
থলথলে পিচ্ছিল জলের মধ্যে গোলাকার থলের মতো কিছু একটা খুঁজে পায় নিঃশব্দ। নেড়েচেড়ে দেখে বুঝতে পারে পর্দার মতো আবরণে ঢাকা এই থলের মধ্যে প্রাণ আছে, নড়ছে কিছু। চারপাশে তাকিয়ে আবর্জনামাখা গর্তের পাশেই একটা ঝুপড়ি গাছের নিচে থলের মতো জিনিসটা লুকিয়ে রাখে। অপেক্ষা করে সন্ধ্যের জন্য। আঁধার না নামলে কুড়িয়ে পাওয়া থলেটি নিজের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে না, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে যেমন, তেমনি ভয়ও রয়েছে এটি হারিয়ে ফেলার।
দুপুরের রোদ খাঁখাঁ করে মাটির বুক ফাটিয়ে তুলছে। নিঃশব্দ ভাবছে খুব। এরই মধ্যে কিছু কুকুর মাটি শুঁকতে শুঁকতে থলেটার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই নিঃশব্দ সামনে দাঁড়ায়। কুকুরগুলো দারুণভাবে ভয় পেয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে পালিয়ে যায়। নিঃশব্দ আঁকতে ভালোবাসে। আর্দ্র মাটিতে একটি জবা ফুল আঁকিয়ে ফেলে। রঙহীন জবা দেখে তার ভালো লাগে না! ইচ্ছে করে লাল টকটকে জবা দেখতে। কিন্তু মাটিতে কীভাবে রঙ করবে, পাবেইবা কোথায়! জবা হতে হবে লাল, টকটকে লাল।
নিঃশব্দ অদ্ভুত আচারণ করতে করতে বুকের বাঁপাশে হাত ঢুকিয়ে ছিড়ে নিয়ে আসে হৃদপিণ্ড। সেখান থেকে টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে সে রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে মাটির জবা! স্বাভাবিকভাবেই আবার সে হৃদপিণ্ড বুকে ঢুকিয়ে নেয়, মাটিতে আঁকানো জবা ফুলটি তাজা জবা হয়ে যায়! সে আকাশফাটা শব্দে হো হো করে হাসতে থাকে। আশপাশে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও তার হাসি কেউই শুনতে পায় না।
মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসতেই থলেটি তার বাসভূমিতে নিয়ে যায়। বাড়ির প্রধান গেটের তালা খুলতেই আশপাশের গাছগুলো কেমন দুলে দুলে নেচে ওঠে। প্রধান গেট বন্ধ করে ঘরের দরজা খোলে, আজ তার কেমন যেন গা ছমছম করে! কোথাও কেউ নেই। বিরান প্রান্তরে নির্জন এ বাড়িতে সে একা বহুবছর বাস করে আসছে। কখনো আলো জ্বালায় না। অন্ধকার তার খুব প্রিয়। তবুও আজ মনে হয় একটু আলো হলে খুব ভালো হতো! থলের মতো জিনিসটাতে হাত দিয়ে অনুভব করছে সেটি এখনও নড়ছে। মেঝেতে রেখে নখের আঁচড়ে একটুখানি ছিদ্র করতেই তার মধ্যে থেকে আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে। নিঃশব্দের চোখ ঝলসে যায় সে লুকিয়ে পড়ে ঘরের এক কোণে।
মনে মনে অনুতপ্ত হয় এই অলক্ষণে জিনিসটা বাড়ি বয়ে টেনে আনার জন্য। অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর সেখানে তাকিয়ে দেখে থলে থেকে পুতুলের মতো একটি আলোকিত পা নড়ছে। সে এগিয়ে গিয়ে পুরো থলেটা ছিঁড়ে ফেলে। তার ঘর আলোর ঝলকানিতে চকচক করে ওঠ পুরো ঘর। যে শিশুটি শুয়ে আছে তার মাথা গা-গতর লজ্জা, জবা ফুলে ঢাকা। তার থেকে আলো ছুটছে খুব। নিঃশব্দ চোখের কোণে জলের অনুভব করে। সে দু হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে নিতে চাইলে শিশুটিও দু হাত বাড়িয়ে তার কোলে ওঠে। নবজাতকের নাড়ি আপনা থেকে কাটা, গা সাফ করা, জন্ম নেওয়ার পর যে ময়লা গন্ধ এসব কিছুই নেই, কিন্তু সে জন্ম থলির মধ্যেই অবহেলিতভাবে আবর্জনার নালার মধ্যে ছিল। অবাক হয়ে নিষ্পাপ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ফিরে যায় প্রেমিকার তলপেটের কাছে, সেদিন সেখানে কান পেতে শুনেছিল আরেকটি প্রাণের স্পন্দন! বাচ্চা প্রসবের আগেই সুযোগ বুঝে ঘরে তুলে নেবে বউ করে এমন কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে কারা যেন ধর্ষণ করে ফেলে রেখেছিল সেই প্রিয় প্রেমিকার মৃতদেহ! বর্তমানে ফিরে এসে শিশুটির হাতের উপর চুমু দিতেই একজন কিশোরীকে সামনে দাঁড়িয়ে চিরুণি হাতে বলতে শোনে— বাবা, চুল বেঁধে দাও। স্কুল যেতে হবে!
নিঃশব্দ বুঝতে চায় আসলে কী হচ্ছে…! চোখের পলকে সময় এভাবেই কেটে গেল নাকি অলৌকিক!
জবা বকবক করতে করতে স্কুল রুমে প্রবেশ করে। বেঞ্চে বসে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্ল্যাকবোর্ডে কালোর মধ্যে থৈ থৈ কালোতে ভাসতে থাকে জবা…। সেখানে শিক্ষকটির মুখসহ ভেসে ওঠে আরও কয়েকজনের মুখ… ওর মাকে মেরে ফেলছে তারা! জবা চোখ খুলে দেখে সে তার বাবার কোলে শুয়ে আছে। চারপাশ শুনশান, বিশাল বাগান, সেখানে এই পরিত্যক্ত বাড়ি। একটা দোলনা বেঁধে রেখেছে জবার বাবা তারই জন্য।
একদিন দুপুরে ছেলে-মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে বল এদিকে আসলে দল বেঁধে নিতে এলে জবাকে দেখে ভূত ভূত বলে ছুটে পালিয়ে যায়। এখানে একা কেউই আসতে চায় না!
জবা বড় হয়ে যায়। অবিকল তার মায়ের মতো চেহারা পেয়েছে। নিঃশব্দের ভয় বাড়তে থাকে। নিঃসঙ্গ এ জীবনে সাথী হয়ে আছে এই মেয়েই। তাকে যদি হারিয়ে ফেলে! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের পর জবা তার সহপাঠী প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের দিকে তাকালে প্রত্যেকের শরীরজুড়ে অসংখ্য পুরুষাঙ্গ এবং নারীদের নারীচিহ্ন দেখে অবাক হয়! পোশাকের মধ্যে দিয়ে সে সব দেখতে পারে কীভাবে! পুরুষ সহপাঠী, শিক্ষক দেখলেই জবার কেমন যেন একটা ভয় জাগে। কারণ তাকে দেখলেই প্রত্যেক পুরুষের শরীরে অসংখ্য পুরুষাঙ্গ মুহূর্তের মধ্যে গজিয়ে উঠতে দেখেছে, শেষমেশ মানুষগুলোর মাথা এবং চোখ কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না!
জবা বাড়ি ফিরে এবার তার বাবার দিকে তাকায়! কিন্তু সে বাবাকে বাইরে দেখতে পেলেও পোশাকের ভেতরে কোনো মানুষের অস্তিত্ব দেখতে পায় না! নিঃশ্বব্দ ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে! নিজেই স্বীকার করে সে মানুষ নয়। স্যাঁতসেঁতে আবর্জনা থেকে একটা থলের মধ্যে জবাকে কুড়িয়ে পেয়ে সেদিন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করেছিল, কারণ দিনের বেলা থলেটা নিয়ে আসতে তাকে কেউ দেখতে না পেলেও থলেটা দেখে আক্রমণ করত। তার প্রেমিকাকে মেরে ফেলার পর আদালতে মামলা দায়ের করার অপরাধে তাকেও মেরে ফেলা হয় পাশবিকভাবে। বাবা মেয়ের কথার মাঝেই কারা যেন দরজায় কড়া নাড়তে থাকে জোরে জোরে। ভেতর থেকে দরজা না খোলায় দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। হাতে লাঠি ফালা! তারা নাকি এই বাড়িতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আর এক তরুণীকে প্রবেশ করতে দেখেছে। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে, কাউকে কোথাও না পেলেও ঘরের মাঝখানে দেখতে পায় জ্বলজ্যান্ত ডাঙ্গর সবুজ পাতার জবা গাছ, তাতে ফুটে আছে একটি লাল টকটকে জবা। একজন সেই জবাটা ছিঁড়তে গেলে গাছসহ ফুলটা মাটির হয়ে যায়। যা দেখে লোকজন ভয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।
সিরাজগঞ্জ থেকে