অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাফিজুর রহমান -
ঈদ এল না

‌গত বছরেই বিয়ে হয়েছে তানজিলার। এখন তার বয়স ১৩ বছর। তার বাবা-মা ও শ্বশুরবাড়ির নিকট তার বিয়ে হলেও প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় এটি একটি বাল্যবিবাহ। সংসারের নানা টানাপোড়েনের মধ্যে গ্রামীণ পরিবারের মেয়েগুলো বোঝা হয়ে থাকে একপ্রকার, তানজিলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তার বয়স ১০ বছর হতেই তার বাবা-মা চিন্তা করতে থাকে মেয়েকে কীভাবে বিয়ে দেবে। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিতে পারলে যেন বোঝাটা একটু কমে যায় তানজিলার বাবা মহাসেন মিয়ার। কেননা তার কাঁধে অনেক বোঝা, তানজিলা বাদেও তার আরো দুইটা কন্যা সন্তান আছে সংসারে। প্রায় অচল সংসারে আবার মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবনাচিন্তায় অনেকটা হাল ছাড়া অবস্থা মহাসেন মিয়ার। সারাদিন কাজ না করলে যে বাড়িতে চুলা জ্বালাতে সাহস হয় না সে বাড়িতে বিয়ের আয়োজন অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা। তবুও তো মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে এই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত মহাসেন ও তার স্ত্রী নাজেরা, যেন খুঁজে না পাওয়া নৌকার মতো।

জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রের মধ্যে ভ্যাপসা গরমে মাঠে ধান কাটতে কাটতে মহাসেনের মেয়ের বিয়ের কথা পাড়ে তার সাথে একই খেতে কাজ করা রহেদ আলী। রহেদ বলে, ছেলে আল্লাহর রহমতে কর্মীক বটে রে মহাসেন, তোর বিটি ভালোই থাইকপে।

মহাসেন বলে, কুনঠে বাড়ি ছ্যাল্যার?

রহেদ : ওই তো ওই গায়ের তফিরের ব্যাটা, গতবার যে (তফির) এক্সিডেন্ কইরি মরি গেল না?

মহাসেন : ও বুঝ্যাছি, ওই ছ্যাল্যা তো মুনে হয় কাটমিস্ত্রির কাজ করে তাই না?

রহেদ : হয়। ছ্যাল্যা কিন্তু কাজের রে মহাসেন। সব রুকুম কাজ জানে।

মহাসেন : তা তো বুঝনু, দেহি কী করা যায়।

রহেদ : হ্যাঁ বাড়িত বুলেক।

মহাসেন : ঠিক আছে।

মাঠে কাজ শেষ করে বাড়িতে এসে মহাসেন রাতে কথাটা তানজিলার মায়ের সাথে আলোচনা করে।

গ্রামীণ পরিসরের মেয়েরা যেন কোনো জড় বস্তু। যাকে অন্যের ইচ্ছায় নড়াচড়া করা লাগে। তার কোনো নিজস্ব মত কিংবা অনুভূতি থাকে না। তেমনি ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া তানজিলাকে একই ভেবে তার বাবা-মা দায় সারতে (কন্যার বিয়ে) প্রস্তুত। সারারাত চোখের ঘুম হারাম করে তারা কন্যার বিয়ের কথাবার্তা চালিয়ে যায়। ফজরের আজান গড়ানোর পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, বিয়ে তারা ওখানেই দেবে।

রাকিবের (তফিরের ছেলে) মা হ্যাঁ সূচক খবর পেয়ে মহাসেনের বাড়িতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে আসে। মহাসেন ও তার স্ত্রী এবং রাকিবের মা তার সাথে রাকিবের খালু মানিক মুন্সি মিলে যেন কেনাবেচায় বসে, ঘণ্টা তিনেক হাজার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে দেনা-পাওনা ঠিক হলো ২৫ হাজার টাকা ও একটি হাতঘড়ি।

বিশ্ববাজারে যেন দরদাম হয়ে বিক্রি হয়ে গেল আরেকটি অস্ফুট ফুল।

তানজিলা এখন একজন বধূতে পরিণত হয়েছে।  যে মেয়েটা এই গত বর্ষায় গাছের ডালে উঠে কদম ফুল নামাত এখন সে সেই কদম গাছের শুকনো ডাল দিয়ে চুলায় ধোঁয়া করে।

যেই মেয়েটি এই আঁকাবাঁকা অজগর পথটি দিয়ে স্কুলে যেত বই হাতে, সে এখন সেই পথটি দিয়ে কাপড়ের পুটলি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যায়-আসে। যেই তানজিলা নেচে নেচে পুরো গ্রামটি চষে বেড়াত সেই তানজিলাই এখন আধ হাত ঘোমটা টেনে বাসন মাজে জয়েন বাবুর পুকুরে। আকাশের মুক্ত বিহঙ্গটিকে এনে যেন পুরে ফেলা হয়েছে লোহার বাসরে।

আগামী সোমবার ঈদ। গ্রাম্য সনাতন পদ্ধতি  এই যে, কন্যার শ্বশুরবাড়িতে উপহার (বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য সামগ্রী গ্রামে কন্যার শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হয় কন্যার বাবাকে) পাঠাতে হয়। মহাসেনের হাতে সময় আর মাত্র ৩ দিন, এবার বন্যায় ধান সব ডুবে যাওয়ায় কাজের খুব দুর্গতি। কাজ পাওয়া মুশকিল হয়েছে। তার নিজের সংসার কোনোমতে চলে। ঈদে বাড়ির মানুষের জন্য নতুন জামাকাপড় তো দূরে থাকুক, বাড়িতে সামান্য সেমাই-চিনিটাও কিনতে পারেনি মহাসেন। এরমধ্যে আবার তানজিলার বিয়ের পর এইটা প্রথম ঈদ, তাকে কিছু না দিলেও নতুন জামাই রাকিবকে অন্তত একটা লুঙ্গি ও শার্ট সমেত ব্যবহার দিতে হবে। এই চিরাচরিত নিয়মটি যেন অনড়। সূর্য উঠতে ভুল করলেও যেন এই নিয়মের একটা অক্ষর নাড়ানো যায় না। মহাসেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে নিয়মটা পালনে।

গ্রামের বাজারের একটা কাপড়ের দোকানদারকে হাতে-পায়ে ধরে বাকি করে একটি লুঙ্গি ও শার্ট নিয়ে আসে মহাসেন। এখন বাকি রইল উপহারসামগ্রীর জোগাড় করা। তানজিলার মা উপায়ান্তর না দেখে বাড়িতে পালিত দুটি হাঁস (যা তারা রেখেছিল ইদের দিন জবাই করে খাওয়ার জন্য) অতি সস্তায় বিকিয়ে দেয়। টাকাগুলো নিয়ে মহাসেন বাজারে যাই বাজার থেকে আধা কেজি সেমাই, এক কেজি চিনি, ৫ টাকার তেজপাতা, দুটো নারকেল ও এক কেজি চিড়া কিনে বাড়ি আসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে।

মাগরিবের আজান শেষে একটু আঁধার ঘনিয়ে এলে মহাসেন ও তার স্ত্রী মিলে ব্যবহার নিয়ে তানজিলার বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা ধরে।

তানজিলার বাড়ি যাওয়ার পথে একটি পাকা সড়ক পার হতে হয়। তানজিলার মায়ের হাতে নারকেল দুটি ঝুলছে, মহাসেনের হাতে অন্য উপকরণগুলোর ভর্তি একটা ব্যাগ। রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎই কোথা থেকে একটা মালবাহী ট্রাক চলে আসে, মহাসেন জীবন বাঁচাতে দৌড় দেয়। অবিশ্বাস্যভাবে প্রাণটা বেঁচে যায় তাদের দুজনের। মহাসেন বলে, কাইল ঈদ বুল্যায় আল্লাহ হয়তোবা বাঁচায় দিল গো তানজিলার মা।

তানজিলার মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ঠিক বুইলিছ তানজুর বাপ।

মহাসেন যেই আবার কন্যা বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় অমনি আবিষ্কার করে তার হাতে সেই ব্যাগটি আর নেই। হন্তদন্ত হয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল রাস্তায় চোখ পড়ামাত্রই মহাসেন দেখে ব্যাগটা রাস্তায় পড়ে আছে।

কাছে গিয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে মহাসেন লক্ষ করে ব্যাগের মধ্যে কিছু আর নেই। গোটা রাস্তায় জিনিস সেমাই ছড়িয়ে পড়েছে। মহাসেনের চোখে যেন সেটিকে সাহারা মরুভূমি লাগতে থাকে।

মহাসেন রাস্তায় বসে পড়ে, তার অগোচরেই তার চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে।

তানজিলার মা রাস্তা থেকে ওগুলো তোলার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে। চারিদিকে তখন এশার আজানের আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও রাসুলের সাক্ষ্য এবং নামাজের আহ্বান চলতে থাকে। একপর্যায়ে শেষ হয়ে যায়। রাত গভীর হতে থাকে, মহাসেন মিয়া রাস্তার পাশেই কদম গাছটার নিচে বসে তাকিয়ে থাকে তানজিলার বাড়ির পথের দিকে। কাল ঈদ!

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *