
উৎপাত
সারাদিন তৃণ খেয়ে জঙ্গলের একটু উঁচু জায়গা দেখে হাতি বিশ্রাম নিচ্ছিল। শেয়াল এসে হাত কচলানো শুরু করল।
হাতি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, কী বলবি জলদি বল।
⸺মামা, আপনি যা-ই বলেন, এটা ঠিক না।
⸺ আমি কী বলি? আর কী-ই বা ঠিক না?
⸺আপনার এত বড় দেহ, এত শক্তি শরীরে, আপনারই জঙ্গলের রাজা হওয়া উচিত। বাঘের একদম রাজা হওয়া ঠিক না।
⸺আমার দেহ বড় হলেও বাঘের শক্তি, ক্ষমতা ও বুদ্ধি ঢের বেশি।
⸺তাতে কী? গণতন্ত্র বলতে তো একটা কথা আছে। বাঘ তো দিনদিন আরও স্বৈরাচার হয়ে উঠছে। মন চাইলেই প্রাণী ধরে ধরে খাচ্ছে। কেউ কিছু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। যেন প্রাণীরা জঙ্গলে বাস করার জন্য তাদের রক্ত বন্ধক দিয়ে রেখেছে? জঙ্গলের প্রতিটি জায়গার তার গোত্রের কেউ। একটা বিহিত না করলে কেউ বাঁচবে না এই বাঘের হাত থেকে।
⸺তা কী করব এখন?
⸺আপনাকে এই জঙ্গলের দায়িত্ব নিতে হবে।
⸺তা কী করে সম্ভব?
⸺আমি প্রত্যেক প্রাণীর কাছে গিয়ে বোঝাব⸺বাঘ রক্ত-মাংস ছাড়া কিছু খায় না, কেউ বাঁচব না ওর হাত থেকে। হাতি তৃণভোজী, চলো বাঘকে তাড়িয়ে হাতিকে রাজার আসনে বসাই।
শেয়ালের কথায় হাতি রাজি হয়ে গেল। চারদিক থেকে তুমুল আন্দোলনে বাঘ পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
মাংস খেতে শেয়ালের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।
কিছুদিনের মধ্যে অন্য প্রাণীদের মতো শেয়ালও টের পেল⸺গুলির শব্দ… করাতের উৎপাত…
লেজ
বাঘকে তাড়াতে আন্দোলন যখন চরমে, প্রাণীরা লেজ নিয়ে পড়ল ভীষণ বিড়ম্বনায়। লেজ সঙ্গে নিয়ে সংঘর্ষে যোগ দেওয়া যায় না, তা ছাড়া লেজ থাকলে ধরা পড়ার ভয় থাকে।
নানান ভাবনা-চিন্তা করে বিপ্লবী প্রাণীরা সিদ্ধান্ত নিল⸺আমরা যার যার লেজ একটি সম্মিলিত ভাণ্ডারে জমা রেখে মাঠে নামব।
আন্দোলন সফল হলে যার যার লেজ ফিরিয়ে নেওয়ার পালা। কিন্তু লেজ নিতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি।
একদল বলল, হরিণের আবার লেজ আছে নাকি?
কাছিমও গেল লেজ আনতে।
জলহস্তী ও গণ্ডার নিজেদের চেয়ে বড় লেজ দাবি করে বসল, আমরা এত বড় প্রাণী, আমাদের লেজ বড় হবে না তো হবে ওই দুষ্ট বানরের?
সাপ আগেই দখলে নিল অনেক লেজ। আর হিসহিস করে বলল, সবাই ভণ্ডামি বাদ দাও, দেখছ না আমার দেহটাই আস্ত একটা লেজ!
সংস্কার
অভ্যুত্থানের পর শেয়াল ভাবতে লাগল কোথায় কোথায় সংস্কার আনা যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ল⸺একটা বিষয় তো আগেই ভেবে রেখেছিল, বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এবার আর ব্যর্থ হওয়া চলবে না। শেয়াল দ্রুত চলল মহারাজ হাতির কাছে।
⸺মহারাজ এবার কোকিলের গান বন্ধ করুন।
⸺কী বলো জঙ্গলে জাতীয় সঙ্গীত বন্ধ করে দেব?
⸺মহারাজ আমাদের মধ্যে এত শিল্পী থাকতে কোকিলের গান কেন জাতীয় সঙ্গীত করতে হবে?
⸺কোকিল কি আমাদের নয়? আমাদের জীবন-যাপনের প্রতিটি অনুষঙ্গেই তো কোকিলের গান মিলেমিশে একাকার!
⸺মহারাজ, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? কোকিল আমাদের কেউ না। সে এ জঙ্গল, ও জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়, মাটিতে তার পা পড়ে না, যতই গাক গান, সে গান কখনও আমাদের হতে পারে না।
⸺তাহলে কে লিখবে জাতীয় সঙ্গীত, কে গাইবে?
⸺কেন আমি?
⸺তুমি?
⸺শুনুন তবে⸺হুক্কা হু….
সঙ্গে সঙ্গে অন্য শেয়ালেরাও তাল মিলাল হুক্কা হু…
এমন মাংসখেকো সঙ্গীতে তৃণভোজী প্রাণীরা মৃত্যু আতঙ্কে জখম হলো।
ঘাসফড়িঙের লাফ
অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে সমাবেশ করছে শেয়াল। একদিন লম্বা লম্বা ঘাসের ভেতর থেকে যাওয়ার সময় দেখে ঘাসফড়িং একা একা লাফাচ্ছে।
শেয়াল বলল, বিজয়ের আনন্দে লাফাচ্ছ বুঝি?
ঘাসফড়িং বলল, আমরা আনন্দেও লাফাই, বেদনায়ও লাফাই, কিছু বুঝেও লাফাই, না বুঝেও লাফাই।
⸺কীসব বলছ, সহজ ভাষায় বলতে পার না?
⸺জঙ্গলে রাজনীতি মোটেই সহজ না।
শেয়াল বলল, ঘাসফড়িঙয়ের মাথাটা এবার গেছে।
ভেট
হাতির দরবারের শেয়ালের আগমন⸺মহারাজ আসতে পারি?
⸺আহা, কতবার বলেছি, সরাসরি চলে আসবে, তোমার আবার অনুমতি কীসের? সবাই আর তুমি এক হলে নাকি? তা বোসো বোসো। কী বলবে বলো।
⸺মহারাজ আপনার জন্য ভেট নিয়ে এসেছি।
⸺কীসের ভেট?
⸺জঙ্গলের প্রাণীদের পক্ষ থেকে ভেট।
⸺বুঝিয়ে বলো।
⸺আপনি মহারাজ, আপনাকে ভেট দেবে না, তার কখনো হয়?
⸺তা কী ভেট এনেছ?
⸺রক্তমাখা তাজা হরিণের মাংস। আপনার জন্য কী আর যেনতেন মাংস আনতে পারি?
হাতি রেগে গিয়ে বলল, তুমি জানো না আমি তৃণভোজী? আমি রক্ত-মাংস খাই না।
শেয়াল হাত কচলাতে কচলাতে বলল, একটু আধটু মাংস না খেলে রাজত্ব করবেন কী করে?
টিয়ার ঠোঁট
মহারাজ হাতিকে নিয়ে শেয়াল এল হরিণপাড়ায়।
উৎসুক হরিণেরা জড়ো হলো, আজ তাদের গর্বের সীমা নেই। মহারাজের আগমন এই দরিদ্র গৃহে, এ কী চারটিখানি কথা!
শেয়াল বলল, মহারাজ, আন্দোলনে যে হরিণটিকে বাঘে খেয়েছিল, এরা তার অভাগা পিতা-মাতা।
শেয়ালের আবেগময় কথায় হরিণদ্বয় কাঁদতে লাগল। হাতির ছোট্ট চোখ দিয়েও অঝোর ধারায় প্রবাহিত হলো অশ্রু। ভিজে উঠল উপস্থিত সব প্রাণীর চোখ।
গাছের ডালে টিয়া কথা বলে উঠল, সেদিন ঘটনাস্থলে আমি তো উপস্থিত ছিলাম, কই মৃত হরিণের শরীরে তো কোনো রক্ত দেখিনি! বাঘে খেলে তো রক্ত বেরুবে?
শেয়াল রেগে উঠল, নিশ্চয়ই তুই সে রক্ত খেয়েছিস, তা না হলে তোর ঠোঁট লাল হলো কী করে?
অনুশীলন
অভ্যুত্থানের পর একদিন হাতির কানের কাছে এসে শেয়াল বলল, আপনাকে নিয়ে বাদর বলে কী জানেন মহারাজ?
⸺কী বলে?
⸺বলে, হাতি মহারাজ হয়েছে তাতে কী, সে কি আর আমার মতো লাফাতে পারে? বলেন, কত স্পর্ধা বাদরের!
⸺কী করা যায় এখন?
⸺বাদরকে উচিত শিক্ষা দিন মহারাজ, ও বিগত শাসকের দালাল।
⸺কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি, জঙ্গলে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে?
⸺তাই বলে মহারাজকে নিয়ে বাজে কথা বলবে?
⸺এখন আর কী করব?
⸺তাই বলে আপনি বাদরের কাছে হেরে যাবেন?
সেদিন থেকে হাতি সকাল সন্ধ্যা লাফাতে লাগল।
মৃত্যুবার্ষিকী
হাতির দরবারে শেয়াল এসে বলল, ভেতরে আসতে পারি মহারাজ?
⸺আরে পণ্ডিত যে, এস এস, তোমাকে আবার অনুমতি নিয়ে আসতে হয় নাকি? তোমার চালাকির জন্যই আজ আমি মহারাজ। তোমার জন্য রাজদরবার চব্বিশ ঘণ্টা খোলা।
⸺মহারাজ, তাই বলে আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দেব না? আমি বাদর নাকি?
⸺হাতি হাসছে, কী জন্য এসেছ তাই বলো?
⸺আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি, মহারাজ।
⸺কী অনুষ্ঠান আবার?
⸺মৃত্যুবার্ষিকী।
⸺কার? তোমার পিতা-মাতা কারও?
⸺না মহারাজ, আমাদের কারও নয়।
⸺তবে?
⸺ছাগলের।
⸺এ জঙ্গলে আবার ছাগল পেলে কোথায়?
⸺এ জঙ্গলে নয় মহারাজ, এখান থেকে বহু দূরে হলেও আগে তো আমরা এক সঙ্গেই ছিলাম⸺ছাগল সেখানে জাতীয় পশু।
হরিণের গয়না
শেয়াল লোকালয় সফর করে হরিণ সমাবেশ ডাকল।
হরিণেরা ভাবল, শেয়ালমশাই তো বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন আমাদের! সফর শেষে আমাদের নিয়ে সভা, ভাবা যায়! বেশ গর্ব হচ্ছে আজ। একেই বলে নতুন দিন!
সমাবেশে শেয়াল বলল, বুঝলি, সফরে লোকালয়ে দেখে এলাম মানুষ কী সুন্দর করে গয়না পরে। এই যেমন : নাকফুল, আংটি, বালা, হার⸺কত কী! ওদের পালিত গরুরাও পরে অলংকার।
হরিণেরা বিস্মিত, গরুও পরে!
শেয়াল বলল, কী আর বলছি তোদের। যদি দেখতি! কত যে অসাধারণ লাগে! লোকালয়ে এ গয়নাকে ঠুসি বলে।
হরিণেরা বলল, এ সব আমাদের শুনে কী লাভ হবে মাননীয়?
শেয়াল বলল, তোরাও আগামীকাল থেকে অন্তত দিনের বেলা মুখে ঠুসি পরবি। তোদেরও দেখতে দারুণ লাগবে। আমি আজ রাতেই লোকায়ে গিয়ে নিয়ে
আসব।
হরিণ বলল, আমরা তবে ঘাস খাব কী করে?
শেয়াল বলল, সুন্দর দেখাতে দিনের বেলা না খেলে কী এমন হয়? ঠুসি পরলেও কথা তো বলতে পারবি তোরা। কথা বলার স্বাধীনতা আর সৌন্দর্যের চেয়ে খাওয়াটা তোদের কাছে বড় হয়ে গেল?
মামলা
মাছরাঙা বকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল।
শেয়াল বলল, বেশ হয়েছে।
হরিণ বলল, এ তুমি কী করলে মাছরাঙা? বকের আবার অপরাধ কী?
শেয়াল বলল, ও বিগত শাসক বাঘের গলা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল, সেটাই ওর অপরাধ।
ডাহুক বলল, সে তো কয়েক শতাব্দীর আগের এক বাঘ ছিল, আর সে বক তো এ না।
শেয়াল বলল, ওই একই কথা।
গুণীর শাস্তি
শেয়াল কচ্ছপকে বলল, তুমিই তো জঙ্গলের সবচেয়ে প্রবীণ, ঠিক বলেছি কিনা?
⸺সে কি আর মানে কেউ আজকাল?
⸺মানবে না কেন? তোমার বয়স, তোমার ধৈর্য, তোমার একাগ্রতা, এসব গুণ জঙ্গলের কে না জানে!
⸺আরে না ভাই, তুমি বাড়িয়ে বলছ, ধীর গতির কারণে আমার বদনামও কম নয়।
⸺আরে তবুও তো খরগোশের সঙ্গে তুমি দৌড়ে জিতেছিলে।
⸺সে দিন কি আর আছে? এখনকার পোলাপান কি আর প্রবীণদের মূল্য দেয়?
⸺মূল্য দেবে না মানে, শোনো বাঘের শাসন শেষ হয়েছে, এখন হাতির শাসনামল, যোগ্যকে যথাযথ সম্মান না দিলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তুমিই তো জঙ্গলে সবচেয়ে প্রবীণ, জীবনে অনেক কিছু দেখেছ, সব ইতিহাস তোমার নখদর্পণে। এইবার শাসক বাঘের অপশাসনের ইতিহাস বলো দেখি, আমি লিখে নিচ্ছি।
⸺আমার তো জলে বাস, ডাঙার খবর আমি জানব কী করে?
⸺মানে তুমি বলবে না? বুঝতে পেরেছি, তুমি বিগত শাসকের দোসর। এই কে কোথায় আছিস কচ্ছপকে বন্দি কর।
টেস্ট
শেয়াল বেজিকে ডেকে বলল, বিগত স্বৈরাচার শাসকের আমলে যারা শোষিত, নির্যাতিত, হতাহত হয়েছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করো।
শেয়ালের নির্দেশনা অনুযায়ী বেজি খরগোশের কাছে এল।
খরগোশ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বলল, বলুন কর্তা।
⸺তোমাকেই তো বাঘ খেতে চেয়েছিল, তাই না?
⸺না না, আমি তো কখনো বাঘের সামনেই পড়িনি।
⸺কেন, তারপর না তুমি অনেক বুদ্ধি করে বাঘকে কূয়োর জলে ফেলেছিলে?
⸺কর্তা, সে তো আমি না, আমার কয়েক পুরুষ আগের কেউ। সে বাঘও তো অনেক আগের।
⸺ওই একই কথা, বাঘ হলেই হলো, আর খরগোশ হলেই হলো। চলো এবার আমার সঙ্গে।
⸺কোথায়, কর্তা?
⸺শেয়ালমশাই তোমায় মহারাজের কাছে নিয়ে যাবেন। মহারাজ তোমায় ক্ষতিপূরণ দেবেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর বেজি দাঁত বসিয়ে খরগোশের এক কান কামড়ে নিল। খরগোশ ব্যথায় চিৎকার করে উঠল।
বেজি বলল, চিৎকার করবি না, খবরদার।
⸺আমাকে খেয়ে ফেলবে আর আমি বসে থাকব?
⸺আরে বোকা খাচ্ছি কোথায়? তুই সেই খরগোশ কিনা ডিএনএ টেস্ট করে দেখছি।
রিপোর্ট
খরগোশ এক কান বাঁচিয়ে কোনোরকম বেজির হাত থেকে পালাতে পেরেছে।
খরগোশ ভাবছে⸺অভ্যুত্থানের পর এরকম তো কথা ছিল না!
খরগোশ বিচারের দাবি নিয়ে ছুটল মহারাজের কাছে। কিন্তু দরবারে প্রবেশ করার মুখে শেয়ালের সঙ্গে দেখা।
শেয়াল জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছিস?
⸺মহারাজের কাছে বেজির বিরুদ্ধে বিচার নিয়ে এসেছি।
⸺মহারাজের অনুমতি নিয়েছিস?
⸺না তো।
⸺অনুমতি না নিলে মহারাজের সঙ্গে দেখা করা যায় নাকি? আয় আমার সঙ্গে আয়।
গোপন জায়গায় নিয়ে শেয়াল বলল, বেজি যে তোর ডিএনএ টেস্ট করতে চাইল, আর তুই রিপোর্ট না নিয়ে পালিয়ে এলি? জানিস মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে যেতে হয়?
⸺না মানে মা-নে⸺
খরগোশ কিছু বলার আগেই শেয়াল খরগোশের বাকি কানটি কামড়ে নিল।
খরগোশ কাঁদতে লাগল।
শেয়াল খেঁকিয়ে উঠল, এবার রিপোর্ট না নিয়ে পালাবি না বলছি।
বিনয়
গোখরা এল অজগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
অজগর : এস এস, অনেকদিন তোমায় দেখি না। তা কী মনে করে এই অধমের বাড়িতে?
গোখরা : আমি না হয় ছোট, তোমার বাড়ি এসেছি, তাই বলে এভাবে অপমান করবে?
অজগর : অপমান করছি না রে, ঠিক কথাই বলছি। তুমি সমস্ত জঙ্গল ঘুরে বেড়াও, মাঝে মাঝে লোকালয়ে যাও। সব প্রাণী তোমায় ভয় পায়। কত ক্ষমতা তোমার!
গোখরা : সবার মতো তুমিও এমন করে বলছ! আমি কী এমন করি যে আমায় ভয় পেতে হবে?
অজগর : কেন তুমি প্রাণীদের কাটো না? তোমার কী বিষ! একবার কাটলে আর বেঁচে ওঠার সাধ্য কার? তোমাকে ভয় পাবে না তো কাকে ভয় পাবে?
গোখরা : আমি কি শুধু শুধু কাউকে কাটি, নিজের জীবন বিপন্নর শঙ্কা হলে তখন কাটি। আর বেঁচে থাকার জন্য দু-একটা ব্যাঙ খাই। তবু সর্বত্র আমারই কেবল বদনাম। তুমি একদম সাধু!
অজগর : দেখো আমি তোমার মতো হিসহিস করি না, ফণা তুলি না। আমাকে মানুষেরাও যদি গলায় পেঁচিয়ে রাখে আমি উঁহ্ শব্দটি উচ্চারণ করি না। আমি বিনয়ী ও ভদ্র। আমার শান্ত কণ্ঠে উত্তেজনা নয়, যেন মধু ঝরে।
গোখরা: তুমি যে প্রাণী ধরে ধরে আস্ত গিলে খাও?
অজগর : বিনয়ী হলে সব অপরাধ ঢাকা পড়ে যায়।
গোখরা : বিনয় এক দারুণ মুখোশ!
স্মৃতিবিভ্রম
জঙ্গলে গোপন স্থানে হরিণের বৈঠক চলছে।
⸺বাঘের শাসনামলে আমাদের প্রাণ যেত। বিপ্লবের সময় আমাদের প্রাণ গেছে। শেয়াল তো ইন্ধন জুগিয়ে পেছনে থেকেছে, সামনে থেকে মারা পড়েছি আমরা, আর এখন দেখো শেয়ালই সবকিছু দখল করে আমাদেরই মাংস খাচ্ছে!
⸺এখন কী করা যায় তা-ই ভাবো সবাই।
সবাই এক সঙ্গে ভাবতে লাগল, এরই মধ্যে দুটি হরিণ দৌড়ে এসে জানাল, সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, মহারাজ হাতি আমাদের সব তৃণ খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে!
⸺আমরা এখন কী খাব! নতুন ভাবনায় জর্জরিত হলো সবাই।
⸺আরে হাতি তো আগেও আমাদের অঞ্চলে ঢুকে এভাবে আমাদের খাবার খেয়ে নিয়েছে।
⸺হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে।
⸺আর আমরা কিনা বিপ্লব করে তাকেই মহারাজ বানালাম!
⸺হায় রে! আমরা এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যাই!
ব্যক্তিস্বাধীনতা
তৃণভোজী প্রাণীদের একটি দল কদিন বিক্ষোভ করে অবশেষে স্মারকলিপি নিয়ে এল মহারাজ হাতির কাছে।
মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দাবি কী?
⸺মহারাজ, আগে তো ঘোষণা করা হয়েছিল, জঙ্গলে সবাই মতামত প্রকাশে স্বাধীনতা পাবে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে।
⸺একদম ঠিক।
⸺কিন্তু মহারাজ, অজগর রোজ রোজ আমাদের বাসস্থানে হামলা চালায়, আমাদের ধরে ধরে গিলে খায়। এর একটা বিহিত করুন মহারাজ।
⸺জঙ্গলে প্রত্যেকেই স্বাধীন, তা আমি কীভাবে অজগরের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি?
সার্কাস
বেজি উচ্ছ্বাস নিয়ে শেয়ালের কাছে এসে বলল, চলো নেতা মহারাজের কাছে যাই।
⸺কেন কী হয়েছে?
⸺আজ লোকালয় থেকে দুটি কুকুর এসেছিল।
⸺কী বলল ওরা?
⸺ওরা বলল, সার্কাসে নাকি বন্য প্রাণীরা খেলা দেখায়। আর জনতা আনন্দ পেয়ে হাততালি দেয়।
⸺কী হয়েছে তাতে?
⸺মানুষ আমাদের খেলা দেখে আনন্দ পেয়ে বাহবা দেয়, ভাবতেই তো ভালো লাগে?
⸺মহারাজের কাছে যাবি কেন, সেটা বল?
⸺মহারাজ আমাদের সেই সার্কাসে পাঠাতে পারে কিনা?
⸺আরে পাগল, তোদের দিয়েও তো আমি সার্কাস খেলাই। জঙ্গলটাই তো এখন একটা সার্কাস!