অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রওশন রুবী -
যে কথা হয়নি বলা, যে কথা শোনার

আজ বুধবার,

শুক্রবারের চেয়ে রাস্তা-সব ফাঁকা ফাঁকা,

চড়ুইভাতি আর ডাঙ্গুলির হাত প্রজন্মে অগ্রসর,

করাতের দরজা রেখে সোনালিমাছ সাঁতরে যাও, সাঁতরে যাও,

সবুজ-পতার-দেশে ফুলের দোকানে দোকানে অনন্যদিন,

আনন্দফোয়ারা রেসকোর্স হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়— সমস্ত শহর ডুবিয়ে নিল।

কী কথা বলবে, কী সারপ্রাইজ দেবে বলে—

সম্বোধন বদলেছে; আলাপের মাঝে সংযোগ কেটেছে;

টুথব্রাশ করতে করতে লাজুক হেসেছে?

সে কি মুসা ইব্রাহিম ঈসার জীবনালেখ্য?

গ্যালারির উৎসুক দর্শকের না বেরুনো চিৎকার?

ফড়িং-হৃদপিণ্ড, মাকড়সার বিষ-পান?

আমি ভাসছি একোন মোহে চিরহরিৎ শাল গজারি হিজল সুন্দরী?

চা পুড়ে গেল, গরমজল টলকে পড়ল,

নুন-বোয়ামে চিনি, চিনি-বোয়ামে টেস্টিংসল্ট,

এইভাবে এইভাবে বুধবার শুরু।

রিকসা পঙ্খিরাজ, অপাপবিদ্ধ গতি,

অপেক্ষা আছে অপেক্ষায়, সাথে সারপ্রাইজ,

প্লেয়ারে সকাল সকাল বেজেছিল ভৈরবী ,

কোন শাড়ি, কোন ব্লাউজ আর অন্যসব…

ওফ্! কী করি! কী পরি করে বেলা গড়িয়েছে খুব!

কী দেবে! কী বলবে? কী যে অসহ্য তাড়না! কী যে শিহরণ!

যে কথা বলা হয়নি সে বলা কী? কী হতে পারে? কী যে এমন…

ভাবনাজুড়ে খেয়ালি খেয়ালি প্রজাপতি উড়ে বসল—

প্রথম বাঁধা খোঁপায়; গোলাপে, আহ্ কী দরদি-ভিড়!

টানা-কাজলের উপর আইলাইনার, আইসেডো,

হাঙ্গরের ক্ষুধা মাপছে আদিগন্ত লাল টিপ,

ছুটছে অকুতভয় অকৃত্রিম ধুক্ ধুক্।

ধুমকেতু, মহাবিশ্বের অণু-পরমাণু ঘূর্ণায়মান,

সভা হবে, সন্ধি হবে, উদ্বোধন হবে একীভূত-চলার;

নামবে নক্ষত্র! নামবে কোথায়?

পাঁজরে পাঁজরে সুকম্পন অত্মহারা।

আজ বুধবার। হলিডে হলিডে রোড,

মানুষ-জন কেমন অচেনা অচেনা,

ফাঁক-ফোকরে গজিয়ে ওঠা দু’একটা গাছ

ঝিরিঝিরি আলোয় আলোয় হাসছে; সদ্য সুবহেসাদেক টপকে—

গোপনে স্নানরত গোলাপের গ্রীবা বাহু যেন দোলে।

তুর পাহাড়ের উন্মাদনা, পিরামিড বিস্ময়

সেন্টমার্টিন রাতারগুল সাদাপাথরের রোমাঞ্চ নিয়ে অনুভব—

শিমুল তুলো উড়ছে, উড়ছে; গণ্ডি থোড়াই কেয়ার;

উড়ুক সাহারা, উড়ুক সংশয়হীন স্বপ্নীল-সুযোগ।

একে একে পেরিয়ে যাওয়া বর্ষাকাল নেমে আসুক,

পা’দানি ভরে যাক জলে, ছলাৎছলাৎ চলুক চপলা।

শীতগুলো পেঁজা-পেঁজা ভেজা-ভেজা, বসে থাক উষ্ণতার জন্য;

বসন্ত আগলে ব্লাউজ, রঙ তার চুড়ি-আঁশলি-দুলে,

আচমকা কোঠরের খলই ভর্তি ইচ্ছেমাছ খলবল করে উঠছে; উঠুক,

যা ইচ্ছে তাই হোক; তাই হোক। সুবাসিত ছুটে চলা,

অতিক্রম করে যাচ্ছে রুপলি-ইলেশের ঘাই জাফরানি আবেশ,

আত্মমগ্ন আমি, তার চেতনায় দিশেহারা।

কী সব অপেক্ষা অপেক্ষা খেলা! ওহো খেলা খোলা-মেলা হও;

এই অদ্ভুত ছেলেমানুষির আড়ালে কী লুকাও?

কী আছে? আছে কি পাহাড়ি ঝরনা?

রিনিঝিনি কানে বাজে সুর; আহা কী মধুর! কী মধুর!

দুধ-রঙা গাই লাফায় আনন্দবাগানে, ওধারে সাপ-মণি নিয়ে—

ছুটছে কুসুম বাই; ইতি দিয়েছে ঘুংঘুর কবে কবে কে জানে।

ইস্! কী হবে সেই সব ফুর্তিবাজ বণিকদের?

কী হবে হা-ভাতে দৈত্যদের?

যাদের থলে ভরা কুসুম বাই, কুসুম বাই অসুখ?

যা ইচ্ছে তাই হোক। আমার কী এসে যায়?

বুধবার বদলেছে তীরের গতি;

আমার-ধনু উচ্ছ্বাসে টানটান, ছুড়ব কিছু পর; সামান্যই পথ।

নতুন পুরাতন বাংলাদেশ, অজপাড়া-গাঁ, ঝালর-পাখা,

জল-জঙ্গল, রয়েল-বেঙ্গল, প্রাচীন স্থাপত্য—

কাঁথা-ফোঁড় শাড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে যায়, নেমে যায়;

নেমে যায় যমুনার প্রবল-বেগ, খরস্রোতা পদ্মা,

আহা ব্রহ্মপুত্র, সুরমা যাও! যাও! কার শিল্পকর্ম কে জানে;

যার হয় হবে। বয়ে যাচ্ছো; যাও!

আমার সারপ্রাইজ অপেক্ষমাণ। কী দেবে সে?

সেই সনাতনী কথা? সেই খুনসুটি? সেই লুটপুটি?

আপাদমস্তক চেনা, তবু অচেনা মানচিত্র! কী বিস্ময়কর!

এই ভূ-মণ্ডলে নেচে গেয়ে মত্ত; উন্মাতাল কাদামাটি,

কাঁচা কাঁচা রোদ, মুঠোফোন-নির্বাক, নির্বিকার রঙের খেলা।

কী আছে ওপ্রান্তের অস্তিত্বে? কেমন তার গন্ধ?

সেকি সুগন্ধী-ফুল, আতরের অনুকূল,

সেকি মায়ের মুখের মিঠে-মিঠে-গন্ধ, বাবার গায়ের?

সরু-সাঁকো, নৌকো, ছনের বাড়ি,

পাখি-পাখি ঘুলঘুলি, রোমাঞ্চকর পিরামিড?

চাকমা মণিপুরী সাঁওতালী-স্নিগ্ধতা?

গারো নৃত্যরত রমণীর কলা?

লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ, হাডু-ডু, গোল্লাছুটের উত্তেজনা?

কী হতে পারে, কী হতে পারে?

একটা কথার গতি কী যে ভয়ঙ্কর গতি ধারণ করে জানে—

একুশে ফেব্রুয়ারি, রেসকোর্স ময়দান, উনিশ শ’ একাত্তর,

সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, সংসদ, ধর্মগ্রন্থ, জাতিসত্তা।

জানে-ধীরেন্দ্রনাথ আলাউল শেখ মুজিবুর,

ক্ষুদিরাম নূর হোসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর;

জানে, মাথিন ধীরাজ এবং

প্রেম-অমরত্বের সুধা-পান করেছেন যাঁরা।

জানুক তাঁরা; জানুক, আমি ছুটছি, বুধবার ছোটে,

ছুটির দিন ছোটে, তাপ-প্রপাত ছোটে।

ভূমিগর্ভ চিরে বেরিয়ে আসবে কি আজ সাদা সাদা পালক;

মোম মোম রাত, ক্যানভাসে প্রিয়-দৃশ্য

মুছে দেওয়া ইজেল ঈর্ষা যেমন?

এই অধম অপরাহ্ন খুঁটে জলরঙে আঁকি কত-ছবি;

আহা জীবনানন্দ! কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত সমীকরণ!

মুছে দেন বেদনাবোধ সবি।

বাঁশের বাঁশি বল দেখি তার রূপ-রঙ,

অদেখা-স্বপন, স্বাদ-বিস্বাদ কেমন?

কালো-ব্যাগের হাতল ছুঁয়ে আছে গোলাপের ঠোঁট;

ওগো সুগভীর পীড়া বুধবার তুমি কী ভীষণ ক্রিয়াশীল;

এখানে চলছে না পরক্রিয়া;

আপনের ক্রিয়ার গতি মাপে প্রতিক্রিয়া।

চলো চলো গতিশীল, চলো সম্মুখ-যুদ্ধে; ভয় নেই,

এযুদ্ধ ল্যান্ড দখলের নয়, অহংকার, হিংস্রতার নয়।

এখন পারমাণবিক যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষে যদিও

পুতিন জো বাইডেন স্বয়ং উপস্থিত,

রাশিয়া ইউক্রেন মুখোমুখি; খুলছে অজস্র মুখোশ;

কোভিড ধরাশায়ী; এইডস পালাতক,

আন্তর্জাতিক আন্দোলনের মুখে আমরা দু’জন;

তাতে কী? পরম যুদ্ধক্ষেত্রে বিলীন করব একাকিত্বের।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমলে নয়,

তাজিনডং কেওক্রাডং চিম্বুক লালমাই চন্দ্রনাথ;

না! সেগুলোও নয়।

হিমালয় অতিক্রম করে আসা বরফ-আগুন;

না! তাও নয়।

ছুটছে রিকশা, অলি-গলি পেরিয়ে পেরিয়ে ছুটছে ছুটছে…

ছুটতে ছুটতে ইতিমধ্যে সে দূরগামী জাহাজ;

যতই বন্দরের কাছাকাছি ততই অন্যরকম অনুভব,

অন্যরকম গন্ধ বলে— ‘আছি!’

সাহস নিংড়ে নিংড়ে ঘাম আকস্মাৎ গলছে, গলে গলে কস্তুরী,

ছড়িয়ে পড়ছে তার উপস্থিতির খবর,

দু’পাশের লোভ লকলকে দৃষ্টি মাস্তুলে রেখে,

উৎকণ্ঠার তীর্যক বেগ নিতান্ত সাধারণ আমারে

টেনে নেয় ইন্দ্রিয়ের ভেতরে।

ঐ তো দেখা যাচ্ছে রোদ বাড়ির ছাদ ঠেলে বহুকাঙ্ক্ষিত—

বহুমাত্রিক-শুভ্রদ্বীপ, উদার-আসমান,

নক্ষত্রের হাট দাঁড়িয়ে আছে;

তার কার্পাস-রঙা পকেটহীন শার্ট বাতাসসমুদ্রের ডিঙি;

চোখ-মুখের অসম্ভবদীপ্ততা আমাকে পর্যবেক্ষণে

আপাতত অন্ধ-বধির, তার বিশ্বস্ত-হাত নিম্নগামী,

আঙুলে আঙুলে বুনন করছে ফড়িং-সোহাগ।

আমার ভেতর উদযাপিত হচ্ছে দুর্গাপূজার খুশি,

অঞ্জলি শঙ্খ ঢাক আরতি উলুধ্বনিতে বাজিমাত,

অশোক কাশফুল ফুটে আছে দিক-দিগন্তে;

শিউলি ঝরে পড়ছে ওর গ্রীবার উপর।

উপবাসী দেহ-মন এতটুকুন পথ

পেরুতে পেরুতে মনে হলো মহাকাল।

ওফ্! আশ্চর্য মহাকাল! হতবাক সময়!

কী আছে ওখানে— মানুষ না দেবতা? যার নিমন্ত্রণে—

নৈবেদ্য নিতে সাতসমুদ্দুর অতিক্রান্তে দাঁড়ায়ে।

এই প্রথম দেখায়— কী দেবে?

কী রহস্য নিয়ে আছে?

সেকি পৃথিবীজোড়া শুভ্রতা?

সেকি মোহময় চেরাপুঞ্জ?

সেকি জীবনের খুব কাছের কবিতার সমগ্র নান্দনিক উত্তাপ?

সব প্রশ্নের উৎকণ্ঠা ঠেলে আমিই বললাম শেষে—

‘দাও! কী দেবে দাও! অর্পণ করো! কৃতার্থ হই।’

সে দুর্গার চরণে যেন অর্পণ করে টকটকে জবা;

অমনি নতমুখ না তুলেই বাড়ানো হাত আলতো ছুঁয়ে বলল—

চোখ বন্ধ কর। যে সারপ্রাইজ দিবো বলে ডেকেছি,

যে কথা শুনবে বলে এসেছ;

সে এখন দেবো এখন শোনাব।

তুমি প্রস্তুত হলে নীরব হও,

অনুভব জাগ্রতের জন্য নীরবতা প্রয়োজন।

যে কথা হয়নি শোনা, যার প্রতীক্ষায় তার জন্য—

পৃথিবীর কপাট বন্ধের মতন বন্ধ হলো চোখ,

পাখির গান আর ফুল-রেণুদের আলাপ ছাড়া

সমস্ত কোলাহল থেমে গেল। বন্ধ-চোখ,

কাঁপা-ঠোঁট স্পর্শ করে পুনরায় শুভ্রতা বলল—

সারপ্রাইজ নিতে, কথাটি শুনতে—

তুমি প্রস্তুত? বলো প্রস্তুত?

স্বর্গের সহস্র দরজা ঠিকরে বেরিয়ে এলো পবিত্র শিহরণ,

ভূমির ধূলি সব বসরার গোলাপ-বাগান,

নিরেট আকর্ষণে দু’হাতে তুলে ধরল মুখ

কিছু না বলে ঠোঁট নামিয়ে আনল আলোর জোয়ার

আমি উন্মাতাল, আমি জোয়ারের ধ্বনি শুনি,

আমি এক ঘোরের মধ্যে বিলবোর্ডে দেখি আঁকা

নান্দনিক কাব্যের পটভূমি,

আমার বন্ধ চোখে তখন নেমে এল প্রজাপতির ঝাঁক

আমার নাসান্দ্র ফুলে ফুলে ওঠে,

আমি মদির বিদ্যের ভূমি চষে লাঙ্গলে তুলে আনি

গভীরের মুহূর্তসমূহ, সে নিবিড় সমুদ্র মন্থনে

উদার আসমান খুলে দেয় ডানা

আমি আচার-বিচার ভুলে যেতে থাকি

ভুলে যেতে থাকি সবুজের বুকে একদিন—

সাঁকো বানিয়ে অন্যপারে যেতে চেয়েছিলাম

ভুলে যাই আমি চলে গেলে

কেউ কোথাও অন্ধকারে বসে কাঁদবে না, ভুলে যাই—

কর্দমাক্ত মাটি চষে একদিন তুলে এনেছিলাম উচ্ছ্বাস,

জীবনের এই ক্ষণে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেলে

বিপরীতে যাওয়ার উপায় থাকে না জেনেও

প্রবাহিত আমি, আমার বসন্ত কোকিলের কণ্ঠলগ্ন,

আমার প্রকম্পিত ঠোঁট আগ্নেয়গিরি

আমি তার আলো অন্ধকার ছায়া পুড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত

আগামীর কান্ধে রাখি জোয়াল,

সে শীতের মতন ওম খোঁজে, বেড়ালের মতন আরাম…

সদর, লক্ষ্মীপুর থেকে

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি

Read Next

শিল্পপথের দুর্ভাগা যাত্রী তারেক মাহমুদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *