১. আলোর বিচ্ছুরণ
পাখির পালকের মতো স্বপ্ন নিয়ে
অসময়ে এসেছিলো দেবদূত আমাদের ঘরে
স্থির চাঁদ আর জ্যোৎস্নায় মহামায়ায়!
জননী আমার আকাশের বুকে
শুভ্র স্বচ্ছ আলোয় ভেসে ভেসে
দেখে এই আমাদের পৃথিবী
তরবারি অথবা কোনো হৃদয় ক্ষরণের বেদনায়।
দৈর্ঘ্য ও সীমানায় সে ওড়ে না কোনোদিন
মুকুট মাথায় ঠিক আলোর মতো আমি তাকে
দেখি বহুবার শ্যাওলাপড়া পৃথিবীর উপর।
হেনা অথবা পৃথিবীর কোর রঙ
থাকে না সেখানে
সেখানে শুধুই উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ।
২. বেদনার শুকতারা
অভাগা একটি জীবন নিয়ে যে ঊষার আলো
আঁটকুড়ার দরজায় এসে
কারবালার মরু আর বেদনায়
খণ্ডিত প্রেমে দিয়ে গেল তার
জনক ও জনম জনমের হৃদয়ের টান,
তপ্ত প্রেমে তার নদী বয়ে যায়।
আসে নতুন নতুন প্রায়শ্চিত্ত যন্ত্রণা।
যে শরীর ছোঁয়ে ছিলাম বহু দূর থেকে
যার ঘ্রাণে ডুবে ছিলাম সারা সুসময়,
নিয়ে ছিলাম নিজেরে দেহ থেকে
তোমাকে ভেবে, সেই ঘ্রাণ
আজ তাকেই মনে পড়ে!
মনে হয় সে বুঝি তুমিই ছিলে।
আজ সারা রাত বৃষ্টি এসেছিল।
শরৎ ও বৈশাখের আকাশে এত বৃষ্টি!
তুমি তো জানো না আমার মনের অজান্তে
কত বৃষ্টি হয়ে যায় কত বেদনায়,
তুমি তো জানো না
তুমি চলে যাবার পর
বেদনায় ডুবে ডুবে
আমি কত কতবার দেখি বেদনার শুকতারা।
৩. জীবিত থাকা
অবশ হওয়া খাঁখাঁ শূন্যতায়
বুকের ভেতর যে মরে যেতে ইচ্ছে করে,
তার নাম কী?
স্বজনের বিদায় বেলায়
লাগে যে বিষণ্ণ চারদিক
আসে যে চারদিক একাকী একাকী
খারাপ লাগার সময়,
তার নাম কী?
ফিকে আলো নিয়ে আসে যে
মন খারাপের সময়,
তারও নাম কী?
আনন্দ বেদনার যে সময়
ঘৃণা ও ভালোবাসা নিয়ে বুকের ভেতর
নানা অনুভূতি জাগায়,
তার নাম কী?
উত্তর পাইনি।
তবে কখনো কখনো মনে হয়
এরেই নাম জীবন
এরেই নাম জীবিত থাকা।
৪. আম্মার সংসার
আমরা এক সময় ভাত দিয়ে তরকারি খেতাম।
তখন শিম ও লাউয়ের লতানো সবুজ গাছ ছিল আমাদের
যদিও সেই জায়গাটা ছিল আমার নানার
পরবর্তীতে নিয়েছে মামারা।
আমি সেই সময় বাজার থেকে পাঁচ টাকা বা দশ টাকার
টমেটো ও বেগুনের ছোট ছোট গাছ এনে রোপণ করতাম
বাড়ির আঙ্গিনার এখানে ওখানে
সেখানেও হতো সবুজ আর লাল সবজি।
শিম টমেটো ও অন্যান্য সবজি দিয়ে আম্মা তখন
বেশি করে তরকারি রান্না করতো সন্ধ্যে বেলায়,
সারা দিন অনাহারে থাকার পর
ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কখন রান্না হবে
কখন আমরা খাব!
রান্না শেষ হলেই আম্মা আমাদের ডাকত খাবার খেতে
আর আমরা তখনেই বুভুক্ষা নিয়ে
খুব দ্রুত প্রায় দৌড়ের মতো হাজির হয়ে যেতাম রান্নাঘরে,
আম্মা তখন গরম গরম তরকারি
আর তার পাশে কিছু ভাত আমাদের থালায় দিতেন।
আমাদের তখন চাল কেনার টাকা ছিল না
আগের দিনে আনা গ্রামের দোকান থেকে যেই চাল ছিল
তা থেকেই আম্মা রান্না করতেন,
আমরা ভাত খেতাম এক পৃথিবীর খিদে নিয়ে!
পরের দিন কোথায় থেকে চাল আসবে
তা জানা থাকত না আমাদের কারও।
অল্প চালের ভাতেই রান্না হতো আমাদের জন্য,
সেই অল্প চালের অল্প ভাতের প্রতিটি লোকমায়
পৃথিবীর সব স্বাদ সব মজা এসে যেতো তখন,
তখন মুখ ফোটে বলতে পারতাম না
‘আম্মা পেট ভরেনি আরো ভাত খাব
আমাকে আরও ভাত দিন!’
আমরা তখন জানতাম
আমাদের ভাতের হাঁড়িতে
অবশিষ্ট আর কোনো ভাত নেই আমাদের।
৫. অজানা কিছু
কবরের জীবন কেমন?
সেখানে কি শুধুই অন্ধকার!
নাকি প্রিয়জন হারানো বিষাদ কান্নায়
ডুবে থাকে বুকফাটা চিৎকারে সবটা সময়।
কবরের জীবন কেমন?
সেখানে কি একাকিত্বের সময়ে স্মৃতি ভাসে
প্রেম প্রীতি অন্যায়ে
হারানোর ব্যথায়?
কবরের জীবন কেমন?
সেখানে কি কেউ আছে?
নাকি কিছুই নেই!
যেমন ছিল না
সৃষ্টি বা জন্মের পূর্ব সময়।
৬. জানালা
আমাদের ঘরে কয়েকটি জানালা আছে।
জানালাগুলো লোহার,
হলুদ রঙ করা প্রতিটি জানালা
আর তার উপর হলুদ পর্দা।
সেই জানালাগুলো দিয়ে হুহু করে বাতাস আসে
ঘরের ভেতরে,
সেই জানালা দিয়ে দেখা যায় বাইরের অনেক কিছু!
কড়া রোদ, মুষলধারা বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ
দূরের কাছের গাছগাছালি
হেঁটে যাওয়া মানুষ, পশুপাখি সব।
আম্মা আমাদের পশ্চিমের রুমে থাকতেন
তাই সেই রুমকে আমরা বলি আম্মার ঘর।
আম্মার ঘরে আম্মা প্রায় সময়
সেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরে!
হেঁটে যাওয়া মানুষ
প্রকৃতি কত কিছুই দেখতেন আম্মা,
দেখতেন আমাকেও।
আমি বাড়ি ফেরার পথের দিকে
আমার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতেন আম্মা।
আম্মার এখন নতুন ঘর হয়েছে!
সেই ঘরের কোনো জানালা নেই
সেই ঘরের কোনো দরজাও নেই
সেই ঘর থেকে পৃথিবীর কিছুই দেখা যায় না আজ।
৭. সুন্দর
আমার বাড়ির চারদিকে এবং মাঝখানেও অনেক ফুল গাছ।
বড়, মাঝারি ফুল গাছগুলোতে নানান রঙ্গে সব সময় ফুল ফুটে থাকে।
হলুদ লাল নীল বেগুনি যত রং আছে সব রঙ্গের হরেক রকম ফুলে
ছেয়ে থাকে বাড়ির সবটুকু উপর।
ফুলের লতানো আর মাঝারি কাণ্ডগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল
ফুলের কলিতে সারা বছর থাকে পরিপূর্ণ।
ফুলের সুবাসে মোহিত হয়ে থাকে চারদিকের আলো ও বাতাস।
আমার ফুলবাড়ির ফুল গাছগুলোতে বছরের প্রতিটি দিনেই
অফুরন্ত ফুলে আর সুবাসে থাকে পরিপূর্ণ,
একটু বাতাস এলেই ফুলের পাপড়ি বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে ছড়িয়ে যায় চারদিকে,
প্রতিবেশীদের আঙ্গিনায়।
আর
এই নিয়ে প্রতিবেশীরা হরহামেশাই আমাকে গালমন্দ করে।
তারা বলে, আমার ফুলগাছের ফুল গিয়ে তাদের আঙ্গিনা নাকি নোংরা করছে
তৈরি করছে আবর্জনা।
তারা ফুল ভালো বাসে না!
তার সৌন্দর্য ভালোবাসে না!
তাদের সুবাস ভালো লাগে না!
তাই,
আমি এত সুন্দরের মাঝে থেকেও সুন্দর লুকিয়ে রাখি
সুন্দর ছড়িয়ে দিতে ভয় পাই।
৮. তারার মেলা
পুকুরপারে আজ দাঁড়িয়ে ছিলাম রাতে
জ্যোৎস্নায় আলোকিত ছিলো চারদিক
আর
মেঘ ভেসে ভেসে বেড়িয়ে ছিলো আকাশে।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পুকুরপারে।
পুকুরপারের আম গাছের দিকে তাকাতেই
দেখি, গাছের পাতায় পাতায়
সাদা ফুলের মতো তারা ফোটে আছে অসংখ্য,
অসংখ্য অগণিত সেই তারায় তারায়
পুকুর পারের আম কাঁঠাল গাছের কালো পাতাগুলো
হয়ে উঠেছে তারার মেলা।
শাহীদ লোটাস
শাহীদ লোটাস বাংলা ভাষার লেখক।
জন্ম : ১৫ জ্যৈষ্ঠ সোমবার সকাল ৮টায়।
তিনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
উপন্যাস : বেদনার বাঁশি, কলকি সুন্দরী, আরশি, ঘৃণা, বসন্তের শেষ বিকেল।
কাব্যগ্রন্থ : একুশ ও মুক্তির গান, মুদ্দাফরাশের কবিতা, একটি শোক সংবাদ, তখনো সে।
আত্মজীবনী : ১৮ মার্চ ২০১৯।