
হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়ে আর অভাবিত লুটপাট করে জয়নগরের লোকমান, তাইজুল, বদরুদ্দিন, সোলেমান খুব খুশি হয়ে অন্ধকারে হাঁটছিল। বহুদিনের মনের আশা আজ ওদের পূর্ণ হয়েছে। হাঁটতে-হাঁটতে ওরা খন্দকারবাড়ির বড়পুকুরপাড়ে এসে থামল। এদিকটায় লোকজন খুব একটা আসে না। এই বাড়িতে কয়েক বছর হলো কেউই থাকে না। আর এই পুকুরটা দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দিনের বেলায়ই কেউ এখানে সহজে আসে না। আর এই নির্জন রাতে এখানে কারও আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই, ওরা চারটে এখানে এসে দাঁড়াল।
ওরা সাহাপাড়ায়-হিন্দুপাড়ায় আগুন দিতে পেরে আপনমনে খুব গর্ব প্রকাশ করছিল। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা সুখের আমেজ ওদের এখন! কথিত বিধর্মীদের ওরা আজকে আচ্ছামতো শায়েস্তা করতে পেরেছে! ওদের চোখে-মুখে সেই আনন্দে দারুণ একটা ফুর্তির ভাব। আজ বহুদিন পরে ওরা যেন একটা সওয়াবের কাজ করতে পেরেছে! এমনই একটা ধারণা ও মনের অভিব্যক্তি আজ ওদের। ওরা লুটপাটও করেছে সমানতালে। বাধা দেওয়ার মতো কেউ সামনে ছিল না। দামি-দামি জিনিসপত্র দুহাতে লুট করেছে। এতে কাউকে ভাগও দিতে হবে না ওদের। মসজিদের মুসল্লি ও জয়নগরের আরও কতক মুসলমানও এইরকম লুটপাট করেছে। তবে ওদের মতো এত সোনাদানা ও নগদ টাকাপয়সা আর কেউ পায়নি। এদিক থেকে ওরা চারটে প্রাণী শীর্ষস্থানে রয়েছে। এজন্য ওরা নিজেদের ভাগ্যকে আজ সালাম জানাচ্ছে বারবার। পারলে ওরা এখন নিজের কপালে নিজেই চুম্বন করে আর কি!
কে কত লুটপাট করেছে— দেখার জন্য এখানে এই নিরাপদ জায়গায় এসে ওরা বসেছে। চারটে প্রাণী এবার নড়েচড়ে বেশ গোল হয়ে বসল। এখানে, ভূতের ভয় ছাড়া মানুষজনের কোনো ভয় নেই। তবে ওরা ভূত-প্রেতকে ভয় পায় না। বরং ভূত-প্রেতই ওদের ভয় পেয়ে কখনো ওদের সামনে আসে না। ওরা প্রাচীনকালের ঠ্যাঙ্গারে কিংবা লুটেরা কিংবা দল বেঁধে ডাকাতি করা ভয়ানক দস্যুদের চেয়েও মারাত্মক। এর আগেও ওরা হিন্দুপাড়ায় লুটপাট করেছে। এসব ব্যাপারে ওরা ভীষণ অভিজ্ঞ। আর ওদের এই অভিজ্ঞতা পুরুষানুক্রমে।
মাঝে মাঝে দেশের ভেতরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে যখন হিন্দুপল্লিতে বা হিন্দুদের পাড়ায় আক্রমণ করা হয়, আগুন দেওয়া হয়, আর যখন তাদের বাড়িঘরে নির্বিচারে লুটপাট করা হয়— তখন ওরা একেকটা লাভের আশায় মুসলমান হিসাবে নেমে পড়ে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এইসব কাজে ওদের কোনো ক্লান্তি নেই। এতে ওদের কয়েক মাসের কামাই-রোজগার হয়। সেইজন্য ওরা আশায়-আশায় থাকে— কখন কে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করবে আর হিন্দুপাড়ায় হামলা চালাবে। ওরা তখন মিশে যায় লুটেরাদের দলে। আজও মসজিদের মাইক থেকে যখন হিন্দুপাড়ায় আক্রমণের কথা বলা হয়েছিল তখন ওরা মসজিদে গিয়ে শামিল হয়েছিল নামাজে। তারপর সবার সঙ্গে হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়েছে। আর মনের সুখে, ইচ্ছেমতো লুটপাট করেছে। ওরা আজ এত-এত সোনাদানা লুট করেছে, ওদের বাপ-দাদারা কেউই এত সোনা জীবনে চোখে দেখেনি। সেই খুশিতে ওরা খন্দকারবাড়ির এই পুকুরপাড়ে লুটের সম্পদ নিয়ে একটুখানি বিশ্রাম করতে এসেছে। আর সঙ্গে এনেছে কয়েক বোতল দেশি মদ। আর ওরা আজ রাতে মনের মতো ফুর্তি করবে। নগদ টাকাও যে এসেছে হাতে!
সবার আগে লোকমান সেখ নিজের লুটকৃত সব দামি-দামি জিনিসগুলো বন্ধুদের সামনে রাখে। সে কয়েক ভরি স্বর্ণালংকার ও হাজার বিশেক নগদ টাকা রাখলো।
তারপর নগদ টাকা বের করে তাইজুল। ওর সংগ্রহ হাজার পঁচিশেক হবে। আর স্বর্ণালংকার লুট করেছে সাড়ে চার ভরি।
বদরুদ্দিন অনেককিছু লুট করেছে। সে কয়েক হাজার নগদ টাকা, কয়েক ভরি স্বর্ণালংকারসহ মানুষজনের ঘরের দামি-দামি ও হালকা পাতলা জিনসিপত্রও একটা বড় ব্যাগে ভরে এনেছে।
আর সোলেমান সোনা-রুপাসহ হাতের কাছে হালকা পাতলা যা পেয়েছে সব লুটে নিয়েছে। ওর লুটকৃত সম্পদ প্রায় এক বস্তা হবে।
ওরা নিজেদের সদ্য লুটকৃত সম্পদ দেখাদেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবার মনের মধ্যে সে কী খুশিভাব! আজ কতদিন পরে আবার এসব লুট করতে পেরেছে। ওর পূর্বপুরুষেরা ১৯৪৬ সালের রায়টে, ১৯৪৭ সালের পার্টিশনের ডামাডোলে-রায়টে ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করেছিল। পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে থেকেছে। তাদের ধর্ষণে সহায়তা করে নিজেদের জায়গাজমি গড়ে তুলেছে। ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা যেন কখনো কষ্ট না-পায় সেইজন্য ওরা আজও এসব চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ওদের পূর্বপুরুষের পেশা। ওরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ওদের আদর্শ পিতা দস্যু সুলতান মাহমুদের মতো সমানতালে, দুহাতে, নির্বিচারে হিন্দুদের সহায়-সম্বল ও সম্পদ লুটপাট করে যাবে।
সন্ধ্যারাতে ওরা যখন খুশিমনে নিজেদের লুটকৃত সম্পদ দেখাদেখিতে একেবারে তন্ময়— তখন পুকুরের বিপরীত দিকে থেকে একটা ছায়ামূর্তি উঠে এল। লোকটার উচ্চতা কমপক্ষে ছ’ফুট হবে। গায়ে-গতরে শক্তিও যথেষ্ট আছে বলে মনে হয়। অন্ধকারে তার চেহারা তেমন দেখা যাচ্ছে না। সে খুব সন্তর্পণে পা ফেলে-ফেলে ওদের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু ওরা তাকে দেখতে পায়নি। বুঝতেও পারেনি তার আগমনধ্বনি।
রাত আনুমানিক সাড়ে আটটা হবে। চারিদিকে ভয়ানক শুনশান অবস্থা বিরাজ করছে। গাছের একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়লে তার শব্দও স্পষ্ট শোনা যাবে যেন! অন্ধকার রাত। চাঁদের আলো এখনও দেখা যাচ্ছে না। তবে আজ অমাবস্যাও নয়।
চাঁদ উঠেছে হয়তো। তবে তা এখন মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি যে হবে তারও কোনো আশঙ্কা নেই। আকাশে এমনিতে মেঘ জমেছে। এগুলো বৃষ্টির মেঘ নয়। ওরা বুঝেশুনেই আজ এখানে আস্তানা গেড়েছে। নিজেরা একটু ফুর্তি করবে বলে।
ছায়ামূর্তিটা একটু-একটু করে ওদের দিকে আরও অগ্রসর হতে থাকে। তার কোনো ভয়ডর নেই। হঠাৎ করেই চাঁদের আলো ছিটকে পড়ায় তার চেহারাটা এবার একটুখানি দেখা গেল। সে যে হিন্দুপাড়ার প্রকাশ চন্দ্র সাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিকাশ চন্দ্র সাহা। ভয়ানক মারকুটে সে। একাই একশ যেন। গায়ে তার অসুরের শক্তি। তার উপরে নিয়মিত ব্যায়াম আর শরীরচর্চা করে। বয়সটাও খুব একটা বেশি নয় তার। বড়জোর সাতাশ-আটাশ হবে। এখনও বিয়েথা করেনি। সামনে তার ছোটবোন রত্না রানী সাহার বিয়ে।
আজ মসজিদের মুসল্লিরা তাদের বাড়িতেও আগুন দিয়েছে। এই সুযোগে তাদের বাড়িঘর লুট করেছে তাইজুল, বদরুদ্দিন, সোলেমান ও লোকমান।
তাদের সাহাপাড়ায় উন্মত্ত মুসল্লিরা যখন আগুন দিচ্ছিল তখন সে একাই এসব মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পিতার নির্দেশে সে গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সে গা-ঢাকা দিলেও তাদের বাড়ির সীমানার বাইরে যায়নি। সে নিজেদের পায়খানার একপাশে লুকিয়ে ছিল খুব সন্তর্পণে। আর আড়াল থেকে সবকিছু দেখছিল। তার বোনের বিয়ের সকল গহনাপত্র এরা মিলেমিশে লুট করেছে। সে এদের পিছু-পিছু এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে এজন্য। বিশ ভরি স্বর্ণালংকার আবার ক্রয় করা তাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। এজন্য ভেঙে যেতে পারে তার ছোট বোনটির বিয়ে। কিন্তু সে তা হতে দেবে না। নিজের জীবনের মায়া না-করে সে এদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে এসেছে।
সে পুকুরপাড়ে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা কয়েকটা আমলকি-গাছের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। এখানটায় যেমন ঘন জঙ্গল তেমনি ঘন অন্ধকার। চাঁদের আলো কখনো এখানে প্রবেশ করতে পারে না। এই সুযোগটা সে কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
গল্পটল্প শেষ করে রাত দশটার দিকে ওরা নেমে এল এই পরিত্যক্ত পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে। এখানে খুব ভালো বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তা দেখে ওদের মন ভরে গেল। মাঝে মাঝে ওরা এখনে মদ খেতে আসে। ওদের ভয়ে এই তল্লাটে রাতের বেলা কেউ আসেও না। সেদিক থেকে ওরা খুব আরামে ও নিরাপদে রয়েছে। ওদের একটা মদের আড্ডাখানা হয়েছে। অনেক সময় ওদের আরও কিছু বন্ধুবান্ধব এখানে এসে ভিড় করে। তখন ওরা এখানে বড়সড় একটা মদের পার্টি দেয়। আজও হয়তো ওদের মদের পার্টি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সঙ্গের লুটকৃত মালপত্র কিছুটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওরা হয়তো তা করল না। এসব ব্যাপারে ওরা খুব হুঁশিয়ার। লুটপাটের অপকর্মে আর মদ খাওয়ার ব্যাপারে ওরা খুবই পারদর্শী। আজও ওরা মদ খেতে শুরু করে। অবশ্য এটাকে মদ্যপান করা বলে না। এগুলো হচ্ছে গোগ্রাসে মদ গেলা। যে যেমন পারছে মনের সুখে মদ খাচ্ছে। আজ ওদের সুখের দিন।
ওদের মদ্যপানের দৃশ্য দেখে বিকাশের মুখে ক্রূর হাসি ফুটে উঠল। ওর ভালো লাগছে এখন। হয়তো সে এখন খুব সহজে নিজেদের বাড়ির লুটকৃত সম্পদ এদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারবে। উদ্ধার তাকে করতেই হবে। নইলে যে তাদের মান বাঁচবে না। ছোট বোনটির বিয়ে ভেঙে গেলে তাদের মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
পর-পর কয়েক গেলাস মদ খাওয়ার পর লোকমান বলে, ‘খালি মদে কি ভাল্লাগে রে সোলেমান? সঙ্গে একটা মালটাল হলি পারে খুব ভালো হইত। আইজকের রাইতটা যা জমতো না!’
খুশির আধিক্যে সে আর কথা বলতে পারে না। ভীষণ আনন্দে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। প্রায়ই সে এমন করে। বেশি খুশি হলে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
সোলেমান ওর কথাটা শুনে যেন প্রাণ ফিরে পায়। সে প্রায় টলতে-টলতে বলে, ‘তা তো হইতই দোস্ত। কিন্তু মালাউনের বেটিরা যে আগেই পালিয়েছে সব। সব দোষ ওই মসজিদের ইমাম ব্যাটা শালার। শালার ব্যাটা শালা মসজিদের মাইকে কেন আগেভাগে কইতে গেল হিন্দুপাড়ায় আগুন দেওয়া হবি! আমরা চুপি-চুপি হিন্দুপাড়ায় ঢুইকে আগুন দিয়ে সবকিছু হাতায়ে নিতি পারতাম।’
লোকমান মদের গেলাস মুখের কাছে নিয়েও থমকে গিয়ে বলে, ‘হ-হ, ঠিক কতা কইছিস। ওই ইমাম ব্যাটা শালাই যত নষ্টের গোড়া। শালার জন্যিই আইজ একটাও হিন্দু বেটি ধরতে পারলাম না। একটা মেয়ে না হইলে আসর জমে না।’
মনভরে মদ খেতে থাকে ওরা। যেন রাত ভোর না-হওয়া পর্যন্ত চলবে এই অভিযান। রাতের নিস্তব্ধতা বাড়তে থাকে। ওরাও ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। হঠাৎ মদের নেশায় বুঁদ হয়ে বদরুদ্দিন বলে উঠলো, ‘মদটা খুব ভালো রে। এর সঙ্গে বিকাশদার বোনটা যদি হইত না— কী যে মজা হইত। কী শরীর ওর! একখান জিনিস রে!’
ওর কথা শুনে বাকি তিনটে একসঙ্গে হেসে যেন বলে, ঠিক কইছিস দোস্ত। বিকাশদার বোনটা যা একখান মাল না! আইজ রাইতে তারে পাইলে কী যে মজা হইত!
কথা শেষ করে সে চোখ বন্ধ করে হাসে। যেন এখনই বিকাশের বোনটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সে!
ওদের থেকে এখন বড়জোর হাত দশেক দূরে বিকাশ। সে ওদের সব কথাই শুনতে পায়। ওদের কথা শুনে তার আত্মাটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠেছে। ভাগ্যিস, তারা বুদ্ধি করে আজ বিকালের আগেই বোনটিকে পাশের থানায় ওর এক মামার বাড়িতে রেখে এসেছিল। আর হামলা আঁচ করতে পেরে হিন্দুপাড়ার মহিলাদের আগেই সরে যেতে বলেছিল ওরা। নইলে যে ওদের ভাগ্যে কী হতো! তবুও বিকাশ শিউরে ওঠে ওদের কথা শুনে। ওর বোনটার প্রতি এদের পৈচাশিক লোভ দেখে সে ভয়ানকভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। তবে সে বাইরে খুব শান্ত থাকে। ওর মনে হয় এরা বেঁচে থাকলে তার বোনটিকে যে কোনোদিন ওরা আবার ভোগ করতে চাইবে।
বিকাশের পরিকল্পনা এবার যেন হঠাৎ করেই বদলাতে থাকে। সে আসার সময় শালকাঠের একখানা মোটাসোটা লাঠি সঙ্গে এনেছিল। আপদ-বিপদের কথা ভেবে সে খালি হাতে আসেনি। সে জানে, ওদের কাছ থেকে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে গেলে ধস্তাধস্তি কিংবা মারপিটও হতে পারে। এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত। সে আজ ছাড়বে না।
বিকাশদের কথায় অন্য বাড়ির লোকেরা সোনাদানা ও নগদ টাকাপয়সা সরাতে পারলেও ওরা কিছুই সরাতে পারেনি। ওদের বাড়িটা হিন্দুপাড়ার একেবারে শেষ মাথায়। তাই, ভেবেছিল, এদিকটায় কেউ হয়তো আসবে না। কিন্তু বিধি বাম। ওদের বাড়িটাই সবার আগে আক্রান্ত হয়েছে।
মদ খেতে-খেতে ওরা একেবারে টাল হয়ে পড়ল। আর কাহিলও হয়ে পড়েছে। ওদের মধ্যে সোলেমান একটু মদ কম খেয়েছে। সে এবার লোকমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী রে, আইজ বাড়ি যাবি না? নাকি এইখানেই সারা রাইত থাকপি?’
লোকমান প্রায় বেহুঁশ। সে কিছুটা হুঁশ এনে সামান্য একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে, ‘এইখানেই থাকপো রে। জিনিসগুলারে একটা ঝোপের মধ্যে রাইখে দে। তাইলে কোনো শালা টের পাবি নানে। কাইল সকালে উইঠে না-হয় সব যার-যার বাড়ি নিয়ে যাব নে। তাছাড়া, এহন এসব বাড়িতে নিলে পুলিশের ঝামেলা হইতে পারে রে।’
বদরুদ্দিন পুরোপুরি বেহুঁশ হয়নি। সেও লোকমানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে থাকে, ‘বুদ্দিটা খারাপ না রে সোলেমান। লোকমানের কতাটা মন দিয়ে শোন। হিন্দুপাড়ায় আগুন দিছি আমরা। লুটপাটও করছি। আরও মাইনষে লুটপাট করছে। লুটপাট তো হইছে। একখান পুলিশি ঝামেলা হইছে রে। এসব মালপত্র এহানে মাটির তলায় রাখতি হবে কয়দিন। খালি আমরা চাইরজনে জানব। আর কেউ এসব জানবে না। পরে পুলিশি ঝামেলা শেষ হয়ে গেলে সব বাইর করে নেব নে।’
সোলেমান বন্ধুদের কথামতো তাই করতে থাকে। ইতোমধ্যে তাইজুল, বদরুদ্দিন প্রায় বেহুঁশ। ওরা এখন কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছে। ভাবে বোঝা যায় ওরা দুটো এখন পুরোপুরি মাতাল।
বিকাশ ওদের আরও কাছে এগিয়ে আসে। এসে ওদের হালহকিকত ভালোভাবে দেখতে থাকে। ওদের অবস্থা এখন জলে ডোবা বিড়ালের মতো।
সে কোনোদিকে না তাকিয়ে মুখে একটা বড়সড় রুমাল বেঁধে নিয়েছে। এখন ওদের কেউই তাকে চিনতে পারবে না। মদমাতালেরা প্রায় বেহুঁশ!
এই একটা সুযোগ! এটা ভেবে বিকাশ সঙ্গে-সঙ্গে আমলকি-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে হাতের লাঠিটাকে সজোরে চেপে ধরে।
প্রথমেই তার সামনে পড়ে সোলেমান। সে এত রাতে এখানে এত লম্বা-চওড়া একজন মানুষকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। পরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হয়তো তাকে চেনার চেষ্টা করছে।
বিকাশ ততক্ষণে তার দু’পায়ে কয়েকটা প্রচণ্ড ঘা বসিয়ে দিয়েছে। তারপর সে বাকি তিনটাকেও একই কায়দায় পা ভেঙে দিল। যেন জীবনে ওরা আর কোনোদিন আর কারও বাড়ি লুট করতে না পারে।
মাতাল হলেও ওরা ব্যথায় কোঁকাতে লাগল। কিন্তু এই নির্জন স্থানে কে শুনবে ওদের কাতরধ্বনি?
বিকাশ ধীরস্থিরভাবে কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের সমুদয় মালপত্র বুঝে নিতে থাকে। তারপর সটকে পড়তে থাকে আগের মতো খুব সন্তর্পণে।
আর ওরা গাছতলায় পড়ে থাকা পচা কাঁঠালের মতো পড়ে আছে। এই বিজনভূমিতে এখন কেউ নেই এখানে। ওরা কোনোদিন আর হাঁটতে পারবে না। বিকাশকে দেখলেও চিনতে পারবে না কেউ। বুঝতে পারবে না কিছুই! এই ঘটনার কোনো সাক্ষী নেই! কেউ নেই এখানে!
আকাশের চাঁদটা শুধু হাসছিল এই নির্জন রাতে।
সাইয়িদ রফিকুল হক : একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক, সমাজ-সচেতন মানুষ ও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় সর্বাপেক্ষা প্রিয়। তিনি কবি, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক। বর্তমানে তার লেখা মুক্তচিন্তা, প্রতিলিপি, সামহোয়্যারইন-ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে ও সাহিত্যপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রকাশিত গ্রন্থ : গোয়েন্দা লালভাই (২০২১), হিজলগাছের রহস্যময় লোকটা (২০২১)।