অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ৫, ২০২৫
২২শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ৫, ২০২৫
২২শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সঙ্গীতা ইয়াসমিন -
সঙ্গীতা ইয়াসমিনের গুচ্ছ কবিতা

তুমিগ্রস্ত বাতিক

ঘুমের ভেতর এক অদ্ভুত পিপাসায় জেগে উঠি,
হাত বাড়িয়ে পানির বোতল খুঁজি।
পানি পেলে মনে হয় এ যেন জলের তৃষ্ণা নয়!
অন্যকিছু আমাকে তাড়ায়! কী যেন ছিল কোথায়!

বাতাসে জানালার শার্সি কেঁপে ওঠে,
উইন্ড চাইমের টুংটাং, বুকের জানালায় কড়া নড়ে।
গাড়ি স্টার্ট অথবা বন্ধ হয়,
ঘিরিইইইম! গ্যারাজ ডোর খোলে কেউ,
ডোর বেল বাজে ক্রিংক্রিং;
টুপটাপ দু’একটা পাতা পড়ে কাছে-পিঠে,
শিশিরের মৌলিক ফোঁটায় চেনা পায়ের গন্ধ।

ক্রমশ একলা হিমে মরে যায় রাতগুলো,
দূরের বনে ঝাউপাতার শিনশিন
বিষণ্নতার লেপে জাপ্টে থাকে শীতকাঁটা।
আবার বিবিধ কাজের জটলা,
ত্রস্ততার মেঘচাদরে ঢেকে যাওয়া দিন
ছুটে চলে দুর্মর সর্ষে সাইকেলে।
আহ্নিক গতির কোলে ঢলে পড়ে চোখ!

বিভ্রমের হাতছানি! কোথাও কি কেউ থাকে!
কেউ কি ডাকে!

 

অলিখিত চুক্তি

দেখাশোনার চেয়ে আমাদের চেনাশোনা ছিল ঢের।
সমাজের শেখানো পথ ছেড়ে
আমরা হেঁটেছি সভ্যতার কাফনে ঢাকা পথে
অনায়াসে ছিঁড়েকুঁড়ে সব জঞ্জাল
পাড়ি দিয়েছি সহস্র নটিকেল মাইল সমুদ্রপথ।
অর্থহীন কথার ফাঁদে ফেঁসে গেছে
হলুদ সকাল, বৈধব্যের শ্রাবণ,
অপুষ্পক বসন্তের পত্রপুট।
অতীতের দেরাজ থেকে আক্ষেপ খুলে নিয়ে
জুড়ে দিয়েছি ছেঁড়া পালে।

দিগন্তে মিলিয়ে যেতে যেতে
অনিবার্য উপস্থিতির মত আমরাও
অস্তিত্ববান হয়ে উঠেছি রোজকার জীবনে।
একাদশীর জোয়ারে ভাসানো সাম্পানে
সমুদয় সম্পদের দেখা মিলেছে,
বিস্ময় ও অস্থিরতা
অনুরাগ ও বিপন্নতা শান্তি ও স্থিতির মতো
ইত্যকার শব্দগুলো নতুন করে মূদ্রিত হয়েছে
আমাদের অগ্রন্থিত অভিধানে।

বহুদিন পরে বেনামী দলিলের
পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখি
আপাত সমিলগুলোই
চৌম্বকধর্মে ধর্মহীন করেছে আমাদের।

 

মিস করার কোনো পরিভাষা নেই

‘খুব মিস করি তোকে’ লিখতে গেলেই
দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত
উড্ডীন হয় কলমের ঠোঁটে।
কাগজের বুকে রক্তশূন্যতা অথৈ
প্রবল আপত্তির ঝড়ে আক্রান্ত শ্বাসযন্ত্র,
রংধনু থেকে বেনীআসহকলা ছিটকে পড়ে
যেন বোয়িং ৭৭৭।

মিস করার কোনো পরিভাষা নেই বাংলা অভিধানে।
দূর অতীতের চর্যাপদ থেকে উঠে আসা অক্ষরে,
নিউলিবারালিজম এবং পোস্ট মর্ডানিজম লেন্সে
নৈকট্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার এই মরণকালেও
সম্মোহন বাজারে এর নিষ্পত্তি হয়নি।

মেয়েবেলার বেণী দোলানো লাল ফ্রকে
টিনের জারের আইসক্রিম, তেপায়ে দাঁড়ানো স্কুলঘর,
পলেস্তারা খসা মেয়েদের কমনরুম,
প্রথম যৌবনের মৌবনে সপাহান্তে নেভিক্যাম্পে নেভিগেশন,
পাঁচ টাকা লক্ষ্মীর ভাঁড়ারে জমাতেই মাসকাবারি টান।
বয়সের কাঁটা মাড়িয়ে মতিহারের সবুজ
কিংবা ভাড়াবাড়ির দশ বাই কুড়ি ফিট ব্যালকনি,
সকলই তড়পিয়ে বেড়ায় স্মরণের খাতায়।

হৃৎপিণ্ডের দেয়াল ঘেঁষে একটা ‘ব্লিডিং হার্ট’
ধীরে ধীরে বাড়ে, লতাগুল্মের ফাঁকে অভয়ারণ্য ভেবে।
সম্ভ্রমের ভরাকটাল ফুলে ওঠে সফেন ঢেউয়ে
বুনোহাঁস জলকেলি অথবা পানকৌড়ির ডুবসাঁতার
ক্লান্ত করে… খুব ক্লান্ত করে।

বালখিল্য খোলস ছেড়ে প্রাচীন ঘুড়ি এখন
ড্রোন ওড়ায় শতাব্দীর আকাশে।
অনুভূতির ভোঁতা দেয়ালে হরিদ্রাভ ছত্রাক,
টিনের চালের বৃষ্টি নুপূর, কলাপাতার ছাতায় ডোবা
লালশালুক দুপুর⸺

দৃষ্টিবিন্দু ছাপিয়ে প্রসারিত রেটিনায় ভেসে ওঠে
আবারও সেই শব্দবন্ধ⸺যা আজও অব্যাখ্যেয়।

 

একটা সকালের গল্প

সেই গল্পটা আর শেষ হলো না…
লাউডগার মতো তিরতিরিয়ে ওঠা
একটা নরোম সকাল ফুরিয়ে গেল
এক দঙ্গল শকুনের পেছনে।

বনের গা ঘেঁষে এক ঝাঁক ধূসর কালো পাখির জটলা,
দূরত্বের লেন্সে জুম বাড়িয়ে দেখে নিলাম
কী নিপুণ প্রত্নতাত্ত্বিক ঢংয়ে মৃত শরীরের উৎসব!
নির্ভুল ভাগাভাগির এমন সুষ্ঠু আয়োজন
গভীর অভিনিবেশে দলীয় বিচরণ,
সহভাগিতায় ওরা শতভাগ সার্থক!

সুন্দর ছুঁয়ে থাকার দুর্দমনীয় লোভে
অস্থির হয়ে উঠল ডান হাতের প্রথমা,
অপেক্ষা কেবল একটি মুহূর্তের…
একটা মোক্ষম ক্লিক!

বেড়াল পায়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই
আরও কিছুটা কাছের দূরত্বে…
রণে ভঙ্গ দিয়ে উড়ে যায় দুদ্দাড়
বাতাসে সন্দেহের পোড়া গন্ধ
প্রাণভয় এসে দাঁড়ায় সমুখে,
পেছনে পড়ে থাকে অসামান্য আহার!

‘শকুনিচোখ’ জানে ক্যামেরার চেয়েও ভয়ানক
⸺মানুষের চোখ।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

অনুপ্রাণন অন্তর্জাল- সম্পাদকীয় (৭ম সংখ্যা)

Read Next

শর্মী দে – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *