অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১৫, ২০২৪
১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ১৫, ২০২৪
১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবিবুল্লাহ রাসেল -
মৎস্যজীবীদের উপাখ্যান

কবি - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

হুমায়ূন রহমানের নামের সঙ্গে অনেকগুলো বিশেষণ তুলে ধরা যায়। তিনি একাধারে লোকসাহিত্য গবেষক, ইতিহাসবিদ, ঔপন্যাসিক। নাটক, জীবনীগ্রন্থসহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একত্রিশ। ‘জিয়ানি জীবন’ তার দ্বিতীয় উপন্যাস। তার দুটি উপন্যাসেই পেশাজীবীদের জীবনচিত্র সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে।

যারা নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে মাছ ধরে বিক্রি করে অর্থাৎ ধীবর বা কৈবর্ত বা মৎসজীবী; তাদের জীবনী নিয়ে এই উপন্যাস। বরিশাল অঞ্চলে এই পেশার লোকদের বলা হয় জিয়ানি। লেখক এই উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়ার জিয়ানিপাড়াকে। লেখকের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা এখানেই। ফলে অত্যন্ত গভীরভাবে মিশেছেন এই পেশাজীবীদের সঙ্গে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতিকে রপ্ত করতে পেরেছেন সাবলীলভাবেই। তাই এ উপন্যাস লিখতে লেখককে শুধু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি, জীবন থেকে গ্রহণ করা অভিজ্ঞতার সঙ্গে যোগ করেছেন সুষম কল্পনা।

উপন্যাসের পরতে পরতে আঞ্চলিক শব্দের ছড়াছড়ি। উপন্যাসে যে সকল আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত নমুনা পেশ করা যাক।

মাছের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শব্দ : ডগরি, চুচড়া, বাইলা, ফেসা, চিঙ্গইর, গোদা, নলগোদা, করিনা, বেলিনা, থুরিনা, তিতপুঁটি, মুতকুড়া ইত্যাদি।

মাছ ধরার সরঞ্জামের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শব্দ : মইয়া জাল, বাদা জাল, চরগড়া, দোনবর্শি, ভাসান বর্শি, লেউত বর্শি, যুতি, খুচইন, চাঁই ইত্যাদি।

অন্যান্য আঞ্চলিক শব্দ : কাতরা, হেতি, উরুম, হোতাখাল, ডরকোলা, উন্দুর, চালি, কান্দা, তালকাছা, কোপবাতি, কাগা, ধইরগা, ঘুইরগা, মইরগা, নাহান, আইয়া, লামা, আচুক্কাচোডে, ছডফডাইয়া, ফাচ্চুর-ফুচ্চুর ইত্যাদি।

সংলাপে যেমন আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি বর্ণনায় কখনো প্রমিত শব্দের সঙ্গে আঞ্চলিক শব্দ যোগ হয়ে সৃষ্টি করেছে নতুন ব্যঞ্জনা। যেমন, ‘বাইলামাছ ও ফেসামাছ ছাড়া কিছুই ধরা পড়েনি।’ ‘কাঠের তৈরি আন্ধারি দিয়ে স্বচ্ছ পানিতে মাছ দেখছে।’ ‘লাইন দিয়ে পুতে রাখা দোন বর্শিগুলো।’

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অশোক। সে পিতৃপুরুষের মতোই মাছ ধরে। মাছ ধরা, মাছ বিক্রি করা তার নেশা-পেশা। লেখা-পড়ার সুযোগ পায়নি অশোক। কিন্তু তার আছে শ্রদ্ধাবোধ, পিতা-মাতার প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, জীবের প্রতি মমতাবোধ, সচেতনতাবোধ।

ভগ্নিপতি রতনকে নিয়ে মাছ ধরতে যায় অশোক। মাছ ধরতে ধরতে যুতির কাটায় জাতিসাপ বিধলেও সাপটাকে মারে না তারা। পোনাসহ দুটি বড় মাছ হাতের কাছে পেয়েও পোনার কথা চিন্তা করে মাছ দুটিকে খুন করে না। অশোক সুন্দরবন কাঁকড়া ধরতে গেলে একটা যুবতী কাঁকড়া তার হাতে ধরা পড়ে। অশোক দুই হাত দিয়ে কিছু সময় কাঁকড়াটা নেড়েচেড়ে পানির মধ্যে ছেড়ে দেয়। অশোকের মা-বাবাও প্রাণীদের প্রতি উদার। চাঁই’র মধ্যে তারা একদিন ঢোঁড়াসাপ পায়। সাপে চিংড়ি মাছ সব খেয়ে নিয়েছে। তারপরও সাপটিকে ছেড়ে দেয় তারা।

মা-বাবার প্রতি দারুণ ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে অশোকের হৃদয়ে। ভগ্নিপতি রতন বিয়ের কথা তুললে অশোক বলে, ‘বাবা মা কত কষ্ট কইরগা আমাগো দুইবেলা খাবার জোগার করছে। নিজেরা না খাইয়া আমাগো খাওয়াইছে। বিয়া করলে বউ যদি বাবা মাকে খাওন না দেয়, পরতে না দেয়, তাইলে সেই দুক্কে বাবা মা মইরগা যাবে।’

দিন দিন জলাশয়ের মাছ কমে যায়। অশোক আক্ষেপ করে বলে, ‘ছোডহালে দেখছি হিন্দুরা বৈশাখ মাসে মাছ খাইতো না। মাছের পেডে তহন ডিম থাকত। এহন শেখ নোমো কারও বাদবিছ নাই। সবাই খায়। ডিমওয়ালা মাছ খায়। মাছ বাড়বে কেমনে?’ সচেতনতা ফুটে ওঠে অশোকের কণ্ঠে। অশোকের চার বোন। পনেরো পার হওয়ার আগেই বোনগুলোর বিয়ে হয়ে গেছে। অশোক এখন বোঝে কাজটি ঠিক হয়নি।

পাশের বাড়ির তুলিকে পছন্দ করে অশোক। মনের কথা কিছুতেই বলতে পারে না অশোক। বড়শি পেতে বসে থাকে। তুলিও বুঝতে পারে তার প্রতি অশোকের দুর্বলতা। তুলি সম্মতি প্রকাশ করে কৌশলে, ‘আসলে অশোকদা, আমার মনে অয় আপনি এট্টা বড় মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। মাছ কিন্তু বর্শি আপনার গিলছে। আপনি আদাজল খাইয়া লাগেন কাম অবে।’

তুলি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ফেল করে লেখা-পড়া বন্ধ। মা নেই। জেঠিমা’র কাছে বড় হয়েছে। তুলির কাছে জাত নয়, মানুষই বড়।

তুলি হিন্দু। অশোক ছোট জাতের জিয়ানি। হিন্দুরা তাদের হিংসা করে, অশোক এ কথা বললে তুলি বলে, ‘আমিও মানুষ, আমনেও মানুষ। আমি তো আর শেহের লগে প্রেম করি না। আর শেহের লগে প্রেম করলেইবা কী? ওরাও তো মানুষ। মানুষ সব এক। জাত মানুষ বানাইছে। আমি জাতপাত বিশ্বাস করি না। দুনিয়া উইল্ডা গেলেও আমরা আলাদা অমুনা। দিব্যি কাডেন।’ তুলির কণ্ঠ দিয়ে লেখক অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন।

জিয়ানিরা দরিদ্র। কিন্তু তাদের অন্তর জুড়ে রয়েছে ভালোবাসা। এই বৃদ্ধ বয়সেও অশোকের পিতা হরবিলাস ও মা সুরবালার মধ্যে ভালোবাসার কমতি নেই। গলদা চিংড়ির চোখের উপমায় লেখক তুলে ধরেছেন ‘শলা চিংড়ির সবুজ চোখের দিকে তাকালেই হরবিলাসের মনে পড়ে ঠিক যৌবনে সুরবালার চোখও এমন ছিলো।’ হরবিলাস একদিন সুরবালাকে বলে, ‘শোন সুরবালা, মানুষের শরীরের পরিবর্তন আসে। মনে আসে না। মন ধান গাছের নাহান সবুজ। সরিষা খেতের নাহান দখিনা বাতাসে দোল খায়।’

যৌবনে তুলির জেঠা মারা গেলেও জেঠিমা পারুল অনাথ তুলিকে বুকে জড়িয়ে স্বামীর ভালোবাসার স্মৃতি লালন করেই কাটিয়ে দেয় যৌবন।

দুষ্ট লোকেরা খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরে। মানুষ দোষ দেয় জিয়ানিদের। জিয়ানিরা পাহারা দেয়। অপরাধী কালা ধরা পড়ে। বাসু বলে, ‘জিয়ানিদের মাছ ধরা পেশা, কষ্ট কইরগা হেরা সংসার চালায়। কেউ কোনোদিন কইতে পারবে কোন জিয়ানি চোর, পরের জিনিস না কইয়া নেছে, পরের ক্ষতি করছে, কেউর ধারে কিছু চাইছে? না খাইয়া মইরগা গেলেও ওরা খালে বিষ দিয়া মাছ ধরবে না।’

নানান তথ্য-উপাত্ত সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করে লেখক গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপন্যাসজুড়ে রয়েছে লোকাচার, লোকপ্রযুক্তি, লোককথা, তন্ত্রমন্ত্র, ধাঁধা, লোকছড়া, লোকগান। উপন্যাসটি পাঠে পাওয়া যায় হাসি-কান্নার এক ভিন্ন অনুভূতি। মানবতাবোধ সামনে রেখে লেখক একটি পেশাকে তুলে ধরেছেন পরম মমতায়।

গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন নাসিম আহমেদ, প্রকাশক : আপন প্রকাশ, মূল্য ১৮০ টাকা।

 

+ posts

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)