
একজন তথাকথিত জ্ঞানী, প্রায় একজন বুজুর্গ। আমি প্রায় বললাম কারণ, তিনি যদিও বুজুর্গ ছিলেন, আসলে সত্যিকারের বুজুর্গ হওয়া কঠিন। আমার কাছে সত্যিকারের বুজুর্গ হওয়ার অর্থ তিনি একজন আলোকিত মানুষ। আসলে তিনি ছিলেন ধার্মিক লোক। এর বাইরে তাঁর সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু লোকেরা তাঁর সম্পর্কে জানত, তিনি একজন জ্ঞানী লোক। তিনি কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন।
তার বাড়ির নিকটবর্তী গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দেখতে পেলেন— এক ব্যক্তি একটি সুন্দর অতিথি পাখি বহন করছে। তিনি পাখি শিকারিকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই পাখিটি কিনে নিলেন।
মনে মনে ভাবতে শুরু করলেন, ‘বাড়িতে ফিরে আমি পাখিটি খেতে যাচ্ছি, এই পাখি মাংসাশী ও সুন্দর।’
হঠাৎ করে পাখিটি বলল, ‘এ জাতীয় চিন্তা ভাবনা বাদ দিন।’
বুজুর্গ ভয় পেয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘কী, আমি কি কথা বলতে শুনেছি?’
পাখিটি বলল, ‘হ্যাঁ, এবং আমি কোনো সাধারণ পাখি নই। আমিও পাখির সংসারে প্রায় আপনার মতো জ্ঞানী। আমি আপনাকে কিছু দিতে পারি। আপনি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিন। আমাকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলে আপনাকে মূল্যবান তিনটি পরামর্শ প্রদান করব।’
বুজুর্গ নিজে নিজে বললেন, ‘এই পাখি কথা বলে। এটিকে অবশ্যই ভালো জানলে-ওয়ালাদের মধ্যে কেউ হতে হবে। আমরা এভাবেই সিদ্ধান্ত নিই— কেউ যদি কথা বলতে পারে তবে তাকে অবশ্যই জানতে হবে! কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু জানাটা খুব কঠিন। এগুলো একে অপরের সাথে মোটেই সম্পর্কিত নয়। আপনি না জেনে কথা বলতে পারবেন, আপনি জেনেও কথা বলতে পারবেন। এর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমাদের কাছে বক্তা সব সময় জ্ঞানী হয়ে থাকেন।’
বুজুর্গ বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমাকে পরামর্শগুলো দাও এবং আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব।’
পাখিটি বলল, ‘প্রথম পরামর্শ— কখনও কোনো অযৌক্তিকতায় বিশ্বাস করবেন না, এটি যেই বলুক না কেন। তিনি একজন মহান মানুষ হতে পারেন। প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, কর্তৃত্বসহ বিশ্বজুড়ে তিনি খ্যাতিমান— তবে তিনি যদি অবাস্তব কথা বলেন তবে তা বিশ্বাস করবেন না।’
বুজুর্গ বললেন, ‘ঠিক!’
পাখিটি বলল, ‘আমার পরামর্শের দ্বিতীয় অংশ হলো— আপনি যা কিছু করেন, কখনো অসম্ভব চেষ্টা করবেন না, কারণ তাতে আপনি ব্যর্থ হবেন। সুতরাং সর্বদা আপনার সীমাটি জানুন; যিনি তাঁর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানেন, তিনি যদি তার সীমা ছাড়িয়ে যায় তবে সে বোকা হয়ে যায়।’
বুজুর্গ মাথা নিচু করে বললেন, ‘ঠিক আছে!’
পাখিটি বলল, ‘এটি আমার তৃতীয় পরামর্শ— আপনি যদি ভালো কাজ করেন তবে কখনও অনুতপ্ত হবেন না। শুধু খারাপ কাজ করলে কেবল তা অনুভব করুন যে এটি খারাপ।’
পরামর্শগুলো দুর্দান্ত ও সুন্দর ছিল। তাই পাখিটিকে মুক্ত করা হলো।
খুবই খুশি মনে বুজুর্গ বাড়ির দিকে চলতে লাগলেন।
তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন, ‘পরামর্শগুলো খুতবার জন্য ভালো উপাদান হতে পারে। পরের সপ্তাহে মসজিদে যখন আমি থাকব কথা বলতে বলতে আমি এই তিনটি পরামর্শ সবাইকে শোনাব। আমি আমার দেয়ালে এগুলো লিখে রাখব। আমি এগুলো আমার বাড়ির ডেস্কে লিখব যাতে আমি তাদের মনে রাখতে পারি। এই তিনটি নিয়মই একজন মানুষকে বদলে দিতে পারে।’
তারপরে হঠাৎ তিনি দেখলেন পাখিটি একটি গাছের ডালে বসে আছে।
বসে বসে পাখিটি এত জোরে হাসতে লাগল যে, বুজুর্গ লোকটি বলতে বাধ্য হলেন, ‘কী ব্যাপার?’
পাখিটি বলল, ‘আপনি একটি বোকা, আমার পেটে খুব মূল্যবান হীরা রয়েছে। আপনি আমাকে মেরে ফেললে আপনি হয়ে উঠতেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।’
জ্ঞানী ব্যক্তি মনে মনে অনুশোচনা করলেন, ‘সত্যিই আমি একজন বোকা। হায়! আমি কী করেছি, আমি পাখিটিকে বিশ্বাস করে কতো বড় ভুল করলাম।’
তিনি তার কাঁধের বইগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে পাখিটিকে ধরার জন্য গাছ আরোহণ শুরু করলেন। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ। জীবনে কখনও গাছে ওঠেননি। তিনি যত উঁচুতে উঠছেন, পাখি ডাল বদল করে আরও উপরের দিকে উঠে গেল। এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে যেতে থাকল।
অবশেষে পাখিটি একেবারে শীর্ষে পৌঁছে একটি ডালে বসল।
বুজুর্গও পাখিটিকে ধরতে গাছের আগডালে উঠল। ঠিক যে মুহূর্তে তিনি পাখিটি ধরতে যাচ্ছিলেন, তা উড়ে গেল। তিনি তার পদক্ষেপটি মিস করে গাছ থেকে পড়ে গেলেন। তার গা থেকে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করে। পা দুটি ভেঙ্গে তিনি প্রায় মারা যাচ্ছিলেন।
পাখিটি আবার নিচের শাখায় এল এবং আহত বুজুর্গকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনি প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, পাখির পেটে একটি মূল্যবান হীরা থাকতে পারে। আপনি বোকা! এরকম অযৌক্তিক কথা শুনেছেন কখনো? তারপরে আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছিলেন— আপনি কখনো গাছে ওঠেননি। যখন কোনো পাখি মুক্ত, আপনি তাকে খালি হাতে কীভাবে ধরতে পারবেন? আপনি মনে মনে অনুতাপ করেছেন, ভালো কাজ করার পর আপনি সেটাকে ভুল করেছেন বলে অনুভব করে। আপনি একটি পাখি মুক্ত করেছিলেন। এটি একটি ভালো কাজ। এখন বাড়ি যান এবং আপনার পরামর্শগুলো লিখুন। পরের সপ্তাহে মসজিদে গিয়ে সেগুলো মানুষকে শোনাবেন।’
সরকার হুমায়ুন
সরকার হুমায়ুন ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার বিরাশী গ্রামে তার স্থায়ী নিবাস। পিতা শামাউন মল্লিক, মাতা ফিরোজা বেগম। সরকার হুমায়ুন পেশায় একজন প্রকৌশলী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত )।
কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞানছড়া, অনুবাদ, শিশুতোষ গল্প ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে পল্লীকথা (যমুনা প্রকাশনী ), এলিয়েন ও এলিনা (কালান্তর), এলিসার মঙ্গল অভিযান (শিশুকানন) কিরকিসিয়ার যুদ্ধ (সরলরেখা) রোবটশিশুর পিতামাতা (অনুপ্রাণন), রোবটদের গল্প (অনুপ্রাণন), সাইবার যুদ্ধের পাগলা ঘোড়া (অনুপ্রাণন), সায়েন্স ফিকশন জোকস (ছোটদের সময় প্রকাশনী), মৌমির মঙ্গলজগত (আনন প্রকাশন), রোবট যুদ্ধ (বুনন প্রকাশন) ইত্যাদি সায়েন্স ফিকশন উল্লেখযোগ্য।
তার সম্পাদনায় একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্ত্রী সাজ্জাত ই জান্নাত হালিমা, পুত্র শামাউন মল্লিক হিমেল ও সামিউন মল্লিক পরশকে নিয়ে সরকার হুমায়ুন ঢাকায় বসবাস করেন।