অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৯, ২০২৪
৩রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৯, ২০২৪
৩রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাহমিনা কোরাইশী -
ওয়াচ ডগ

 

অভিজাত এলাকায় বেশ অনেকটা জায়গার ওপরে বড় একতলা বাড়িটিতে মিসেস টি. আমিন একলাই থাকেন।

বয়সের ভারে কিছুটা বিপন্ন তো বটেই। বাড়িটিরও বয়স হয়েছে। বয়সের ছাপ বেজায় তীব্র। কোথাও কোথাও পলেস্তরা খসে পড়ে ইটগুলো দাঁত বের করে হাসছে। দেয়ালের গায়ে তৃণলতারা দেহ বিস্তার করে আছে। বাড়িটার সামনে পেছনে প্রচুর গাছগাছালি, যেন একান্নবর্তী পরিবারে বয়োবৃদ্ধদের সাথে এ প্রজন্মের মেলবন্ধন। বাগানটি আর কোনো শ্রী নেই। এতটাই বাড়বাড়ন্ত যে একেবারে ঝোপ-ঝাড়ে রূপান্তর হয়েছে। বাগানের পরিচর্যার জন্য মালির ব্যবস্থা নেই আজকাল। ঐ যে দারোয়ান, সেই দয়াপরবশ হয়ে কখনও সখনও পানিটানি দিয়ে থাকে। বাড়ির প্রায় সব কাজই তাকেই তদারকি করতে হয়। অবশ্য তার স্ত্রী মোমেনা মিসেস টি. আমিনের দেখাশোনা রান্নাবান্নার দায়িত্বে আছে। আরো আছে দারোয়ানের ছেলে আজিম। কুকুর দুটোর দেখা-শোনা করে। মাঝে মাঝে বাবা কলিমের সাথেও হাত বাটে। সারা রাত ঐ দুটো ওয়াচ ডগকে পাহারায় দিয়ে সবাই দিব্যি আরামে ঘুমোয়। কিন্তু আজকাল ছেলেটা বড় হচ্ছে। দারোয়ান কলিম আর তার স্ত্রী মোমেনার চিন্তা বাড়ছে। ছেলেটা কেমন যেন আগের মতো নেই। বাউণ্ডুলে প্রকৃতির হয়ে উঠছে। কত নিষেধ করা সত্ত্বেও সে কারও কথায় কর্ণপাত করছে না। বাড়ির মালিক মিসেস টি. আমিনের কথা কিছু শোনে। চোখ তুলে তার সাথে কথাটি পর্যন্ত কয় না। যতটুকু সম্মান সে তাকেই করে। তাতে করে মনে হতে পারে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ কিনা! এদের নিয়েই মিসেস টি. আমিনের ঢাকার জীবন। যখন দারোয়ান কলিমের বয়স ১০/১২ হবে তখন থেকেই এ বাড়িতে কাজে এসেছে। দিনে দিনে হয়েছে মুনিবের বিশ্বস্ত একজন। সেই ছোট থেকে বাজার করা বাসার কাজকর্ম মিসেস টি. আমিনের ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া অবশ্য গাড়িতে করেই সাথে যাওয়া। ড্রাইভারের সাথে। মিস্টার টি. আমিনের ফুটফরমাশ খাটা। খুব পছন্দের ছিল বিশেষ করে সাহেবের।

পরবর্তীকালে বিয়ে করেছে। বউটি মিসেস টি. আমিনের রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজ করে। কলিম মোমেনার ছোট ঘরে জন্মায় আজিম। টি. আমিনের বাসায় ওদের থাকার ব্যবস্থা সবই আছে। বাড়িটির এক কোণে দারোয়ানের ঘর সংসার। টি. আমিনের সংসারটিও দিন দিন বড় হয়।

আজকের এই প্রাণহীন বাড়িটি ছিল এককালে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। দুটো ছেলে মেয়ে ওদের বউ-মেয়ের জামাই নাতি-নাতনি বন্ধুবান্ধব। এক সময় ওরা চলেও যায় উন্নত বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির পান্থশালায়। নতুন ধারাপাত রচনায় ব্যস্ত জীবন। ফিরে আসবার চিন্তা ওদের নেই। সেটেল হয়ে গেছে ঐ দেশে। মাঝে মধ্যে মা-বাবার জন্য আসে দেশে বেড়াতে। হঠাৎ করেই টি. আমিনের মৃত্যু মিসেস টি. আমিনকে একাকিত্বের নির্মমতায় ফেলে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা বলে তাদের সাথে প্রাচুর্যের উন্নত ছোঁয়ায় দিনযাপনে। মিসেস আমিন রাজি হয়নি। অবশ্য মাঝে মধ্যে বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু এ মাটির সোঁদা ঘ্রাণের টানে ফিরে এসেছে। কত স্মৃতি গলায় জড়াজড়ি করে এই বাড়ি ঘিরে তার অপেক্ষায় বসে থাকে। তার স্বামী সন্তানদের কথোপকথন ইথারে ইথারে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্মৃতিগুলো বায়োস্কোপের মতো চলছে চোখের সামনে স্ক্রিনে। যখন তখন দেখে নেওয়া যায় মনের মাউসটি ক্লিক করলেই। ঘরময় যত্রতত্র তাদের ব্যবহার্য বস্তুর ওপর চোখ পড়লেই চলতে থাকে বায়োস্কোপ।

আজকাল ড্রাইভারও বিদায় করে দিয়েছে। তেমন কোথায়ও যায় না। ভাই-বোনদের বললে ওরাই গাড়ি পাঠিয়ে দেয় অথবা তার বাড়িতে বিশাল আয়োজনে পিকনিক হয়ে যায়। শহরে এমন পিকনিক স্পর্ট পাবে কোথায়? সবাই বলে— ভয় করে না একলা থাকতে?

মিসেস টি. বলেন, একলা কোথায়? কলিম, মোমেনা ওদের ছেলে আজিম, বড় কথা বিশ্বস্ত দুটো ওয়াচ ডগ আছে না?

সরাইল থেকে এনে দিয়েছিল ওদের পুরোনো ড্রাইভার কাশেম আলী। সেও মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যায়। সেলফোনের যুগ সেও তার নম্বরটি বেগম সাহেবের কাছে রেখে গেছে। যদি কখনো প্রয়োজন হয়। কোনো সংকোচ না করে এই ভৃত্যকে যেন ডাকেন সে খুশি মনে চলে আসবে। একটু সেবা করে ধন্য হতে ওর বড় সাধ। এতকাল যাদের নুন খেয়েছে। মিসেস টি. আমিনের সবচেয়ে প্রিয় একটি যন্ত্র আছে যার নাম টেলিফোন। ওটা প্রাণের চেয়েও যেন প্রিয়। একটা দিনও নষ্ট যেন না থাকে। লাইনম্যান এসে প্রতি মাসে চেক করে দিয়ে যায়। যদিও সেলফোন আছে তবুও আগেকার মানুষদের ঐ ফোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ঐ ফোনটিতে সকালে একচোট, সন্ধ্যার পরে এক চোট কথা সারে। মনে হয় এই তো ওদের সাথে দেখা শেষ হলো, প্রয়োজনীয় কথাও শেষ হলো।

ভালোই কাটছিল তার এমন সংসার। এরই মধ্যে উটকো ঝামেলা দিন দিন বাড়ছে। উৎপাতও বাড়ছে। যদিও বাইরের গেটে লেখা আছে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। তবুও সময় নেই অসময় নেই কলিং বেল বেজে ওঠে, অথবা মোবাইল ফোন কিংবা টিএন্ডটি।

ভৌতিক সব কথাবার্তা। মধ্যরাতে গাছগাছড়ায় ধামধুম টিল পড়ে। কাগজ ছুড়ে ঢিল বানিয়ে সময় সুযোগ বুঝে দেয়। ওদের চোখ এড়িয়ে। কাঁচা হাতের লেখা প্রচুর ভুল বানানে লেখা বাড়িটিতে ভূতের আস্তানা হয়েছে। রাত দুপুরে দেখবেন ভূতের নৃত্য। বাড়িটি ছাড়ছেন কবে?

বিক্রির টাকার হিস্যা না দিয়ে বাড়ি ছাড়তে পারবেন না। ভূত হয়ে আপনার ঘাড়ে চেপে বসব। ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তো আছে ভূমি দুষমন ডেভেলপারদের জ্বালাতন। প্রতিদিন ফোনে নতুবা ঘরে এস ভদ্রবেশে কত মধুর বাক্য বর্ষণ করবে তার ইয়ত্তা নেই। একেবারে জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে এই সব পরিবেশ দুষমনরা। বহুবার বারণ করার পর এরা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দালালদের মতো নাছোড়বান্দা। তবুও পারেনি টলাতে মিসেস টি. আমিনকে।

কেউ সনাতনে আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করে। ভাবাতুর দিন কাটাতে ভালোবাসে। কেউ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টে যেতে পছন্দ করে। তার ভালোর জন্যই এই সব ডেভেলপারদের আনাগোনা বোঝে মিসেস আমিন। কিন্তু ঐ সব সুবিধা নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। অর্থ সুযোগ-সুবিধা জনবল সর্বোপরি সৌন্দর্য সবই তার কাছে গৌণ। কেবল মনটাই আসল। সনাতন জীবনের মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে নাটাই ঘুড়ি টানতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যদিও ওদের ভূমি দুষমন বলে গাল দেয় তবুও বোঝে সময়ের সাথে সাশ্রয়ী উন্নত প্রযুক্তি পন্থার পক্ষের শক্তি ওরা।

মিসেস টি. আমিনের অর্থবিত্ত কিছুরই প্রয়োজন নেই। যা করার তার ছেলে-মেয়েরাই করবে। তার কেবল মৌ মৌ সরষে ফুলের হাসিমাখা স্মৃতিতে সবুজ স্বপনের পিছু ছোটা। যদিও পায়ের তলায় ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনির বিলাপ। হেঁটে চলেছে সেই পুরোনো বাগানের ছায়াবৃক্ষ তলে। আঁচলে কুড়িয়ে নেওয়া পেয়ারা জলপাই আমলকি। স্মৃতিগুলো ওর সাথে হেঁটে চলে পায়ে পায়ে। কখনও কিশোর বেলার খিলখিল হাসিতে কখন ঠোঁটের কোণে মৃদু রেখাতে। গাছপালার সহিত মোহন বাতাস সুর তোলে পাঁজরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে শিহরণ জাগায়। এই যে এই আঙিনা উঠোন ছেড়ে যাবে সে কোথায়। যতদিন দেহে আছে ছোট একটি প্রাণ পাখি। লুকিয়ে থাকা স্মৃতি নিটোল গৃহকোণ। সবুজ প্রাণবন্ত চত্বর সবই তো নিজের। স্বামীর কেনা সেই সেগুনকাঠের কারুকার্যে ভরা পালঙ্কখানা স্মৃতির খামে ভালোবাসার চিঠি। শান্তির নিদ্রায় নিশ্চিন্ত মরণ শয্যা ও পালঙ্কখানি।

ছোটবোন হাসনুও বলেছে বড়বু ছেলেমেয়েদের কাছে থাক এই বয়সে একলা থাকাটা ওদের জন্য পীড়াদায়ক। তোমার নিজের জন্য তো বটেই। ছেলেমেয়েরাও বলে বলে একেবারে নাজেহাল। মানুষ কী বলবে? তোমাকে একলা ফেলে আমরা মহাসুখে আছি। তোমার চিন্তায় আমাদের নাভিশ্বাস। সারাটাক্ষণ কেমন এক অস্থিরতায় কাটে। অসুখ-বিসুখ আপদ-বিপদের কথা বলা যায়? কারও কথাই শুনতে সে রাজি নয়। ভুতুড়ে বাড়িটা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখবে যতদিন বাঁচে।

সে জানে ছেলেমেয়েদের এই বাড়ির জন্য কোনো মায়া নেই। ওদের নিজেদের সবারই বাড়ি আছে ঐ সকল উন্নত দেশে। টাকা পয়সারও কোনো কমতি নেই। মাকে স্বর্গীয় আরাম আয়েশেই রাখতে পারে। মেয়ে বলেছে দুঃখ করে— তোমার নাতনিদের জন্য তোমার কষ্ট হয় না? আমাদের জন্য একটুও মায়া হয় না? এই ভুতুড়ে বাড়িটি তোমার আপন?

ওদের কথার উত্তর দিতে পারে না। পাথর হয়ে বসে থাকে মিসেস টি. আমিন। ভাবে এই আঙিনা উঠোন গাছগাছালি স্বামী সন্তানের স্মৃতিজড়িত। নিজের আত্মার কিছু সম্বল। এই তো এইখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে। এই তো এখানে খেলেছিল আমার সন্তানেরা, এই তো সেদিনের কথা। ঘরের চারদিকে ছড়ানো এলোমেলো মিস্টার টি. আমিনের ব্যবহার্য সামগ্রী। ওর মনে হয় তাকে শেকড়সহ অন্য মাটিতে নিয়ে ছেলে-মেয়েরা প্রতিস্থাপন করতে পারবে ঠিকই কিন্তু হাজার কলস জলে পরিচর্যাও করতে পারবে। কিন্তু ওর রুহটাকে কি সতেজভাবে রক্ষা করতে পারবে? হু হু করে কেঁদে ওঠে অন্তর আত্মা।

পাশেই বসে ছিল মোমেনা। সেও বলতে চাইল, আপনি যান ছেলেমেয়ে গো সাথে। কিছুর জন্য চিন্তা কইরেন না। কুত্তা দুইটারে যত্ন নিমু, বাড়িঘরও ঠিক রাখমু। ‘ওয়াচ ডগ’ দুটো লাফিয়ে লাফিয়ে মিসেস আমিনের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে— তোদের জন্যই তো যেতে পারি না। যেভাবে আমাকে আগলে রেখেছিস তোরা দুটিতে। আর মোমেনা কলিম আর তোদের ছেলেটা আজিম। তোদের নিয়েই আমার এই লতাপাতার ছোট সংসার।

মহাসুখেই আছি। নিজের বলেই স্বাধীনতা নিজস্ব আলোয় আছি। পরদেশে পরগাছা জীবনের অংশীদারিত্ব ভালো লাগে না, সে যত আরাম আয়েশের হোক। নিজের ভাইবোনেরা তাদের ছেলেমেয়েরা খালামণির বাসায় আসে মনে হয় নক্ষত্র আলোয় ঝিকমিক করছে। নিশিথে আসে দল বেঁধে আসে স্মৃতিরা। তার সাথে চোর ডাকাত, আসে ভূত-প্রেত। কেমন যেন আনচান করে রাতের ভৌতিক বাতাস। ইদানিং তাই ঘুমের বড়ি খেয়েই ঘুমের মাসিপিসিকে ডাকতে হয়। আজিমের মা, মানে মোমেনা তার পায়ে পায়ে চলে। বেগম সাহেব ঘুমুলে ভালো করে কম্বলটা তার গায়ের ওপরে বিছিয়ে দেওয়া এনার্জি সেভিং পাওয়ার লাইটটা বন্ধ করে নীল সাগর আলোর ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।

কিন্তু আজ রাতে এর কোনোটাই হয়নি। সারাদিন মেলা কাজ করেছে। অনেক মেহমান খেয়েছে দুপুরে। তারা যেতে যেতে সন্ধ্যা। মোমেনা কাজ শেষ করে ভীষণ ক্লান্ত শরীরে বেগম সাহেবের পাশের রুমেই ঘুমিয়ে পড়ে। কলিমেরও খাটুনি কম হয়নি। সে তার ছেলেকে ‘ওয়াচ ডগ’কে খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়ে সেও শুয়ে পড়ে বেশ তাড়াতাড়ি।

আজিমের মাথায় যে আজ অমানিশার ভূত ভর করেছে কে জানে? বেশ কিছুদিন ধরেই ছেলেটাকে বকে চলেছে ওর বাপ। কূলকিনারা করতে পারছে না। লেখাপড়া তো করলই না। পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে মেলামেশা। এ ব্যাপারে নালিশও এসেছে কতবার। সাবধানও করা হয়েছে ওকে। গরিব মানুষের ছেলেপুলে ভালো অবস্থানে থাকলে ওরা ভাবতে থাকে ঐ সম্পত্তি বিষয় সামগ্রী ওর নিজের। পানির দরেই কেনা যায়। সবকিছুই সহজলব্ধ তার সাথে এ যুগ দ্রুত পরিবর্তনের। মানে হাতের মুঠোয় বিশ্ব। তার হাতে সেলফোনও আছে। পড়ালেখা না করলেও এই ব্যাপারে পারদর্শী। যুগের হাওয়া যেমন মানুষের সুযোগ সুবিধা যোগাযোগ সকল ব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি করেছে। তেমনিভাবে অবক্ষয়ও বেড়েছে। সমাজের বখে যাওয়া মানুষগুলো আরও বেশি সহজেই অপরাধ চক্রের সাথে অতি সহজেই কাজ উদ্ধার করছে।

রাতের কৃষ্ণকালো রঙ ভয়ার্ত বাতাস আজিমের কানে কানে কী বলে গেল? আজিম সেলফোনটা কানের কাছে চেপে ধরে ফিসফিস করে কী যেন বলে কাকে। তারপর কুকুর দুটোকে নিজের হাতে বেশ যত্নের সাথেই খাওয়ায় আরও দুই বন্ধু মিলে। গাঢ় ঘুমে পুরো বাড়ি যেন মৃত্যুপুরী।

কুকুরগুলো খাবার খেয়ে আজ আর লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শক্তি হারিয়ে ফেলে। সাথে সাথেই অচেতন ঘুমে না ফেরার দেশে চলে যায়। এবার টার্গেট গৃহকর্ত্রীর রুম। প্যাসেজ পার হয়ে ভেজানো দরজা একটু আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে যায় দরজা। বেডসাইড টেবিলে আলমারির চাবির গোছা। হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় আজিম। এ বাড়ির সব কিছুই তার নখদর্পণে। জন্ম থেকেই বেড়ে ওঠা এই বাড়িতেই। পাহারায় যে ছেলেটা তার নাম মোকলেস। ওকে আগেই বুঝিয়ে নিয়ে এসেছে। সে আলমিরা খুলে সোনাদানা টাকাপয়সা বের করে ব্যাগে ভরবে। ঐ মুহূর্তে যদি মিসেস টি. আমিন জেগে না ওঠে তবে ভালো কথা আর যদি জেগে যায়ই তবে বালিশ চেপে ধরে বুড়িকে শেষ করে দিবি। না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশি। মোকলেস আস্তে আস্তে বুড়ির বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ দেখে বুড়ি নড়াচড়া করছে। উঠে বসার চেষ্টাও করছে। সে ভয়ে একটু উচ্চ স্বরেই বলে উঠল অহন কী করমু। বালিশ চাইপ্পা ধরুম। ততক্ষণে কে-কে, কে এখানে বলে চিৎকার করেই বলে ওঠে মিসেস টি. আমিন।

আজিম হঠাৎ করেই রেগে যায়— ঐ খানকির পোলা, তোরে কী কইছিলাম? ধর চাইপ্যা।

মনিবের দিকে চোখ ফেরায় না। মোকলেস চেষ্টা করে বালিশ চাপা দেওয়ার ততক্ষণে পুরোপুরিভাবেই শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে মিসেস টি. আমিন। দু’জনের ধস্তাধস্তিতে চিৎকারের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় মোমেনার। ওদের চিৎকারে দৌড়ে আসে কলিম। হাতে লোহার রড। বাড়িতে ডাকাত পড়ল নাকি। সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়া শরীরে বেশ শক্তি সঞ্চারিত হয়ে ওঠে। মোমেনা রুমে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দেয় এ কী কাণ্ড। ওর নিজের পেটের সন্তানের এই অধঃপতন। দৌড়ে গিয়ে মোকলেস হাত থেকে মনিবকে রক্ষা করে। মোকলেস দৌড়ে পালায়। মোমেনা জাপটে ধরার চেষ্টা করে আজিমকে। জোয়ান মর্দ হয়েছে ওর সাথে পেরে ওঠে কী করে! এদিকে কলিম হাতের রড দিয়ে বেধড়ক পেটাতে লাগল তার নিজের সন্তানকে। কলিম আজ বুদ্ধি বিবেক জ্ঞানশূন্য পশু হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। বিশেষ করে আজিমকে দেখে তার আর মাথা ঠিক থাকে না। সারাটা জীবন যাদের নুন খেয়েছি, এই বিপদে পক্ষপাত নয়। যায় যদি মরে যাক এই কুলাঙ্গার ছেলে। চারদিকে চিৎকার কান্নার রোল। আশপাশের কেউ কেউ ছুটে আসে। টি. আমিন ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে।

কলিম, থাম থাম। ও ছেলে তো মরে যাবে!

ওর হাত থেকে রডটা টানাটানি করতে ব্যস্ত মোমেনা তার সাথে মিসেস টি. আমিনও। রক্তে ভেসে যায় ঘর। তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে টাকাপয়সা কিছু গহনা কিছু ডলার তার মাঝে হঠাৎ করেই পড়ে যায় রক্তাক্ত শরীরখানা মেঝেতে। কী বীভৎস সেই রক্তে মাখামাখি চেহারা! মায়ের প্রাণফাটা চিৎকার। বাবার বোবা দৃষ্টি। ছেলের নিথর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে কলিম। মোমেনা আছাড় কেটে কেটে কেঁদে ওঠে। মিসেস টি. আমিন হতবাক চেহারায় চেয়ে থাকে কষ্টে ওর বুক ফেটে যায়। কী নির্মম পরিণতি! এমন একটি দিনের অপেক্ষায় সে কি ছিল। ছেলে-মেয়েদের কথা শুনলে কি এমন দিন দেখতে হতো। দোষ কাকে দেবে? কে যেন পাশে এসে এক গ্লাস পানি দিল মিসেস টি. আমিনের হাতে। আরো একজন বলে উঠল, খালাম্মা আপনের কুত্তা দুইডাও মইর‌্যা পইড়্যা আছে বারান্দায়।

দুই চোখ গড়িয়ে পড়ল বুকের নির্যাসিত রক্তাক্ত জল। এক সাথে এতগুলো কষ্ট সহ্য করতে পারে না মিসেস টি. আমিন। অতি শোকে একেবারে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। কী সান্ত্বনা দেবে মোমেনাকে? কী সান্ত্বনা দেবে কলিমকে?

চারিদিকে হৈ চৈ। সেলফোন বাজছে টেলিফোন বাজছে। কেউ না কেউ তুলে ঘটনার বিবরণ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। কলিমও হাতের রডটা ছুড়ে ফেলে ছেলের নিথর দেহটার পাশে বসে পড়ে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে।

মিসেস টি. আমিন কেবল বিড়বিড় করে বলে, আমার জন্যই তুই তোর সন্তানকে বলি দিলি। আমি আর তোদের কষ্ট দেব না। চলে যাব যে দিকে দুচোখ যায়।

হু হু করে বাতাস কাঁদে। কাঁদে মনিব, কাঁদে ভৃত, কাঁদে পুরো বাড়ির ঝোপঝাড়। সব স্মৃতি আজ চোখের জলে ধুয়ে যায়। কেবল ছোপ ছোপ রক্তের বানে নিথর দেহটি বাস্তব হয়ে ওঠে চোখের বায়োস্কোপে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *