অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাশিদুল ইসলাম -
পার্সেল

রকেটকে দেখে মনে হবে সেই যেন পোস্টমাস্টার বাবুটি কিংবা সুকান্তের কবিতায় হারিকেন হাতে দুরন্ত রানার। রকেটকে রকেট ভেবে অনেকেই গুলিয়ে নিতে পারে। সেই অকর্মটি করার আগেই বলি ওর নাম শুধু জ্ঞাতসারেই রওনক। তা বাদে রকেট নামের নামোপমার সাথে তার সকল কলাকুশলীর অন্তমিল। তার হাত যে সদা নিশপিশ করে তা সবার অদ্যপান্ত জানা। বাপদাদা যুগের ডাকঘর আধুনিক পার্সেল অফিসে রুপাচ্ছাদিত হয়েছে বলাবাহুল্য। রওনক সে-রকম একটা অফিসের করিতকর্মা লোক। যত না পরিশ্রমের আলুথালু ছাপ তার মুখে তার থেকে বেশি যাতনার ছাপ প্রতীয়মান। অবশ্য তার কাজ যে খুব একটা কায়িক তা নয়। গুলশানের আশপাশে যেসব বাসায় পার্সেল আনা-নেওয়া হয় সেই তদবিরগুলো রওনকের কাঁধেই সোপর্দ করা হয়। অফিসের ফাঁকিবাজ কলিগদের মতো তার মেন্টালিটি গ্রোআপ হয়নি গেল পাঁচ বছরেও। গৃহকর্ত্রী এ নিয়ে কথা শোনাতে কম যায় না।

—তোমার সংসার করে জীবনের সাধ আহ্লাদ কবরে গেল। কী চেয়েছিলাম আর হলো কী!

কথাটা যতবার রওনক শুনেছে তার সাথে স্ত্রীর লম্বা শ্বাস তার দারিদ্র্যকে চিনিয়ে দিয়েছে। এর প্রত্যুত্তরে কী বলবে রওনক? বলার ভাষা সে এতদিনেও আয়ত্তে আনতে পারেনি। এই একটা জায়গায় যেন সাধের মাতৃভাষা মুখ থুবড়ে আছে কিংবা বলা যেতে পারে তার বোবা কালা ছেলেটির মতো কণ্ঠের অচলতা। আগে এসব ভাবলেও এখন কান যেন রুখে দাঁড়ায় এইসব সংলাপ শ্রবণে। হৃদপিণ্ড যেন দ্বিঘাত হয় আর লিভার সেগুলো গোগ্রাসে হজম করে। তারপর অভাবের খতিয়ানে সংসারের জেরা বইতে বইতে চেনা শহরের অলি-গলি গেট-দারোয়ান আর অভিনব কলিংবেলের শব্দে সে নিজ গৃহের জঞ্জালকণা রুমালে ঘাম মোছার মতো মুছে ফেলতে চায়। সকালের নাস্তা বাড়িতে করার চল কবেই চুকেছে। স্ত্রীর বকুনির ঝালে তা যে মুখে তোলাই ভার। তখন তার ছেলেটা জেগেছে।

—ছেলেটা জাগল নাকি দেখো তো।

বোতামগুলো শার্টের ছিদ্রের ফাঁকে গাঁথতে গাঁথতে যেই বলেছে রওনক ওমনি হিংস্র প্রিয়তমা এসে ঠমকচালে ঝগড়ার তাল ঠিক রেখে উচ্চাঙ্গ অশ্রাব্য গীতি একনাগাড়ে রেওয়াজ করে গেছে। বাধ্য হয়ে রওনক ছেলেটার উঁ উঁ ধ্বনিকে উপেক্ষা করে দিনকার মতো বউ বাচ্চার গাট্টি বোচকা একটা মৃদু তবু রাগী ‘ধুরররর জীবনটা ঝালাপালা করে ফেলল’ সংলাপে কুঠুরি পেরিয়ে শহরের মঞ্চে সুখের যাত্রাভিনয় করে অফিস পথে হাঁটে । কাছেই বৃন্দাবনের সেলুনে চুলের এলোমেলো ঝাঁকগুলো সরু নদীটির মত চিরুণির শাসনে ঠিক করে নেয়। তার ভেতরে গুপ্ত থাকা আশৈশব চঞ্চলতা, দারুণ ঝিকঝিক গতিময়তা, অশ্রান্ত, অক্লেশ সরলতা জেগে ওঠে তখন। বাড়ির বাইরে এলেই তার হালকা লাগে।

পার্সেল অফিসের দুটি দরজা। পাশাপাশি এক ঘরে গ্রাহকের মালামাল সামগ্রী আর এক পাশে স্লিপিং রুম। সেখানেই টেবিলের উপর কাগজের দস্তখৎ নিয়ে বসে আছেন নবীনদা। নবীনদা অফিসের বস। চেহারায় তিরিক্ষি ভাব থাকলেও বেশ সরল-শান্ত। যখন কথা বলে মনে হয় কথাগুলো পোনা মাছের মতো খলবল করে কণ্ঠ নিঃসৃত হয়ে বের হচ্ছে। রওনক ওরফে রকেট কাছে গিয়ে দাড়াতেই খসখসে কলমের আচড়ে একটা আড়ং রশীদ ধরিয়ে দিয়ে আরেকটায় মনোযোগ দিলেন। চোখ নামিয়ে বললেন, মালামাল খুব একটা দেওয়া নেওয়া হচ্ছে না রে। এই মাস ছোকরাগুলো খাটুক। সামনে মাসে কিছু ছাঁটাই হয়ে যাবে মনে হয়।

রওনক নিশ্চুপে ছুটল পার্সেল হাতে পথে। ঠিকানা অনুযায়ী হাঁটা পথে মিনিট বিশেক লাগার কথা। তবু তার ভেতরে অদ্ভুত তাল। সামনের মাসে কি তাকে ছাঁটাই করা হবে? সে ফের ভাবে— নাহ, সার্ভিস তো খারাপ দিয়ে আসছে না। তবুও সূক্ষ্ম একটা চিন্তা তাকে খোঁচায়। সংসারের অশান্তি নিয়ে সে কোনোমতে বেঁচে আছে চাকরি গেলে তা যে চরমে পৌঁছাবে। নাকি ব্যাকআপ হিসেবে অন্য কিছু খুঁজবে? কপালের ঘামটা একবার সে মুছে নেয়। গুলশান ১ এ দাঁড়িয়ে রওনক। রশীদের ঠিকানা অনুযায়ী সে চলে এসেছে। চোখ কপালে উঠার মত মস্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তার নিজের অবস্থান নিয়ে হাসি পায়। কারুকাজ করা গেট পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় পৌঁছে যায়। কলিংবেল টিপতে হবে এবার। কলিংবেলটা রওনকের কাছে ভাগ্যের উপমা মনে হয়। কত জায়গায় সে কত তদবির নিয়ে গেছে কিন্তু কখনো তার মনে এতটুকু কালিমা উঁকি দেয়নি। কখনো তার মনে হয়নি পার্সেলটা খুলে পরখ করে। দরজা খুলে যে বের হলো তার আঙ্গিক বিবরণ এইটুকু যে সে একজন উঠতি বয়সী মেয়ে। রশীদে সিগনেচার করে পেঁচানো মুঠি বদ্ধ কয়খানা নোট সে রওনকের হাতে গুঁজে দিয়ে তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গেল। মেয়েটির মুখের অন্ধকার রওনকের চিরচেনা চিত্র। তার দৃষ্টিপটে এই বিমর্ষ রূপ অসংখ্যবার ধরা দিয়েছে। রওনক টাকাগুলো দু’বার গোনে দাঁড়িয়েই। সর্বমোট ১৫০ টাকার নেতানো জলজ নোটগুলো সে মুষ্টিবদ্ধ করে আর ঠিক তখনি আগের মতো তড়িঘড়ি করে ভেজানো দরজা ফাঁক হয়ে যায়। মেয়েটি অসম্ভব অস্থিরভাবে নড়ছে। তার কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বাদামি শপিং ব্যাগ ঢুলছে।

—ভাইয়া একটু উপকার করেন না প্লিজ। ব্যাগটা পৌঁছে দেবেন দয়া করে। ব্যাগের গায়ে ঠিকানা লেখা আছে।

মেয়েটি হাত আগাল তবে রওনক নিশ্চল। সে অফিসিয়াল কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো আবদার সচরাচর রাখে না। এখন অবশ্য যেচে উপকারে ফায়দা খুব কমই হয়। একবার এইরকম একটা গল্প— না গল্প কেন তারেক ভাইয়ের সাথে তো সত্যি ফলেছিল। তারেক ভাই রওনকের কলিগ। লোভনীয় একটা তদবির সে পেয়েছিল নাকি। মোহাম্মদপুর নিয়ে যেতে হবে একটা ব্যাগ তার জন্যে লোকটি পাঁচশত টাকার কচকচে একটা রূপবতী নোট তার পকেটে গুঁজে দিয়েছিল ঠিকানাসমেত। যথারীতি তারেক ভাই গেলেন মোহাম্মদপুর নেমেই নীল দস্যুরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। পরে অনেক লোক লশকর ধরে তাকে নাকি ছাড়ানো হয়েছিল। পরে জানা যায় ওই প্যাকেটে লাল গোল রুপভান ছিল। তবে মেয়েটির থমথমে মুখ দেখে তেমন কিছু মনে লাগল না রওনকের। মেয়েটি আর্জি নিয়ে তাকাল আর তখনি বেদনার একটা দেশলাই যেন নিঃশব্দে জ্বলে উঠলো মেয়েটির অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখে। পোটলাটা তার নিতেই হলো। মেয়েটি আর্দ্র কণ্ঠে বলল, ব্যাগের ভেতরে আরও দুইশ টাকা আছে। ভাড়া দিয়ে যা বাঁচে আপনার।

—কী আছে এতে?

মেয়েটি তাকাল তবে এবারে আবার সেই অবাধ্য অন্ধকার ভেসে উঠল মুখে আর রওনক ‘পৌঁছে দেব’ বলে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। মেয়েটির মুখের অন্ধকার রওনকের আর দেখা হবে না। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের অতল কুটিরে। প্রতিটি ধাপে তার মৃতপ্রায় ইচ্ছাগুলো ঝরে পড়তে লাগল শীতের পাতাদের মতো।

ব্যাগের গায়ে কাঁপা ছোট-বড় অক্ষরে যে ঠিকানা লেখা সেখানে হেঁটে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। রওনকের পেট টনটনায়। মেইন রোডে এসেই সে বাস ধরল। এই বাস বেগুনবাড়ি হয়ে যাবে। বাসে উঠেই তার ভ্রান্ত ধারণা কেটে গেল যে পাবলিক বাসে নাকি যা তা অবস্থা। ভাড়া নেওয়ার সময় দেখা গেল মেশিনের বোতাম টিপে স্লিপ বের করে দিল কালেক্টর লোকটি। জানলার ধারে চেপে বসলে শহুরে হাওয়ায় তার কেমন একটা ভাসা ভাসা ছবি চোখে পড়ে গেল। ঠিক চোখে নয়— মনে পড়ল। নাইমাকে নিয়ে তার সতেজ স্মৃতিগুলো শুকনো হয়ে গেছে এতদিনে। সংসারে এসে নাইমা প্রেম পর্যায়ের রূপরেখা বদলে যে রুদ্রমূর্তি তার নরম চিবুকে অঙ্কিত করেছে তা রওনক কখনো ভাবেনি। এখন নাইমাকে মনে হয় পাতাহীন রুক্ষ কাঠবাদাম গাছের মতো— তার সাংসারিক হস্তক্ষেপকে বলা যায় মেছের আলির ক্ষ্যাপলা জালের মতো আর নাইমার শরীর যেন অতিরিক্ত নোনতা তরকারির মতো— চাখলেই জিহ্বা তুরতুর করে। বউয়ের কথা রেখে রওনক ভাবে তার বোবা-কালা ছেলটির কথা। সে কি রওনকের নিস্তব্ধ কণ্ঠের বারতা নিয়ে এসেছে? ওর জীবন-ই হয়তো ভালো। রওনকের মতো অজস্র কণ্ঠ ওর মতোই তো অব্যবহৃত ফাঁকা আওয়াজ করে— কেবল শুকনো একটু বাতাস মুখ গলিয়ে বেরিয়ে যায়।

কালেক্টর দ্বরাজ গলায় হাঁকে— এইইইই বেগুনবাড়ি নামেন— বেগুনবাড়ি। ওস্তাদ বাঁয়ে।

রওনকের ক্ষণিক যাত্রাপথের ভাবনা চুকে গেলে সে নামে। আশপাশে বস্তিগুলোর চাঁদোয়ার চালা যেন হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। ব্যাগে লেখা ঠিকানায় চোখ বোলালো রওনক।

শামীম শেখ

বেগুনবাড়ি মোড় (দোকানে জিজ্ঞেস করলে ঘর দেখিয়ে দেবে)

ঠিকানার বিষয়বস্তু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। রওনক দেবে যাওয়া পেটে হাত বোলায় কয়েকবার। বাস ভাড়া দিয়ে একশত আশি টাকা তার মুঠির ভেতরে গরম হচ্ছে। সেখান থেকে ফিরতি ভাড়ার বিশ টাকা সে বুক পকেটে রেখে ফোলা পকেটটা আলতো চাপ দিল। দোকানে যেহেতু জিজ্ঞেস করতে হবে তাহলে একটা বিস্কুট সহযোগে এক কাপ চা তো পেটের অতল গহ্বরে চালান করা যায়। মোড়ের দোকানটায় গিয়ে বসল রওনক। শহরের দোকানে বসা মানেই চা হাজির। তবে শুকনো একটুকরো থ্যাবড়া কেক সে নিজের হাতেই নিল। রওনক একসময় খেয়ালে বলল, শামীম শেখের বাসাটা কোথায় বলতে পারেন?

মনে হয় এ পাড়ায় শামীম নামের একজনের বসবাস। বলতেই দোকানদার দেখিয়ে দিল ইশারায়। বস্তিঘেরা এলাকার ভেতর দিয়ে রঙচটা ঐ দালানটাই মনে হয় ইশারার ম্যাপে। রওনক চায়ে চুমুক দিতেই তার কেমন যেন অনুভূতি লাগে। সামনে মাসের চাকরি খোয়ানোর দোটানা ভাবনা তার চিন্তায় বসে না। বরং সে ভাবে গুলশানের আলিশান বাসার একটা মেয়ে বেগুনবাড়ি বস্তির একটা ছেলেকে কী পাঠাল আর তাও আবার জরুরিভাবে। এই নিমগ্ন পার্সেলের গূঢ়ার্থ জানার কৌতূহল তার রক্তে কেমন শিহরণ জাগাল। মেয়েটির থমথমে অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘাবৃত মুখটি পলকে ভেসে উঠলো আবারও। তবে কি শ্রেণিচেতনার ভয়াবহ আবহে চিত্রিত এই প্রেমিক যুগলের পরাজয়? রওনক আর নাইমা তো একই শ্রেণি থেকে উটে আসা অসুখী দম্পতি। ভালোবেসে তারাও তো লক্ষ্মী সঁপেছিল পায়ে। তারাও তো চেয়েছিল চার দেওয়ালের শান্তি আর স্নিগ্ধতা। তারা চেয়েছিল একটি ফুলেল বাগান—গুটিকয় সফেদ ফুল— সমশ্রেণি থেকেই। পেয়েছে কি? ঘোরের ভেতরেই সে ব্যাগের মুখ খোলে। তার খটকা লাগে জিনিসটা দেখে। সাদা রঙটা যে রওনক প্রথম দেখছে তা না। তার একটা পাঞ্জাবি রয়েছে ধবধবে সাদা। তবে এটা কেমন সাদা ঠাহর হয় না। খানিকক্ষণ আঙ্গুলের ঘষামাজা চলে। যখন সে বুঝতে পারে কাপড়টি প্রাণহীন মানুষের দেহে আবৃত শেষ পরিধেয় কাফন তখন তড়িঘড়ি করে চা বিল মিটিয়ে গুলশানের বাস ধরতে ছোটে রওনক। দোতলার সেই মেয়েটির মুখের অন্ধকার কি এখনো জেগে আছে প্রাণ নিয়ে?

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *