অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোর পণ্ডিত -
ইলিশ সমাচার এবং অতঃপর

মন্ত্রী মহোদয়ের ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছা হলে তার পিএ নদীর ঘাট থেকে ভরা মৌসুমে তাজা অধিক স্বাদযুক্ত এবং সাইজে বড় বেশকিছু ইলিশ কার্টুনে প্যাক করে ব্যক্তিগত পাজেরো জিপ গাড়িতে মাছের কার্টুন তুলে গাড়ি ঢাকা অভিমুখে ছাড়ল। মধ্যরাস্তায় এসে মন্ত্রীর গাড়ি এক্সিডেন্ট ঘটাল। রাস্তার কোনো এক মোড়ে পকেট রাস্তা হতে ব্যাটারি চালিত এক অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে অটোচালকের বড় ক্ষতি হলেও ইলিশ গাড়ির তেমন ক্ষতি হলো না। তবে ইলিশের বড় ক্ষতি হলো। তামসিক মানুষের ভিড়ে তাদের হাতে হাতে কিছু ইলিশ হারানো গেল।

অটোচালক কুরবান আলীর বোন রমিছা বেগম এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে বাড়ির মধ্যে হুলস্থুল বাধালে বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠল। চোখ কচলাতে কচলাতে কেউ একজন তাকে চেঁচামেচির কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে অধিক চেঁচিয়ে জোর গলায় বলতে লাগল বড় রাস্তার মোড়ে কোরবান এক্সিডেন্ট করেছে। এ কথা শুনে বাড়ির লোক কোরবান আলীকে উদ্ধারের জন্য বড় রাস্তার মোড়ে যেতে প্রস্তুত হলে পেছন থেকে কাঁধের কোদাল নামিয়ে কুরবান আলী বলল, কী হয়েছে, তোরা দৌড়াচ্ছিস কেন?

রমিছা বেগম কোরবান আলীকে দেখে গগনবিদারি চিৎকার করে বলল, ও আল্লাহরে, কুরবান তো বাড়িতেই, তাইলে গাড়ি নিয়ে গেল কেডা?

পরে সত্য সামনে এল। কুরবান আলী সচরাচর এই অটো চালায়। আজ কোরবান আলীর ছেলে আমির আলী সকালে অটো নিয়ে বের হয়েছে। পরে বাড়ির লোকজন মুমূর্ষু আমির আলীকে চিহ্নিত করল।

মন্ত্রীর কাছে খবর পৌঁছাল। মন্ত্রী বাহাদুর থানায় টেলিফোন করে জানিয়ে দিলেন অটো চালকের সঠিক চিকিৎসার জন্য এবং স্পষ্ট এও জানিয়ে দিলেন হারিয়ে যাওয়া ইলিশ উদ্ধারের জন্য। পুলিশ এসে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আহত আমির আলীকে জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাল। পরে হারিয়ে যাওয়া ইলিশের সন্ধানে ব্যস্ত হলো।

দুর্ঘটনাস্থল থেকে পাশের গ্রামের আজগর আলী একখানা ইলিশ নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি যাচ্ছিল। পথের মধ্যে কেউ একজন তাকে ইলিশের দাম কত জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, দুই হাজার টাকা। পাশেই দাঁড়ানো ১৪-১৫ বছরের ছেলে তাজ‌ তার বাপকে বলল, দেখছ আব্বা, হালায় মাছ চুরি কইরা আইনা কয় দুই হাজার টাকা দিয়া কিনা আনছে!

আজগর আলী কোনো কথা বলল না। আজগর আলী বাড়িতেও ইলিশের দাম দুই হাজার টাকা বলে চালিয়ে দিল। সেদিন তার বাড়িতে তার মেয়ের জামাই এসেছিল। সে ইলিশ দেখে এত আনন্দিত হলো যে মাছ কাটা থেকে শুরু করে রান্নাকরা পরে খাওয়া পর্যন্ত মাছের সাথেই রইল। শ্বশুরের সাথে একত্রে খেতে বসে ইলিশের পেটির প্রতি চোখ স্থির করে জিব্বা মুখের বাইরে না নিলেও ভেতরে ঘোরাতে লাগল। এমন সময় উঠোনে মানুষের সমাগম টের পাওয়া গেল সাথে পুলিশ। পুলিশ যে খবরের ভিত্তিতে এসেছিল তা সঠিক বলে বিবেচিত হলো। রান্নাঘর থেকে ইলিশের তরকারির গন্ধ আসছিল। তারা ইলিশের তরকারির পাত্র জব্দ করল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আজগর আলী আগেই কেটে পরে গিয়েছিল। তাই আজগর আলীকে উপস্থিত পাওয়া গেল না। পুলিশ তার জামাতাকে ধরে নিয়ে গেল। সাথে ইলিশের তরকারির পাত্র। আজগর আলী গ্রামের মাতাববর এবং ডাকসই নেতা আনু সাহেবের কাছে গিয়ে বিস্তারিত বললে আনু নেতা তাকে নিয়ে থানায় গেলেন। তিনি থানায় গিয়ে দেখলেন ওসি সাহেব তার কামরায়ই আছেন। ওসি সাহেব আনু সাহেবকে চিনতেন তাই তিনি তাকে বসতে বললেন। আনু সাহেব চেয়ার টেনে তার সামনে বসলেন। ওসি সাহেব তার সামনে বসা আরেকজনের সাথে কথা বলছিলেন। ওসি তার সামনের লোকটিকে বললেন, আপনি বলুন। কে আপনি? কেন এসেছেন?

লোকটি দেখতে মোটাসোটা, বয়স্ক। চশমার উপর দিয়ে চোখ বের করে নিচ দিয়ে মুখ এগিয়ে কথা বলছিলেন। উনি বললেন আমি কলাবাড়ি ‘বিএসএ’ পার্টির ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি।

এই কথা শুনে ওসি সাহেব ভ্রু কুঁচকে ওনার দিক থেকে নজর সরিয়ে আনু সাহেবের দিকে তাক করে বললেন— নেতা, আপনি বলুন, কেন এসেছেন?

আনু সাহেব বললেন, আগে ওনারটা শেষ করুন।

ওসি সাহেব আবার ওই লোকটিকে বললেন, আপনার আর অন্য কোনো পরিচয় আছে?

লোকটি এক হাইস্কুলের নাম ধরে বললেন, আমি ওই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক।

এবার ওসি সাহেব নরম গলায় বললেন — মাস্টার সাহেব, আপনার এরকম একটা পরিচয় থাকতে কীসের পদ-পদবির কথা বলছেন?

মাস্টার সাহেব মুচকি হাসলেন। ওসি সাহেব বললেন, কী অভিযোগ নিয়ে এসেছেন?

মাস্টার সাহেব বললেন, আমার পাড়ার দু’জন ছেলেকে থানা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে।

ওসি সাহেব কথা না বাড়িয়ে সেন্ট্রিকে বললেন, কোন এসআই ওই এলাকার, তাকে আসতে বল।

এসআই এলে ওসি সাহেব বললেন, তুমি কাদের ধরে নিয়ে এসেছ? কেন?

এসআই বলল, দু’জন লোককে ধরে নিয়ে এসেছি। ওরা জুয়া খেলছিল।

ওসি সাহেব বললেন, মাস্টার সাহেব এসেছেন। ওদের একটা ব্যবস্থা কর।

দায়িত্বপ্রাপ্ত এসআই ক্ষেপে গিয়ে বলল, শালারা খুব কষ্ট দিয়েছে, স্যার। আমরা প্রায় দুই কিলোমিটার পথ দৌড়ে ওদের ধরেছি। দশ হাজার টাকার নিচে ছাড়ব না। আপনার, আমার আর দুইজন কনস্টেবল নিয়ে গিয়েছিলাম ওদেরকে কিছু দিতে হবে।

মাস্টার সাহেব কিছু বলতে চাইলে ওসি সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, চালান দিলে অনেক টাকা লাগবে।

মাস্টার সাহেব আসামি পক্ষের লোকদের ডাকলেন এবং টাকার কথা বললেন। দুই আসামির একজন শ্বশুর এবং অন্যজনের স্ত্রী এগিয়ে এসে বলল, ছাগল বিক্রি করে এই টাকাগুলো এনেছি।

মাস্টার সাহেব শেষপর্যন্ত আট হাজার টাকা দিয়ে আসামিদের উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে গেলেন।

এবার ওসি সাহেব নজর দিলেন আনু সাহেবের দিকে। ডিউটি অফিসারদের ডাকা হলো। তিনজন ডিউটি অফিসার এসে বলল, পাঁচ পিস ইলিশ খোয়া গিয়েছিল, স্যার। চার পিস আস্ত পাওয়া গেছে আরেক পিসের তরকারি। যে ইলিশের তরকারি পাওয়া গেছে সেই ইলিশের কেসটা আনু সাহেবের।

এসআই তিনজন আরও বলল, ওদের দুই হাজার করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ ইলিশ পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।

এবার ওসি সাহেব বললেন, আস্ত ইলিশ পাওয়া গেলে তেমন ঝামেলা হতো না। বুঝুন তো মন্ত্রী সাহেবের ইলিশ। ওকে কি চালান করতেই‌ হয় নাকি?

আনু সাহেব বললেন, তা করা যাবে না। আমার পাশের বাড়ির লোক। ওসি সাহেব তার এসআইদের নিয়ে যুক্তি-বুদ্ধি করে বললেন, তবে দশ হাজার টাকা দিতে হবে। তবেই আসামিকে ছেড়ে দেওয়া যাবে। আনু সাহেব চমকে উঠে বললেন, এক ইলিশ দশ হাজার টাকা!

ওসি সাহেব মুচকি হাসলেন। বললেন, একবার ভেবে দেখুন, অন্যের ইলিশ ওকে নিতে হবে কেন?

আবার বললেন, চিন্তা করুন মন্ত্রী বাহাদুরের ইলিশ ও কেটে খায়, সাহস কত? ঠিক আছে আপনার সম্মানের খাতিরে ওকে চালান করব না। আপনি পাঁচ হাজার টাকা দিন।

অজগরের আলী তার লুঙ্গির ভাঁজ থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিল। তার জামাতা পাঁচ হাজার টাকায় মুক্তি পেল। এক ইলিশের দাম পড়ল পাঁচ হাজার টাকা। এবার ওসি সাহেব বললেন, ইলিশের তরকারি কোথায়? তরকারি তো আর পাঠানো যাবে না। এক এসআই তরকারির পাতিল ওসি সাহেবের টেবিলের উপর রাখলে তারা সবাই একখণ্ড করে টেস্ট করতে লাগল।

আজগর আলীর জামাতা বাইরের জানালা দিয়ে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাড়ি ফিরল।

আমির আলীর জেলা সদরে চিকিৎসা চলছিল। সাথে গিয়েছিল তার বউ জমিলা ও বড় বোন জামাই সাহেব আলী। আমির আলীকে নিয়ে ডাক্তারদের ব্যতিব্যস্ততা দেখে মনে হয় আমির আলী ভীষণ অসুস্থ। কিন্তু তাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তৃতীয় দিন পর তার অবস্থা বড়ই নাজুক দেখাল। সাহেব আলী ও জামিলা পালাক্রমে রাত জাগতে লাগল। একরাতে তার অবস্থা খুবই খারাপ হলো। আমির আলীর সাথে আসা লোকজন এবং পাঁচজন ডাক্তার সারারাত তার দেহের পাহারা দিল ঠিকই কিন্তু শ্বাসের পাহারার প্রয়োজন মধ্যরাতে শেষ হয়ে গেল। শেষ রাতে ডাক্তাররা স্যরি বলে চলে গেলেন। জমিলার গগনবিদারি চিৎকারে হাসপাতাল কেঁপে উঠল। অন্যান্য রোগী এবং রোগীর পাহারাদারেরা চোখ মেলে দেখল এবং কান খুলে শুনল। ডাক্তারদের গোয়াল নতুন রোগীতে ভরে গেল। যার যাওয়ার তারই গেল। ভোরে জায়গায় জায়গায় টেলিফোনে আমির আলীর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। তার আত্মীয়স্বজনরা তার লাশ বাড়ি নিয়ে এল। মন্ত্রী বাহাদুর নিজের দুর্নাম ঢাকতে প্রশাসনকে সুব্যবস্থা করার জন্য জানিয়ে দিলেন। পরে থানার পুলিশ স্থানীয় মাতাব্বর ও আমির আলীর পরিবারবর্গের উপস্থিতিতে পাঁচ লক্ষ টাকায় এই কেসের নিষ্পত্তি করা হলো। থানার মুন্সি গোপনে হিসাব কষে ওসি সাহেবকে বলল মন্ত্রী মহোদয়ের ইলিশের দামটা একটু বেশি পড়ে গেল স্যার, তাই না?

ওসি সাহেব তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। ওসি সাহেবের ধমকের ভাব বোঝা গেল না। এটা মিষ্টি, রসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক নাকি কষানো ধমক।

আমির আলীর মৃত্যু হলে জমিলা বেগমের ছয় মাস কাল স্বামীর অভাব থাকল। সপ্তম মাসে এসে তার স্বামীর অভাব থাকলেও সাথীর অভাব থাকল না। কখনো পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ঘুরে বেড়াত। কখনো আবার সস্তা লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে হেসে সাথীর সঙ্গ দিত। প্রধান সাথী সাহেব আলীকে বড় সন্তুষ্ট এবং খুশি দেখাচ্ছে। জমিলা এবং সাহেব আলীকে নদীর ধারে বনের ধারে ঝিলের ধারে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। মফস্বল শহর থেকে জেলা শহরে তারা ঘুরে বেড়াতে থাকল। আমির আলীর মৃত্যুর পর এ কথা গোপনে প্রচার হয়েছিল যে আমির আলী ব্যথায় কাতর হয়ে কাঁদলে হাসপাতালে কোনো এক রাতে জমিলা ঘুমিয়ে থাকলে আমির আলীর অত্যাচার তাকে ক্রুধিত করলে সে নাকি আমির আলীর বুকে সজোরে ঘুষি মেরেছিল। সেদিনের পর থেকেই তার অবস্থা সংকটাপন্ন হতে থাকে। তারপর তার মৃত্যু হয়। একথা সাহেব আলী তার শ্বশুরবাড়ির কোনো এক চাচাতো শ্যালকের কাছে গল্প করেছিল। তার চাচাতো শ্যালক এবং সে নিজে জমিলার প্রতি দুর্বল ছিল। জমিলার প্রতি অধিক মোহে সে এ কাজ করেছিল বলে, সে তার শ্যালককে বলে দু’জনেই হেসেছিল। এখন দু’জনে জমিলার ঘনিষ্ঠ সাথী হলেও প্রধান সাথী সাহেব আলীই হলো। একদিন সাহেব আলী কারও অনুমতি ছাড়াই জমিলাকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাড়ি গিয়েছিল। তিন দিন পর সকাল থেকে ঘুরে ফিরে শ্বশুরবাড়ি গেলে তার শাশুড়ি এবং শ্বশুর বড়ই ক্ষিপ্ত হলো। সাথে তার বউ ফরিদা। মা-বাবা ও কন্যার ক্রোধানলে সাহেব আলী খুব তিরস্কৃত হলো। তাদের তিরস্কারে সে বড় ব্যথিত এবং লজ্জিত হলো। পরদিন শ্বশুরের আদেশে শাশুড়ির অনুরোধ ও নিজ স্ত্রীর অভিমানে সাহেব আলী সস্ত্রীক শ্বশুরালয় ত্যাগ করল। আটচল্লিশ বছরের শ্বশুর কুরবান আলী চল্লিশ বছরের শাশুড়ি কোহিনুর বেগম তাদের বিশ বছরের বিধবা বউ জমিলার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হলো। শাশুড়ি কোহিনুর বেগম শাসন ও সোহাগ উভয়ের সাথেই জমিলাকে লালন পালন করতে লাগলেন। শ্বশুর শাসন না দেখিয়ে সোহাগ দেখাল বেশি। জমিলা শাশুড়ির আদরে তেমন সন্তুষ্টি না দেখালেও শ্বশুরের আদরে আদৃত হয়ে শ্বশুরের প্রতি বড়ই সন্তুষ্টি দেখাল।

সাহেব আলী চলে যাওয়ার দিন পনেরো পরে জমিলাকে একটু অস্বাভাবিক দেখালেও পরবর্তী দিনগুলোতে সে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। বাহ্যিকভাবে তেমন না সাজলেও ভেতরে ভেতরে তাকে খুশি দেখাল। গায়ে প্রসাধনীর গন্ধ না থাকলেও যৌবনের গন্ধ এবং দম্ভ দুটোই তার শরীরে রাজত্ব করছে বোঝা যায়। তার মনের গভীরতা বোঝা না গেলেও দেহের যৌবনের গভীরতা বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট। তাছাড়া মাংসভোগী প্রাণী মাংসের আস্বাদন নিতে সদা উদগ্রীব থাকে। মাঝে বিরতি বা বিলম্ব ঘটলেও তার চাহিদা আরও বহু গুণে বেড়ে যায়। কোহিনুর বেগম জমিলাকে নিয়ে বড় চিন্তিত হলেন। বিশেষ করে তার ভবিষ্যৎ।

দুই মাস পর জমিলার মনের ভাবের পরিবর্তন বোঝা না গেলেও দেহের ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল। একদিন কোহিনুর বেগমের সামনেই জমিলা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। চারদিক থেকে বাড়ির মানুষ এসে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মাথায় জল ঢালা হলো। মাথা শরীর টিপে স্বাভাবিক করা হলো। জমিলার জ্ঞান ফিরল। মাঝে মধ্যেই জমিলার দেহে এই বিকার হতে থাকল। তার দেহের উপশমের জন্য উপজেলা হাসপাতালে তার চিকিৎসা করা হলো। চিকিৎসা শেষে তার শরীরে কোনো রোগ পাওয়া গেল না, তবে একটা অসুখের খবর পাওয়া গেল। কোহিনুর বেগম এক গোপন অসুখের খবর নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মনে মনে বড় চিন্তিত হলেন। তার সুখের মাঝে কে জমিলার এই অসুখের কারণ।

একদিন রমিছা বেগম এবং কোহিনুর বেগমের সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হলো। রমিছা বেগম তার সন্দেহে যে পুরুষের কথা বলল সে কথা শুনে কোহিনুর বেগম একেবারে চমকে উঠলেন। সে চিৎকার করে বলল, ছি ছি একী বলছ বুবু? এও কি সম্ভব? রমিছা চুপ করে থাকে। কোহিনুর বেগমের সন্দেহ সাহেব আলীর মধ্যে স্থির রইল। কিছুদিন পর অনেক ভাবনার মধ্যে কোহিনুর বেগম এক ভাবনায় স্থির হলেন। তার এবং তার পরিবারের মান রক্ষার জন্য এই ভাবনার আর বিকল্প নাই। তাই তিনি তার মেয়ে ও জামাতা সাহেব আলীকে তার বাড়ি আসতে খবর পাঠালেন। খবর পেয়ে মেয়ে ফরিদা অখুশি হলো। সে বাপের বাড়ি যেতে চাইল না। কিন্তু সাহেব আলী মনে মনে খুব খুশি হলো। তার গভীর আগ্রহের কথা চেপে রইল। মায়ের বারবার খবরে একদিন ফরিদাই ইচ্ছা করে তার স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গেল। সারাদিন কেটে গেলে কোহিনুর বেগম তার মেয়ে ফরিদাকে নিয়ে রাতে এক গোপন বৈঠকে বসলেন। সে বৈঠকের এজেন্ডায় যে আলোচনা উঠল সেই আলোচনা শুনে ফরিদা যেন আকাশ থেকে পড়ল। একপর্যায়ে ফরিদা বলল দোষ যদি করে থাকে সাহেব আলী করেছে সে দোষের ভাগীদার আমি কেন হব? আমি কেন সতীনের ঘর করব। কোহিনুর বেগম বললেন একটা কথা চিন্তা কর ফরিদা আমি কত কষ্ট নিয়ে এ কথাগুলো বলছি। কোনো মা ইচ্ছা করে কি আর তার মেয়েকে সতীনের ঘরে ঠেলে দেয়? আমি অনেক ভেবে এই ভাবনায় স্থির হয়েছি। আমাদের লজ্জা সামাজিক মান-মর্যাদা আর এই পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে এই সিদ্ধান্ত ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় তো ভেবে পাচ্ছি না। এই পরিবারের মানতো তোমারও মান। তাছাড়া আমাদের সমাজে কত মেয়েই তো তাদের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সতীনের ঘর করছে। এই পরিবারের কথা ভেবে তোমাকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক অবশ্যই কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আচ্ছা মা, তুমি একজন মেয়ে মানুষ হয়ে অন্য একটা মেয়ের মন কেন বোঝ না? মেয়েরা সংসারে সকল ভাগ ছেড়ে দিলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে কি? দেহের ভাগ ছেড়ে দিলেও মনের ভাগ ছাড়া যায় না, মা।

কোহিনুর বেগম বললেন, আচ্ছা। সব বুঝলাম। তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার স্বামী যে দোষে দুষ্ট সে দোষ কাটানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত ছাড়া আর অন্য উপায় তো আমার কাছে নেই, মা। জমিলার দায়িত্ব এবং ওর গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব তোমার স্বামীকেই নিতে হবে। কারণ তোমার গর্বের স্বামী জমিলার গর্ভের জন্য দায়ী। এ কথা শুনে ফরিদা বলল, তাহলে এমন একটা দুশ্চরিত্রের পুরুষের ঘর আমি কেন করব?

কোহিনুর বেগম চুপ করে রইলেন। ফরিদা চুপ রইল না। সে অনেক ক্ষোভ, অনেক রাগ নিয়ে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে স্বামীর ঘরে গেল। সে দেখল সাহেব আলী চুপ করে বসে রয়েছে। ফরিদা বুঝল সে কিছু আঁচ করতে পেরেছে। ধর্মের আঙ্গিকে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যে ভালোবাসা যে অনুরাগ যে বন্ধন যে দায়িত্ব কর্তব্য ফরিদা সে সকল ভুলে গেল। সে সকল সীমা অতিক্রম করে তার স্বামী সাহেব আলীকে সর্বোচ্চ অপমান করল। সাহেব আলী তার স্ত্রীর সকল অপমান নীরবে সহ্য করল। শেষে সাহেব আলী বলল, ঠিক আছে। তোমার সকল অপমান আমি সহ্য করে নিচ্ছি। কিন্তু যে দোষে আমাকে দোষী বানাচ্ছ সেই দোষী তো আমি নই। জমিলার গর্ভের সন্তানের দায় তো আমার নয়। আমি মানছি জমিলাকে আমি অনেক সময় দিয়েছি। সেও আমাকে অনেক সময় দিয়েছে। আমি তার সাথে ঢলাঢলি করেছি। কিন্তু সেটা তো কেবল বাহ্যিক আদর। আমি তো কখনো তাকে গোপন আদর করিনি। যে আদরে সে আমার দ্বারা গর্ভধারিণী হবে। ঢলাঢলি করা সহজ হলেও মাখামাখি করা খুবই কঠিন কাজ। মন চাইলেই সুযোগ হয় না, আর সুযোগ হলেও মন চায় না। মনের ব্যাপারটা পুরুষের চেয়ে মেয়েদেরই বেশি।

ফরিদা তার কোনো কথাই বিশ্বাস করল না। তার চোখের জলে মনে দানা বাঁধল অবিশ্বাসের বাসা। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সাহেব আলী ফরিদার ধপধপ পায়ের শব্দে রাগ অভিমান ও অবিশ্বাসের ভাষা বুঝল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে তার শাশুড়ি কোহিনুর বেগম ঘরে ঢুকলেন। কোহিনুর বেগম পাশের ঘর থেকে তাদের সকল আলোচনা শুনেই এসেছেন। কোহিনুর বেগম বললেন, এক মাসে যা দেখেছি, যা বুঝেছি তাতে বলতে পারি তুমি জমিলাকে পছন্দ কর। তাই নয় কি?

সাহেব আলী নিরুত্তর রইল। তাহলে আমি যদি আমার মেয়ের বিপক্ষে গিয়েও তোমাকে বিয়ে করার অনুমতি দিই তাহলে তোমার আপত্তি থাকবে না নিশ্চয়ই!

সাহেব আলী বলল, সেরকম অসভ্য চিন্তা আমার আছে। কিন্তু জমিলার গর্ভের দায় যে আমায় নিতে বলছেন সে দায় তো আমার নয়। বিশ্বাস করুন মা, সে হয়তো অন্য কোন নতুন সাথী খুঁজে নিয়েছে।

কোহিনুর বেগম তার কথায় কান না দিয়ে বললেন, আমার সন্তানের জানের দামে যে পাঁচ লক্ষ টাকা আছে তা তোমাকে দিয়ে দেব। জমিলার গর্ভের দায় অস্বীকার কোরো না। সকল দায় স্বীকার করে আজ রাতেই তোমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।

সাহেব আলী তার মনের গভীর থেকে ভাবল তার মন ফরিদার মনে থাকলেও তার দুষ্টু চোখ জমিলার নিটোল দেহে বাসা বেঁধেছে। তাই জমিলার দেহ সাথে নগদ পাঁচ লক্ষ টাকার লোভ সাহেব আলীকে দুর্বল করে দিল। সে তার শাশুড়ির পক্ষ নিল। রাতেই জমিলা আর সাহেব আলীর বিয়ে হয়ে গেল। পর দিন ফরিদা চোখের জল মুছে সতীন নিয়ে বাড়ি ফিরল।

বহু মানুষের ভিড়ে যে ঘরে প্রতিদিন প্রতি রাতে থাকত কোলাহল সে ঘর থেকে মানুষও কমল কোলাহলও গেল। ঘরে রইল দু’জন মহিলা রমিছা আর কোহিনুর বেগম। কোহিনুর বেগম রমিছাকে উদ্দেশ্য করে বললেন— বুবু, তোমার সন্দেহই ঠিক, আমার সন্দেহ ভুল। শত বছর ঘর-সংসার করলেও মানুষের ভাব বোঝা যায় না। মানুষের মনের ভেতর একটা পশু ঘুমিয়ে থাকে। সেটা পুরুষ বা নারী উভয়ের মাঝেই থাকে। মাঝে মাঝে সেই পশুটা মনুষ্যত্বকে হারিয়ে দেয়। কিছু সময়ের জন্য মানুষ পশু হয়ে যায়।

পনেরো দিন পরে কোহিনুর বেগমের কাছে একটা কল এল। মোবাইল ফোনের বিপরীত দিক থেকে কলার বলল, কোহিনুর মান বাঁচাতে জান দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু জানের বড় মায়া। সেটা দিতে পারলাম না বলে বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হলাম। এ জনমে তোমার সাথে আর দেখা হবে না।

কোহিনুর বেগম নিশ্চুপ রইলেন।

কিশোর কুমার পণ্ডিত

কিশোর পণ্ডিত টাঙ্গাইল জেলার, মধুপুর উপজেলার, বেকার কোনা (গাঙ্গাইর) গ্রামে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর এক বিখ্যাত পণ্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রাধা রমন পণ্ডিত, মাতা কিরণবালা পণ্ডিত। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক।

তিনি ছড়া, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি সাহিত্য রচনা করেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘অবন্তিকা’ ও ‘নিন্দিত নরলোকে’ ও গল্পগ্রন্থ ‘অমরাবতী’। তিনি আবুল খায়ের গ্রুপ আয়োজিত MARKS Gold GenX Memories’-2021 সেরা গল্পকার পুরস্কার, JAR LIMITED আয়োজিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতা-২০২১ পুরস্কার, কবি আব্দুল হাকিম সাহিত্য পুরস্কার-২০২১-সহ আরও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

kishorpandit964@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নিঃশব্দ আহমেদ – গুচ্ছকবিতা

Read Next

অণুগল্পগুচ্ছ

One Comment

  • সম্পাদক সাহেবকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার ছোট গল্পটি প্রকাশ করার জন্য। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *