এক
হেস্টিংস শহরের সব পথ রাকিবের চেনা। সেই দীর্ঘ সেন্ট ওভেন স্ট্রিটের পর ম্যাথুন স্ট্রিট, তারপর সাউথল্যান্ড রোড ও রডনি স্ট্রিট। দশ বছর আগে পুরো চারটা বছর সে এই হেস্টিংস শহরে বসবাস করে গেছে। তখন রিনেই ভাবির বাসায় সে কত এসেছে।
রাকিব রডনি স্ট্রিটে এসে ড্রাইভওয়েতে উঠতেই দেখল, রিনেই ভাবি তার বাসার সামনের বাগানে গোলাপ গাছের ছোট ছোট ডালা কাটছেন। তার সঙ্গে খুব সম্ভব তার ছোট মেয়ে। বয়সের হিসেব অনুযায়ী তাই মনে হচ্ছে।
গাড়ি দেখামাত্রই রিনেই ভাবি ড্রাইভওয়ের দিকে এগিয়ে এলেন। রাকিবকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর তোমার, কেমন আছ?
রাকিব গাড়ি থেকে নামতে নামতে মৃদু হেসে বলল, আমি ভালো। আপনারা কেমন আছেন, ভাবি?
রিনেই ভাবি বললেন, সেই একই রকম। দশ বছর আগে যেমন দেখে গেছ। মাঝখান থেকে সময় যাচ্ছে আর বয়স বেড়ে বেড়ে বুড়ি হচ্ছি।
রাকিব বলল, তাই!
এরই মধ্যে রিনেই ভাবির পাশে সেই মেয়েটা এসে দাঁড়াল।
রিনেই ভাবি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন— কোহিনূর, তোর রাকিব আঙ্কেল। চিনতে পেরেছিস?
কোহিনূর বলল, জি।
রাকিব বলল, তুমি তো বেশ লম্বা হয়ে উঠেছ। আমার চেয়েও লম্বা।
কোহিনূর খানিকটা লজ্জা পেল।
রিনেই ভাবি বললেন, হ্যাঁ, সে তার বাবার মতো লম্বা হয়েছে।
রাকিব মাথা ঝাঁকাল। তার ইচ্ছে হলো হাছান ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সে ইচ্ছেটা এ মুহূর্তে চেপে গেল। আজকের রাতটা তো সে এ বাসাতেই কাটাচ্ছে। যে কোনো একসময় সে জিজ্ঞেস করতে পারবে।
রাকিব গাড়ির পেছন খুলে তার ছোট্ট লাগেজটা বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল— ভাবি, পুতুল কোথায়?
রিনেই ভাবি বললেন, পুতুল তো কাজে গেছে। সে কাউন্টডাউন সুপার মার্কেটে চেকআউটে কাজ করে। তুমিও তো একসময় ওখানে কাজ করতে।
রাকিব বলল, জি, ভাবি। সেই এগারো-বারো বছর আগে।
রিনেই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এগারো-বারো বছর তো হবেই।
দুই
পড়ন্ত বিকেলে কাঁচাসোনা রোদ প্রকৃতির সর্বত্র বিছিয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মের দক্ষিণ-দুয়ারি বাতাস সবুজের ওপর নরম স্পর্শ দিচ্ছে। আকাশে বেশ পরিষ্কার নীল। রাকিব দাঁড়িয়ে আছে বাসার পেছনের ডেকে। রিনেই ভাবির বাসাটা রডনি স্ট্রিটের বেশ উঁচুতে বলে ডেকে দাঁড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।
রাকিব জানে, হেস্টিংস শহরকে বলে হয় ‘দ্য ফ্রুট বল অব নিউজিল্যান্ড’। হেস্টিংস শহরের আবাসিক এলাকা শেষ হতেই শহরটার চারপাশে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ফলের বাগান। আপেল, এপ্রিকট, প্লাম, পিয়ার্স, ম্যান্ডারিন, পার্সিমন কত জাতের ফলের বাগান যে! আর আঙ্গুরের বাগান তো মাইলের পর মাইল।
বাসার ভেতর থেকে রিনেই ভাবির গলা শোনা যাচ্ছে। তিনি কোহিনূরকে কিছু একটা বলছেন। পুতুল এখনও কাজ থেকে ফিরেনি। রডনি স্ট্রিট ধরে কিছুক্ষণ পর পর একটা-দুইটা গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। কাছে কোথাও একটা বৈকালিক ট্রেন যাচ্ছে— কুঁ-ঝিক ঝিক, কুঁ-ঝিক ঝিক।
রাকিব রিনেই ভাবির গলা আবার শুনল। সঙ্গে সঙ্গে কোহিনূরেরও। ওরা কিচেনে রান্না করায় ব্যস্ত।
রাকিব গলা বাড়িয়ে বাসার ভেতর ওদের দেখার চেষ্টা করল। হাট দরজা গলে সে বাসার ভেতর বিকেলের স্তব্ধতাই দেখল শুধু।
রাকিব ভাবল, কোহিনূর বেশ বড় হয়েছে। পুতুল নিশ্চয়ই উনিশ-বিশ বছরের যুবতী। দশ বছর আগে সে যখন এই বাসায় আসত, তখন কোহিনূরের বয়স ছিল তিন কি চার। পুতুলের বয়স ছিল নয় বা দশ। কোহিনূর তার কাঁধে চড়ে, পুতুল তার হাত ধরে রডনি স্ট্রিট পেরিয়ে ম্যাথুন স্ট্রিট হয়ে সেন্ট ওভেন স্ট্রিটের ডেইরিতে যেত। পুতুল সেই ডেইরি শপে গেলেই বিফ পাই খেতে চাইত। আর কোহিনূর খেতে চাইত আইসক্রিম।
রাকিব একটা ব্যাপার আজও বুঝতে পারে না, হাছান ভাই এমন ফুটফুটে দুটি মেয়ে রেখে কীভাবে চলে যেতে পারলেন? রিনেই ভাবির কথা না হয় বাদই দেওয়া যায়। তিনি ইউরোপিয়ান সাদা, পাকিহা মহিলা। কোনো বাঙালি পুরুষ যদি তার বিদেশি স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করতে না চায়, ওরা যে কোনো একটা বাহানা ধরে চলে যায়। সে পরিচিত অনেক বাঙালিকেই এরকমটা করতে দেখেছে।
আতিয়ার সোহেল নামে এক ভদ্রলোককে রাকিব চেনে। ভ্যাবিয়ান নামে এক সুন্দরী মেয়েকে পটিয়ে সে প্রথমে লিভ-টুগেদার, পরে বিয়ে করে পাঁচ বছর সংসার করে। সেই পাঁচ বছর সংসার যাপন কালে ভ্যাবিয়ানের প্রতি তার সে কী ভালোবাসা ও টান! কিন্তু যেদিন তার নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব হয়, এর একমাস পর কোনো কারণ ছাড়াই সংসার ভেঙে দিয়ে সে অন্য শহরে উধাও হয়ে যায়। শফিউল নামে অন্য আরেক ভদ্রলোক, যার স্ত্রীর নাম ছিল হ্যালি। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে হ্যালি স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করে হালিমা হয়। হিজাব ধরে, ধর্মের রীতিনীতি পুরোপুরি পালন করতে শুরু করে। কিন্তু সাত বছর সংসার যাপনের পর শফিউল ভদ্রলোকও একদিন উধাও হয়ে যায়। পরে সংবাদ আসে, সে নিউজিল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমিয়েছে।
কিন্তু এদিকে সেই হালিমা এখন আবার আগের হ্যালি হয়ে যায়। হিজাব ছেড়ে সে এখন স্কার্ট-মিনিস্কার্ট পরে। প্রতি উইকএন্ডে সে নাইটক্লাবিং করে। আর প্রতিনিয়ত সে নিজেকে অভিশাপ দেয়। শফিউল ভদ্রলোককে অভিশাপ দেয়। কখনও কখনও সে শফিউলের নাম তুলে সমস্ত বাঙালি জাতিকে অভিশাপ দিয়ে বসে।
রিনেই ভাবি অবশ্য হ্যালি বা ভ্যাবিয়ানের মতো নন। তিনি আজও কোনো বাঙালি পেলে নিজের লোক মনে করেন। নিউজিল্যান্ডে নতুন আসা যে কোনো বাঙালিদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তিনি নিজের নামের পেছনে এখনও স্বামীর নাম যোগ করেন। কারও সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে বলেন, আই অ্যাম মিসেস রিনেই পলিয়াস ন্যাথেলি হাছান।
তিন
রাতের খাবার শেষ করে রাকিব লাউঞ্জে এসে বসল। টিভির রিমোটটা টি-টেবিলের ওপরই রাখা। সে হাত বাড়িয়ে রিমোটটা নিয়ে টিভি চালু করল। চ্যানেল টু-তে দেখল, গ্ল্যাডিয়েটর মুভিটা চলছে। রাসেল ক্রোর মুভি। মুভিটা সে আগেই দেখেছে।
মুভিটা প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল, আট-নয় মিনিট দেখতেই তা শেষ হয়ে গেল।
রাকিব ঘড়ি দেখল। রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। আরেকটা নতুন মুভি শুরু হল। রবিবার রাতে সারারাত এভাবে একটার পর একটা মুভি হতে থাকে।
কিছুক্ষণ দেখতেই মুভিটা রাকিবের ভালো লেগে গেল। এটা হলিউডের মুভি নয়, অস্ট্রেলিয়ান মুভি। অস্ট্রেলিয়ার এক বিশাল ম্যানগ্রুব সোয়াম্পে মুভিটার শুটিং করা হয়েছে। শুধু একজন নায়ক, একজন নায়িকা, একজন পার্শ্ব-নায়িকা ও একটা বিশাল কুমিরকে কেন্দ্র করে মুভির কাহিনী।
রিনেই ভাবি কখন সোফার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন রাকিব খেয়াল করেনি। হঠাৎ তিনি আস্তে করে ডাক দিতেই সে চমকে উঠে বলল— ও, ভাবি!
রিনেই ভাবি পাশের সোফায় বসতে বসতে বললেন, হ্যাঁ, আমি। তোমাকে দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে মুভিটা দেখছ।
রাকিব মৃদু হেসে বলল— জি, খুব ভালো একটা মুভি।
—কী নাম মুভিটার?
—ব্ল্যাক ওয়াটার। অস্ট্রেলিয়ান মুভি।
—ও, আচ্ছা।
—আপনি এখনও ঘুমাননি?
—না, আমি বেডরুমে একটা কাজ করছিলাম। টিভির শব্দ পেয়ে এলাম। ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি।
—পুতুল-কোহিনূর কোথায়?
—ওরা তো ডিনার শেষ করেই বেডে চলে গেছে।
—ও, আচ্ছা।
—কফি খাবে?
—জি, খাওয়া যায়। কিন্তু আপনি আবার এখন কষ্ট করে কফি বানাতে যাবেন?
—কী যে বলো না রাকিব, তুমি এতদিন পরে এলে…।
—আপনি খাবেন?
—হ্যাঁ, খেতে পারি। তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে এককাপ খাই। তুমি বসো, আমি বানিয়ে নিয়ে আসি।
রাকিব সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
রিনেই ভাবি উঠে কিচেনে চলে গেলেন।
লাউঞ্জে সিক্সটি ওয়াটের বাতিটা জ্বলছে রাতের নিস্তব্ধতার সঙ্গে মানিয়ে। জানালার পাট সামান্য খোলা বলে রঙিন পর্দা গ্রীষ্মের নরম বাতাসে হালকা হালকা দুলছে। টিভির মুভিতেও নিস্তব্ধতা। বিশাল কুমিরটা জলে সিঁথি কেটে সাঁতার কাটছে। জলের শব্দ- টুপ টাপ, টুপ টাপ। মুভিতে কুমিরের অবস্থান ও জলের শব্দ রাকিবের দৃষ্টিকে হিম করে দিচ্ছে।
চার
রিনেই ভাবি কথা বলবেন বলে লাউঞ্জে এলেও তিনি এখন টিভিতে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে আছেন। তার কফি কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে সরু সরু রেখা করে।
রাকিবের কখনও টিভির দিকে তাকাচ্ছে, কখনও সে প্রশস্ত দৃষ্টিতে রিনেই ভাবিকে দেখছে। রাতের নির্জনতা আরও বাড়ছে। মুভিতে জলের শব্দও বেড়ে চলছে— কল কল, কল কল। জলে দুই-তিনটা ঘূর্ণন দিয়ে নায়ক এরই মধ্যে কুমিরের পেটে চলে গেছে। নায়িকা এবং পার্শ্ব-নায়িকার সে-কী আর্তনাদ…।
রাকিব মুভিটার দিকে এখন ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না। তার মনে থেমে থেমে পুরাতন প্রশ্নটাই উদয় হচ্ছে। হাছান ভাইয়ের কেন চলে গেলেন? রিনেই ভাবি কি কোনো দোষ করেছিলেন? কিন্তু তিনি তো দোষ করার মতো মহিলা নন। দীর্ঘ পনেরো বছর সংসার করার পর এমন একটা ঘটনা! আতিয়ার, শফিউল বা বোরহান উদ্দীনের কথা আলাদা। ওরা নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য এদেশি মেয়েদের পটিয়ে বিয়ে করেছিল। স্বার্থ শেষ, তারপর চলে গেছে। কিন্তু হাছান ভাইয়ের ব্যাপারটা তো অন্য। তিনি একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। রিনেই ভাবিকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। তারপর পনেরো বছরের সংসার।
রাকিবের মনে আছে, হাছান ভাই ভালোবেসে রিনেই ভাবির নাম দিয়েছিলেন— রুনা লায়লা। রিনেই ভাবি অনেকটা মোটা ধাঁচের মহিলা। যদিও দেখতে তিনি মোটেও রুনা লায়লার মতো নন। হয়তো হাছান ভাই রুনা লায়লার গান খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি রিনেই ভাবিকে রুনা লায়লা বলে ডাকতেন। আর রিনেই ভাবিও হাছান ভাইকে খুশি করার জন্য দুই-তিনটা বাংলা গান শিখে নিয়েছিলেন। ‘…এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে…’। ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুভাগ্য হইল না…’।
রাকিব ভাবল, সত্যই রিনেই ভাবির বন্ধুভাগ্য হলো না। তা না হলে অদ্ভুত সুন্দর দুটো মেয়েকে ফেলে, চমৎকার একটা সংসারটা ফেলে হাছান ভাই চলে গেলেন কেন? তারপর এগারোটি বছর! সেই এগারোটা বছর রিনেই ভাবি মেয়ে দুটোকে আঁকড়ে ধরে হাছান ভাইয়ের অপেক্ষায় আছেন। একটা দীর্ঘ অপেক্ষা।
রিনেই ভাবি নীরবতা ভেঙে কথা বললেন, কাল তোমার মিটিং কয়টায়?
রাকিব বলল, এগারোটায়।
—তুমি কোথায় না চাকরি কর?
—ফ্লিটচার কন্সট্রাকশান ফার্মে।
—আগামীকাল তো এখানে থাকবে, তাই না?
—না না ভাবি। কাল মিটিং শেষে অকল্যান্ড চলে যাব। পরশু সকালে অফিসে রিপোর্ট করতে হবে।
—শুধু একদিনের জন্য এলে?
—দেখা তো হলো ভাবি।
—হুম, দশ বছর পর এলে, তা-ও আবার একদিনের জন্য।
রাকিব একটা লজ্জার হাসি দিল। তার তখন মনে পড়ল, আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে সে বাংলাদেশ থেকে আসে, অকল্যান্ড হয়ে সরাসরি হেস্টিংস শহরে চলে এসেছিল। বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছিল বলে প্রথম প্রথম তার খুব মন খারাপ থাকত। চৌদ্দ বছর আগে তার বয়স কতইবা ছিল। বাইশ-তেইশ। তখন এই মায়াবতী মহিলা তাকে মাতৃস্নেহে আগলে নিয়েছিলেন। হাসান ভাই দিয়েছিলেন ঠিক বড় ভাইয়ের স্নেহ।
রাকিব কী ভেবে বলল— ভাবি, আপনার কথা বলেন।
রিনেই ভাবি ঈষৎ হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার আবার কী কথা?
—পুতুল-কোহিনূরের কথা বলেন। পুতুল তো বেশ সুন্দর হয়েছে। কোহিনূরকেও দেখলাম বেশ বড় হয়ে উঠেছে।
—আর সুন্দর, বদের হাড্ডি।
—কেন, কী হয়েছে?
—আর বলো না, কোহিনূর তো ছোট। এখনও ঘরেই থাকে। কিন্তু পুতুল!
—পুতুল আবার কী করেছে?
—এই বয়সের মেয়েরা যা যা করে। মদ, দুইদিন পর পর নতুন বয়ফ্রেন্ড। আজকাল আবার গাঁজা-টাজাও নাকি টানে। কাউন্টডাউনের চাকরিটা করে যা বেতন পায়, তা দিয়ে তো তার ফ্যাশন করে আর নাইট ক্লাবিং করেই শেষ করে দেয়। ভাগ্যিস সে আমার বাসায় থাকে। কোথাও বাসা ভাড়া দিতে হয় না।
—আপনি কিছু বলেন না?
—কী যে বলো না! একে তো আমি একা, হাছান নেই অনেকদিন। আর তুমি তো জানোই, এদেশে ছেলেমেয়েদের আঠারোর পরে কিছু বলা যায় না। তারপরও মাঝে-মধ্যে মেজাজ খারাপ হলে যে কিছু বলি না, তা না। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। এক-দুই সপ্তাহের জন্য সে বাসা থেকে উধাও হয়ে যায়। পরে আমাকেই আবার খুঁজে বের করে আনতে হয়। কী করব বলো, মেয়ে তো আমার। একবার শুনেছিলাম সে আমার বাসা ছেড়ে দেবে। এক আইরিশ ছেলের সঙ্গে লিভ-টুগেদার শুরু করেছিল। কিন্তু সে বাসা খুঁজতে খুঁজতেই সেই আইরিশ ছেলেটার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে যায়।
—পুতুলের তো মনে উনিশ হলো?
—কী বল, তার একুশ বছর হয়েছে।
রাকিব মাথা ঝাঁকাল। কী ভেবে চুপ হয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিল একটু লম্বা সময় নিয়ে। টিভির দিকেও তাকাল। কিন্তু মুভিটায় মনোযোগ দিল না।
রিনেই ভাবিও চুপ হয়ে গেলেন। তিনি টিভির দিকে তাকিয়ে কফি খাচ্ছেন বেশ শব্দ করে।
রাকিব টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিনেই ভাবির দিকে তাকাল। ভাবল, কফি তো এত গরম নয়, তিনি এত শব্দ করে খাচ্ছেন কেন? তারপরও তার রিনেই ভাবির কফি খাওয়ার দৃশ্যটা বেশ ভালো লাগল।
রাকিব বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ভাবি?
রিনেই ভাবি টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাকিবের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা?
—পুতুল কি বাংলাদেশের কথা বলে?
—নাহ, কয়েক বছর ধরে বলতে শুনিনি।
—সে ছোটবেলায় তো বেশ বাংলাদেশ-বাংলাদেশ করত। বাংলা গান খুব পছন্দ করত। একটা বাংলাদেশি কালচারাল প্রোগ্রামে সে নেচেছিল।
রিনেই ভাবি হাসলেন। বেশ নরম হাসি। বললেন, কী যে বলো না তুমি! ছোটবেলার পুতুল আর এখনকার পুতুল কি এক? তখন তার বাবা ছিল। আর বাংলাদেশি কালচারের কথা বলছ? তোমাকে তো একটু আগেই তার কীর্তিকলাপের কথা বললাম।
রাকিব বলল, আপনি তো ধরে রেখেছেন, ভাবি। একজন ইংরেজ-নিউজিল্যান্ডার হয়েও বাংলাদেশি কালচারটা ধরে রেখেছেন।
রিনেই ভাবি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কেমন?
—এই যে, হাছান ভাই নেই কত বছর ধরে। কিন্তু আপনি এখনও নিজের নামের পেছনে স্বামীর নামটা এখনও রেখেছেন।
—ও, ওই কথা। বলেই রিনেই ভাবি আবার নরম হাসলেন। তবে এবারের হাসিটা অনেক নিষ্প্রভ। তিনি বললেন, রাকিব, আমি বাঙালি কালচার ধরে রেখেছি, এটা মোটেও ঠিক না। আমি এদেশি। আমার দ্বারা বাঙালি কালচার ধরে রাখা মোটেও সম্ভব না। তবে আমি হাছানের অপেক্ষায় যে নেই, তা নয়। মাঝে-মধ্যে আমার মনে হয়, এই বুঝি হাছান ঘরে ঢুকে রসিকতা শুরু করে দেবে। দুষ্টুমি করে বলবে, কই গো আমার রুনা লায়লা!
রাকিব হেসে উঠল।
রিনেই ভাবি বললেন, আমি রুনা লায়লার সেই গানগুলো এখনও মনে রেখেছি।
রাকিব অবাক হয়ে বলল, তাই!
—হ্যাঁ, শুনবে একটা গান?
—ঠিক আছে, একটা গেয়ে শোনান।
রিনেই ভাবি গান ধরলেন— ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধুভাগ্য হইল না…’।
রাকিব বেশ শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, সেই একই গান!
রিনেই ভাবি গান থামিয়ে বলল, হ্যাঁ, সেই একই গান। আরও একটা শুনবে?
—না না ভাবি, আর গান শোনাতে হবে না। ভাগ্যিস রুনা লায়লা কখনও নিউজিল্যান্ডে আসেননি।
—এলে কী হতো?
—আপনার গান শুনে তিনি আত্মহত্যা করতেন।
—চুপ, চুপ! বলেই রিনেই ভাবিও বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন।
রাতের নিস্তব্ধতা আরও বেড়ে গম্ভীর হচ্ছে। বাতাস বইছে আগের মতোই। জানালার পর্দার দুলুনি— তির তির, তির তির। মুভিতে শরীর নেড়ে নেড়ে সিঁথিকাটা জলে কুমিরটা বীরদর্পে চলছে। এখন নায়িকার একাকী ভয়ার্ত আর্তনাদ।
রাকিব বলল, একটা কথা, ভাবি।
রিনেই ভাবি জিজ্ঞেস করল, কী?
—আমি কি হাছান ভাইয়ের কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?
—হাছানের কী কথা?
—ওই তো, হাছান ভাইয়ের কোনো খবর আপনার কাছে আছে কিনা।
রিনেই ভাবি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, আছে রাকিব, অবশ্যই আছে। সে দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডেলেইড শহরে বসবাস করছে।
রাকিব খুব অবাক হলো। বলল, বলেন কী, আপনি জানেন যে হাছান ভাই অ্যাডেলেইডে আছে, আপনি ওখানে যাচ্ছেন না কেন?
—ওখানে গিয়ে আমি কী করব?
—হাছান ভাইয়ের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াবেন।
—আচ্ছা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তাতে কী লাভ?
—ভাবি, একটা মানুষের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালে আসল সত্যটা বের হয়ে আসে। আপনি, আমি-আমরা কেউ জানি না হাছান ভাই কেন পালিয়ে যাওয়ার মতো এমন রহস্যজনক একটা কাজ করলেন।
—রহস্যটা জেনে লাভ?
—বারবার এত লাভ-লোকসানের কথা বলছেন কেন, ভাবি?
রিনেই ভাবি কথার জবাব না দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন।
রাকিব বলল, সরি, আমি মনে হয় একটু কঠিন করে বলে ফেলেছি।
রিনেই ভাবি মৃদু হাসলেন। বললেন, অসুবিধা নেই। ভুল তো বলোনি। কিন্তু কথা কী রাকিব, একটা সময় লাভ-লোকসানের হিসাব করতে হয়।
রাকিব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কেমন?
রিনেই ভাবি বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, এই যে আমি, এখন আমি আর সাতাশ-আটাশ বছরের যুবতী না যে তোমার হাছান ভাই আমাকে দেখে খুশিতে ডগ-মগ ডগ-মগ হয়ে ভালোবাসবে। আমার বয়স এখন তেপ্পান্ন। আই উইল বি ফিফটি ফোর ইন নেক্সট মান্থ। তার সঙ্গে পনেরো বছর সংসার করেছি। তারপর এগারো বছর ধরে সেপারেশানে।
—ভালোবাসার কোনো বয়স আছে, ভাবি?
—হ্যাঁ, আছে। পুরুষের না থাকলেও মেয়েদের আছে। মেয়েদের চল্লিশ বছর হলেই ওদের মধ্যে হতাশা এসে ভিড় করে। তখন ওরা মনেপ্রাণে যৌবনকে ফিরে পেতে চায়। আর পঞ্চাশ বছর হলে ওরা বুড়ি হয়ে গেছে মনে করে স্থিতিতে চলে আসে। আর আমি তো এখন প্রায় চুয়ান্ন বছরের বুড়ি।
—হাছান ভাইয়ের কি বয়স বাড়েনি?
—হ্যাঁ বেড়েছে। হাছান আর আমি তো একই বয়সী ছিলাম। তবে ওই যে বললাম, পুরুষদের বয়স বাড়ে না, মেয়েদের বাড়ে।
রাকিব মাথা ঝাঁকাল। এমনিই। একমুহূর্তের জন্য থেমে জিজ্ঞেস করল, হাছান ভাইয়ের আর কোনো খবর?
রিনেই ভাবি একটা ছোট্ট কৌতুকের হাসি দিলেন। কিন্তু পরক্ষণই তার সেই হাসির মধ্যে বিষণ্ণতা এসে ভর করল। তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, আর কী খবর জানতে চাও, সে বিয়েশাদি করেছে কিনা?
—জি, ভাবি।
—হ্যাঁ, সে বিয়ে করেছে। একটা বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে। সেই মেয়েটা তার অর্ধেক বয়সী।
—কিন্তু আপনার সঙ্গে তো তার ডিভোর্স হয়নি।
—নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার আইনে আগের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করার নিয়ম নেই। কিন্তু তোমাদের রীতিতে তো বিয়ে করায় কোনো আপত্তি নেই।
রাকিব আবার মাথা ঝাঁকাল। এবার সে মাথা ঝাঁকাল অনির্ভরতায়।
রিনেই ভাবি সহজ গলায় বললেন, তুমি আরও খবর জানতে চাও?
—জি, বলুন।
—তার নতুন সংসারে একটা ছেলে হয়েছে।
রাকিব একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল— ভাবি, আপনি হাছান ভাইয়ের এত খবর জানেন, তারপরও তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন?
রিনেই ভাবি হাসলেন। বড্ড করুণ হাসি। বললেন, হ্যাঁ, আমি হাছানের স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছি। কিন্তু কেন পড়ে আছি জানো, পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা বড্ড বেশি পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখে বাঁচতে চায়। আর নতুন কোনো স্মৃতির ব্যাপারে ভয় পায়। আমি হলাম সেই ধরনের মানুষ। আর কোনো কোনো মানুষ আছে যারা চমৎকারিত্বে বেশ বিশ্বাস করে। এই যেমন— যাদু, জীবনের যাদু। ওই যে কিছুক্ষণ আগে বললাম না, যদি হাছান চলে আসে! তার সেই হাসি, সেই রসিকতা…।
রিনেই ভাবি একটু থামলেন। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন— রাকিব, মানুষ কল্পনায় ভাসে বলেই তো বাঁচার স্বাদ পায়। নয়তো মানুষ ঠুস। তবে রাকিব, আমার জীবনে একটা বড় শখ আছে।
—কী শখ, ভাবি?
—একবার বাংলাদেশ যাব। যে মানুষটার সঙ্গে পনেরো বছর সংসার করেছি, আর এগারো বছর অপেক্ষায় আছি। সেই মানুষটার দেশটা একবার দেখব না?
রাকিবের মনে পড়ল, হাছান ভাই প্রায়ই খুশি করানোর জন্য রিনেই ভাবিকে বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন। রিনেই ভাবিও খুশি হতেন। কিন্তু রিনেই ভাবির বাংলাদেশ যাওয়ার আগেই হাছান ভাই উধাও।
রাকিব জিজ্ঞেস করল— ভাবি, আপনার কবে বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে?
রিনেই ভাবি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, মানে?
—মানে, আপনার বাংলাদেশ যাওয়ার কথা বলছি। আপনি কবে যেতে চান?
—তুমি কী যে বলো না, রাকিব!
—কেন, কী হয়েছে?
—আমার কাছে অত টাকা কোথায় যে বাংলাদেশ যাব? এমনিতে দুটো মেয়েকে একা একা বড় করছি। ওদের খরচ, সংসার চালানো…।
রাকিব জোর গলায় বলল, আপনার কবে যাওয়ার ইচ্ছে, সেটা বলেন।
রিনেই ভাবি একমুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। কী ভেবে মাথা ঝাঁকালেন দুই-তিনবার। তারপর আস্তে করে বললেন— রাকিব, আমি যাব। বৃদ্ধ বয়স হলেও বাংলাদেশ যাব। আগে আমার মেয়ে দুইটা নিজের পায়ে দাঁড়াক।
রাকিব বলল— ভাবি, নিউজিল্যান্ডে ছেলেমেয়েদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তাদের বাবা-মাকে চিন্তা করতে হয় না। চিন্তা করে নিউজিল্যান্ডের সরকার। আপনি বাংলাদেশ যাওয়ার তারিখ ঠিক করেন। আপনার ভ্রমণের সব টাকা আমি দেব।
—তুমি দেবে?
—জি ভাবি।
—কেন দেবে?
—কারণ বাংলাদেশ ভ্রমণের টাকাটা আমার কাছে আপনার প্রাপ্য।
রিনেই ভাবির চেহারায় যেন একটা অদ্ভুত আভা ফুটে উঠল। বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, এত টাকা তোমার কাছে আমার কীভাবে প্রাপ্য?
—আপনার সেটা বুঝতে হবে না। তবে আমি যা বলছি সত্য বলছি।
—তুমি এত টাকা পাবে কোথায়?
—ভাবি, আমি এখন আর সেই কাউন্টডাউনের চাকরি করি না। আমি বেশ ভালো একটা চাকরি করি। বেতন বেশ ভালো পাই। মাস শেষে হাজার হাজার ডলার আমার ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। গত দশ বছরে একটা বড় অঙ্কের টাকাই ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে। ওই টাকা থেকে খুব সামান্য টাকাই আপনাকে দেব।
রিনেই ভাবির চেহারার অদ্ভুত আভাটা হঠাৎ যেন মিইয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ তার চেহারায় একটা করুণ ছায়া পড়ল। মনে হলো, এই ছায়াটা একটু দীর্ঘ হলে তিনি কেঁদে ফেলবেন।
রিনেই ভাবি এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললেন।
রাকিব ধরা গলায় বলল, একটা কথা, ভাবি, আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটি।
mohibulalam.k@gmail.com