
জাত-বেজাত
আরও দুতিনটি বোরকাপরা মেয়ের মাঝখান থেকে এ মেয়েকে শরিফ আলাদা করেছে ওর কপালের লাল টিপটি দেখে। এ লাইনে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে অনেকেই আজকাল বোরকা পরছে। তবে বোরকার সাথে টিপপরা মেয়ে শরিফ এই প্রথম দেখল। তাও আবার লালটিপ। তাই আজ লাল টিপওয়ালিকেই বেছে নিল সে। মিরপুর ‘সনি’ সিনেমা হলের সামনে যেসব মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের বেশির ভাগই ‘লাইনের মেয়ে’। এর আগেও শরিফ এখান থেকে শিকার ধরেছে কিংবা উল্টো করে বলা যায় নিজেই শিকার হয়েছে।
চিড়িয়াখানা রোডে শরিফ ওর এক রুমের বাসায় মেয়েটিকে নিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই মেয়েটি বোরকা খুলে ফেলল। মেরুন কালারের সালোয়ার-কামিজের সাথে ম্যাচিং করে মেয়েটি মেরুন-লাল টিপ পরেছে খুব যত্ন করে। শরিফের সন্দেহ হলো, মেয়েটি আবার হিন্দু নয়তো? নাম জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কারণ ‘লাইনের মেয়েরা’ সঠিক নাম কখনো বলে না। আর নাম শুনে হিন্দু-মুসলমান চেনার দিন শেষ হয়েছে অনেক আগেই।
তবুও একটা অস্বস্তি রয়েই গেল শরিফের। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করেই বসল— ‘এ্যাই, তুমি কি হিন্দু?’
মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে শরিফের গায়ে ঢলে পড়ল। নিজের কাপড় খুলতে খুলতে বলল, ‘টাকার কি কোনো জাত থাকে?’
বাজার
গত দুদিন থেকে এ অবস্থা চলছে। সামান্য ব্যাপারেই তিনি রেগে উঠছেন, যখন-তখন, যার-তার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন। ম্যাডাম কেন এরকম করছেন তা অফিসের অধঃস্তনেরা কিছুকেই বুঝে উঠতে পারছেন না। ম্যাডামের এরকম ‘রণরঙ্গিনী মূর্তি’ এর আগে আর দেখা যায়নি।
অফিসের বসেরা সাধারণত পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যায় ভুগলে অফিসে এসে অধঃস্তনদের অযৌক্তিক হম্বিতম্বি করেন। প্রচলিত নিয়মে তাই দেখা যায়। কিন্তু যতদূর জানা গেছে, এ ম্যাডামের পারিবারিক জীবনে একজন স্বামী থাকলেও কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এরপরেও ঢাকা শহরে তার দুটো বাড়ি। দুটো বাড়িই বেশি টাকায় ভাড়া দিয়ে নিজে কম ভাড়ার বাসায় থাকেন। টাকাই ভদ্রমহিলার ধ্যান-জ্ঞান, টাকাই ঈশ্বর।
অধঃস্তনেরা বহু অনুসন্ধান করেও ম্যাডামের গত কদিনের মেজাজ বিগড়ানোর কার্যকারণ উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছেন।
অবশেষে একজন অধঃস্তন ম্যাডামের ‘উনপঞ্চাশ মেজাজ’-এর মাজেজা খুঁজে পেয়েছেন। কী এক কাজে তিনি যখন ম্যাডামের রুমে ঢুকছিলেন তখন শুনতে পেলেন ম্যাডাম ফোনে কাকে যেন বলছেন, ‘কিছুই তো খবর রাখো না। আমার যে সবই গেল। গত কদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। আমার তো ওখানে প্রায় এক কোটি টাকা খাটছে। মর্জি-মেজাজ কি ঠিক থাকার কথা?’
নয়া ধান
আজ তিন চারদিন দানাপানি একেবারেই মুখে নিচ্ছে না যতীন। ছেলে বিমল হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায় বাবাকে। গ্রাম থেকে সরাইল সদর হাসপাতাল খুব বেশি দূরে নয়। যতীন কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না।
‘আসফাতালঅ গেলে আমি মারা যামু।’
যতীনের ধারণা, হাসপাতাল থেকে কেউ ভালো হয়ে ফেরত আসে না। ছেলে বিমলকে ডেকে বললেন,
‘তুই বুড্ডার নরেশ ডাক্তররে লইয়া আয়। দেহিছ, আমি বালা অইয়া যামুগা।’
বুড্ডার নরেশ ডাক্তার অত্র এলাকার প্রবীণ ও একমাত্র ডাক্তার। রোগী দেখে ডাক্তার যতীনের ছেলেকে আড়ালে ডেকে বললেন, ‘অহনত কাতি মাইয়া টান। বাপে যা খাইতে চায় খাওয়াইয়া লও। আর আমার ওষুধগুলাও খাওয়াও। বাঁচানোর মালিক ওপরঅলা।’
যতীন সবই বুঝতে পারেন। ছেলে বিমলকে বলেন, ‘কাতি মাইয়া টানে (কার্তিক মাসের মঙ্গা বা অভাব) মানুষ মইরা যায় কিন্তুক আমি অহন মরতাম না। আমি মরুম আগইন্যা নয়া ধান ঘরঅ আইলে। ’
উঠোনে যেদিন অগ্রহায়ণের নতুন ধান এল এর দুদিন পর যতীন চোখ বুজলেন।
আমার সোনার বাংলা
ঢংঢং ঘণ্টা শুনলেই শফুর পাতা কুড়ানো থেমে যায়। সে গিয়ে দাঁড়ায় ‘শিশু কানন’-এর কাছে। তারই মতো ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে এক সারিতে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই একসাথে গেয়ে উঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ শফুও দূর থেকে ওদের সাথে ঠোঁট মেলায়।
গান শেষে সুন্দর পোশাকপরা ছেলেমেয়েরা দৌড়ে ক্লাসে ঢুকে যায়। শফু পাতাকুড়ানো টুকরি নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। দেরি হলে মা বকা দেবে যে।
শফুর অনেক দিনের ইচ্ছে স্কুলের ঐ ছেলেমেয়েদের মতো সুন্দর জামাকাপড় পরে এক সারিতে দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাবে। তারপর বইখাতা নিয়ে দৌড়ে তাদের সাথে ক্লাসে চলে যাবে। কিন্তু সুন্দর আপা এবং ঐ সুন্দর ছেলেমেয়েরা কখনও তাকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। ধুরধুর করে কুকুরের বাচ্চার মতো তাড়িয়ে দেয়।
একদিন শফু সাহস করে ঢুকে যায় সুন্দর ছেলেমেয়েদের সারিতে। গান শুরু হয়ে গেছে ‘আমার সোনার বাংলা…’। পেছন থেকে সুন্দর আপার এক গলাধাক্কায় ছিটকে দু’হাত দূরে গড়িয়ে পড়ে শফু। তখনও তার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা…’।
অলক্ষ্মীর বাসা
কৈশোরে সিনেমার গান শুনেছিল সুবীর, ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার, ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন।’ ততদিনে পাখির বাসার মতো চোখওয়ালা সহপাঠিনী প্রীতি হারিয়ে গেছে। কেউ বলল প্রীতিরা আগরতলায় গেছে, কেউ বললো আসাম আবার কেউবা কোচবিহারে।
প্রীতির সাথে অনেক কথা বলতে বলতে এক সময় সুবীর বলে ফেলত, ‘এ্যাই, তোর চোখগুলো এত বড় কেন রে? চোখ বড় বলেই বোধহয় তুই এত সুন্দর।’
‘জানিস সুবীর, মা বলে, এই চোখ চোখ নয়, অলক্ষ্মীর বাসা। এই চোখ তোকে একদিন ডুবাবে।’
আঠারো বছর বয়সে সুবীর ‘বনলতা সেন’কে খুঁজে পেয়েছিল কলেজ লাইব্রেরিতে। পড়েছিল, ‘…পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
প্রায় অর্ধশতাব্দী বয়সে এসে সুবীর জানল, বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশেরই কাকাতো বোন শোভনা।
কিন্তু এখনো সুবীরের জানতে বাকি রয়ে গেছে তার কৈশোরের ‘বনলতা সেন’ ‘অলক্ষ্মীর বাসা’ নিয়ে কোথায়, কতবার ডুবেছে।
আজানে-আজানে জীবন
ফজরের আজানের একঘণ্টা আগেই শুরু হয় রেশমার সকাল। তিনটি পরিবারের রান্না একটি চুলায়। ‘সিরিয়াল’ না পেলে ঐদিন খাওয়া ‘নট’। পাঁচ মিনিট দেরিতে ‘গার্মেন্টস’-এ ঢোকার গেট বন্ধ।
জোহরের আজানের সাথে সাথেই লাইন ধরে পিপীলিকার মতো ছুটতে হবে বস্তির ‘বাসায়’ । ঠাণ্ডা ভাত-তরকারি গলার নিচে ফেলে আবার দৌড়।
আছরের আজান কানে পৌঁছালেও তখন সেলাই মেশিনে সমস্ত মনপ্রাণ। প্রতিদিনের নির্দিষ্ট ‘টার্গেট’ ফিলআপ না করতে পারলে সুপারভাইজারের রক্তচাহনি আর অশ্লীল গালিগালাজ আজানের সময়ও চলতে থাকে।
মাগরিবের আজানের সময় মাথায় কাপড় তুলে দিলেও চোখ থাকে রেশমাদের সেলাই মেশিনে। তখনও তারা মেশিনে জীবন ‘সেলাই’ করে চলে।
এশার নামাজের অনেক পরে ঘরে ফিরতে হয়। এ রুটিন নিত্যদিনের। রান্না করে খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয় রাত ১২টার পর। আবার উঠতে হয় ফজরের একঘন্টা আগে। আবার জীবন। আবার আজান-জীবন।
হিমাদ্রিশেখর সরকার : প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার
shekhorhimadri@gmail.com