অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১০, ২০২৫
২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১০, ২০২৫
২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমিনুল ইসলাম -
আমিনুল ইসলামের একগুচ্ছ কবিতা

আমিনুল ইসলামের একগুচ্ছ কবিতা-

 

নদীমাতৃক প্রচ্ছদে

লালনের গান শোনার আগেই আল ডিঙানোর মাটি
পায়ে নিয়ে সে ঘরে ফিরেছে;
সাতপুরুষের জোত ঘামের বদলে দেয় সোনালি গম্বুজ;
অথচ ছুটদাগের বুকে সবুজের ঢেউ দেখে
ঘাড়ের গামছা ঘাড়ে নিয়েই সে কণ্ঠে তোলে
প্রান্তরের সুর; আর বানেজলে একাকার হলে
পাল ওড়াতে কোনো শাসনই থাকে না;
অবশ্য বাজখাই অধিকার ফিরে পেতে
বলিষ্ঠকোমর অধিকাংশ চরের কিষাণ।

নদীর কত শাসন! জলের কত সংবিধান!
তবু নদীমাতৃক এই দেশে
সিকস্তির ঝুঁকি নিয়েও নদীপাড়ে গড়ে ওঠে ঘর,
ভেসে আসা কণ্ঠে খোলে অনুশাসিত কত জানালায়।

ভালোবাসায় ফিরে আসা

আমবাগানের ছায়ায় স্থির বাতাসে ওড়ে শুকনো কুয়াশার মতো
পূর্বজনমের ধুলো; পোড়ামাটির ফলক ভারহীন চাকায়
চূর্ণ হয়ে গেলেও আকাশের মিউজিয়ামে ছবিটা রয়ে গেছে;
আসলে নক্ষত্রগণই খাঁটি কিউরেটর। হয়তো তাই
অচেনার পথ ধরে চোখাচোখি হতেই সান্ধ্যাপায়রার মতো
আমাদের চোখে এসে বসেছে পানিহারের প্রত্ন-আলো;
ফলে মধ্যবর্তী অন্ধকার খসে পড়লে আমাদের মাথার
ওপর নেমে এসেছে ঝুলন্ত আমের থোকা-টক এবং
মিষ্টি- দুই-ই; অধিকন্তু বাতাসেও সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রত্নঘ্রাণ।

আর স্বর্গচ্যুত আদম হাওয়ার চোখে পরস্পরকে চিনতেই
আমাদের পায়ের কাছে নেমে এসেছে সম্ভাবনার সিঁড়ি,
স্বাতি ও অরুন্ধতীর চোখ
টর্চের মতো উদ্ভাসিত করেছে সে-সিঁড়ির গা।

অথচ গাবের আঠার মতো কী যেন জড়িয়ে তোমার মন!

সীমানা

কত আর বলো নতুন জলের আবাহন!
ভাঙনের রেখা যত বাড়াও
ততটাই বাড়ে ভালোবাসার জলমহাল।
বসে আছি: হাতে জাল- জগতবেড়
সে আমার হৃদয়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই আর
জানি, সে শুধু ডাঙার অভিধান;
প্রণয়ের জলনীতি বদলায়নি মূলধারায়
আজো তাই জাল যার জলা তার।
অতএব যতই গভীর হোক চোখের জলের নদী
সে লোনা অতলে কার অধিকার?
তো নদীর সহোদরা, পালাবে কোথায়?
ধরা তুমি  পড়েই আছো-ডুবসাঁতারের আড়ালে।

ভ্রাম্যমান ক্যামেরায়

অবাধের পথ ধরেছে সবাই; কেউ আগে, কেউ পিছে।
কোথায় গিয়ে থামবে ওই ঘণ্টাধ্বনি-
সেই খবর কিন্তু কারো কাছেই নেই।
মিডিয়াবাজিতে মুগ্ধ অনিকেত কাফেলার চোখে
অগ্রগামী পাছার নগ্নতাই উজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
পেছনে রেখে আম্রকানন-
কাফেলা ডিঙিয়ে যায়
সোনালি ধানের নৃত্যমঞ্চ,
আঁচলবিছানো উঠোনের প্রান্তরেখা;
জননীর স্নেহমাখা পিছুডাক
কোলাহলে লুপ্ত হয়ে যায় দ্রুত;
কৈশোর পেরুনো শেফালী দাঁড়িয়ে রয়েছে
সিদ্ধান্তহীন,
তার বুকে বিড়ম্বিত প্রণয়ের বোঝা;
প্রতিযোগী অন্ধকার
আতশবাজি আর আশমানবাজিতে
ভুলিয়ে রাখতে চায় তাকে;
আর বিমুগ্ধমেধার দামে
নষ্টবিপ্লবীরা গড়ে যায় বিপরীত মিনার।

‘বিকট দাঁতের পাহারাই নিরীহ প্রাণিকুলের
নির্ভরতার গ্যারান্টি’–এ কথায় গলা ফাটায়
অন্তহীন ন্যায়যুদ্ধের দাঁতাল ঘোষক;
পাখিরা ডানা গুটিয়ে জড়োসড়ো;
খুশিতে তৎপর টিকটিকিরা।

আর অদূরে সদ্যপ্রত্যাবৃত্ত তিনজন যুবক
মহানন্দার পশ্চিমপাড়ে বসে গায়:
‘যে তোমার ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা।’

তবু প্রেম তবু ঘরবাঁধা

উত্তরের হাওয়া এসে মাড়িয়ে যায়–রাজধানীর কলাকেন্দ্র,
সখিনার ঘর-বর, নুয়ে-আসা শস্যের খেত এবং
নুলোভিখেরীর খটখট আওয়াজে অভ্যস্ত দুয়ার।

কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসে
মুগ্ধমোড়ে বনলতার হতাশ চোখ,
বলাকার চঞ্চলবুক,
মাথার ওপর শিশুর আকাশ
এবং শীতবৃদ্ধের বিকেলের একমুঠো সোনারোদ ।

দুহাতে শূন্য ছড়ায় চার্বাকের দূত ,–উদ্দীপ্ত বাতাস,
সবুজ চত্বরে হেসে ওঠে কাঁচি ও করাত;
সমূহশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত শুধু হাতেগোনা কয়টি পুরোনো বৃক্ষের গোড়া;
আর নিরজনে কেঁপে ওঠে
দাদির কবর ছুঁয়ে শুয়ে থাকা ডালিমের ছায়া।
ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘতর কেন্দ্রচ্যুত কাফেলার সারি,
বিভ্রান্তলক্ষ এবং গাইডশূন্য মোড়।

এমন অবেলায় কে পারে থাকতে বসে দাওয়ায়?

টমাহক গিলে গিলে অগ্নিসহ আমি এক অদ্ভুত প্রেমিক
উধাও-বসন্তের বিশ্বে— যমদূতের অভিসন্দর্ভ ।
স্বপ্নের আঙিনা ছোঁয়া নশ্বর তল্লাটে
জীবনানন্দীয় প্রত্যয়ে অশ্বত্থের বীজ রোপি রোজ
আর শোনাই গান;
আমার কণ্ঠে বাঁধা আবহমান নিসর্গের সুর
হে বন্ধু, ভুলো না চিনে নিতে,
কোনোদিন নিপাতনে সত্য হলে মুগ্ধকল্প কবির বিশ্বাস।

 

*********************

আমিনুল ইসলাম

জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ।
নব্বইদশকের কবি-প্রবন্ধিক-নজরুল গবেষক।

প্রকাশিত গ্রন্থ : ৩১ট।

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

মুভি রিভিউ – জংলি, চক্কর ও দাগি

Read Next

বরফ গলা নদী- আমার প্রিয়তম বই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *