোর্ট দিয়ে কী করবেন? পারবেন ওই… ওই বড়োলোকের বাচ্চাগুলোকে শূলে চড়াতে? আমরা দেখি, এখনো ক্ষোভ! অদ্ভুত প্রকাশ তবে অস্বাভাবিক নয়।
বিকেলে আজিমপুর গোরস্থানে সব লাশ দাফনের পর মাহমুদ সোজা হাঁটতে থাকে। তার গন্তব্য কোথায় জানা নাই তার নিজেরও। মনসুর তাকে নিতে চায় সঙ্গে। মাহমুদ তার উত্তর দেয় না। মাহমুদ রেগে আছে। প্রচণ্ড রাগ তার। কার উপর জানা নাই। সে শুধু জানে বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে তার সাথে। বিশ্রামাগারে যখন খোদাবক্স সান্ত্বনা দিতে যেয়ে তাকে বলে- কী আর করবেন, সব খোদার ইচ্ছা- তখন মাহমুদ তার গলা টিপে ধরে চেঁচায়- সব খোদার ইচ্ছা? শালা জোচ্চুরির আর জায়গা পাওনি। গলাটা টিপে এখনি মেরে ফেলব তোমায়, দেখি কোন খোদা বাঁচাতে আসে, শয়তানের বাচ্চা কোথাকার।
এটাই মাহমুদের দূর্ঘটনা পরবর্তী চূড়ান্ত মানসিক পরিস্থিতি- যার উপর উঠা যায় না আর। যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথেই বিদ্রোহ করে বসে মানুষ। প্রেসে মাহমুদ চারদিন ঘুমায়। জ্বরে অচেতন। চতুর্থ দিনের মাথায় চোখ খুলে সে দেখতে পায় লিলিকে। আর তিনটা প্রশ্ন করে- আমার কী হয়েছে? কোথায় আছি আমি? মা, ওরা কোথায়?
বাড়ি ভেঙে পুরো পরিবার থেঁতলে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মরিয়মকে বকা দিতে যেয়ে যে ছেলেটা বলেছিল- হ্যাঁ আমি নির্দয়, কারো জন্য আমার কোনো অনুভূতি নেই। বাবা মা ভাই বোন, এই যে কতগুলো শব্দের সৃষ্টি করেছ তোমরা, একটা অর্থহীন সম্পর্ক ছাড়া এর কোনো মূল্য নেই। এই ছেলেটা চতুর্থ দিনের মাথায় স্বল্প পরিচিত এক নারীর আঁচলে আশ্রয় নেয়, আর অসহায়ের মতো অনুভব করে- এই বিশাল পৃথিবীতে সে বড়ো একলা হয়ে গেছে, তার আর কোথাও কেউ নেই, যে অর্থহীন সম্পর্ক রোজ ফ্রাস্টেশন ঝেড়ে রুক্ষ করেছে সে এতকাল, ওই রুক্ষ প্রান্তর আজ নরম কাদাজলে ভর্তি, ওই শক্ত বরফ গলে নদী হয়ে গেছে অথচ ওরা কেউ নেই, ওই জলে গা ভেজানোর একটা মানুষও রইল না তার।
ফলে, লিলির মুখের দিকে তাকিয়ে ওই একটামাত্র আশ্রয় দু’হাতে চেপে আপাদমস্তক বরফ যুবক বেদনাজড়িত গলায় বলে ওঠে- কেন এমন হলো বলতে পারেন? কেন এমন হলো? আমার যে কেউ রইল না, আর কেউ না, আমি কেমন করে বাঁচবো?
‘বরফ গলা নদী’র উপসংহারটাও ‘উপসংহারের আগে’র পার্টের মতো ছোট্ট অথচ তীব্র মায়া ও ভালোবাসায় টলটল। উপসংহারটা শুরু হয় পাঁচ বৎসর পর। যখন মাহমুদ ও লিলির ছোট্ট সংসারে একটা ছোট্ট অতিথির আগমন ঘটেছে, মিতা। মিতার জন্মদিনে সবাই আসে। মনসুরও আসে নতুন বউকে নিয়ে। তসলিম আসে। বন্ধুরা আসে। ছোটোখাটো একটা আয়োজন হয়। সবার সঙ্গে পরিচয় হয় পাঠকের নতুন করে আবার। পাঁচ বৎসর পর। আর বরফ গলা নদী শেষ হয় একটা ছবি দিয়ে। পুরনো একটা বই খুঁজতে গিয়ে টুপ করে পড়ে যাওয়া একটা ছবি। লিলি হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওই ছবির দিকে। মাহমুদ গিয়ে দেখে একটা ফ্যামিলি ফটো। হাসমত আলী, সালেহা বিবি, মাহমুদ, মরিয়ম হাসিনা সহ সবাই আছে ওখানে।
লিলি ছবিটার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। কখনো একসময় ভীষণ ভেঙে পড়া মাহমুদকে যে লিলি সামলে নিয়েছিল, ওই ক্রন্দনরত লিলিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সামলায় মাহমুদ। বরফ গলা নদী শেষ হয় মাহমুদের ওই সংলাপ দিয়ে। যা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। যা তাকে ভগ্নস্তুপ থেকে টেনে তুলেছিল। যেখানে এসে নিহিলিজমের গা ছুঁয়ে যা পরিণত হয় স্টোয়িসিজমে। জীবনটা কারো অপেক্ষায় বসে থাকে না। আমাদের সবারই মৃত্যু হবে আর তখনো পৃথিবীটা এমন করেই চলবে। তার চলা বন্ধ হবে না কোনোদিন। যে শক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে, তার কি কোনো শেষ আছে?
বরফ গলা নদী শেষ হয়। আর আমি অনুভব করি, শুরুর পৃষ্ঠা থেকে যে যাত্রাটা আরম্ভ করেছিলেন জহির রায়হান, ওটার কোনো গন্তব্য ছিল না। এই যাত্রা শেষ হয়নি। এই যাত্রা কোনোদিন শেষ হয় না। এই যাত্রার অংশ হওয়া যায় শুধু। বরফ গলা নদী শুরু হয়েছিল লিলির জানালা খোলা দিয়ে। মাহমুদ যে রুমে মানবজীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ধাক্কাটা খেয়ে ভাঙচুর হয়ে পড়ে আছে, ওই অন্ধকার রুমে লিলি আলো প্রবেশ করিয়েছিল জানালার পর্দা সরিয়ে। বরফ গলা নদী শেষও হয় ওই আলোর প্রতিফলন দিয়ে। আমরা দেখতে পাই, প্রবল ভালোবাসায় হাত ধরে লিলি মাহমুদের আঙুলে যা গুঁজে দিয়েছিল, তা বিলিয়ে দিচ্ছে মাহমুদ, ক্রন্দনরত লিলির তীব্র বেদনার শিরা উপশিরায়। এই তো জীবন। আহা জীবন!
আজ বই দিবস। আমি লক্ষ করলাম, প্রচুর বই নিয়ে লিখলেও আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের বইটা নিয়ে কখনো কিছু লিখিনি। আজ লিখলাম। ‘বরফ গলা নদী’ থেকে অনেক মানসম্পন্ন অজস্র উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে, কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় আজ অবধি এই উপন্যাসের উপর কোনো উপন্যাস রাখিনি। ক্লাসিক কোনো সাহিত্যও না। আমার কাছে বরফ গলা নদী একটা ইমোশন, একটা যাত্রা, একটা আদ্যোপান্ত জীবন। আমি এই নদীতে আজীবন সাঁতার কাটতে চাই।
সাখাওয়াত হোসেন
জন্ম: ১৯৯৭ জন্মস্থান: চট্টগ্রাম।
প্রথম উপন্যাস: মৃগয়া। প্রথম গল্পগ্রন্থ: সুবর্ণ-রাধিকা
Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

আমিনুল ইসলামের একগুচ্ছ কবিতা

Read Next

স্মৃতিতে হুমায়ূন ফরিদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *