
মরিয়ম গলায় থাকা সোনার তাবিজে হাত দিয়ে দেখে। বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া একমাত্র গহনা। যখনি বাড়ির কথা মনে হয় ও তাবিজগুলো হাতিয়ে দেখে। দেখতে কড়ির মতো হলেও গ্রামে এগুলোকে তাবিজই বলে। মরিয়ম দ্রুত কাজ করে। পায়ে পায়ে ধান মেলে দেয় আর বারবার উনুনের দিকে তাকায় ধানগুলো সেদ্ধ হয়ে গেছে। নামাতে হবে পাশের উঠানে মেলে দিতে হবে। কাজগুলো সে গুছিয়ে রেখে যেতে চায়।
নইলে বৌ হলেও ছুটি মিলবে না।
দেওয়ান মনসুর বাইরে বের হয়েছে। কলতলায় গেছে। খাদিজা তার তৃতীয় বৌ। সেই আজ খাবার বানাচ্ছে।
এটুকু মরিয়ম ম্যানেজ করেছে।
দেওয়ান মনসুরের চারটে বউ। বড়বৌ জুলেখা, মেজবৌ নাফিসা।
জুলেখা ও নাফিসার বাবা প্রচুর যৌতুক দিয়েছে, জমি জিরাত দিছে তারা তাই পায়ের ওপর পা তুলে খায়। তাদের কোনো ছেলে নেই।
দেওয়ান মনসুর ছেলে নেই সেই ধুয়া তুলে তৃতীয়, চতুর্থ বিয়ে করে।
আসল ব্যাপারটা তা নয়। সে কাজের লোক রাখে না।
ঘর গেরস্থালির কাজ করার জন্য সে বিয়ে করে। তার নিজের জমি, প্রথম ও দ্বিতীয় বৌয়ের সূত্রে যে জমি পেয়েছে, সেগুলো বাড়িয়ে তিনগুণ করেছে। এখন যৌতুক ছাড়া বিয়ে করে আনে ও বিনে পয়সার ঝি বানায়। দুটো কাপড় দুটো ব্লাউজ ও তিন বেলা ভাতের বিনিময়ে।
এখন পাঁচ নম্বর বৌয়ের তালাশে আছে।
দেওয়ান মনসুর বড় বৌ জুলেখার ঘরের বারান্দায় বসলো। তার তৃতীয় বৌ খাদিজা সকালের খাবার দিয়ে গেল। মরিয়ম শুনতে পেল, দেওয়ান মনসুর আজ পঞ্চম বিয়ে করতে যাবে সেকথা বলছে।
জুলেখা হা না কিছুই বলল না। চুপ করে শুনল।
দেওয়ানের কথা শেষ হলে, জুলেখা বলে— মরিয়মরে বাপের বাড়ি পাঠাইতেছি দুপুরে। ওর বোনের বিয়া লাগছে।
দেওয়ান বললো, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে দিও। গহনা দিয়ে সাজাই পাঠাইও।
দেওয়ান ছেলে নাই বলে আর একটা বিয়ে করতে চলল। কারও কিছু বলার নাই, শোনা ছাড়া।
তার করা নতুন ঘর ও বৈঠকখানা সাজিয়ে রাখতে বলে।
২
মরিয়ম সন্ধ্যার পর বাড়ি পৌঁছাল। বিয়ে জমে উঠেছে। লোকজন বিয়ের গান গাইছে।
তাদের বাড়ির এমন অবস্থা নয় যে গানবাজনা করার লোক আসতে পারে, তার বাবা যৌতুক দিতে পারবে না বলে, দেওয়ান মনসুরের চতুর্থ বৌ হয়েছে সে।
তার বাবা বারবার বিয়ে ঠিক করে কিন্তু যৌতুকের অভাবে বিয়ে এগোয়নি। ফ্রিজ, টিভি, মোটরসাইকেল ছাড়া জমি-জিরাত ও টাকাপয়সাও চেয়েছে অনেকে। বাবার গোঁ একটাই— যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেবে না। উল্টো দেওয়ান মনসুরকে মরিয়মের নামে দু’বিঘা জমি লিখিয়ে নিয়েছে।
এগো সতীনের ঘরে মেয়ের নিরাপত্তা কী?
সে হাত মুখ ধুয়ে পোশাক বদলিয়ে মায়ের কাছে বসল।
এত আয়োজন কেমনে করলা, মা।
সবই আয়েশার কপাল। ছেলেপক্ষ মেয়ে সাজাইয়া লইয়া যাইতেছে। খরচপাতিও দিছে। আমাদের বরপক্ষের আট, দশজনকে খাওয়াতে হবি শুধু।
মরিয়মের মা ঘরের দরজা টেনে দিল।
গহনাপাতি সব দেখাল, শাড়ি কাপড় মরিয়ম দেখে বলল, খুবই ভালো গহনাপত্র ও কাপড়চোপড় দিছে। আয়েশা কপাল করি আইছে বটে।
সে মনে মনে জ্বলছে একটু বোনের এত ভাগ্য দেখে।
সেটা না প্রকাশ করে বলল, আমাকে কী কী রাঁধতে হবে কও?
কিছু না। রহিম বাবুর্চি আইয়া রান্না করবে।
সে তো অনেক খরচ লয়।
নিক।
আট-দশজনের রান্নার জন্য আমিই করতে পারব, খরচটা বাঁচবে।
না, না মরিয়ম; তোরা আনন্দ কর। এত কাজের দরকার নেই। আর তা ছাড়া ওর বিয়ের ঘটক রহিম বাবুর্চি। ওকে ডাকা দরকার ছিল।
মেহমান হিসেবে ডাকতে।
তাহলে তো ওর কাজটা হতো না। ওর টাকাপয়সার দিকটাও দেখতে হবে তো। মরিরমের মা বলে।
ছেলের বাড়ি কই?
পদ্মার চরের ওপারে।
মরিয়ম আর প্রশ্ন করে না।
সে গানের আসরে গিয়ে বসে থাকে।
৩
হিলাল ফয়েজ গায়ে, কানে শেষবারের মতো আতর মেখে মাইক্রোবাসে ওঠে। বিয়ের সাজগোজ সব ঠিকঠাক। সব বরযাত্রীই তার পছন্দমতো। যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। ৩/৪ দিন শুধু ভালোই রিহার্সাল দিয়েছে ভুল হওয়ার কিছু নেই। তবুও চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। ড্রাইভারটা ওপারের ওর ওপর একটু কড়া নজর রাখতে হবে। দুঘণ্টা চলার পর তারা বিয়ের আসরে পৌঁছাল।
মরিরমের বাবা জামাই হিলাল ফয়েজকে নিয়ে বসাল। তার বুকটা টানটান। সেই গ্রামের একমাত্র ব্যক্তি যে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দিয়েছে, বরং মেয়ের নামে জমি লিখে নিয়েছে। জামাইয়ের আরও তো বৌ আছে।
তাতে কী। মুসলমানে ৪টা বিয়ে করতে পারে।
তবে এই বিয়া দেখে সবাই ধন্য ধন্য করছে।
সব বরযাত্রী বসলে পাড়ার মেয়েদের নিয়ে মরিয়ম সরবত, মিষ্টি দিয়ে যায়। কথাবার্তা সব ঠিক ছিল বিয়ে হতে দেরি হলো না। কাজী ওরাই নিয়ে এসেছিল। ওরা বিকেলবেলা পদ্মা পার হবে। মেয়েরা এসে আয়েশাকে তুলে দিল। ফিরানি দুইদিন পর ঠিক হলো।
হিলাল ফয়েজ আয়েশার পাশে বসল। একঘণ্টা পার হওয়ার পর একটা ছোট ব্যগ ধরিয়ে দিল। বলল গহনাগুলো ব্যাগে রাখ। নদীতে নৌকায় চড়াকালে গয়না থাকলে কে কোথায় ছিঁড়ে নিয়ে লাফ দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায় বলা যায় না। হিলাল ফয়েজ ভাবছিল ফিরানির পর ওকে নিয়ে যাবে। এখন ১০টা দিন কাটিয়ে যাবে এরকম টসটসে মাল সে কয়দিন রাখবে। প্রতিবার বিবাহিত, অবিবাহিত মেয়েদের সে পার করে দেয়, সোনাগাছি না বোম্বাইয়ে যায় সে হিসাব সে রাখে না।
রাতের বেলা হালকা কয়টা গহনা দিয়ে বলল, এগুলো ফিরানিতে পরবে।
সব ঠিকঠাক আছে। ড্রাইভার পার হয় চলে গেছে। মা-বাবা ছাড়া চারিদিক বরযাত্রী ছড়িয়ে পড়েছে। সেও এক সপ্তাহ পর হিলাল ফয়েজ থেকে কাইউম মণ্ডল হবে। এত সুন্দরী একটা মেয়ে তার সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
তাদের এই মেয়ে পাচারকারী ব্যবসার সাথে আবেগকে প্রশ্রয় দিতে নেই। গরিব বাবা-মার আবেগকে পুঁজি করে তাদের ব্যবসা চলে। যৌতুক লাগবে না, মেয়েকে সাজিয়ে, গুছিয়ে নিয়ে যাবে একথা বললে, মেয়ের বাবা মা খুব সহজেই টোপটা গেলে। তাই বিয়ে করে মেয়ে পাচার করাটা সহজ। ফিরানি করে আসার পরদিন বেড়ানোর নাম করেই বেরিয়ে পড়বে ও এখান থেকে হাওয়া হয়ে যাবে।