অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২২, ২০২৪
৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২২, ২০২৪
৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আশরাফ খান -
দুই জোস্‌না

বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমায় নায়িকা অঞ্জু ঘোষ যখন কোমরের বিছা দুলিয়ে নাচে আর গান গায় ‘আরে ও… পাহাড়িয়া সাপের খেলা…’ আফছারালী তখন অঞ্জু ঘোষের মুখের উপর জোস্‌নার মুখটি প্রতিস্থাপন করে মনে মনে ভাবে এ যেন বেদের মেয়ে জোস্‌না নয়, চন্দ্রপুরের জয়নাল তালুকদারের মেয়ে জোস্‌না। আর অঞ্জু ঘোষ যখন ইলিয়াস কাঞ্চনের হাত ধরে ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না আমায় কথা দিয়েছে, আসি আসি বলে জোস্‌না ফাঁকি দিয়েছে’ গান গায় আফছারালী তখন সিনেমা হলের অন্ধকারে জোস্‌নার হাত খুঁজে বেড়ায়। সে হয়তো জোস্‌নার হাত খুঁজে পায় অথবা পায় না।

—জোস্‌না কোয়ানে গ্যাচে? কবে আসপো?

গ্রামের লোকদের এ প্রশ্নের উত্তরে রেহানা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে করে সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলে— জোস্‌না নানির বা’ত গ্যাছে। ক’দিন পর আসপো।

—আফছারালীকেও দেহি না কয়দিন হ’ল। আফছারালী কোয়ানে গ্যাছে?

—বাইত গ্যাচে।

রেহানা বেগমের এই উত্তরের মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম লুকায়িত দুঃখবোধ আছে তা তার মুখের ভাষা পড়লেই খুব সহজেই অনুমান করা যায়। তবুও গ্রামের লোকেরা তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে জোস্‌নার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকে। জোস্‌না ফিরে এলে পাঁচ হাজার লোকের বসত চন্দ্রপুর গ্রামে কোনো লাভ হবে না, আবার ফিরে না এলে কোনো ক্ষতি হবে না। লাভ-ক্ষতির হিসাব শুধু তার পরিবার জানে অথবা জানে না আবার জানলেও কিছু করার থাকে না। তবুও জোস্‌না প্রসঙ্গে গ্রামবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই। দেখতে দেখতে বিশ বছরের অধিক সময় পাড় হয়ে যায় তবুও জোস্‌না ফিরে আসে না। এতদিনে অনেকে জোস্‌নার কথা ভুলে গেছে আবার অনেকে ভোলে নাই। তাই তো এখনও বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমার কথা উঠলেই চন্দ্রপুরের মানুষের মনে জোস্‌নার কথা নতুন করে জেগে ওঠে।

জোস্‌নার বাবার জয়নাল তালুকদারের গোলা ভরা ধান। গোয়ালভরা গরু। পুকুর ভরা মাছ। তিন-চার জন বছরসাল কামলা। জয়নাল তালুকদারের বাড়ি লোকমুখে তালুকদার বাড়ি নামে পরিচিত। তালুকদার বাড়ির আদি পুরুষ আব্দুস ছোবহান তালুকদার ফুলপুর থেকে এসে চন্দ্রপুরে বসতি স্থাপন করে। আব্দুস ছোবহান তালুকদারের দুই পুত্র ছিলিম তালুকদার ও ইলিম তালুকদার। ছিলিম তালুকদারের সাত পুত্র ও ইলিম তালুকদারের আট পুত্র। বংশ পরম্পরায় আব্দুস ছোবহান তালুকদারের পুত্র ও প্রপৌত্র শাখা প্রশাখা লতা পাতা গজাতে গজাতে তালুকদার বাড়ি একটা স্বতন্ত্র গ্রামে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ যেন গ্রামের মধ্যে আরেক গ্রাম। ধনবল জনবল কোনোটি কমতি নেই তালুকদার বাড়িতে।

যে বছর জোস্‌না নিখোঁজ হয় সে বছর পঙ্গপালের আক্রমণে জয়নাল তালুকদারের দশ বিঘা জমির ধান চিটায় পরিণত হয়। মাথাখেকো লেদা পোকা উৎপাতে দুই বিঘা ফুলকপির বাগান নষ্ট হয়ে যায়। ভিটা বোঝাই যে আম গাছগুলোতে আমের ভিড়ে গাছের পাতা দেখা যেত না সে গাছগুলোতে কোনো মুকুল দেখা যায় না। গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে, জয়নাল তালুকদারের ঘরের লক্ষ্মী চলে গেছে। জোস্‌না নিখোঁজ হওয়ার পর তালুকদার বাড়ির পোষা কুকুরটি পেছন বাড়ির বাঁশঝাড়ের মধ্যে অনবরত ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। গ্রামের লোকেরা বলে, সাদা কালো কুকুরটি যখন আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে করুণ সুরে ঘেউ ঘেউ করত তখন তার দু’চোখ দিয়ে পানি বের হতো এবং চোখের অনেক নিচ পর্যন্ত পানির দাগ দেখা যেত। কয়েকদিন পর কুকুরটি নিরুদ্দেশ হলো। জোস্‌না নিখোঁজ হওয়ার পর একটি আগন্তুক দাঁড়কাক তালুকদার বাড়ির বাঁশঝাড়ে একটানা কাঁ কাঁ করতে থাকে। জোস্‌নার মা রেহানা বেগম দাঁড়কাকটি তাড়াতে গিয়ে নিজের চোখ দুটো জলে ভরে তোলে কিন্তু সে জল কেউ দেখার আগেই মুছে ফেলে।

২.

মমতা সিনেমা হল এখন মমতা ছাত্রাবাস আর মোঘল স্থাপত্য শৈলীর আদলে নির্মিত লক্ষ্মী সিনেমা হল লাঠিভর দিয়ে কুঁজো হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এদের একটা উজ্জ্বল অতীত আছে। ঋ-ফলার মতো বড়পুলের পশ্চিম পাড়ে যেখান থেকে ইংরেজি বড় হাতের ওয়াই বর্ণের মতো দুটি রাস্তা দুই দিকে ছড়িয়ে সামান্য একটু আগাতেই আবার দুটো রাস্তা একত্রিত হয়ে অনেকটা প্যাটমোটা বীণ বাঁশির মতো আকার ধারণ করেছে। বীণের প্যাটের মতো রাস্তার মধ্যাংশের পূর্ব প্রান্তে লক্ষ্মী সিনেমা হল এবং পশ্চিম প্রান্তে পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশ ফাঁড়ি পার হলেই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ক্লিনিক দি ল্যাব প্যাথলজি। মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকটি বিশেষভাবে পরিচিত। দি ল্যাব পাথলজি থেকে উত্তরে জেল খানার ঘাটের দিকে একটু আগাতেই মমতা সিনেমা হল। মমতা সিনেমা হল থেকে আরও একটু উত্তর দিকে আগাতেই নীলা সিনেমা হল।

মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে পর পর তিনটি সিনেমা হল অবস্থিত হলেও নীলা হল অঙ্কুরের বিনাস হয়। বেদের মেয়ে জোস্‌না ছবির মাধ্যমের নীলা হলের উদ্বোধন হয়। কিন্তু এ উদ্বোধন শুভ না হয়ে অশুভতে পরিণত হয়। সাপে কাটা ইলিয়াস কাঞ্চনকে সুস্থ করার জন্য নায়িকা অঞ্জু ঘোষ মরণ বীণ বাজাতে শুরু করলে হলের ভেতর এক অবাক কাণ্ড ঘটে। সিনেমা পর্দার উপর একটা সাপ দেখা যায়। প্রথমে সবাই পর্দার ভেতরের সাপ মনে করলেও পরবর্তীকালে বুঝতে পারে যে এটা সিনেমার সাপ নয় বরং একটি সত্যিকারের সাপ পর্দা বেয়ে উঠেছে। হৈচৈয়ের মুখে কর্তৃপক্ষ সিনেমা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। উৎসুক জনতা লাঠি সোটা নিয়ে এলোপাথাড়িভাবে সাপ মারতে গিয়ে হলের পর্দা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। তারপর থেকে নীলা সিনেমা হল আর চলতে দেখা যায়নি। পরবর্তীকালে মমতা ও লক্ষ্মী সিনেমা হলে একযোগে বেদের মেয়ের জোস্‌না সিনেমা চলতে থাকে।

লক্ষ্মী সিনেমা হলের সামনে প্রতিদিন ফার্স্ট শো শুরুর আগে এক বয়স্ক হকার যৌনশক্তি বর্ধক তেল বিক্রি করতেন। বড়পুলের পূর্বপ্রান্তের যেখান থেকে মইয়ের মতো একটি সিঁড়ি সুইপার কলোনির দিকে নেমে গেছে। সিঁড়ির পশ্চিমে শহর সাব পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন চন্দনদা, যার শ্রুতিমধুর কণ্ঠ। শহরের অধিকাংশ প্রচারের রেকর্ডে তার কণ্ঠ শোনা যায়। পোস্ট অফিসের সামনে বৃদ্ধ কড়ি গাছটার নিচে প্রতিদিন ফার্স্ট শো, সেকেন্ড শো ও ইভেনিং শোর পূর্বে রমজান হকার নজরবন্দি খেলা দেখাত। খেলার শুরু আগে সে বৃত্তের মতো করে একটা দাগ দিতেন এবং দর্শনার্থীদের সেই দাগের বাইরে থাকার নির্দেশ প্রদান করতেন। দর্শনার্থীগণ রমজান হকারের আদেশ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের চেয়ে অধিক গুরত্ব সহকারে মেনে চলতেন। বৃত্তের বাইরে গোলাকার হয়ে দর্শনার্থীগণ রমজান হকারের জাদুর খেলা দেখতেন। রমজান ও তার দুই সহযোগী বৃত্তের ভেতরে থেকে খেলা পরিচালনা করত। খেলা শুরু আগে রমজান বট বটাং চট চটাং করে কী যেন মন্ত্র পাঠ করতেন। গ্রামের লোকেরা বলে, সেই মন্ত্র কিছুটা এরকম— লাগ ভেলকি লাগ, চোখে মুখে লাগ, আমাক বাদ দিয়া সকলের লাগ।

লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী কুচকুচে কালো রমজান ঝাঁকড়া চুলের বাবরি মাথায় লম্বা কাবলি টুপি পরতেন। সাদা ধুতি লুঙ্গি ঊরুর শেষ পর্যন্ত তুলে উরুতে বারবার থাপ্পড় দিতেন আর মন্ত্র পড়তেন। থাপড়াতে থাপড়াতে তার দুই ঊরুতে কয়লার মতো কালো দাগ পড়ে গেছে। খেলার একপর্যায়ে রমজান তার সহযোগী সোলেমানের গলা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতেন। তখন রমজান সবাইকে জোরে জোরে হাততালি দিতে বলতেন। দর্শনার্থীগণ রমজানের কথায় সম্মোহিত হয়ে জোরে জোরে হাততালি দিতেন। সোলেমান মা… মাগো… বলে জোরে চিৎকার দিয়ে থপাস করে মাটিতে পড়ে যেত। রমজান তখন একটি কালো কাপড় দিয়ে গলাকাটা সোলেমানকে ঢেকে রাখতেন। তারপর শুরু হতো রমজানের আসল খেলা। সে বলত— যার কাছে যা আছে, সব দিয়ে দেন। যদি না দেন তাইলি খুব বিপদ হবে। তখন দর্শনার্থীগণ পাঁচ টাকা, দশ টাকা, বিশ টাকা বৃষ্টির মতো ছুড়ে দিতেন। রমজান দর্শনার্থীদের মনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য বলতেন— যদি কারোর পকেটে টাকা থাকার পরেও না দেন তাহলে পকেটে আগুন ধরে যাবে। বিশ্বাস না হয় আপনারা যে যার যার পুরুষাঙ্গে হাত দিয়ে দেখেন আপনাদের পুরুষাঙ্গ আছে কিনা? গ্রামের লোকেরা বলে, আমরা তখন আমাদের পরনের লুঙ্গি অথবা প্যান্টের ভিতরে হাত দিয়ে আমাদের পুরুষাঙ্গ খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু সত্যি সত্যি আমরা আমাদের পুরুষাঙ্গ খুঁজে পাই না। রমজান পুনরায় বলে— যদি টাকা না দেন, তাহলে আপনারা আপনাদের লিঙ্গ আর কুনোদিন ফিরে পাবেন না। প্রথমে রমজান যাদের কাবু করতে পারে নাই, এবার তারাও ভয়ে টাকা দিতে বাধ্য হয়। বৃদ্ধ কড়ি গাছটার পাশে অল্প বয়সী কড়ি গাছটার নিচে হিজড়াদের আড্ডা ছিল। শো শুরুর আগে হিজড়ারা দলবদ্ধভাবে বড়পুলের র‌্যালিংয়ের উপর আড্ডা দিত। সিনেমার দর্শকদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করত।

৩.

রাত তো দূরের কথা দিনের বেলাতেই লোকজন মরা খালের মধ্যে চলাচল করতে ভয় পেত। কিছুদিন আগে নলছিয়া গ্রামের শাহজামালকে কারা যেন গলা কেটে হত্যা করে এই খালের মধ্যে ফেলে রেখেছিল। নলছিয়া, চন্দ্রপুর, দ্বীপপুর, তৈলকুপিসহ আশপাশের দশ গ্রামের নারী পুরুষ দল বেঁধে সেই গলা কাটা লাশ দেখতে এসেছিল। লাশ দেখতে এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে দুর্বল চিত্তের অনেকেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যে সকল শিশু লাশ দেখেছিল তারা রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়ে চিৎকার করে উঠত। আবু বক্কর হুজুরের পানি পরা খেয়ে শিশুদের কান্না বন্ধ হয়। তারপর থেকেই এই খালের নাম হয় মরা খাল। নাইট শো সিনেমা দেখে মরা খালের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আফছারালীর গা কিছুটা ছমছম করে। জোস্‌না জিজ্ঞেস করে— কী আফছার ভাই, ভয় পাইত্যাছেন নাহি?

আফছারালী বলে, না। ভয় কীসের। কুনো ভয় নাই।

আফছারালীর ভেতরে ভীষণ ভয় করছে। কিন্তু সে ভয় ভূতের নয় অন্য কিছুর। গত বিশ বছরে মরা খালের গলা কাটা লাশের কথা লোকেরা ভুলে বসেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে চাষিরা মাঠে কাজ করতে যাওয়ার সময মরা খালের ভেতর বস্তাভর্তি দুটি লাশ দেখতে পায়। তখন তাদের মনে আবার সেই গলা কাটা লাশের কথা মনে পড়ে যায়।

রাত তখনো প্রায় একটা। সুনশান নীরবতা চন্দ্রপুরের বাঁশতলা বাজারে। বাজার বলতে একটি চায়ের দোকান ছোট বড় চার থেকে পাঁচটি মুদির দোকান এবং একটি ওষুধের দোকান যেখানে মূলত কনডম, মায়াবড়ি, গ্যাস্ট্রিক, জ্বর, আমাশা ও ব্যথার বড়ি ছাড়া অন্য কিছুই পাওয়া যায় না। যেখানে রাত নয়টার মধ্যে সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায় সেখানে এত রাতে লোকজন কল্পনা করা যায় না। তবুও আফছারালী ও জোস্‌না ভয়ে ভয়ে বিড়ালের মতো চুপি চুপি পা ফেলে বাঁশতলার বাজার পার হয়।

৪.

সেদিন সম্ভবত পূর্ণিমা ছিল। বকের মতো সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে মধ্যরাতে বড়পুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জয়নাল তালুকদার। বড়পুল শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত হলেও জয়নাল তালুকদারের বাড়ি চন্দ্রপুর বড়পুল থেকে তিন মাইল পশ্চিমে। তিন মাইল দূর হতে পায়ে হেঁটে হেরিবন্ড রাস্তা পাড়ি দিয়ে মধ্যরাতে জয়নাল তালুকদার বড়পুলের উপর কেন দাঁড়িয়ে আছে? শুধু আজ নয়, মাঝে-মধ্যেই তাকে মধ্যরাতে বড়পুলের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নির্জন মধ্যরাতে ষাটোর্ধ্ব জয়নাল তালুকদারের কানে লক্ষ্মী সিনেমা হল হতে গানের সুর ভেসে আসে— ‘কে বলে আমি ভালো না, আমি তো মানুষ, থাকবে কিছু দোষ, আমাকে মন্দ বোলো না।’ জয়নাল তালুকদার গভীর মনোযোগ দিয়ে সে গান শোনে। অর্ধশিক্ষিত জয়নাল তালুকদার এই গানের মর্মকথা গভীরভাবে অনুধাবন করতে না পারলে এর সরল অর্থ বুঝতে তার কষ্ট হয় না। তার মনে শৈশবের স্মৃতি ভেসে ওঠে। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার কথা মনে পড়ে। তুখোর সিনেমাখোর না হলেও মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা হতো। বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা সেও দেখেছে। কিন্তু তাকে তো কেউ শাসন করে নাই। শাসন করতে করতে মারতে মারতে একদম…। তার বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠে। ওরা কেন এতটা নির্মম নির্দয় কাজ করল? এই প্রশ্নের সদুত্তর জয়নাল তালুকদার নিজেও জানে না।

কিছুক্ষণ পর নাইট শো ভাঙবে। ওই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছে জয়নাল তালুকদার। সিনেমাখোরেরা বলে— নাইট শো ভাঙার পর বড়পুলের উপর মাঝে মধ্যে সাদা কাপড় পরা এক তরুণীকে দেখা যায়। সিনেমাখোরদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। সিনেমাখোরেরা যত তাড়াতাড়ি হাঁটে সাদা কাপড় পরা তরুণী তত জোরে হাঁটতে থাকে। কেউ তাকে ধরতে পারে না। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তরুণী এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। এ কথা এ কান ও কান হতে হতে সমগ্র শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের তুলনায় গ্রামের লোকগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি সিনেমায় আসক্ত হওয়ায় এ কথা দ্রুত শহরতলী গ্রামগুলোতেই ছড়িয়ে পড়ে এবং একদিন জয়নাল তালুকদারের কানে পৌঁছে। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই জয়নাল তালুকদার মধ্যরাতে বড়পুলের উপর দাঁড়িয়ে থাকে।

লক্ষ্মী সিনেমা হল থেকে হৈচৈ শব্দ ভেসে আসছে। তার মানে শো ভেঙেছে। মৌচাকে ঢিল দিলে মৌমাছিগুলো যেমন দিদ্বিদিক ছুটে যায় শো ভাঙার পর সিনেমাখোর মানুষগুলো ঠিক তেমনি যার যার গন্তব্যে ছুটছে। জয়নাল তালুকদারের মনের গহিনে নাড়া দেয় বিশ বছর আগের স্মৃতি। একমাত্র মেয়ে জোস্‌নার কথা তার ভীষণ মনে পড়ে। জোস্‌নার তখন পনেরো অথবা ষোল বছর হবে। তার বাড়ির কামলা আফছারালীর বয়স চব্বিশ অথবা পঁচিশ হবে হয়তো। আফছারালীর সাথে জোস্‌নার খুব খাতির ছিল।

তখন বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা হিড়িক পড়েছে। দ্বিপপুর, চন্দ্রপুর, মুনসুমি, ঢোলভিটি, রহমতগঞ্জ গ্রামের জোয়ান-বুড়ো ছেলে-মেয়ে অনেকেই অনেকবার বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখেছে। একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার, সাতবারও দেখেছে কেউ কেউ। দ্বীপপুরের তুখোড় সিনেমাখোর আবু বক্কার প্রতিদিন নাইট শোতে থার্ড ক্লাস সিটে বসে বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখত। দীর্ঘ একমাস সিনেমা চলে। শেষের দিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সেদিন আবু বক্কার সিনেমা দেখার টাকা জোগাড় করতে পারে না। তবুও তার সিনেমা দেখা চাই। সে মনে মনে এক পরিকল্পনা করে। বিগত ঊনত্রিশ দিনের সিনেমা টিকিট তার সংগ্রহে ছিল। ঊনত্রিশ দিনের টিকিটের ছেঁড়া অংশ একত্রিত করে সে সিনেমা হলের ম্যানেজারের কক্ষে উপস্থিত হয় এবং বলে, আমি গত ঊনত্রিশ দিন এই সিনেমা দেখেছি এই আমার টিকিট কিন্তু আজ আমার কাছে টাকা নাই আজ আমাকে বিনা টিকিটে সিনেমা দেখার সুযোগ দিতে হবে। ম্যানেজার কিছুটা মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকে বিনা টিকিটে সিনেমা দেখার সুযোগ করে দেয়।

মানুষের মুখে মুখে রটে যায় বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমার গল্পকথা। আবু বক্কারের মতো তুখোড় সিনেমাখোরেরা তো বটেই অনেক সাধারণ মানুষ বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখার জন্য হলে ভিড় জমাতে থাকে। কেউ পরিবারপরিজন নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সাথে কেউবা প্রেমিকার সাথে সিনেমা দেখতে যায়। শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা রাতভরা সিনেমা দেখে দিনে খেতখামারে কাজ করতে গিয়ে ঘুমে ঝিমুনি দিলে গেরস্ত গালি দিতে থাকে— কিরে তুই কি রাতে বেদের মেয়ের জোস্‌না দেখপার গেছিলি!

—হ, চাচা গেছিলাম। একবার দেকছি। আবার দেকমু।

রাতভরা সিনেমা দেখে দিনভরা গাঁতা কামলারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিনেমার গল্প করতে থাকে। বাঁশতলা বাজারে মনছেরের চায়ের দোকানে মানুষ আট আনায় ‘র’ চা আর এক টাকায় দুধ চা খাওয়ার ফাঁকে সুযোগ পেলেই বেদের মেয়ের জোস্‌নার গল্প শুরু করে দেয়। সেদিন জেন্নত চাচা কইলো- হ, ভাতিজা, আমি এ পর্যন্ত তিনবার দেখছি। তাও সাধ মেটে নাই। ভাবছি আরো একবার দেখমু।

বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমার গল্প জয়নাল তালুকদারের মেয়ে জোস্‌নার কানে পৌঁছে। সিনেমা দেখার জন্য তার মন আনচান করে। ইতিপূর্বে সে তো কোনোদিন সিনেমা দেখে নাই। মনে মনে ভাবে সুযোগ পাইলে জীবনের প্রথম বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখবে। কিন্তু সিনেমা দেখার উপায় কী? সেদিন সন্ধ্যায় তালুকদার বাড়ির বাহির বাড়িতে হাস্ত্রোর ও ধাঁধাঁ খেলার আসর বসে। দিন শেষে সন্ধ্যায় প্রায়ই তালুকদার বাড়িতে এ ধরনের আসর বসে। ভদ্রসমাজ যাকে লোকগল্প বলে চন্দ্রপুরের লোকেরা তাকে হাস্ত্রোর বলে। সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ির ঝি-বৌয়েরা বসে হাস্ত্রোর ও ধাঁধাঁর আসর বসায়। সুযোগ বুঝে আসরে বাড়ির পুরুষ সদস্যরাও যোগ দেয়। সেদিন ধাঁধাঁ বা হাস্ত্রোরের পরিবর্তে আসরের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমার কাহিনী। সেখানে আফছারালী উপস্থিত ছিল। সকলের মুখে বেদের মেয়ে জোস্‌নার গল্প শুনে জয়নাল তালুকদারের মেয়ে জোস্‌না মনে বেদের মেয়ের জোস্‌না সিনেমার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। মনে মনে সে বেদের মেয়ে জোস্‌নার একটি চিত্রকল্প অঙ্কন করে। গল্পের আসর ভেঙে গেলে জোস্‌না চুপি চুপি ফিসফিস করে আফছারালীকে বলে— আপনি দেকছেন নাহি!

—হ, দেকছি।

—আমি এল্লা দেকপার চাইছিলাম।

আফছারালী চুপ করে থাকে কিছু বলে না। জোস্‌না মনে মনে ভাবে আফছারালী হয়তো তার কথা শোনে নাই। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে আফছারালী পেছনে ফিরে আসে এবং চুপিচুপি জোস্‌নাকে বলে, কালকে আবার দেকপার যামু, তুমাকও নিয়া যামু। যাইবানি?

জোস্‌না আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়— হ, যামু।

—তাইলি রেডি অয়া থাইকো। আমি সুযোগ বুইজা আসমুনি।

জোস্‌না কখন কীভাবে আফসারালীর সাথে সিনেমা দেখতে যায় তা কেউ টের না পেলেও কিছুক্ষণ পর একজন দুইজন করে বাড়ির সবাই বুঝতে পারে যে জোস্‌না বাড়িতে নাই এবং তারা এ ঘর ও ঘর খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও জোস্‌নাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কাছারী ঘরে আফছারালীকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। বেদের মেয়ের জোস্‌না সিনেমার গল্প যখন মুখে মুখে তখন জোস্‌না কোথায় যেতে পারে একথা জয়নাল তালুকদারের বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু গেরস্থর মেয়ে হয়ে বাড়ির কামলার সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া সে যে ভীষণ অন্যায়। প্রথমে ক্ষিপ্ত হলেও পরবর্তীকালে কিছুটা শান্ত হয়ে জোস্‌নার পিতা জয়নাল তালুকদার এ অন্যায় মেনে নিতে চাইলেও তার মৌলবি ভাই গঞ্জের তালুকদার কোনোক্রমেই মানতে রাজি না। তারা দলবদ্ধভাবে জোস্‌নার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকে।

নাইট শো শেষে জোস্‌না যখন মধ্যরাতে তার দাদির বোরকা পরিহিত অবস্থায় চুপিচুপি বাড়ি ফিরে ধীরে ধীরে বিধবা দাদির ঘরে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় এবং মনে মনে ভাবে— যাক, তাহলে রক্ষা পাওয়া গেল। কেউ টের পাই নাই!

ঠিক তখনই জোস্‌নার মৌলবী চাচা গঞ্জের তালুকদার খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। অন্যান্য চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা জোস্‌নার মুখ চেপে রেখে চুলের মুঠি ধরে বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যে নিয়ে যায়। তারপর আর কোনোদিন জোস্‌না ফিরে আসে নাই। আফছারালী কোনোমতে জান নিয়ে পালিয়ে যায়, তারপর তাকেও আর কোনোদিন চন্দ্রপুরে দেখা যায় নাই।

৫.

বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখতে না পেরে মৈমনসিংহের এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছে। বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখতে গিয়ে এক গর্ভবতী মা সিনেমা হলের ভেতরে বাচ্চা প্রসব করেছে। এসব খবর অনেকে জানে। কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্‌না সিনেমা দেখার অপরাধে চন্দ্রপুরের জয়নাল তালুকদারের মেয়ে জোস্‌না নিখোঁজ হওয়ার কথা কেউ জানে না।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নিঃশব্দ আহমেদ – গুচ্ছকবিতা

Read Next

অণুগল্পগুচ্ছ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *