
ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বন্যার পানি। লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘরবাড়ি ছাড়ছে। জমা হচ্ছে বাঁধের উপর। যার ঝামেলা বেশি, গরু-বাছুর আছে সে খানিকটা অপেক্ষা করছে যদি পানি আর না বাড়ে। বাড়িঘর ছাড়তে চাইলেও সহজে ছাড়া যায় না, হাজারো ঝক্কি-ঝামেলা। বাঁধে গরু রাখা সমস্যা, খাওয়া দাওয়ার সমস্যা। ঘাসলতাপাতা কিছু থাকে না। যার ঝামেলা নেই সে হালকা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে বাঁধের উপর। পলিথিন, কলাপাতা দিয়ে কোনোমতে ছাপড়া তুলছে খোলা আকাশের নিচে। আশপাশে কোনো স্কুল-কলেজ নাই যেখানে মানুষ গিয়ে ঠাঁই নেবে। বন্যার সময় এই বাধঁই সম্বল। নয়তো তিন চার মাইল দূরে খোলাহাটি গ্রাম। সেখানে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া দুষ্কর।
হাসেন আলী লালু-কালু নামের ষাঁড় দুটি নিয়ে বড় চিন্তিত। লোন নিয়ে দুই বছর ধরে সে বড় করেছে কোরবানি ঈদের জন্য। ন্যায্য দাম পেলে গরু দুটা কম করে হলেও দুই আড়াই লাখ টাকার উপর বিক্রি হবে। এই টাকায় লোন শোধ করে দুইটা বাছুর কিনবে বড় করার জন্য। সেই সাথে মেরামত করবে তার ঘরদোর। সে ঠিক করেছে কাল রসুলপুরের হাটে তুলবে গরু। পাঁচ দশ হাজার কম হলেও ছেড়ে দেবে। এমনিতে করোনার আতংক তার উপর বন্যা, অবস্থা ভালো ঠেকছে না। ঈদের আগে দুইদিন মাত্র হাট। যেমন করেই হোক ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করা নাইগবেই।
হাসেনের গরু কয়েকজন দেখেও গেছে। দেড় লাখ, ষাট পর্যন্ত দাম উঠেছে। তার উপর কেউ বলেনি। তবে ঘাস খৈল খাওয়া দেশি গরুতে অনেকের আগ্রহ। চাহিদাও বেশি। প্রতিবছর শহর থেকে সাহেবরা এসে দাম বেশি দিয়ে হলেও দেশি গরু নিয়ে যায়।
ও পাড়ার কলিমুদ্দি সর্দার গরুর ব্যবসা করে। যতটা না ব্যবসা তার চেয়ে বেশি দালালি। লোকটা জুতের না। কথাবার্তায় বড় ফটফট করে, টাউট টাইপের।
সে গরুর গায়ে জোরে চাপড় দিয়ে বলে, যে হারে পানি বাইড়তেছে গরু নিয়া তো সমস্যায় পইড়বু মিয়া। এলাও গরু বেঁচিস নাই? পরে আম ছালা দুইটাই যাইবে। করোনায় বেছা কিনা তেমন নাই, ছাড়ি দ্যাও, পরে কিন্তু পস্তাবু।
—গরু ব্যাছের জন্য তো বড় করছু। নিয়া যাও না ক্যানে?
শুন, গরুর পাইকার বড় লাও নিয়া আইসছে, এক দুই ঘণ্টা থাইকবে। বাঁধের উপর গরুর অভাব নাই। যদি দেইস তো, বায়না করি যাও।
—কত?
—এক নাখ পঞ্চাশ।
—তোমার কি মাথা খারাপ হইছে ব্যাহে? দুই নাখ টাকার গরু দেড় নাখ!
—মোর মাথা নষ্ট হয় নাই। গরুর বাজার ড্যাম। করোনায় মাইনষের হাতোত পয়সা নাই, কাজকাম নাই, গরু কিনবে কী দিয়া? প্রত্যেকদিন টেরাকে টেরাকে মানুষ ঢাকা শহর ছাড়ি গ্রামোত আইসতেছ, দ্যাখো না?
যাউক ওলা কথা, তোমার কথাই সই। এই ষাইট দিনু, বলে কিছু খসখসে নোট গুজে দেয়ার চেষ্টা করে হাসেন মিয়ার হাতে।
হাসেন কিছুটা বিরক্ত হয়, বিব্রত হয়।
এইটা কী কও মিয়া? এই গরু এক নাখ ষাইট? হইবে না। মুই পাইম না।
কলিমুদ্দির কাণ্ড দেখে হোসেন মিয়ার ছেলে মনির হোসেন বলে, গরুর ঘাস কাইটতে কাইটতে হাতোত ছাল পড়ি গেইছে চাচা, তোমরা কন ষাইট হাজার?
—অত খোয়াব দেখিস না ভাতিজা। দ্যাশের পরিস্হিতি বুঝি কথা কও। করোনায় চাদ্দিকে কাজকাম নাই। বেচাকেনা থমকি আছে, পাইকার নাই, গরু কাঁয় কিনবে?
পাশেই দাঁড়ানো হাসেন আলীর বউ ছমিরন। গরুর দেকভাল ও রাত জেগে পাহারা দেওয়াতে শরীরের অবস্থা কংকালসার। তার শরীরে হাড্ডি গোনা যায়। নিজের ছেলের চেয়েও আদর যত্ন করে মোটাতাজা করেছে গরু দুটিকে। নিজে খেয়ে না খেয়ে ভাতের মাড়, ভুসি, ঘাস খাইয়ে বড় করেছে এই দুই বছর। গরু দুটার উপর ভাসছে তার স্বপ্নের নাও।
ছমিরন কলিমুদ্দির সামনে গিয়ে খাড়ায়। ঘাসের ডালিটা নিচে ফেলে দিয়ে বলে, ভাইছাব গরু কি সত্যই তোমরা কিনমেন?
—না নিলে এই পানি ভাঙ্গি আসছু?
—শোনেন, মোর কিন্তু ইনজেকশন দেওয়া গরু নোহায়, একনা টেবলেট, মেডিসিনের গন্ধও নাই। নিজে যা খাঁও ভাত মাড় খাওয়াইয়া গরুক পালছু। যদি নেঁও, নেওয়ার মতো দাম কন।
—গরু তোমার ভালো দেখি তো আইসছি ভাবিসাব। তো এমন গরু আরও আছে। এলা কথা হইলো, ম্যালা সময় নষ্ট কইরছি। দুইডা গরুই মুই নেইম, দাম পাইবেন এক পয়ষট্টি।
ছমিরন খেটে খাওয়া নারী। তার শরীরে স্পষ্ট কষ্টের নির্মম মানচিত্র। সে বলে, এই দামে টেবলেট খাওয়া গরুও তো পাইমেন না ভাইছাব।
—গত হাটের খবর পান নাই? শোনেন নাই কিছু? খামারিরা গরু নিয়া ফ্যা ফ্যা কইরা খাড়ে আছিলো। কালকে হাটে যায়া দ্যাখেন কী অবস্থা হয়।
—শোনেন হাটের কথা কওয়া যাইবে না। ঈদের আগত হাট জমে। এলা ওকনা কথা বাদ দেন। কামের কথায় আইসেন।
—তাইলে কামের কথাই কই। ব্যাটা মানুষের জবান, শ্যাস দাম সত্তর। এলা গরুর দড়ি ছাড়েন।
এমন সময় আরেক পার্টি এসে হাজির।
—গরুর দরদাম হয়ছে বুঝি? তা কত চাও হাসেন মিয়া?
হাসেন মিয়া বলে, হ্যাঁ দাম তো কয়ছে। তোমরাও কবার পান।
হাসেন মিয়া কলিমুদ্দির কাছে এসে বলে— ভাই, হাড় মাংস পানি করি বানাইছু এই গরু। যদি নব্বই পারো তাইলে গরু নিয়া যাইয়ো।
কলিমুদ্দি গরুর দড়ি ছেড়ে দেয়। যাবার সময় বলে, বড় ভুল করলু হাসেন মিয়া। বড় ভুল করলু। মোর শক মিঠি গেইছে। মুই এলা যাও।
গরুর দাম শুনে দ্বিতীয় পার্টি বলে, একেকটার বড়জোর সাড়ে তিন মণ মাংস হইবে। এক নাখ চাইলে হইবে মিয়া?
—এই আন্দাজ নিয়া গরুর পাইকারি করেন, ব্যাহে? একেকটা সাড়ে চাইর থাকি পাঁচমণের কাছে মাংস হইবে। বিশ্বাস না হইলে নেখি নাও।
বনিবনা না হওয়ায় দুই বেপারি একসাথে চলে যায়।
হাসেন মিয়া জানে এগুলো গরুর দালাল। গরু প্রতি কয়েক হাজার করে লাভ করে পাইকারের কাছে। এই গরু কেজি হিসাবে বিক্রি করলেও গরুর দাম একলাখ আশি হাজার নব্বই হয়। কাইল হাটত ফয়সালা হইবে গরুর আসল দাম।
লোকজন মাথায় করে, কলার ভেলায় করে জিনিসপত্র নিয়ে বাঁধে উঠছে। হাসেন মিয়াও সব কিছু বেঁধে রেডি করে রাখে। কালকে গরু বিক্রি করে নতুন বাছুর কিনে সেও উঠবে বাঁধে। দেরি হয়ে গেলে বাছুরেরও দাম বেড়ে যাবে। পানির উপর বিশ্বাস নাই। আকাশও গম্ভীর হয়ে আছে।
পরদিন হাটের অবস্থা দেখে হাসেন মিয়ার মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। গরুর তুলনায় কাস্টমারের সংখ্যা কম। ভয়ানক কম। বন্যার ভয়ে গাই বাছুর বলদ সমানে উঠেছে হাটে। প্রতিবার গরু নেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সারি সারি ট্রাক আসে এবার তেমন দেখা যায় না। ভিড়ভাট্টা মাঝারি। দরদামও দায়সারা। হাসেন আলীর মুখটা শুকিয়ে যায়। তার গরুর মতো আরও অনেক গেহস্থ তরতাজা গরু নিয়ে এসেছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা করে। ক্ষুধাও লেগেছে ভয়ানক। তার উপর একটা গরু উঠে আরেকটার উপর। শুরু করে ঢিসাঢিসি। হাসেন মিয়া হাঁপিয়ে ওঠে। এমন সময় একজন এসে টোকা দিয়ে যায়। হাসেন আলী হাত চেপে ধরলে এক বিশ বলে চলে যায়। আরেকজন কোনোমতে ঠেলেঠুলে পঁচিশ বলে।
হাসেন মিয়া ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গরম হয়ে ওঠে। মিয়ারা জানে না ভুসির বস্তা কত, খৈলের পাল্লা কত? কিন্তু কাস্টমারের সাথে রাগ করতে পারে না। কাস্টমার হলো লক্ষ্মী।
তার ছেলে মনির হাট ঘুরে এসেছে। ছোট ছোট বাছুরও উঠেছে অনেক। দাম সস্তাই। পঞ্চাশ ষাট হলে ভালো একজোড়া ষাড় বাছুর কেনা যাবে। কিন্তু গরুই তো বিক্রি হয়নি, বাছুর কিনবে কী দিয়ে? যদি হাট থেকে কিনতে না পারে তাহলে বাঁধের উপর দুইটা আছে সেটাই কেনা যাবে।
পায়ে হেঁটে, পানি ভেঙে বাপ-বেটায় গরু নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বাজে। বাঁধে এসে দাঁড়াতে বুকটা কেঁপে ওঠে। আশপাশের অনেক শুকনা জায়গায় পানি উঠেছে। সকালে তো শুকনা ছিল, এত পানি কোত্থেকে আইসলো? এখন কী উপায়? গরু নিয়া তো বাড়ি যাওয়া নিরাপদ না। আরও পানি বাড়লে সর্বনাশ হয়া যাইবে। হাসেন মিয়া ঠিক করে গরু বাঁধেই রাখবে। এলা খালি ছমিরনকে যায়া নিয়া আইসতে হইবে।
হাসেন মিয়া গরু বাঁধার জন্য খুটি খুঁজতে থাকে। অন্ধকারে এর ওর ছাউনিতে খোঁজ করে। কয়েক কদম এগুতে দেখে কুপি হাতে এগিয়ে আসছে ছমিরন। সে জানে তারা এই বাঁধ দিয়েই আসবে।
গরু দেখে ছমিরন হতাশ হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে। বিষণ্ন গলায় বলে, তোমরা আইছেন? গরু ব্যাছের পারেন নাই?
ক্যামন করি বেচিম? এক নাখ বিশ ত্রিশ কয়। তাও আর ঘুরি আইসে না। ক্যামন করি বেচো? জীবন পানি করা গরু।
—এলা কী হইবে?
—প্রত্যেকবার কত টেরাক আইসে, শহর থাকি সাহেবরা আইসে, এবার কিচ্ছু নাই। হাতে গোনা গাহাক।
—তাইলে এলা কী কইরমেন? কাইল তো শ্যাস হাট?
—আল্লাহই জানে। কালকে আল্লাহ যদি মুখ তুলে চায় তো হইবে।
—কলিমুদ্দিকে খুঁজি বাইর করা যায় না বাবা? ছেলে মনির হোসেন বলে।
—বাবারে কলিমুদ্দিরা ঝানু ব্যবসায়ী। সেকি আর আগের দাম কইবে? সে হাটের দাম দেইখছে না? তারপরও যদি চোখে পড়ে পুছি দেখিস। যাউক, অত চিন্তা করিস না। উপরে একজন আছে। তা, মনিরের মা, তুই কখন এইঠে উঠছিস? জিনিসপত্র আনতে পারছিস কিছু? ক্লান্ত কণ্ঠে হোসেন মিয়া জিজ্ঞেস করে।
ছমিরনের মুখে কোনো কথা নেই। জিনিসপত্র আনতে যে ধকল গেছে তারচেয়ে বেশি ধকল গরু বিক্রি না হওয়াতে। সে যেন পাথর হয়ে গেছে। যে আবাদ করেছিল সউগ পানির তলে ডুবি গেইছে। পুষ্কিরিনীর মাছও ভাসি গেইছে। এলা কী হইবে? কালকে হাটোত কী হয় আল্লাহই জানে।
হাসেন মিয়া একটু এগিয়ে দেখে সংসারের প্রায় সবকিছু ছমিরন এনে জড়ো করেছে। হালকা করে একটা টিনের চালও ছাপড়া করে বেঁধেছে। শুকনা খড়ি, হাঁস-মুরগি সব নিয়ে এসেছে একাই। তার আশপাশে গাদাগাদি করে আরও কত পরিবার। গরু বাছুর গোবর— একাকার। সবার জিনিসপত্র এলোমেলো, আগোছাল। হোসেন মিয়া হাত মুখ ধুয়ে বলে, খাওনের কিছু আছে?
ছমিরন গরু দুটিকে কিছু ঘাস পাতা খেতে দেয়। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে তিনজনে খেতে বসে, সাদামাটা খিচুড়ি। কিন্তু, ছমিরনের ভেতর যেন খাবার নামে না।
উপরে খোলা আকাশ। চারিদিক মেঘে ঢাকা। বাঁধের দু’পাশে জলের মাতামাতি। ভেঙ্গেচুরে ছুটছে ভাটির দিকে। ছমিরনের ভাগ্যও যেন ভেঙে ভেঙে ছুটছে ঐ জলের তোড়ে। ছমিরন ভাবে, এত পানি কোন্ঠে থাকি আইসে! একমাস আগেও আছিলো শুকনা ঠনঠনা, আর এলা সয়লাব। আল্লাহর কী লীলাখেলা!
তিনজনই ক্লান্ত। গাদাগাদি করে শুইতেই নিঃসাড় হয়ে পড়ে গভীর ঘুমে।
লোকজনের চেঁচামেচিতে সকাল সকাল সবার ঘুম ভেঙে যায়। পানি আরও বেড়েছে। লোকজন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। যে কোনো সময় নামতে পারে আকাশ। তখন বেড়ে যাবে আরও দুর্গতি। বাঁধের দুই এক জায়গায় হালকা ফাটল দেখা দিয়েছে। মুরব্বি আমজাদ সর্দার লোকজন নিয়ে একজোট হয়ে তা মেরামত করেছে। তবে পানি যদি বাড়ে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মনির দেখে একদিনেই গরুর পেট পড়ে গেছে। রাতে পেটে তেমন কিছু পড়েনি। এখন এই পড়া পেট নিয়ে হাটে গেলে দাম আরও কমে যাবে। সে বাঁধের উপর এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে কিছু খড় নিয়ে আসে। বালতি নিয়ে দৌড়ায় কারও কাছে ভাতের মাড় পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু জোগাড় হয় না। এই বন্যায় কে কার মাড় দেবে, নিজেই তো খেয়ে ফেলে।
দূরে একটা নৌকা এগিয়ে আসতে দেখা যায়। বাঁধের লোকজন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ত্রাণের নৌকা।
সবাই জড়ো হয় এক জায়গায়। যতই কাছে আসে ততই বেড়ে যায় প্রত্যাশা। শেষে স্বপ্নভঙ্গ হয়। ওরা এসেছে পর্যবেক্ষণ করতে, দূর দিয়ে চলে যায় নৌকা।
একটু বেলা হতে আল্লাহর নাম নিয়ে হাসেন আলী মনিরকে নিয়ে সকাল সকাল বের হয় গরু নিয়ে। আশপাশের আরও কয়েকজনের গরু অবিক্রীত। সবাই বের হয়েছে। গ্রামের বয়স্ক মুরব্বি আমজাদ শেখ জোরে জোরে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, দাম যাই উঠুক গরু ছাড়ি দিমেন ব্যাহে। কপালের উপর কারও হাত নাই। বন্যার পানি কিন্তু আরও বাইরবে। জান বাঁচাইমেন না গরু বাঁচাইমেন? গরু ফেরত আইনমেন না যেন। যাও আল্লাহ ভরসা।
গরুর গতি শ্লথ। পা যেন চলতে চায় না। গরু কি বুঝতে পারে কালকে আর আসা হবে না এই জনপদে? সে কি টের পায় তার খাওয়া শেষ হয়ে আসছে?
কে জানে। তবে কালকে পাঁচ ছয় মাইল হেঁটে লালু-কালু অনেকটাই নিস্তেজ। আজ প্রায় অভুক্ত পেটে আবার শুরু হয়েছে পথচলা। কখনো পানি কখনো শুকনা দিয়ে হাঁটতে হবে কয়েক মাইল। তারপর উপজেলার হাট। পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা দুইটা বাজবে।
গরুর হাটের এই সমস্যা, বোঝার উপায় নেই কোনো বছর খামারিরা হাসবে, কোনো বছর ক্রেতা কাঁদবে।
ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে পালা করে চলে এই জোয়ার-ভাটা, ভাগ্যের উত্থানপতন।
হাটে পা দিতেই বোঝা যায় হাটের নাড়িনক্ষত্র, হাটের ধারাবাহিক অবস্থা বড় করুণ। কালকে যে দাম উঠেছিল আজকে তার ধস নেমেছে। হাটজুড়ে হাহাকার। কাস্টমার নেই, পাইকার নেই। কিছু দালাল আছে তারা যেন আজ জমিদারপুত্র। দায়সারা ভাব। মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে বেড়ায় এ গরু সে গরু। এই দামে দিলে দাও না হয় চল।
যারা উঁচু জায়গা থেকে এসেছে তারা জলের দামে গরু না বেচে ফেরত নেওয়ার পক্ষপাতী। কসাইয়ের কাছে বেচলেও এর চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাবে।
বন্যাক্রান্ত খামারিরা চোখে অন্ধকার দেখে। তাদের না বেঁচে উপায় নেই। এই বন্যায় জীবন নিয়ে টানাটানি, গরু কোথায় রাখবে। বান বাড়লে গরু ভেসে যাবে। তারা বোবা হয়ে গেছে। পাথর হয়ে গেছে। গরু প্রতি তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা লস।
হাসেন আলী গরু নিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের নিচে মাটি আলগা হয়ে গেছে। তার গরু জোড়া এক লাফে এক সত্তর থেকে এক লাখে নেমে এসেছে। আরও দেরি করলে যেন আরও নিচে নেমে যাবে।
এ কোন লীলাখেলা! এ কোন রঙ্গ! গরুর খুঁত নেই, রোগবালাই নেই, গরু যেন আজ বড় বিড়ম্বনা, খামারীর গলার ফাঁস।
বিকেল হয়ে আসছে। সন্ধ্যার পরে আরও কমে যাবে বেচাকেনা। আলো-আঁধারিতে গরু তেমন বোঝা যায় না। কাস্টমার উল্টাসিধা দাম হাঁকায়। হাসেন আলীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। পেটে এমনিতে ক্ষুধা তার উপর দুশ্চিন্তা। চোখে অন্ধকার দেখে। এমন সময় দূরে দেখতে পায় কলিমুদ্দিকে। সে প্রজাপতির মতো ছুটাছুটি করে দাম হাঁকছে।
হাসেন মিয়া পাগলের মতো ছুটে যায় তার কাছে। তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে গরুর কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে— ভাই, গরু দুইটা তোমরা নিয়া যাও। দাম যা দেওয়ার দেও, তাও গরু নিয়া যাও।
কলিমুদ্দিন বরাবরই ধুরন্ধর। পকেটে হয়তো ভালোই মালপানি পড়েছে। সে হাসতে হাসতে বলে, সেই পাইকার তো টেরাক ভরি গরু নিয়া গেইছে। আইজ আইসছে আরেক পাইকার। হেয় তো হাটের খবর দেইখতেছে। তোমার গরু আর কয় টাকা হইবে?
কলিমুদ্দির তাচ্ছিল্য হাসেন গায়ে মাখে না। সে কলিমুদ্দির হাত চেপে ধরে। কাতর চোখে তাকায়। রাজা আর প্রজার ভূমিকায় যেন আজ ক্রেতা আর বিক্রেতা।
কিছুক্ষণ গরু দুটিকে হাতিয়ে কলিমুদ্দি হাসেন আলীকে দয়া করে, উদ্ধার করে এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে। সে গরু নিতে রাজি হয়। ভেবে-চিন্তে বলে, নব্বই হাজারে দিবু?
হাসেন আলীর করুণার্ত চোখে মুহূর্তে আগুন জ্বলে ওঠে। রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মুখে কিছু বলতে পারে না। মানুষ কি সউগ অমানুষ হয়া গেইছে? চক্ষু নজ্জা বলি কিছু নাই? ক্যামন করি এই দাম কয়?
দাম শুনে মনিরও আর সহ্য করতে পারে না। সে চিৎকার করে বলে, গরুক কাটি গাঙোত ভাসে দেইম তাও এই দামোত বেচিম না। গরু পুষি পালি হামরা যেন বড় অন্যায় করি ফেলাইছি। হামরা যেনো আইজ পানিত পড়ি গেইছি। চলো, গরু নিয়া বাড়ি যাই। এইঠে খাড়ায় খাড়ায় আর নাটক কইরবার দরকার নাই।
বাবা ছেলেকে শান্ত করে। বোঝায়, তারা পরিস্থিতির শিকার। কী করার আছে ধৈর্য না ধরে? নিশ্চয়ই আল্লাহ মুখ তুলে চাইবে।
দিনের আলো ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে আসছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে হাসেন আলীর মতো অসহায় খামারিরা। সবাই চোখে অন্ধকার দেখে। বিভীষিকা দেখে। তারউপর হঠাৎ শুরু হয় অঝোর বৃষ্টি। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। একজন পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, আল্লাহ হামাক কি মারি ফেলাবু? হামরা কি না খায়া মরি যাইম? এ ক্যামন বিচার তোমার! হামার কি জীবন নাই, ঈদ নাই?
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে খামারিরা। কেউ মাটিতে শুয়ে পড়ে। কেউ গরুর গলা ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। অবোধ পশু বোঝে না মালিকের এই অসহায়ত্ব, এ বোবা কান্না।
বৃষ্টি থেমে গেলে একজন এসে হাসেন আলীর গরু দেখা দেখি শুরু করে। জিজ্ঞেস করে একটার দাম কত? হাসেন আলী তার হাত ধরে বলে, ভাইজান হামরা আর কী দাম চাইম। হামার সউগ শ্যাষ। অন্য সময় চোউক বুঝি একটার দাম এক লাখ বিশ বাইশ হইতো। এলা কপাল ভাঙি খানখান হইয়া গেইছে। লোন নিয়া গরু বড় করছি। আল্লাহর কসম একনা মিথ্যা কথা নোহায়। কোনো টেবলেট ছুঁয়েও দ্যাখোনি। তোমরা এলা বিবেচনা করি একনা দাম কয়া গরু নিয়া যাও।
হোসেন আলীর কথা যেন ক্রেতাকে স্পর্শ করে। সে অন্য কোনোদিকে না তাকিয়ে পয়ষট্টি হাজার টাকায় লালুকে নিয়ে যায়।
একটা বিক্রি করতে পেরে হাসেন আলী কিঞ্চিত দম ফিরে পায়। ক্ষতি যা হইবার হইছে, করার কিছু নাই। যদি কালুকে একনা বেশি দামে বেচা যায় তাহইলেও বাঁচি থাকা যাইবে।
রাত হয়ে গেছে। হাঁট আরও নিঃস্ব, নির্জীব হয়ে পড়েছে। মেঘ চমকাচ্ছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। কাস্টমার নেই। অনেকে গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হাসেন আলী ছটফট করতে থাকে। কী করবে এখন? এই গরু ক্যামনে ফেরত নেবে? কোথায় গরু রাখবে, কী খাওয়াবে? হাসেন আলী উপরে হাত তুলে দোয়া করতে থাকে, মালিক দয়া কর। মালিক রহম কর।
শেষপর্যন্ত মুখে মাস্ক পরে একজন এসে হাজির হয় কালুর কাছে। কাদা গোবর দেখে তার সঙ্গের ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসেন আলী মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালায়। একটু বেশি দামে বেচতে পারে কিনা। ক্রেতা পঁয়ষট্টি হাজারের উপরে উঠতে নারাজ। কারণ সে দেখেছে আগেরটা পঁয়ষট্টি হাজারে বিক্রি হয়েছে।
হোসেন আলী যুক্তিতে হেরে যায়। একই জোড়ার গরু পঁয়ষট্টির উপরে চাওয়ার তার অধিকার নেই। তাদের এই দরাদরি দেখে লম্বা চুলওয়ালা মাস্ক পরা ভদ্রলোক কাদা এড়িয়ে কষ্ট করে গরুর কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখে বোঝা যায় ওজনদার লোক। বড়লোক। জিজ্ঞেস করে, কী সমস্যা?
—স্যার, একি জোড়ার গরু পঁয়ষট্টি হাজারে একটু আগে একটা বিক্রি করেছে এখন সে সেই দামে ছাড়বে না।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করে, কী নাম তোমার?
—স্যার, হাসেন আলী।
—একই গরু দুই দাম কেন? এটা তো কোরবানির নিয়ম না। দিল পরিষ্কার না হলে কোরবানি দেওয়া নেওয়া করে কী লাভ? কোরবানিতে নয়-ছয় ঠিক নয়।
এক কথায় হাসেন আলী কাবু হয়ে যায়। সে কাচুমাচু করতে থাকে। কিন্তু বলতে পারে না তার অসহায়ত্বের কথা।
—শোনো আমি হোটেল ব্যবসা করি। আমি আরও একটা গরু কিনেছি। এই গরুতে কত কেজি মাংস হবে আমি বলে দিতে পারব। এককেজি এদিক ওদিক হবে না ইনশাল্লাহ। ও তো দশ হাজার বেশি বলেছে। এখন বেচা-কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কাস্টমার নেই। ভালোটা পঁয়ষট্টি হাজারে বিক্রি করেছ, এটা পঞ্চান্নর একটাকা বেশি হবে না। পঞ্চান্ন হলে দাও না হলে অন্য গরু দেখি। বাজারে এখনো যথেষ্ট গরু আছে।
এই কথা বলে সে তার কাজের লোকটাকে জোরে ধমক দেয়, কোন গরুর কত দাম বোঝ না?
হাটে আর কাস্টমার নেই বললে চলে। এমনিতে করোনাভীতি তার উপর অনিশ্চিত সময়— হাট প্রায় জনশূন্য। তবুও কেউ গরু নিয়ে এখনো বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছে। যদি দেবদূতের মতো আসে কোনো কাস্টমার। কেউবা চলে যাচ্ছে। দ্রুত ভাঙছে হাট। হাসেন মিয়ার মাথা ঘুরছে।
লোকটা চলে যেতে উদ্যত হলে মনির খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে— স্যার, গরু দুইটার দাম দুই লাখ বিশ হাজার ছিলো। লোন নিয়া গরু কিনেছি। এখনো ব্যাংকে ষাট হাজার টাকা লোন আছে। দুই বছর ভুসি ভাত খাওয়ায় গরু বড় করেছি। উপরে আল্লাহ নিচে এই অধম বাপ-বেটা, গরুকে কোনো টেবলেট খাওয়াই নাই। আল্লাহ আমাদের কপালে যা লিখছে তাই হবে। আপনি গরু নিয়া যান।
—তাহলে পঞ্চান্নই ফাইনাল?
উত্তরে মনির, হাসেন আলী নিরুত্তর থাকে। তারা বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে। কী বলার আছে। তারা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে।
এই তুমি গরু নিয়ে বাসায় যাও। আমি হাসিলের কাছে যাচ্ছি। সাবধানে যাবে। ভদ্রলোক বলে।
হাসেন আর মনির বিধ্বস্ত হয়ে ভদ্রলোকের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। তাদের পা আর চলে না। হাসেন মিয়া যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। চোখের সামনে দশ হাজার টাকা মেরে দিল। আল্লাহ তুমি এইসব বড়লোকের বিচার কইরো।
লোকটি হাঁটতে হাঁটতে মনিরকে জিজ্ঞেস করে— তুমি কী করো? খালি কি গরু পালো?
পিশাচ লোকটার সাথে মনিরের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এইসব টাউট বাটপাররা গরিব মানুষকে জোঁকের মতো শোষণ করে এইভাবে বড়লোক হয়।
—কই বললে না কী করো?
—কিছু বলছেন?
—কিছু করো নাকি?
—কলেজে ডিগ্রিতে পড়ি। বন্যায় বইপত্র সব ভেসে গেছে। বাধ্য হয়ে মনির উত্তর দেয়।
—ভেরি স্যাড।
হাসিলের কাছে কোনো ভিড় নেই। সারাদিনের হৈচৈ শেষে নেমে এসেছে নীরবতা। এবারের মতো যবনিকা পড়ছে হাটের। আবার সামনের বার শুরু হবে হৈচৈ, আনন্দ বেদনার কাব্য।
চলবে দরাদরি, বাদানুবাদ।
হয়তো কেউ টাকার অংকে জিতবে কেউ ঠকবে তবে হাসবে একজন— সে উপরওয়ালা।
হাসিলওয়ালা জিজ্ঞেস করে— গরু বিক্রেতার নাম কী?
—হাসেন আলী।
—গ্রাম?
—অসুরখাই।
—ক্রেতা?
—নওরোজ হাসান চৌধুরী।
—বাড়ি?
—রানাভোলা, ঢাকা।
—গরুর দাম?
কিছুক্ষণ নীরবতা। ভদ্রলোক কিছু বলে না।
হাসিলওয়ালা আবার বলে, বলেন না কেন? গরুর দাম কত?
কেউ কিছু বলে না।
—গরুর দাম কত, গরু কত টাকায় বেচাকেনা হইছে? তাড়াতাড়ি কন।
—পঁয়ষট্টি হাজার। মনির উত্তর দেয়।
—ও ভুল বলছে। পঁয়ষট্টি নয়। এর দাম নব্বই হাজার। ভদ্রলোক সংশোধন করে দেন।
হাসেন আলী, মনির দুজনে চমকে ওঠে। ভুল হচ্ছে তো।
মনির বলে, স্যার ভুল বলছেন তো।
—ভুল বলি নাই। এই গরুর দাম পঁয়ষট্টি হতে পারে না, এটাই ন্যায্য দাম।
ভদ্রলোক হাসেন মিয়ার হাতে নব্বই হাজার টাকা গুনে দেন। তারপর হনহন করে হাটতে থাকেন গাড়ির দিকে। কিছুদূর গিয়ে কী মনে করে আবার থমকে দাঁড়ান। তারপর মনিরের হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেন, দরকার মনে করলে দেখা কোরো।
লোকটি দ্রুত চলে যাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি আসবে। হাসেন মিয়া আর মনির তার দিকে বিহৃবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবিশ্বাস্য। তারা বাপ বেটায় হু হু করে কাঁদতে থাকে। আনন্দ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। একসময় দেখে ভিড়ে মিশে গেছে লোকটি।
এরপর হঠাৎ করে কারেন্ট চলে আসে। তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, চমক ভাঙে। দেখে লোকটি আর নেই, চলে গেছে।
শুরু হয় বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। সব ময়লা আবর্জনা ভেসে চলেছে বৃষ্টির তোড়ে। ওরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ওদের শরীর থেকে মুছে যেতে থাকে ক্লান্তি, আক্ষেপ আর হতাশা।
তারপর বৃষ্টির মধ্যে তারা হাঁটতে থাকে বাঁধের দিকে— যেখানে অপেক্ষা করে আছে একজন।