অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাইয়িদ রফিকুল হক -
আমার প্রিয় মিনতিদি

বাবার বদলির চাকরি। তাই, বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে হঠাৎ করেই গ্রামে আসতে হলো। গ্রামেরই বহু পুরাতন একটা হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম।

বন্ধুবান্ধব হিসেবে ভালো কাউকে পেলাম না। তবু মন খারাপ করে বসে না-থেকে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে লাগলাম। তখন, নতুন বছরের জানুয়ারি মাস সবে শুরু হয়েছে। স্যাররা আমাদের পুরোদমে ক্লাস করার জন্য বিশেষ তাগিদ দিতে লাগলেন। পড়ালেখা যেহেতু করতে হবে সেহেতু আমরাও নিয়মিত স্কুলে যেতে লাগলাম।

স্যারদের শাস্তির ভয়ে স্কুল-কামাই করার কথা ভুলে গেলাম। খুব কড়াকড়ি চলছিল তখন। আর ছিল বেত্রাঘাতের ভয়ানক ভয়!

আমাদের দেশে তখন ছিল সামরিক শাসন। স্কুলের স্যাররাও যেন সামরিক কায়দায় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। ছাত্রছাত্রীদের সামান্য একটু ভুলত্রুটি হলে অমনি তারা বেত্রাঘাত করতেন। আর এই কাজটি তারা খুব গর্বসহকারে করতেন।

স্যারদের এই বাড়াবাড়ি অনেক সময় আমাদের ভালো লাগত না। কিন্তু অনেক স্যারই বিষয়টাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন যেন! নইলে, তারা সবসময় বেত হাতে ক্লাসে আসবেনইবা কেন?

একদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম মিনতিদিকে। তিনি আমার স্বল্পপরিচিতা। আমার নানার বাড়ির পাশের গ্রামে হিন্দুপাড়ায় থাকতেন তিনি। সেখানকার সাহাপাড়ায় তাদের বাড়ি। তিনি আমার নানার বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতেন। সেই হিসেবে তার সঙ্গে আমার এক-আধটু পরিচয় ছিল। টুকটাক কথাবার্তা হতো।

আমাদের স্কুলে মিনতিদিকে দেখে যারপরনাই খুশি হলাম। ভাবলাম, এখন থেকে তার সঙ্গে আমার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হবে। তবে সেদিন আমাদের তেমন-একটা কথাবার্তা হলো না। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। আর একটু দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসলেন।

তিনি আমার চেয়ে মাত্র এক ক্লাস উপরে পড়তেন। অর্থাৎ, ক্লাস টেনে। আর আমি ক্লাস নাইনে।

অনেকদিন পড়ে তাকে দেখে আমার বড় ভালো লেগে গেল। এরপর আমি রোজই হাসিখুশিভাবে স্কুলে যেতে লাগলাম—শুধু মিনতিদিকে দেখার লোভে। এখানে, একটা কথা বলে রাখি, তিনি আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় ছিলেন। শুনেছি, তিনি নাকি দুই বছর গ্যাপ দিয়েছেন ক্লাস নাইনে। তারপর গত বছর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে এবছর ক্লাস টেনে উঠেছেন।

স্কুলে মিনতিদিকে দেখে আমার স্কুলে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কেমন যেন একটা ভালোলাগার ক্ষেত্র তৈরি হলো। এর কারণ অবশ্য আমি বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝতে পারলাম, তাকে আমার ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে? কী জন্য ভালো লাগে? তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না আমি। শুধু জানি—তাকে আমার ভালো লাগে। আর খুব ভালো লাগে।

এরপর প্রায়ই আমাদের এক-আধটু কথাবার্তা হতে লাগল।

মিনতিদি সবসময় হেসে কথা বলতেন। তার মুখটি ছিল জোছনাভরা চাঁদের মতো!

তিনি খুব ফর্সা আর কমনীয় ছিলেন। একেবারে ধবধবে ফর্সা। সফেদ শাদা। তবে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে নয় কখনো। তার গায়ের রঙটি বড় মনোলোভা ছিল। মুখটি ছিল চাঁদের চেয়ে সুন্দর!

মিনতিদিই একমাত্র মেয়ে—যিনি আমাদের স্কুলে ড্রেস পরে আসতেন। আমাদের স্কুলের মেয়েদের ড্রেস ছিল আকাশি রঙের কামিজ, সাদা সালোয়ার আর সাদা ওড়না। এই ড্রেসে ফর্সা-কমনীয় মিনতিদিকে কী যে সুন্দর লাগত! তিনি ছিলেন মহাসুন্দরী!

দিন-দিন মিনতিদিকে আমার আরও বেশি ভালো লাগতে শুরু করল। সুযোগ পেলেই তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। চোখাচোখি হলে তিনি শুধু হাসতেন। আর মাঝে মাঝে আস্তে জানতে চাইতেন, আমি ভালো আছি কিনা। শুধু এইটুকু। কিন্তু আমি যে এর চেয়ে বেশি কথা তার সঙ্গে বলতে চাইতাম। সেকথা হয়তো তিনি জানতেন না কিংবা বুঝতে পারতেন না। হয়তো জানারও চেষ্টা করেননি কখনো।

মিনতিদির প্রতি আমার আরও মায়া জন্মাতে লাগল। মাঝে মাঝে তিনি স্কুল-কামাই করতেন। আমি ভাবতাম, তিনি ইচ্ছে করে এমনটি করছেন। হয়তো তার পড়ালেখায় আগ্রহ নেই। কিন্তু আমার যে তাকে দিনে অন্তত একবার না-দেখলে কিছুতেই ভালো লাগত না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম তখন। কেমন একটা ভালোলাগার নেশা যেন পেয়ে বসেছিল আমার মনে। মিনতিদিকে ঘিরে সারাদিন আমি কত স্বপ্ন দেখতাম! সেসব হয়তো পৃথিবীর কোনো লোক কোনোদিনও জানতে পারবে না। জানতে চাইবেও না। কিন্তু আমি জানি, মিনতিদিকে ঘিরে সেই সময়টা আমার কত ভালোলাগার ছিল! আর কী ভালো লেগেছিল মিনতিদিকে!

মিনতিদি এত সুন্দর ছিলেন যে, স্কুলের বড় ছেলেরা—মানে, ক্লাস টেনের ছাত্ররা সবসময় তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মেয়েদের কমনরুমের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করত। কিন্তু তিনি যে বিশেষ কাউকে পাত্তা দিতেন—তা আমার কখনো মনে হয়নি। তবু আমার সিনিয়র দুই-একটা ছেলে-ছোকরাকে তার সঙ্গে একটু কথা বলতে দেখলে আমার ভীষণ রাগ হতো। ছোকরাগুলোকে আমি মনে মনে খুব ঘৃণা করতাম। আর ভাবতাম, ওরা কোনো অস্পর্শ্য-জীব। কিন্তু মিনতিদির ওপর আমার কখনো রাগ হতো না। তিনি ছিলেন আমার খুব পছন্দের মানুষ।

মিনতিদি হিন্দুর মেয়ে। তাকে সবাই ভালোবাসত না। মুসলমানের ছেলেরা হয়তো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু কখনো চান্স পায়নি।

আমি একজন মুসলমান হলেও আপনমনে ভেতরে-বাইরে কখনো মিনতিদিকে সামান্য পরিমাণে অপমানও করতে চাইনি। কখনো তার কোনো অমঙ্গল কামনা করিনি। আর তাকে কখনো হিন্দু ভাবিনি। আমি তাকে মানুষ ভেবেছি। একজন মমতাময়ী নারী ভেবেছি। তার কারণ, তার চোখে-মুখে আর তার মনের গভীরে আমি খুব মায়া দেখেছি।

তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম কিনা—তা আজ আর আমি বলতে পারব না। সেসব আমি বলতেও চাইনে। তবে জানি, তিনি আমার মনজুড়ে ছিলেন। আমার হৃদয়ের মধ্যখানে তাকে বসিয়ে রেখে দিয়েছিলাম।

কাকে কেমন করে পেতে হয়, কাকে কী করে কী বললে কাছে পাওয়া যায়, আর কাকে কেমন করে নিজের করে নিতে হয়—সেই সময় আমার সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। তখন আমি ছিলাম একটা সাধারণ মানবশিশু। হৃদয়ভাবের সঙ্গে কোনোকিছু উপলব্ধি করতে, বুঝতে শিখিনি। শুধু আপনমনে স্বপ্ন দেখেছি নিজের বাড়িতে বসে-বসে! তখন আমার বয়সটাইবা কী! কাকে কী বলব? কেমন করে বলব? তার কোনো দিকনির্দেশনা জানা ছিল না। তাই, আপনমনে গুমরে মরেছি, আর গন্ধবিধুর ধূপের মতো পুড়েছি, জ্বলেছি, তিলে-তিলে আরও বেশি মরেছি।

মাস কয়েক পরে মিনতিদি খুব স্কুল-কামাই করতে লাগলেন। আজকাল তাকে প্রায় স্কুলে দেখাই যায় না! তার খোঁজখবর নিতে একদিন আমার নানার বাড়িতে গেলাম। কিন্তু সেখান থেকে কোনো খবর জোগাড় করতে পারিনি। সেই সময় কাকে কিছু জিজ্ঞাসা করাটাও ছিল ভয়ানক একটা সন্দেহের ব্যাপার। কে কী ভেবে বসে!

ভগ্নমনে ফিরে এলাম নিজেদের গ্রামে। এরপর আরও কয়েক মাস মিনতিদিকে স্কুলে আর কখনো দেখিনি।

স্কুলের একজন জুনিয়র বন্ধু একদিন আমাকে জানাল—তারা নাকি সপরিবারে ভারতে চলে গেছেন! খবরটা শুনে নিজের বুকের ভেতরটা কেমন করে যে উঠল! মনে হচ্ছিল, বুকটা বুঝি এখনই দুমড়েমুচড়ে ভেঙে যাবে। হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে যাবে তার স্থান থেকে। কিংবা এখনই ফেটে যাবে বুকটা!

দুঃখ মনে নিয়ে ক্লাস করছিলাম। স্কুলে যেতে আর ভালো লাগছিল না। তবু যে যেতে হয়। সামনে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। আর তো স্কুল-ফাঁকি দেওয়া চলে না।

হঠাৎ একদিন মিনতিদিদের গ্রামে গিয়েছিল আমার বিশেষ বন্ধু প্রশান্ত কুমার পাল। সে একদিন ক্লাস শেষে আমাকে একটুখানি নিরিবিলিতে ডেকে নিয়ে খুব মন খারাপ করে জানাল—মিনতিদির বিয়ে হয়ে গেছে! মনে হচ্ছিল—এখনই বুঝি দড়াম করে আছড়ে পড়ব ভূতলে। আর সেখানেই লুটায়ে থাকব চিরতরে! ইহলীলা বুঝি এবার সাঙ্গ হবে! বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল বারবার মাটির সানকি ভাঙার মতো করে—একেবারে খানখান হয়ে। আর শুধু মিনতিদির মুখটা ভেসে উঠছিল মানসপটে। কত যে যত্নে রাখা আছে তার মুখটি স্মৃতিপটে!

আজ এতকাল পরেও বুকের পাথর বুকে চেপে আমি আবু কায়েস মোহাম্মদ লি কায়মনোবাক্যে বলছি—আমার প্রিয় মিনতিদি, তুমি যেখানেই থাকো—ভালো থেকো। সুখে থেকো। আজ-এখন আমি সব বুঝতে পারি। কোনো কথা গোপন না করে তাই বলছি—আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আর আজও ভালোবাসি সেই রকম। তুমি চিরদিন আমার প্রিয় মিনতিদি হয়েই থাকবে। আমার ভালোবাসার মন্দিরে চিরদিন বসে থাকবে আসন পেতে।

সাইয়িদ রফিকুল হক

সাইয়িদ রফিকুল হক একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক, সমাজ-সচেতন মানুষ ও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় সর্বাপেক্ষা প্রিয়। মূলত তিনি কবি, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক। বর্তমানে তাঁর লেখা মুক্তচিন্তা, প্রতিলিপি, সামহোয়্যারইন-ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে ও সাহিত্যপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রকাশিত গ্রন্থ : গোয়েন্দা লালভাই (২০২১, অনুপ্রাণন প্রকাশন), হিজলগাছের রহস্যময় লোকটা (২০২১, নোটবুক প্রকাশ), একটি বালিকার জন্য (২০২২, অনুপ্রাণন প্রকাশন)।

 

Print Friendly, PDF & Email
সাইয়িদ রফিকুল হক

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

One Comment

  • গল্পটি কারও ভালো লাগলে লিখে জানাবেন। কিংবা কেন ভালো লাগেনি তাও জানাবেন। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *