প্রকাশিত হলো শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা। এর পূর্বের সংখ্যা অর্থাৎ ৫ম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল গত অক্টোবর ২০২৩-এ। ৫ম সংখ্যা প্রকাশের সময় থেকে ৬ষ্ঠ সংখ্যাটি প্রকাশে এতটা দেরি হওয়ার জন্য আমরা দুঃখিত। অপ্রত্যাশিত দেরির একটা কারণ হতে পারে— এবারের ৬ষ্ঠ সংখ্যায় লেখার সংখ্যা ৫ম সংখ্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতগুলো লেখা
বহুমাত্রিক স্বাদের মায়াবী অন্তর্জাল – নুরুন্নাহার মুন্নির কবিতা
হাবিবুর রহমান
কবিতা,যাপিত জীবনের মায়াবী আদলে মনের সাজানো শব্দপুরাণ আর কবির রাত দিনের এপিটাফে হৃদয়ে টোল পড়া সাজানো মানচিত্র।সমাজের নিছিদ্র গলিতে মানবতার শিখা প্রজ্জ্বলনের নিমিত্ত কুশীলব।তৃপ্তি-অতৃপ্তি, রোধন আর ধীরে ধীরে উপলব্দির পাহাড় ডিঙিয়ে অনন্য স্বপ্নচূড়ায় আরোহন করার শিহরণ জাগানিয়া সময় অনুধাবন।একটি রোদেলা মধ্যাহ্ন, ক্লান্ত গোধূলী বেলার প্রকৃতি খেলার খুনসূটি, নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর যেন বোধের বিচরন।সম্পর্কের ইতিহাস কাল থেকে কালান্তরে সুখ দুঃখ কেনাবেচা করে; আবার কখনোবা নদীর মতোই স্মৃতির পলি জমিয়ে ইতিহাস ভরাট করে। কবি নুরুন্নাহার মুন্নির ‘আধখোলা জানালার আলাপ‘ কাব্যগ্রন্থের সর্ম্পক ও নদী কবিতায় সর্ম্পকের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে তাইতো কবির হৃদয় থেকে নিঃসৃত হয়েছে-“অনন্ত প্রেমে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরা ঘুনপোকা সরাতে/কেরোসিন আর কাঠের সর্ম্পক হয়/প্রলেপের উপর প্রলেপ দেয়া দেয়ালের সাথে রঙের সর্ম্পক হয়।”
আবার নদীর সাথে সর্ম্পকের পৃথিবী বর্ণনায় গভীর অনুধাবনে কবি বলেছেন-‘একুল ভাঙে তো ওকুল গড়ে/নদীর মতোই সর্ম্পক আশায় হাতড়ায়/এক জমিনের মাটি নিয়ে অন্য জমিন বাঁধে।”
আপাত দৃষ্টিতে সবুজ কালিতে মার্ক করা সমাজের মানুষগুলোর মুখোশের আড়ালে গিরগিটি রুপী এই হিউম্যান বিং সমাজ উন্নয়নের যে বিরাট অন্তরায় তা কবির ‘খোলস’ কবিতায় সুস্পষ্ট।পিশাচরুপী এ মানুষগুলোকে কবি মার্কুইস মিসাইলের সাথে তুলনা করেছেন যা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।
জাগতিক জীবনের ইতিহাসে যৌবন পুড়িয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে রচিত হয় পৃথিবীর বুকে স্বাধীনতার মানচিত্র।অতঃপর সন্ত্রাসী দাঙ্গা ,ধর্ম আর মানবতার দোহাই দিয়ে স্বাধীন দেশে পরাধীনতার স্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় দিনের পর দিন।‘জন্মকে দেখেছি দ্বিতীয়বার’ কবিতায় কবি তাই বলে উঠেছেন-”মদখোলা বোতলের ভেতর প্রাচীরে যেমন/গনতন্ত্রের দ্বিতীয়,তৃতীয় জন্ম হয়;/আমিও আমার জন্মের প্ল্যাকার্ডে লিখেছি/আমার স্বাধীনতার নাম।”
’আধখোলা জানালার আলাপ’ কাব্যগ্রন্থটি কবি মোট আশিটি কবিতায় সাজিয়েছেন।কিছু কবিতায় শুরু থেকে শেষ অবধি পাঠককে শব্দের মোহজালে জড়িয়ে রেখেছেন, কখনোবা ভালোবাসার রসগোল্লাা খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিতদের হয়ে লড়ে গেছেন প্রতিবাদী গনমিছিলে, তুলে এনেছেন সমসাময়িক দেশজ প্রেক্ষাপট।রুপক কবিতার আদলে সমাজে নিগৃহীত আর অবহেলিত শ্রেনীর ভঙ্গিতে বের করে এনেছেন।
কবি যেমন মাটি, প্রকৃতি আর নদীর শীতল পরশে বেড়ে উঠেছেন তেমনি শহরের কনক্রিট, ধুলোবালি আর বৈদ্যুতিক নিয়ন বাতির সাজসজ্জায় ও নিজেকে বার বার পুনরুজ্জীবিত করেছেন, তারই সুস্পষ্ট দলিল রেখে গেছেন তার‘ সোনার খাঁচায় রুপালি শহর’ কবিতায়।তবে শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদী নিবিড়ভাবে মিলেমিশে একাকার যেন কবিজীবন আর তার কবিতা।জলশ্যামল নারী কবিতায় তাইতো এভাবে তিনি গেয়ে গেছেন-
‘মৃত্যুর প্রজাপতি’ ‘দারিদ্রের গলায় ফিলোডেনড্রন’ ‘কঙ্কালের প্রতিবাদ’ ‘রেললাইনে পড়ে থাকা আধমরা বিবেক’ ‘হাজার মৃত্যুর পর’ ‘প্রশ্নের বুদবুদে গলিত পৃথিবী’এ রকম বেশ কয়েকটি কবিতায় কবির রুদ্রমূর্তি যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি ভালোবাসার আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে জন্ম দিয়েছেন অসংখ্য মোহময়ী প্রেমের কবিতার অন্তর্জাল।
প্রেমের সত্যি কি কোন স্ট্রাকচার আছে? কখনও শূন্যে উড়িয়ে, কখনও মায়াবী স্পর্শে টলটলে যৌবনের পশমীয় আদর, যুবতীর শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে বিনম্র আবেদন কিংবা হারানোর ব্যাথাকে পুঞ্জীভূত করে জ্যোৎস্না স্নান কিংবা প্রিয়জনের হাতে হাত ধরে হাঁটা রাস্তার পাশে ভাঁট ফুলের উপহার বিনিময়।
ভালোবাসা যেন স্বর্গীয় দান, ঈশ্বরের উপহার, আবেগের স্বভাবজাত অনুভূতির সুপারপাওয়ারেই হয়ত কবি তার সাবলীল ভাষায় অনন্য শব্দ প্রয়োগে মনের আবীর মিশিয়ে সাজিয়েছেন তার বেশ কয়েকটি রোমান্টিক কবিতা।নিজস্ব চিন্তাধারা অর্থাৎ গতানুগতিক ভাবনার বাইরে বেরিয়ে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন নিজের মতো করে।অসংখ্য মিথের ব্যবহার কবিতাগুলোকে প্রানোজ্জল করেছে।‘তিপ্পান্ন হলো বুঝি’ কবিতায় কবির এই পঙ্কতিগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়-
“কখনো রাশিয়ার ব্ল্যাক ডলফিন কিংবা/কিউবার গুয়ান্তানামো বে অথবা মায়ানমারের ইনচেনে/আমার সোনার হরিণ নেই/আমার অভিজ্ঞতার ছদ্মবেশ ও নেই/তাই আবেগের হরমোনে ক্লোরোফর্ম ঢেলে নিশ্চিন্তে ঘুমাই/বাতাসে ভেসে আসে তোমার নিমগ্ন প্রেমের গল্প/আমি ভাবি, বয়সটা তোমার তিপ্পান্ন হলো বুঝি।”
কবি নুরুন্নাহার মুন্নির আধখোলা জানালার আলাপ কাব্যগ্রন্থে ঋতুবৈচিত্রের অনন্য উপস্থাপন পরিলক্ষিত হয়। তিনি চৈত্রের দুপুরকে যেমন জ্বলজ্বলে করে পিচঢালা রাস্তায় টেনে এনেছেন তেমনি বর্ষার জলে সকল উত্তপ্ত দগ্ধ মহড়াকে শান্ত করেছেন, তুলে ধরেছেন ঝড়, বন্যার পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েও।‘শ্রাবণের হোমল্যাস সিনড্রোম’ কবিতাটি তারই প্রমান রেখে যায়।
ইভুলিউশান নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় অনেক জ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিরাও বন জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কবি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন বলেই হয়ত তার সূক্ষ্ম চিন্তাগুলো কবিতার ভাষায় নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পেরেছেন। তবে কখনও কখনও তাকে একটু কৌশলী হতেও দেখা গেছে, যেমন ‘ঈশ্বরের ডোমচিল’ কবিতায় কবি বেশ আধ্যাত্মিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি বলেছেন-“পাসর্পোটটা প্রায় রেডি হয়ে গেছে/ভিসার নতুন ক্যানভাস অনেকটাই সিলগালা/এখন ফসলের মাঠ জুড়ে চলছে/ধান মাড়াইয়ের পালা।”
মাতৃপ্রেম, পিতৃপ্রেম, যৌবনে পূজিত প্রেম, সব প্রেমই মানব প্রেম।মানব প্রেমের অভ্যন্তরে আমাদের সকলের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে দেশপ্রেম।স্বাধীন পৃথিবীতে জন্ম নেয়া কবি তার কবিতায় স্বাধীনতা পরবর্তী সৃষ্টি হওয়া রাজাকার, সন্ত্রাসী দানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সমসাময়িক মানচিত্র এটে দিয়েছেন তাদের কপাল জুড়ে, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রুখে দাঁড়িয়েছেন,উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন প্রতিটি সাধারন মানুষকে সমাজের উচ্ছিষ্টগুলোকে ধ্বংস করতে।’স্বাধীনতার অন্তরায়’ কবিতায় কবিকে এমনি ভাবেই বলতে দেখা যায়-“মনে হয় আজও বেজন্মা কুকুরের উচ্ছিষ্টগুলো স্বাধীনতার চেতনার বুকে ছুরি বসাতে ওত পেতে আছে/নশ্বর করে দিতে মাতৃভূমির সুঠাম দেহ।”
আধখোলা জানালার আলাপ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই কোন না কোন কারনে আমার মন ছুঁয়ে গেছে।কোন কবিতা চমৎকার শব্দের গাঁথুনির জন্য, কোন কবিতা ভাবার্থের জন্য, কোন কবিতা মিথ ব্যবহারে নান্দনিকতার জন্য।
নারী এক সৌন্দর্যের নাম, এক শক্তির নাম, এক প্রেরণার নাম, এক একটি দৃষ্টাান্তের অমর স্বাক্ষর নারী।নারী নিয়ে যুগে যুগে কবিরা সৃষ্টি করে গেছেন অমর কবিতা, অমর বাণী।কবি কাজী নজরুলের নারী কবিতার উদ্ধৃতি টেনে যদি বলি
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
কবি নুরুন্নাহার মুন্নি তার ‘মানবী’ কবিতায় পুরো পৃথিবীর আদলে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন বা দেখেছেন, কবি বলেছেন-“পৃথিবীর অবয়বে আমি/গ্রহ নক্ষত্রের উত্তাপে আমার হয়না ক্ষয়/মলিন হয়না আমার মাধূর্য্য/আমি আলোকিত হই দ্বিগুণ দাবিতে/মুক্তো ছড়াই আপন আদরে;/আমি নারী,আমি পূর্ণ অলংকারে/পৃথিবীর অবয়বে।”
শুরু থেকে শেষ অবধি প্রতিটি কবিতাই আমাকে অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়েছে, বোধের তৃপ্তিতে ডুবে গেছি।বহুমাত্রিক স্বাদ জাগানিয়া ‘আধখোলা জানালার আলাপ’ কাব্যগ্রন্থটি। শেষ করতে চাই প্রথম কবিতাটির অনুভূতি দিয়ে, কবিতাটির প্রথম লাইনটি আমাকে বিশেষভাবে র্স্পশ করে, তারপর অবলীলায় ঢুকে পড়ি কাব্যগ্রন্থটির গর্ভে। লাইনটি ছিল এমন-“পাখি আর প্রকৃতি অন্ধ নিয়মের মতো হেঁটে চলে/দাপিয়ে বেড়ায় বৈশ্বিক রাজত্বে”
এ দুটি লাইনের ভাবার্থ আমাকে ভাবিয়েছে গভীরভাবে, হয়ত অন্যদেরকেও এভাবেই ভাবাবে। কবি নুরুন্নাহার মুনির ‘আধখোলা জানালার আলাপ’ কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে আধখোলা নয় তিনি ভালোলাগার পুরু জানালা খুলে দিয়েছেন পাঠকের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩।প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন।আমি কবির কাব্যগ্রন্থটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩ এ অনুপ্রাণন প্রকাশনীর স্টল থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। আমি ’আধখোলা জানালার আলাপ’ গ্রন্থটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।