অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১৪, ২০২৫
৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১৪, ২০২৫
৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নাহার তৃণা -
উষ্ণ উদ্ধারের অনুভব

ডায়েরিটার নাম মায়া ডায়েরি। এর পাতায় পাতায় আমার যাবতীয় মায়া জমা থাকে। বাবার দেওয়া। স্কুলজীবন থেকে আমার টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস। প্রতি বছর বাবা অফিস থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ডায়েরি নিয়ে আসত। মায়ের বাজারের হিসাব, জরুরি ঠিকানা, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি টুকে রাখার জন্য একটা বরাদ্দ ছিল। বাবার আদুরে মেয়ে হওয়ার সুবাদে ভাগে আমিও একটা পেতাম। আমার সংগ্রহে এমন পাঁচ-ছটা ডায়েরি জমেছিল। কিন্তু কেন জানি প্রাণে ধরে তাতে লিখতে হাত উঠত না। যখের ধনের মতো আগলে আগলে রাখতাম। নিজের অথবা ভাই-বোনদের পুরোনো খাতায় লেখালেখি করলেও ডায়েরিগুলো বহুদিন অবধি ছিল অক্ষরশূন্য।

অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে ফুলের ছবিওয়ালা ডায়েরিতে আমার মেয়ে আরাত্রিকার কথা লিখতে শুরু করি। দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় একা শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। বিরক্তি উজিয়ে উষ্ণ উদ্ধারের অনুভব হয়ে আমার জীবনে আরাত্রিকার আগমন। এমনিতে প্রকাশ্যে ফুপি-ফুপা কিংবা রাশু ভাই যখন আসে তখন যা কথা হয়। ফুপা বেশির ভাগ সময় নানা গল্প-কথায় জমিয়ে রাখেন। রাশু ভাই ফুপার মতো হয়েছে। ফুপি কথা কম বলেন, শোনেন বেশি। বাকি সময় নার্সের আসা যাওয়া। পাশের বেডের রোগিদের দেখতে আসা দর্শনার্থীদের মাঝ থেকে ছিটকে আসা কথোপকথনে উদাসীনভাবে মুখ ডুবিয়ে আমার সময় কাটে। প্রথম প্রথম হাসপাতালে আমাকে অনেকেই দেখতে আসত। তাদের সান্তনায় ডোবানো কথাগুলো অসহ্য লাগতো। স্পষ্ট বুঝতে পারতাম বলতে হয় তাই বলা। লোক দেখানো আচারের বাতুলতা মাত্র।

আস্তে আস্তে আত্মীয়দের আসা-যাওয়া কমে গেল। এখন সেটা তলানিতে ঠেকেছে। খালা অবশ্য এসেছিল গত পরশু। প্রবাসী ছেলেমেয়ের কাছে বেড়াতে যাচ্ছে। মাস ছয়েক কিংবা তারও বেশি সময় আটকে থাকবে ইত্যাদি আলাপের মোদ্দা কথা হলো, আমার ব্যাপারে খালা সরে দাঁড়াল। এরপর থেকে আমার দেখাশোনার জন্য ফুপিই সম্বল। মধ্যবিত্ত ফুপির ঘাড়ে পড়তে যাচ্ছে পঙ্গু ভাইঝির দায়দায়িত্ব। গত পরশু খালা যখন এসেছিল রুমে তখন রাশু ভাইও ছিল। খালার শুকনো সান্ত্বনার এক পর্যায়ে আমার মাথায় হাত রেখে রাশু ভাই দুম করে বলে বসে— বুলি ভাবিস না; আমরা এখনও বেঁচে আছি। আলিশান বাড়ি কিংবা ঠাঁটবাটের জীবন হয়তো পাবি না; কিন্তু আদর যত্নের কমতি হবে না। এখন থেকে তোর দায়িত্ব আমাদের। খালা, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুন। বোনটার জন্য দোয়া করবেন।

মেঘকালো মুখে খালা বিদায় নিয়েছিল। যাওয়ার সময় ভদ্রতা করেও আমার গায়ে মাথায় একবারের জন্য হাতটা রাখেনি। বুঝতে কষ্ট হয় না, খালা আমায় ভীষণ অপছন্দ করে। কেন আমাকে এতটা অপছন্দ করে খালা? নিজেকে প্রশ্নটা করেছি। মন হাতড়ে তার যুতসই জবাব পাইনি। ইদানীং অনেক কিছুই মাথার ভেতর কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে। অনেক কিছুই মনে করতে পারি না। গভীরভাবে কিছু ভাবতে গেলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। বিস্মৃত হওয়ার ব্যর্থতা ঢাকতে নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিই। দক্ষ ডুবুরিও অনেক সময় জলের গভীরের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। একাগ্রতা সত্ত্বেও বিশেষ প্রশ্নের উত্তর তাই অধরা থেকে যায়। তবে চেষ্টা ছাড়ি না। উত্তরটা আমার জানা দরকার।

ভাবছেন মেয়ের কথা লিখছি, মেয়ে আর মেয়ের বাবা কোথায়? আমার বিয়ে হয়নি, স্বামী থাকার প্রশ্নও তাই নেই। কিন্তু আরাত্রিকা নামের মিষ্টি একটা মেয়ের মা আমি। একটু একটু করে স্বপ্ন আর মায়ার মোড়কে আমার ভেতরেই ওর জন্ম। ডায়েরির পাতায় সেই মেয়ে আরাত্রিকার কথা লিখি। যখন মন চায় লিখি। লেখার পাশে ওর নানা আদলের ছবিও আঁকি। আমার স্কেচের হাত বরাবরই খুব ভালো। যে কারও চেহারা নিখুঁতভাবে আমি এঁকে ফেলতে পারি। আঁকাআঁকি শিখিনি কোথাও। ওটা গড গিফ্টেড বলা যায়। ছবির গাবলু গুবলু আরাত্রিকা কোনোটায় দোলনায় দুলছে। কোনোটাতে ঝুটিবাঁধা মেয়েটা ছুটে ছুটে প্রজাপতি ধরতে চাইছে। মেয়েটা দেখতে অবিকল আমার মতো। যে কেউ দেখলেই বলে দিতে পারবে আমরা মা-মেয়ে। রংপেন্সিল পেলে বেশ হতো। আরাত্রিকার জামা, চুলের ফিতা, সব রঙিন করে দেওয়া যেত। রাশু ভাই কিংবা ফুপাকে বলতে হবে। আসলে আবদার করতে কুণ্ঠা হয়। না চাইতেই এত পাচ্ছি ফুপি-ফুপা, সবার কাছ থেকে।

আগের জীবনেও অনেক কিছু না চাইতেই পেয়ে যেতাম। একটা স্বচ্ছল পরিবার ছিল আমার। ব্যাংকার বাবা আর স্কুলশিক্ষক মায়ের প্রথম সন্তান হিসেবে আদর আহ্লাদ পেয়েছি প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ছোট দুই ভাই-বোনও ভালোবাসা দিয়েছে হাত উপুড় করে। সত্যি বলতে পরিবারের সবার অতি মনোযোগ আর ভালোবাসার বৃত্তে দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবী কতটা নির্দয় সেটা পরিমাপের ফুরসত হয়নি। দুর্ঘটনাটা না ঘটলে খালার মুখোশটা খসে গিয়ে তার নির্দয় চেহারাটাও হয়তো দেখা হতো না। দুর্ঘটনার সবটা মনে করতে গেলে সব কেমন ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ঘটনা মনে করতে পারি। মা আর ভাই-বোনেরা বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য অনেকদিন ধরে মুখিয়ে ছিল। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল সবাই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই পরিকল্পনা মতো আমরা পাঁচজনে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। মা খুব করে চেয়েছিল ঘোরাঘুরির ছুতোয় বাবা আর আমার ঠাণ্ডা সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। বাবার সাথে আমার সম্পর্ক কী কারণে বিগড়েছিল মনে পড়ে না। সুযোগটা যদিও আমাদের নাগালে আসেনি। যাওয়ার পথে ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অলৌকিকভাবে একমাত্র আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। প্রাণে বাঁচলেও বাকি জীবন পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়াতে হবে। তারচেয়ে মরে যাওয়াটাই বরং ভালো ছিল। মরবার কথা বলছি বটে, কিন্তু আমি প্রাণপণে বাঁচতে আগ্রহী। নইলে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজি কেন? সেই তাগিদটা আমার ভেতরে জন্ম দিয়েছে আরাত্রিকা। মেয়েটার সাথে একতরফা লেখার সূত্রে কথা বলে বেঁচে থাকার শক্তি জড়ো করি। ফুরিয়ে আসা প্রাণশক্তিকে দানাপানি যোগাতে ডায়েরির পাতা ভরিয়ে লিখে যাই। এই ডায়েরিই বুঝি এখন আমার প্রাণ ভোমরা। ‘যেখানে আমার আমি হয়ে ওঠার সকল অভিষেক দাঁড়িয়ে থাকে মহীরুহ হয়ে’।

কখনো কখনো রাতে ঘুম না এলে লিখতে বসি। সেরকম এক রাতে লিখে রাখি মেয়েটার কথা। ডায়েরিতে লিখতে গিয়ে কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না সেরাতে। কাঁদতে কাঁদতেই কীসব লিখেছিলাম। কিছুই আর মনে ছিল না। কী লিখেছি পড়ে নেওয়ার জন্য সকালে ডায়েরিটা খুলতেই কেমন ধাক্কা খেলাম। আমার লেখার নিচে অপরিচিত হাতের গুটিগুটি অক্ষরে কেউ কিছু লিখেছে! মন দিয়ে পড়ে বুঝলাম আমার লেখার প্রত্যুত্তর দিয়েছে কেউ।

ডায়েরির পাতায় সেদিন লিখেছিলাম— আরাত্রিকা, মা রে তোকে বুকে ধরে তোর গন্ধ নেওয়ার, তোকে স্পর্শ করার সুযোগ বুঝি এ জীবনে আমার হবে না। খুব ইচ্ছে করে তোর নরম হাতের ছোঁয়া চোখে মুখে মাখি…

নিচে কাঁচা হাতে তার উত্তর লেখা— মা, তুমি কিন্তু ভারি বোকা! আমি তো তোমার ভেতরেই থাকি। চাইলেই তো ছুঁতে পারো…

হৎপিণ্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসার জোগাড় হয়েছিল। এটা কীভাবে সম্ভব! ভেবে কূল পেলাম না। এটা কার লেখা হতে পারে? এই বাড়িতে এরকম লেখার মতো ছোটো বাচ্চা কেউ নেই। থাকার ভেতর ফুপি-ফুপা আর রাশু ভাই। শিমু আপা শ্বশুর বাড়িতে। তাহলে? কে লিখল এটা? তাছাড়া আমার ডায়েরি এতদিন তো কেউ ধরেনি, হুট করে কে ধরল! শুধু ধরেই ক্ষান্ত দেয়নি লেখাজোকাও করে গেছে। রাশু ভাই নয় তো? রাশু ভাই আমাকে হাসিখুশি দেখতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে এমন আজব আজব, কাণ্ড করে যে মুখ ভার রাখা দায়। রাশু ভাইয়ের কাজ একটাই। বাড়িতে যতক্ষণ আছে মজা করা! এটা রাশু ভাইয়েরই কাজ। তক্কে তক্কে থাকি তাকে হাতেনাতে ধরার।

আমাদের মা-মেয়ের যৌথ লেখালেখির একমাস পূর্ণ হলেও এখনো রাশু ভাইকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। হবেইবা কীভাবে, কোম্পানি থেকে রাশু ভাইকে ট্রেনিংয়ে দিল্লি পাঠানো হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই একমাসে আমিই এক তরফা লিখে গেছি; মেয়েটা কোনো সাড়াশব্দ করেনি। রাশু ভাইকে নিয়ে আমার সন্দেহটা যে কারণে পাকাপোক্ত হয়েছে। ডায়েরিতে কে উত্তর লিখছে সে বিষয়ে আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। তবে বিষয়টা খানিক অস্বস্তিরও, রাশু ভাই আমার এই গোপন নির্মাণের সবটা জেনে গেছে। তারচেয়েও আশ্চর্যের সেটা নিয়ে রাশু ভাই কোনো মজা করেনি। কার মন কতটা ইম্প্যাথিতে ভরা এরকম ছোটখাটো ব্যাপারগুলোর আয়নাতে তার প্রতিফলন ঘটে। এ বাড়ির সবার ইম্প্যাথিতে আমি ঘিরে থাকি। হাসপাতাল থেকে সরাসরি আমি নিজেদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। ফুপি এক শব্দে জানিয়ে দেন— অসম্ভব। ফুপা আর রাশু ভাইয়ের দিক থেকেও প্রবল আপত্তি ওঠে। শেষমেশ আমাদের বাড়িটা ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্হা হয়, আমি ফুপির বাড়িতে এসে উঠি।

ফুপির বাড়িতে আমার তিল পরিমাণ অযত্ন হয় না। দুর্ঘটনায় আমার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। এমন অনেক স্মৃতি আমার মগজের খোপ থেকে হারিয়ে গেছে। আবার কখনও কখনও খুব ছোটবেলার অনেক স্মৃতি হুটহাট এসে হানা দেয়। স্মৃতি আর বাস্তবতার দোলাচলে প্রায় বিভ্রান্ত হই। আমাকে সচল করতে হাসপাতাল থেকে নিয়মিত একজন থেরাপিস্ট আসেন। নানা রকমের হালকা এক্সারসাইজ করানো হয়। একপায়ে ভর দিয়ে হাঁটনো হয়। একটা কোরিয়ান সিনেমায় দেখা সাদা ফ্রকপরা মেয়েটার মতো আকাশে ক্র্যাচ উড়িয়ে দৌড়োতে ইচ্ছে করে আমার। অথচ আর কখনো দৌড়ানো হবে না। ভাবনাটা প্রায়শ ভেতরে একধরনের অস্হিরতা সৃষ্টি করে। আমার অস্থিরতা দেখে থেরাপিস্ট খুব আন্তরিকভাবে ভরসা দেন। অসম্ভব সব সম্ভাবনার গল্প শোনান। ধারে-কাছে থাকলে ফুপিও এসে সস্নেহে উৎসাহের পিঠ চাপড়ে দেন। আজও থেরাপিস্ট আর ফুপির সেরকম প্রচুর সান্ত্বনাবাক্য শুনেছি চুপচাপ। ওদের আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই জানি, কিন্তু আজকাল এই সান্ত্বনাগুলো আমাকে তাতিয়ে দেয়। চারপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দেবার আক্রোশে ভেতরটা কেমন নিশপিশ করে। ভেতরে ভাঙচুরের মাত্রা বেশি হলে সেদিন খাওয়াদাওয়ায় অরুচি ধরে। অনেক সাধ্য সাধনা করেও সেকারণে রাতে আমাকে খাওয়ানো যায়নি। আজ আমার মন চূড়ান্ত রকমের খারাপ। ঘোরের ভেতরও টের পাই আরাত্রিকা চুপচাপ পাশে এসে বসেছে। ওর তুলতুলে নরম হাত দুটো মুঠোয় পুরে কতক্ষণ গল্প করেছি, কখনইবা ঘুমিয়েছি মনে নেই।

সকালের নাস্তার পর্ব সেরে আনমনে ডায়েরির পাতা উলটাতে উলটাতে একজায়গাতে চোখ আটকে যায়। গুটিগুটি অক্ষরে কী লিখেছে আমার মেয়েটা! তারিখটা গতকালকের না? ফোনে তারিখ মিলিয়ে নিশ্চিত হই। হ্যাঁ, ওটা গতকালেরই তারিখ। খুব বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে গতকাল লিখেছিলাম— সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করতে ইচ্ছে করছে। খুব অসহ্য লাগছে… অসহ্য লাগছে। ঠিক তার নিচে লেখা, ‘তোমার অসহ্য লাগাকে খুব ভয় পাই, মা। একবার এরকম অসহ্য লাগায় তুমি ছয় ছয়টা বেড়ালছানা মেরে ফেলেছিলে। ওভাবে আমাকে মেরে ফেলো না, মা। আমি বাঁচতে চাই। প্লিজ মা!.. প্লিজ…’

অবশ হয়ে আসা শরীরের ঘেরাটোপ পেরিয়ে হ্যাঁচকা টানে স্মৃতি দুদ্দাড় নিয়ে যায় শৈশবে। চলমান চলচ্চিত্রের মতো কিছু দৃশ্যের কোলাজ ভেসে ওঠে।

মায়ের স্কুলে সেদিন বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান ছিল। ফিরতে দেরি হবে জানতাম। ছুটির দিন হওয়ায় ভাইবোনেরা দিনটাকে হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখি। বিকেলে ছোটো ভাইবোনদের নিয়ে বারান্দার দোলনায় দোল খেতে খেতে তলপেটে চাপ পড়ায় উঠে এসেছিলাম। টয়লেট থেকে বেরিয়ে বারান্দায় ফিরে যাওয়ার সময় খালার ঘরের আধখোলা দরজার ওপাশে চোখ পড়তেই অলক্ষ্যের কেউ বুঝি আমায় ‘স্ট্যাচু’ বলে ফ্রিজ হতে বাধ্য করেছিল। ওই ঘরের অকল্পনীয় কোনো দৃশ্য নজরে পড়েছিল, যা বিশ্বাস করা ছিল আমার পক্ষে কঠিন। কিন্তু কথায় বলে না সত্যি কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। মেঝেতে গেঁথে বসা পা দুটো সচল হওয়া মাত্র ছুট দিয়েছিলাম দুদ্দাড়। অসহ্য এক জ্বালা আমাকে বারান্দার পরিবর্তে ছুটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পেছনের উঠানে। দিন চারেক হলো বাড়ির পেছনে ভাঙাচোরা জিনিস ডাঁই করা ঘরটার এককোণে মিনি বেড়ালটা ছয়টা বাচ্চা দিয়েছে। নরম তুলতুলে বাচ্চাগুলো এত আদুরে। আধ ফোঁটা চোখ নিয়ে সারাক্ষণ মিঁউমিঁউ করে। মাকে ছানাগুলোর জন্য একটা বিছানার বায়না করেছিলাম। কুলসুম বুয়া ওদের জন্য ছেঁড়া বস্তার উপর পুরোনো কাঁথা দিয়ে বিছানার মতো করে দিয়ে গেছেন। নানা বাহানায় কখনো আমি একা, কখনো তিন ভাইবোনে কৌতূহল নিয়ে ওদের দেখতে আসি।

সেদিন অসহ্য অনুভূতির তোড় যখন ওই ঘরটাতে আমাকে নিয়ে দাঁড় করালো, মিনি বেড়ালটা তখন সম্ভবত ধারে-কাছে ছিল না। মিহিস্বরে বাচ্চাগুলো মিঁউমিঁউ করছিল। খ্যাপার মতো আমি গিয়ে ভাঙা চেয়ার, টেবিল আর সিমেন্টের বস্তা— হাতের কাছে ভারী যা কিছু পেয়েছিলাম তাই দিয়ে ওদের নরম শরীর চাপা দিয়ে পিষে ফেলেছিলাম পাগলের মতো। যেন ওদের মুছে দিতে পারলেই মাথার ভেতর গেঁথে বসা দৃশ্যটুকুও মুছে যাবে। বাবা আর খালাকে ওভাবে দেখে ফেলার অব্যক্ত যন্ত্রণা সেদিন আমাকে ভীষণ এক খুনি বানিয়ে ছেড়েছিল। এই সত্যি, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। এমনকি মায়ের পক্ষেও চিন্তা করা সম্ভব হয়নি চামচিকা দেখে আতঙ্কে সিটকে থাকা তার বড় মেয়ের হাত দিয়ে বীভৎস কাণ্ডটা ঘটেছিল। স্বামী আর সহোদরার বিশ্বাসঘাতকতার কতটা মা জানতে পেরেছিল, কিংবা আদৌ কিছু জেনেছিল কি না সেও জানা হয়নি।

সেদিনের পর থেকে দুজন মানুষকে আমার সহ্যই হতো না। নানা অজুহাতে ওদের এড়িয়ে চলতাম। বাবা ছিল আমার বন্ধুর মতো। বন্ধু হারিয়ে ফেলার কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে কত যে কেঁদেছি। মায়ের অগোচরে বাবা আমার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণের চেষ্টা করেছিল। সেই সময় বাবার চেহারা দেখে মায়া আর ঘৃণা দুটোই হতো। চরম রূঢ় আচরণ দিয়ে বাবাকে বুঝিয়ে দিতে কসুর করিনি আমার পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সন্তানের চোখে চোখ রেখে কথা বলার জোর বাবা হারিয়ে ফেলে।

শৈশব হারিয়ে হুট করে যেন আমি পরিণত হয়ে উঠি। মা-ভাই-বোনদের সাথে স্বাভাবিক থাকলেও ওই দুজনের ছায়াও আমার সহ্য হতো না। ওদের ছায়া থেকে দূরে যাওয়ার অজুহাতে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তির জেদ ধরে বসি। অনেক সাধ্য সাধনার পর মা রাজি হয়। একটা নষ্ট স্মৃতি মস্তিষ্কের কোষ থেকে ধুয়ে-মুছে ফেলার কৌশল হিসেবে আমি পড়াশোনায় মনপ্রাণ ঢেলে দিই। পড়াশোনার ছুতো দেখিয়ে কমিয়ে দেই বাড়িতে আসা। আমি চলে যাওয়ার পর খালাও আমাদের বাড়ির পাট চুকিয়ে হলে চলে যায়। অবশ্য খালার বিয়ে আমাদের বাড়ি থেকেই হয়েছিল। তার বিয়ে এড়িয়েছি পরীক্ষার অজুহাতে। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কেমন ধোঁয়াশার মতো হয়ে যায়। যেন আমার পৃথিবীতে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই না থাকার সবটা মা কিংবা ভাইবোন কেউই জানতে পারেনি। মা ধরে নিয়েছিল কিছু একটা নিয়ে বাবার ওপর আমার অভিমান জন্মেছে। বাবার মতো আমিও অভিনয়ে পাকা ছিলাম।

মাথার ভেতর পর পর পাজলের টুকরোগুলো জুড়ে বসে অনেক প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর জানিয়ে যায় নীরবে। যার অভিঘাত আমাকে কেমন এলোমেলো করে দেয়। সব ভুলে বহুদিন পর আমি বুক ভাসিয়ে কাঁদি। চুপি চুপি আরও একজন সে কান্নায় সঙ্গ দেয় আমাকে। কাঁদতে কাঁদতেই মেয়েটাকে কী লিখব মনে মনে সাজাতে থাকি… মা রে, তোকে মেরে ফেললে নিজেকেই যে মরে যেতে হয়। আমি বাঁচতে চাই মা। আমাদের মায়ার পৃথিবীতে আমার ভেতর তুই, আর তোর ভেতর আমি, তুমুলভাবে বেঁচে থাকব।

শিরোনাম কবি ফেরদৌস নাহারের একটি কবিতা থেকে নেওয়া।

 

Print Friendly, PDF & Email
নাহার তৃণা

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *