অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুস্মিতা পাল -
ক্যাসুরিনা

প্রথমে শুক্তির মনে হয়েছিল, তফাতটা শুধু রঙের। মা অতটা কালো নয় তো। ভোরের অল্প আলোটুকু যেন ঘষা কাচের ওপার থেকে চোখ মেলে দেখার মতো সামনে একটা অস্পষ্ট পর্দা ফেলে রেখেছে। সামনের ধূধূ জল যেন রাতের ঘুম ভেঙে এখনো চুপ করে শুয়ে আর একটু আরাম করে নিচ্ছে। এরপর সারাদিন দৌড়তে হবে তো! ঠিক শুক্তির মায়ের মতো। মুচকি হাসে শুক্তি, দূরে হালকা কালচে ছাই রঙের প্রায় সমতল জল যেন মায়ের একফালি কপাল। ওখানে, ঠিক মধ্যিখানটায় এক্ষুনি একটা মস্ত বড় গোল লাল সিঁদুরের টিপ দেখা দেবে, সেটা ঐ দশ বছরে ভালো মতোই জানত সে। শুধু স্থির হয়ে বেশিক্ষণ নজর করা, ধুত, ধাতে সয় নাকি! সে বলে প্রত্থমবার সমুদ্দুর দেখতে এসেছে। সে হলোই না-হয় ছোটখাটো একটা জায়গা। সমুদ্র তো সবখানেই নীল।

‘কী রে শুকু, একা একা কখন এলি?’ লায়লা দিদি পিঠে চড়টা একটু জোরেই মেরেছিল।

‘আ!’ ব্যথাটা সামলাতে গিয়ে একটু থমকে গেল শুক্তি।

‘কী এত দেখিস রে? সারাদিন হাঁ করে তাকিয়ে থাকিস কেন? আমার তো স্নান করতেই শুধু ইচ্ছে করে। কেমন হাবুডুবু স্নান।’

লায়লাটা এমনই। শুক্তির উল্টো ধাঁচের। বড্ড হৈচৈ ভালোবাসে। জেঠতুতো দিদি বলে ভয়ভক্তি করবে কী, শুক্তি বরং বুদ্ধিবিবেচনায় ওর দশ গুণ সরেস। সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল লায়লা আর পিসির ছেলে টোনিদা। তারপর সবাই মিলে ফ্যামিলি ট্যুর। দূর দূর সমুদ্দুর, কোথায় যাবি? চাঁদিপুর।
টোনিদাদা টেবিলে তাল দিতে দিতে এই কথাগুলো বলত, সুর করে। ভাইবোনেরা গলা মেলাত। এখনকার লায়লা ভাবতেও পারবে না বোধহয়। গুরগাঁওতে শৌনকদার সঙ্গে বেশ আছে। পার্টি, শপিং, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ হুল্লোড়। বাচ্চাকাচ্চা নেই, কোনো সমস্যা আছে কিনা কে জানে! কথাই হয় কালেভদ্রে।
শুক্তি বড্ড লাজুক, বড় নরম। স্কুলে, পাড়ায়— সব জায়গায় অন্যরা আঁচড় কেটে যায়। তার দাগ চোখে দেখা যায় না, মনে মনে ব্যথায় ভারি হতে থাকে। নিজের সঙ্গে আরও একা হতে থাকে শুক্তি। ঝিনুকের মতোই চারপাশে গম্ভীর একটা খোলস তৈরি করতে থাকে। সবাই ভাবে মেয়েটা কেমন যেন, বড় বেশি শান্ত।
‘শুকু, শুকপাখি, আয় না ঢেউয়ের সঙ্গে ছুটি।’

যায় না সে, জলকন্যে হতে সাধ হয় না তার। তার চেয়ে ভালো তীরে বসে দূরে খেলনার মতো নৌকাগুলো ভাসতে দেখা। আর রাতে ঢেউয়ের চূড়ায় সফেন আলোর কারিকুরি।
শুক্তির চোখের তারায় নীল সমুদ্র নিজেকে দেখতে গিয়ে হারিয়ে যায়। নাকি শুক্তিকেই ভাসিয়ে নিয়ে সাত সাগরের পারে মুনস্টোন বিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। ভাবলেই অবাক লাগে, সমুদ্র দেখবে বলে বাবা-মাকে কত বিরক্ত করত ছোটবেলায়, আর এখন জীবন তাকে এনে ফেলেছে সমুদ্রতীরের শহরে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ায় শুক্তি। প্রাচীনতা তাকে টানে, পাথর কথা বলে তার সঙ্গে। ফেলে আসা অতীতের নীরবতার অমোঘ টানে বাঁধা পড়ে আছে সেই কোন কাল থেকে। তাই বোধহয় চাঁদিপুর বেড়াতে গিয়ে মূর্তিটা তার চোখ টেনেছিল।

পাথরের ছোট মূর্তি, সবটা যে নিখুঁত, তাও নয়। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির দেখতে যাওয়া হয়েছিল সেদিন।
দুধারে গাছ আর দূরে পাহাড়। মাঝে রাস্তায় ছুটে চলেছে গাড়ি। মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছনোর জন্য দুশো ষাটটা সিঁড়ি উঠতে হবে শুনে বড়দের কপালে ভাঁজ আর ছোটদের লাফ দিতে দিতে ধাপ টপকানো। কথা কম বললেও মজা তো কম পেত না শুক্তি। তাছাড়া, প্রাচীন মন্দির, দেবতা, প্রাসাদ মানেই বুঁদ হয়ে দেখত সে। কী যে এক আকর্ষণ! এই মন্দিরটাই দ্যাখো। পাঁচ পাঁচটা শিবলিঙ্গ, ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে জলের তলায়। ভাগ্য ভালো হলে উঁকি দিয়ে দেখা দেবে, নয়তো পেন্নাম ঠুকে বাদবাকি যা আছে, দেখে শুনে বিদেয় হও। তা মহাদেব দয়া করলেন। পুজো দেওয়া হলো। মা, পিসি, জেম্মা আবার সুতো বাঁধলেন মানত করে। ফিরে আবার ছোটরা সব ছুটল সমুদ্রের পাড়ে। আজ একটু অন্যদিকে এসেছিল ওরা। ছোটো কয়েকটা বালিয়াড়ি মাথা তুলে সমুদ্রের সঙ্গে চোখাচোখি করার মিথ্যে চেষ্টা করছে। সামনে অনেকগুলো ক্যাসুরিনা গাছ দল বেঁধে ওদের পাহারা দিচ্ছে যেন। চাঁদিপুরের সমুদ্র মাঝে মাঝে পালায়। পিছু হটতে হটতে হঠাৎ নজরের আড়ালে।তারপর তুমি যখন দিশাহারা হয়ে খুঁজছো, চোখে জল এলো বলে, তখন আবার ফিরে আসে দৌড়ে। তেমনি একটা ঢেউ হঠাৎই ছুটে আসে চুপচুপে ভিজিয়ে দেবে বলে। দৌড় দেয় শুক্তি, কী যেন একটা ভাসিয়ে এনে ফেলে রেখে গেল না ঢেউগুলো! নাকি কাঁকড়া? এই সৈকতে যেখানে সেখানে লাল চাদর বিছানো থাকে। সামনে এগোলেই বালির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় আবার। কী মজা না? আসলে সব লাল কাঁকড়ার দল। লুকোচুরি খেলে।

জিনিসটা তুলে নেয় শুক্তি। হাতের তেলোয় নিয়ে দেখে ভালো করে। ছোট মূর্তি একটা, পাথরের। বড় চেনা লাগে ওর। ইতিহাস বইতে দেখা মহেঞ্জোদারোর সেই নারীমূর্তির মতো কিছুটা। কোমর, হাতে গয়নার আবরণ। অদ্ভুত শুধু হাত দুটো। বলা ভালো, হাতের আঙুলগুলো। গোড়া থেকে ভাঙা। অসমান, ছোট-বড়। কিন্তু পুরোপুরি একটাও অক্ষত নেই। কত পুতুল আছে তার। ছোট মাসি তো লন্ডন থেকে দেশে এলে প্রতিবার একটা করে নতুন ধরনের ডল আনে। তবু কী যেন একটা আছে এটাতে। টান এড়াতে পারেনি সে। হোটেলে ফিরে ব্যাগে লুকিয়ে রাখে। মা জানলে বকা দিত নির্ঘাত। চলে এল ক্যাসুরিনার তলায় পাওয়া আদ্যিকালের মূর্তি ট্রেনে চেপে কলকাতায়। পুতুলের বাক্সে জায়গা পেল। যখনই নাড়াচাড়া করত, কেমন যেন আবিষ্ট বোধ করত শুক্তি। অমন ভাঙা, পুরোনো— তাও কেন যেন মনে হতো, দেখতে পেলে কেউ হয়তো নিয়ে নেবে। ফেলেই দেবে। বাড়তি যত্ন নিয়েই গোপন রাখত। দুবছর পরে জন্মদিনে বাবার বন্ধু অরূপকাকু একটা বই উপহার দিল। ‘মিথিক্যাল স্টোরিজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখ আটকালো ছবিটায়। ইন্যুট সভ্যতার আদি দেবী সেডনা। তাড়াতাড়ি গল্পটা পড়তে থাকে শুক্তি। সে এক করুণ আখ্যান। সৃষ্টিকর্তা আঙ্গুটার কন্যা সেডনা, জন্ম থেকেই তার রাক্ষুসে খিদে। পেটে যেন দিনরাত রাবণের চিতা জ্বলছে। বাবা-মা অস্থির মেয়ের খাবার জোগান দিতে দিতে। বাবা চললেন মেয়েকে নিয়ে সাগরে। ফেলে দিলেন জলে। মরিয়া হয়ে সেডনা কায়াক-নৌকার ধারের কাঠ আঁকড়ে ধরে। আঙ্গুটা মেয়ের হাতে কোপ মারে, কাটা যায় দশ আঙ্গুল। ডুবে যায় সেডনা, তলিয়ে যায় পাতালে। পাতালের রাণী হয় সে, তার কাটা আঙ্গুলেরা তিমি, হাঙর, অক্টোপাস হয়ে ঘুরে বেড়ায় সমুদ্রে। কেমন যেন স্থির বিশ্বাস জন্মাল শুক্তির, পাতাল থেকে সেডনা-ই এসেছেন তার কাছে। সমুদ্রের অতল অন্ধকার কি ভালো লাগে মেয়েটার? আহা রে বেচারা! নিজের বাবা না কসাই? আঙ্গুলগুলো কেটে দিল! আয় রে মেয়ে, আমার বুকে থাক। তুই আমার ক্যাসুরিনা, সাগরতীরের ধন।

শুক্তির মনে হল, তার তো তেমন বন্ধু কেউ নেই। মনের কথা মনেই গুমরোয়। লায়লাদিদি, টোনিদাদা কেমন সবার সঙ্গে গল্প জমায়। আর সে? মা চুলে তেল মাখিয়ে দেয় বিলি টেনে টেনে— ‘কী এত ভাবিস রে? না বললে কথারা মরে যায়। যাকে বিশ্বাস করিস, ভালো লাগে, তাকে বলবি। তোর কষ্ট, দুঃখ, আনন্দ সব কিছু।’ হেসে মাকে জড়িয়ে ধরত শুক্তি। তবে এখন দিব্যি কথা বলে সে। হাসিমুখে স্টুডেন্টদের, কলিগদের সঙ্গে। আর ক্যাসুরিনার সঙ্গে। সে আজও আছে শুক্তির বাক্সে। তেমন তেমন দিনে বের করে। ও জানে, ক্যাসুরিনা ঠিক কোনো না কোনো উপায় করবে। ও শুক্তির মুসকিল আসান। লায়লা দিদির কথাই ধরো না কেন! কার অ্যাকসিডেন্টে বিয়ের দু মাস আগে হবু বর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে কী অবস্থা হতে পারে মেয়েটার? অমন চনমনে মেয়েটাকে যেন ভূতে পেল। সারা বাড়ি মুহ্যমান। কত কিছু কেনাকাটাও হয়ে গিয়েছিল। কে কাকে সান্ত্বনা দেয়! দেখেশুনে শুক্তিও কাঁদো কাঁদো মুখে ক্যাসুরিনাকে বলেছিল সুরাহা করতে। এত বুদ্ধি-বিবেচনা তার, কিন্তু এই এক অন্ধবিশ্বাস— ক্যাসুরিনা গাছের শিকড় যেন, কঠিন আর অনেক গভীর। যদিও বলেছিল নিজের মন হালকা করতে। কারও ক্ষতি তো করছে না, আর তা বলে সবসময়ই যে কিছু নিজের জন্য চাইছে, তাও নয়। কিন্তু কিমাশ্চর্যম। এক মাসের মধ্যে চাকরি জয়েন করে দিল্লি চলে গেল লায়লা। পালাল বলা ভালো, দমবন্ধ কষ্ট, আত্মীয়স্বজনের অযাচিত আহা-উহুর হাত থেকে বাঁচতে। সেখানেই শৌনকের সঙ্গে আলাপ, তারপর এখন দুটিতে জুটি বেঁধে কেমন সংসার করছে।

সেই থেকে শুক্তি জানে, ক্যাসুরিনা সুরাহা করবে। অন্যরা যাই বলুক, তার দশ আঙ্গুলের অক্টোপাস সব বিপদ-আপদকে গিলে নেবে, যদি শুক্তি চায়। ক্যাসুরনা শুক্তির বন্ধু, একমাত্র, গভীর গোপন। সেই তো নিয়ে এল এতদূরে আর এক সাগরপারে। নয় নয় করে তিন বছর কেটেও তো গেল। ভালো আছে শুক্তি, নিজের একটা আস্তানা হলে মা-বাবাকে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে দেখানোর একটা ইচ্ছেও আছে। এখানে সবকিছু, সবাই এত খোলামেলা, অন্যরকম যে ও নিজেও একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে, বুঝতে পারে। নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখা ভুল। এত আলো, হাসি, আনন্দ ছড়িয়ে আছে— নিজেকে মেলে ধরার অপেক্ষা শুধু। মিয়া যেমন বলে— ‘লাইফ ইজ অ্যানাদার নেইম অফ লাফটার। লেটস্ এনজয় শুকটি।’ ওদের জিভে ত পাল্টে ট হয়ে যায়। শুক্তি পাল্টে যায় একটু একটু করে। চারপাশের মানুষ, পরিবেশ পাল্টে দেয় তাকে। ক্যাসুরিনাকে মনে হয় শুধুই একটা পুরোনো মূর্তি, পাথরের, নিষ্প্রাণ। কাকতালীয় কয়েকটা ঘটনাকে অলৌকিক ভেবে বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন।

ইউনিভার্সিটিতে ওদের ক্লোজ গ্রুপটা বেশ জমাট রকম। মাঝে মাঝেই আউটিং, ফুট জয়েন্ট বা রেস্তোরাঁয় ভোজ, ছোটখাটো পার্টি লেগেই থাকে। দলটাও হরে-কর-কমবা। শুক্তি তো আছেই।

লুকাস, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের। বছর তিরিশের চনমনে যুবক। যেখানে যাবে স্পটলাইট নিজের দিকে টেনে নেওয়া বাঁ হাত কী খেল।

মি. আর্থারটনকে দেখলে যতটা না, কথা বললে শ্রদ্ধায় নত হতেই হবে। মাঝবয়সী, অবিবাহিত। নিয়ম করে চার্চে যান। ফিজিক্স না পড়িয়ে বাইবেল হাতে চার্চে বা পোপের পাশে তাকে বেশি মানাত। এত সৌম্য, বিনয়ী, ভদ্র মানুষ শুক্তি দেশে থাকতেও দেখেনি। চরিত্রের মতো পছন্দের রঙটিও নিষ্কলঙ্ক। সাদা ছাড়া অন্য রঙের রুমাল ব্যবহার করতে কখনো ওনাকে দেখেনি শুক্তি।

লিয়া ম্যাডাম আবার ভীষণ স্টাইল সচেতন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ সবসময় রঙিন। তবে বড্ড মেজাজি। ওর বর নাকি চাকরি বাকরি কিছু করে না, তিনটি ছেলেমেয়ে, রান্নাবান্না সব সামলান। হাউস হাসব্যান্ড বলা ভালো।

গ্রেসন আবার এত সিনসিয়র যে কাজ দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত। ওস্তাদ কুক। রোস্ট বানাতে জুড়ি মেলা ভার। ওর হাতের রোস্ট আর ফ্রাই খেয়ে তেত্রিশ বছরের জীবনে শুক্তির প্রথমবার প্রেম পড়ো পড়ো ভাব জেগেছিল।
কিন্তু যার সঙ্গে শুক্তির সবচেয়ে বেশি মাখো মাখো দোস্তি, অদ্ভুতভাবে তার সঙ্গে স্বভাবের অমিলটাই চোখে পড়বে আগে। মিয়া দেখতে ভারি মিষ্টি, একটা লিলি ফুলের মতো তরতাজা। ওকে অনেকেই পছন্দ করে না। ছেলেদের সঙ্গে এত সহজভাবে আর স্বতঃস্ফূর্ত মেশে যে কখনো কখনো ওকে স্বৈরিণী বলে ভুল হতেও পারে। দুটোর মধ্যে সীমারেখাটা বড় সূক্ষ্ম, আবছা। গায়ে পড়া স্বভাব বলেও মনে করে কেউ কেউ। কিন্তু দেশ ছেড়ে বিভুঁইতে অমিশুক শুক্তিকে মিয়াই নিজে থেকে কাছে টেনে নিয়েছিল, সব চিনিয়েছিল। ও সাহায্য না করলে এত সহজভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারত না শুক্তি।

ছোট ছোট পাথরগুলো পায়ের তলায় চাদরের মতো বিছিয়ে রেখেছে নিজেদের। সাধারণ পাথরের তুলনায় নরম বলে কম অসুবিধা হয় পা ফেলে চলতে। তাই তো ক্যাম্ব্রিয়ার এই সৈকত মুনস্টোন বিচ নামে সবার কাছে পরিচিত। দূরে সবাইকে দেখতে পাচ্ছে শুক্তি আর মিয়া, স্যুইমস্যুট পরে জলে নেমে যাচ্ছে। ওদের চেনা গ্রুপ, তাদের কারো কারো ক্লোজ কেউ— সব মিলিয়ে জনা বারো এসেছে উইকএন্ড ট্রিপে। ওরা দুজন যাবে না, সমুদ্রস্নানে। ওদের মন ভালো নেই। জীবনটা তো আর মুনস্টোন বিচের মতো স্মুদিং নয়, তাই না?

‘এমন চুপ করে থেকো না, মিয়া। তোমাকে এমন দেখতে আমার ভালো লাগে না।’

‘কী করব বলো তো! আমি কিছুতেই ইনার পিস ফেরাতে পারছি না যে। যদি জানতাম…’ নাকের ডগা মুছতে মুছতে বোধকরি উপচে আসা চোখের জল লুকোতে চায় মিয়া। আস্তে করে মিয়ার পিঠে হাত রাখে শুক্তি, আশ্বাস দিতে পারবে না জেনেও। তবু তো চায় মানুষ, কাছের সবাই ভালো থাক, আনন্দে থাক। দু’সপ্তাহ আগে সবটা জানার পর মাথার ভেতর দপদপ করছিল। রাগ আর অপমান মিলেমিশে এক পাগলকরা আগুন জ্বলছিল বুকে। এই দূর বিদেশে যেমন মেয়েদের সম্মান আকাশছোঁয়া, বঞ্চনা অপমানেরও তো কমতি নেই। দুদিন ফোন করে তাকে না পেয়ে চিন্তা হচ্ছিল শুক্তির। গত রোববারে বার্থডে সেলিব্রেশন হলো মেয়েটার। তারপর হলোটা কী? মঙ্গলবার ক্লাসের পরে টিউব পাকড়ে সোজা হানা দিয়েছিল মিয়ার এক কামরার ফ্ল্যাটে। তিনবার বেল বাজার পরে দরজা খুলল। সামনে মিয়া-ই, বিধ্বস্ত চেহারা। চোখের কোণে কালো দাগ। একাই থাকে সে, আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। বাবা মারা গেছে ওর বছর পনেরো বয়সে। মা আবার বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। অবাক শুক্তিকে হতভম্ব করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মিয়া।

রবিবার পার্টিতে দশ­-বারোজনের জমায়েত হয়েছিল। ওদের চেনা দলের সবাই, মিয়ার কিছু বন্ধু, দুজন প্রতিবেশী। হৈ হৈ হলো, কেক কাটিং পর্ব মিটল। পানাহার চলছিল তারপর। মদ্যপানে ওস্তাদ এরা সব। মি. আর্থারটন আর শুক্তি আবারও রসে বঞ্চিত। ওরা দুজন বেরিয়েছিলও একসঙ্গে। শুক্তিকে টিউবস্টেশনে ড্রপ করে দিয়েছিলেন আর্থারটন। পাশের ফ্ল্যাটের জনসন আর মিয়ার হাতে তখনও লাস্ট পেগভর্তি গ্লাস। রঙিন রাত আর সোনালি সুরা মিলেমিশে রিমঝিম নেশা চারপাশে। এটা শেষ করেই জনসন উঠবে, দরজা টেনে চলে যাবে। এভাবে বেরিয়েও যায় ওরা এদিক-সেদিক। মিয়া বলল যে জনসন জড়ানো গলায় ‘বাই’ বলে উঠে গেছে, স্পষ্ট মনে আছে তার। তারপর নেশা আর ক্লান্তি মিলে ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। তীব্র একটা অস্বস্তি আর চাপে যখন আবার একটু ঘোর কাটে, বুঝতে পারে কেউ ওকে লুটে নিচ্ছে। আদর ভালোবাসাহীন লালসা, তীব্র কামনা নিয়ে তছনছ করছে তাকে। অন্ধকার ঘর, নেশায় বিভোর শরীরে বাধা দিতে পারেনি একটুও। মিয়াকে এলোমেলো ফেলে রেখে দ্রুত দৌড়ে বেরিয়ে যায় দস্যু। শক্তি ছিল না মিয়ার, চেতন অচেতনের মাঝামাঝি দুলছিল।

শুক্তির হাত ধরে একটা কথাই আওড়াচ্ছিল সেদিন— ‘কেন? কেন? আমাকেই কেন? সেই পনেরো বছর থেকেই তো একা থাকি। অনেকে ভাবে আমি যার তার সঙ্গে শুই। তুমি তো কাছ থেকে দেখছ এতদিন। এমনটা নাকি আমি?’

মিয়ার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে শুক্তি— ‘এসব বলছ কেন? শরীর তো বাইরের একটা খোল।

নোংরা হলে সাফ করে নেবে। মনটা পরিষ্কার থাকলেই হলো।’

জোরে জোরে দু দিকে ঘাড় নাড়ে মিয়া।

‘কিন্তু আমি শুধু পাগল হয়ে যাচ্ছি একটা উত্তরের জন্য। কে বলো তো? লোকটা খুব বিকৃত, জানো! তোমাকে যদি শরীরের দাগগুলো দেখাতে পারতাম।’ আবার ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা।
সত্যি। কে হতে পারে? মিয়া যে নেশায় বিভোর বা দরজা যে ভেতর থেকে লক করা থাকবে না, সেটা তো সেদিন যারা উপস্থিত ছিল, তারা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জানা বা আন্দাজ করা অসম্ভব। তাহলে কি তাদের মধ্যেই কেউ? মিয়া পুলিশে যেতে পারে, কিন্তু সেদিন পুরোপুরি ঘোর কাটার পর ওর সেসব মনে আসেনি। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছে। ধুয়েমুছে গেছে সব নোংরা, সব প্রমাণ।
মিয়াকে নিয়ে সোজা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরত এসেছিল সেদিন। সামলেছে আস্তে আস্তে। আজ তো বেড়াতেও এসেছে।

চিৎকারটা কানের পর্দায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ায় সামনে তাকাল দুজনে। কিছু একটা হচ্ছে তীর থেকে একটু দূরে, জলের মধ্যে। ছুটতে গিয়ে হোঁচট খায় পায়ে, ব্যথাটা ডুবে যায় উদ্বেগে।লিয়া মুখ কালো করে এগিয়ে এল।

‘হোয়াট আ অ্যাকসিডেন্ট! হু নোজ দিস উড হ্যাপেন।’

বিচের পাবলিক সেফটি ডাইভাররা ততক্ষণে নেমে পড়েছে জলে। এমনটা খুব রেয়ার ইনসিডেন্ট। সমুদ্রের হাওয়া খুব গরম হয়ে গেলে মাঝে মাঝে জলের নিচে উল্টো স্রোত তৈরি হয়। সেই মুহূর্তে কেউ সেখানে সাঁতার কাটলে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। গ্রেসন টের পেয়েছিল প্রথম, চিৎকার করে সতর্কও করতে চেষ্টা করেছিল। তবু বিপদ এড়ানো গেল না।

পাঁচটা মিনিট যেন পাঁচ ঘণ্টা। ফিঙ্গার ক্রস করে অপেক্ষায়। সবাই ফিরল, কেউ নিজে, কেউ সেভারের সাহায্য নিয়ে। হাঁফাচ্ছে, কাশছে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাও প্রাণ নিয়ে ফিরেছে— এই স্বস্তির কাছে সব তুচ্ছ।
লুকাস তুলনায় সহজে বেঁচেছে, ফিরেছেও।

ও-ই লাফিয়ে উঠল— ‘হ্যোয়ার ইজ আর্থারটন? হি ওয়াজ উইথ মি।’

বাকিরা একসঙ্গে ডুকরে উঠল। সেফটি সেভারের লোকেরা হলফ করে বলল যে আর কাউকে পাওয়া যায়নি। ঐ বিপদটুকু আকস্মিক তবে সামান্য সময়েই কেটে যায়। সমুদ্র এখন শান্ত, আর কাউকে তারা দেখতে পায়নি। বিদ্যুৎ চমকে যায় শুক্তির মাথায়। তবে কী? তাই কি? যেদিন মিয়াকে নিয়ে এল নিজের কাছে, সেদিন রাতে ও ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি ক্যাসুরিনাকে হাতে নিয়েছিল সে। সব বলেছিল।
‘জানি, আমার ভুল হয়তো। তবু, যদি পারো, শাস্তি দিও। মিয়াকে এত কষ্ট যে দিল, তাকে।’

লিয়া ম্যাডাম হাউমাউ করে কাঁদছেন। নকল আইল্যাশ ভিজে যাচ্ছে। অনেকে দৌড়াদৌড়ি করছে। মিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শুক্তি দেখছে সামনে, শান্ত স্থির নীল জল। অন্য কেউ দেখলে মনে করবে সে হতবাক, অন্যমনস্ক। আসলে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ঢেউগুলো উঠছে নামছে। তার নিচে, অনেক নিচে দশটা কাটা আঙুল মি. আর্থারটনকে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

সুস্মিতা পাল

কলকাতা, ভারত থেকে

পেশায় শিক্ষক। কলম ভালোবেসে লেখালেখির সামান্য প্রয়াস।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *