অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১১, ২০২৫
২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১১, ২০২৫
২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মোহাম্মদ কাজী মামুন -
ব্রেকিং নিউজ

দীপ পড়ার টেবিল থেকে উঠে ডাইনিং রুমে একটু উঁকি মেরেছিল, সেখানে বাবা বসে আছেন চোখ জোড়া সম্পূর্ণ টিভির মধ্যে সেট করে। ওর হাতে একটা অসম্পূর্ণ সমীকরণ অঙ্ক ধরা ছিল, অনেক কাটাকাটি করেও সমাধানটা মেলাতে পারছিল না, ভেবেছিল বাবার কাছে গেলে মুহূর্তেই পেয়ে যাবে সূত্রটা। দীপের কোনো প্রাইভেট মাস্টার নেই, দিনের বেলায় স্কুল ও রাতে বাবা— এরাই তার শিক্ষক।

বেশ কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়িয়েও যখন কোনো সাড়া পেল না বাবার, তখন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু টেলপে ভেসে উঠা ব্রেকিং নিউজটা তাকে থামিয়ে দিল! যে লোকটির নাম দপদপ করে উঠছিল আর কাঁপিয়ে দিচ্ছিল স্ক্রিনটাকে ক্ষণে ক্ষণে, তাকে এই তো গেল মাসেও দেখে এসেছে সিনেপ্লেক্সে! সেই পারিবারিক মুভি টাইমে মায়ের সাথে বাবাও তো ছিল! তাহলে বাবা এখন এত নির্বিকার কেন? আচ্ছা, আবার এমন হয়নি তো, বাবা ব্রেকিংটা খেয়ালই করেনি একটুও! পুরোই মজে রয়েছে টকশোতে, যেখানে অংশ নিয়েছে সরকার ও বিরোধী দলের দুইজন নেতা, আর একজন আরেকজনের উপর শুধু হামলে পড়তেই বাকি রেখেছে!

একটা সময় ধ্যান ভাঙাতেই হয়তোবা প্রশ্নটা ঝরে পড়ল দীপের কণ্ঠ বেয়ে, ‘সিওপিডি রোগটা কি জিনিস, বাবা? মানে, লোকটা হঠাৎ করেই চলে গেলেন যে রোগে!’

‘হঠাৎ করে আবার কি রে! গড় আয়ু অনেক আগেই পার করে ফেলছিলেন! মানুষ কি চিরকাল বাঁচে!’ দীপের বাবা মুখ খোলেন, কিন্তু টকশো থেকে চোখ না তুলেই। তার নির্বিকার কণ্ঠের ধ্বনিগুলো গমগম করে কাঁপাতে থাকে ড্রয়িং রুমের পর্দাগুলোকে! আর দীপ কিনা ভেবেছিল বাবার চোখেই পড়েনি ব্রেকিংটা!

শেষ দেখা সিনেমাটার কথা মনে পড়ে দীপের। সহঅভিনেতার পার্ট ছিল, আর খুব কম সময়ের জন্য ছিল সে সিনে। কিন্তু তাও মনে দাগ কেটে গিয়েছে দীপের! সেই হাড়কাঁপানো পৈশাচিক হাসি! সেই লোকটা এখন আর নেই! কালকেই তাকে জানাজা শেষে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে কবরে! মাটির ঘরে শুয়ে থাকবেন চোখ বুজে! এক সময় সারা শরীর থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়বে মাংসগুলো, শধু পড়ে থাকবে কঙ্কাল। আরও পরে তাও ঝরে গিয়ে থাকবে দু’চারটা হাড়গোড়; হাজার বছর পর সেই ফসিল নিয়ে হয়তো হবে কোনো গবেষণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে সেই হাড়ের উপর চলবে ঠোকাঠুকি! আর ভাবতে পারল না দীপ! তার বিজ্ঞান ক্লাসে যখন কথাগুলো শুনেছিল তখন এতদূর তলিয়ে দেখেনি সে! এখন যেন সবকিছু তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে!

পড়ার টেবিলে নিঃশব্দে ফিরে আসে দীপ, আর ঐ সমীকরণটা ছেড়ে নতুন একটা সমীকরণে মন দিতে চেষ্টা করে! এই অঙ্কটা আগেরটার মতো বিদঘুটে ছিল না, তবু মাঝপথেই থেমে যেতে হয় তাকে। একটা চিন্তা মেঘের বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠে তার মনে আর কাঁপিয়ে দিয়ে যায়! আচ্ছা, ঐ অভিনেতার বয়স হয়ে গিয়েছিল, তাই চলে যেতে হলো! আর তার বয়স অনেক কম বলে তাকে সেই মৃত্যুটি দেখতে হলো! এমনি করে যারাই তার থেকে বড়, তাদের সবার মৃত্যু তার চোখের সামনেই ঘটবে! তার চারপাশের প্রায় সবাই তো তার বড়! তাহলে! ভয়ে সাদা হয়ে গেল সে! একটি মৃত্যু জাহাজ তরতর করে এগিয়ে আসছিল তার দিকে!

একটা সময় কিছুটা সম্বিত ফিরে এলে নিজেকে বুঝ দিল, যা ঘটার ঘটবে, চাইলেও ঠেকাতে পারবে না সে। তার চেয়ে ভালো মৃত্যুদৃশ্যগুলোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখা! আচ্ছা, যেদিন তার দাদার মৃত্যু হবে, তাদের গ্রামের বড় বাড়িটা ভেঙে পড়বে মানুষে, তাই না? বাবা আর ফুপুর করুণ কান্নার সুরে বুক ভেঙে যাবে সবার, মৃত্যুর কনকনে হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে তার মা আর বোন জড়িয়ে ধরে থাকবে তার দাদিকে। তার দাদা একজন মানি লোক, অনেক বিচার-আচার করেছেন; সুতরাং, মৃত্যুর আবহাওয়াটা বজায় থাকবে বেশ কদিন বাড়িতে। কিন্তু তার দাদির সময় হয়তো এতটা ভিড় হবে না! তাও তাদের পরিবারের কষ্টটা আগেরটার সাথে যোগ হয়ে বিশাল আকার ধারণ করবে! তার বাবা হয়তো নাওয়া-খাওয়াই ছেড়ে দেবে! আর তার একমাত্র ফুপুটা যখন একটানা সুরে বিলাপ করতে থাকবে, ‘আমার বাবাও নাই, মাও নাই… আমি এতিম… এতিম… এই দুনিয়ায়!’ তখন সে আর তার বোন জাপটে ধরে থাকবে ফুপুকে!

‘দরজাটা ভালো করে আটকায় দাও। আমি একটু আইতাছি। মোশারফ ফোন দিছিল, তাড়াতাড়ি করতে কইল।’ বাবার কণ্ঠ ধ্যান ভাঙায় দীপের, ফিরিয়ে আনে যমপুরী থেকে। মোশারফ একজন মাছ বিক্রেতা, বাবার সাথে বেজায় খাতির, ফ্রেশ মাছের স্টক এলে প্রথম ফোনটা সে বাবাকেই করে! একটা মচমচে মাছ ভাজার গন্ধ তাতিয়ে দিতে লাগল দীপকে! পড়ার টেবিলে আর মন বসল না; ‘বাবা নেই’ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ড্রয়িং রুমের রিমোটটা হাতে তুলে নিল। ব্রেকিং নিউজটা এখন হেডলাইনে কনভার্ট হয়েছে, মানুষ ভেঙে পড়ছে প্রয়াত নায়কের বাড়িতে, একের পর এক সাক্ষাৎকার আসছে, ক্যামেরাম্যান হুমড়ি খেয়ে পড়েছে!

এক সময় একঘেয়ে লাগতে শুরু করে দীপের। একটি কার্টুন চ্যানেলে ঠাঁই নিয়েছিল কেবল, হঠাৎই মায়ের থমথমে গলা শুনতে পেল, ‘তর বাবায় তো কহনো এত দেরি করে না! একটু দেইখা আয় তো দীপ!’ হাইস্কুলের ছাত্র হওয়ার পর দীপ মাঝে মাঝে একাই বাজার যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এক-আধ সের মাংস বা গরম মশলা— এরকম টুকিটাকি জিনিস কেনায় সে নজরকাড়া সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে!

কিন্তু আজ একটু বেশি রাতই ছিল, আর এরকম সময় বাজারে যাওয়া এই তার প্রথম! যতই হাঁটতে থাকে, একটা অশুভ চিন্তা ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে তাকে! আচ্ছা, বাবার যদি সত্যি সত্যি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়! সে গিয়ে হয়তো শুনল মোশারফ কাকার কাছে, বাবা অনেক আগেই মাছ নিয়ে বাসার দিকে চলে গেছে! তখন তো নিশ্চিত আরও খোঁজাখুঁজি হবে! শেষমেশ হয়তো আবিষ্কার হবে, বাবা পথিমধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, আর কাছের মনোয়ারা বেগম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে! তারা ছুটে গেল সবাই আইসিইউতে, কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেল বাবাকে মাথা ঢেকে বের করা হচ্ছে সেখানে থেকে! তার মা বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠবে, আর হাসপাতালের অভ্যস্ত দেয়ালও তা সইতে পারবে না! সে এক সময় শুয়ে পড়বে বারান্দাতেই, আর সে আর তার বোন দুই ধার থেকে তাকে জড়িয়ে থাকবে!

দীপের চারপাশ হঠাৎ করেই প্রবল বাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আর তাকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয় সেখান থেকে বের হতে, কারণ একটি কাজ নিয়ে সে বের হয়েছে রাস্তায়। রাস্তার গ্যাঞ্জামেই কিনা, একটা সময় আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হতে শুরু করে, আর দীপের মনে হতে থাকে, সে একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে। এমন কিছু হবে না। বাবা অক্ষতই আছে। আর অক্ষত না থাকলেও যা হওয়ার তো হবেই, সে ঠেকাবে কী করে! বাবা-মা তো চিরকাল আর বেঁচে থাকে না।

হঠাৎ দীপের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, মা শব্দটা এসে তার ভাবনার রাজ্যকে নতুন করে ওলটপালট করে দিয়ে গেছে! সে যতই চেষ্টা করল চিন্তাটাকে দূর করে দিতে, ততই এসে দাঁড়াল সত্যটা! সে দেখতে পেল, মা হাসপাতালে পড়ে রয়েছে, দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর অন্তিম মুহূর্তটা পার করছে! ডাক্তার নিজেই তাদের দুই ভাইবোনকে ডেকে এনেছেন। তার বোন ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে, আর সেই সঙ্গে কেবিনের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান হচ্ছে! দীপ প্রবলভাবে জাপটে ধরে আছে তার বোনকে!

ঐ তো বাজারটা দেখা যাচ্ছে। আলোর বিস্ফোরণ! শত শত মানুষ গিজ গিজ করছে! এত রাতেও! ‘বড় আপুটা থাকলে ভালো হইত, মায়ের পাশে থাকলে একটু সাহস পাইত।’ আপনমনেই বিড়বিড় করতে থাকে দীপ বাজারটার কাছাকাছি এসে। কিন্তু হঠাৎই তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে যায় চিন্তাটা; আপুটা তার থেকে বড়, তাহলে তো…! পুরো শিউরে উঠে সে এবার! সে সবাইকে ছাড়তে পারে, কিন্তু বড়াপুকে না! বাবা-মার হাতে অনেক মার খেয়েছে, কিন্তু বিয়ের পর বরের সংসারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে শুধু আগলেই রেখেছে দীপকে! বড়াপু যেদিন চলে যাবে, সেদিন কি হবে কে জানে! সে নিশ্চয়ই উন্মাদে পরিণত হবে! আচ্ছা, কে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখবে তখন!

‘এই দীপ, কী হলো, উঠ, উঠ, খাইতে আয়! তর বাবার আনা মাছগুলি এইমাত্র ভাজা হইছে!’ মায়ের ডাকে হুঁশ ফেরে দীপের, পড়ার টেবিলেই এলিয়ে পড়েছিল কখন খেয়াল নেই। পরে যখন বাথরুমে যায় হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে, একটা বিষয় মাথায় আসতেই শীতল স্রোত বয়ে যায় তার মেরুদণ্ড দিয়ে! বড়াপুর পরের মৃত্যুপর্বটা তখন রচিত হতে শুরু করেছে!

চেনা দুনিয়াটা হঠাৎ করেই অচেনা হতে শুরু করে দীপের, একটা সময় সব কিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে! এই শহর, বাড়িঘর, রাস্তা, বাজার-ঘাট, মোশারফ কাকার মাংসের দোকান, তার পড়ার টেবিল, বই-খাতা, সমীকরণ অংক— সবকিছু খসে পড়তে থাকে একে একে, কাগজের টুকরো হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে, আর তার মাঝে সে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে!

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *