
পৌষের সকালে মিহি রোদ ঝরছে। শীত আসি আসি বলে বায়না করছে অবাধ্য কন্যার মতোন। যেকোনো সময় এসে কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে দেবে নিশ্চয়। এমন সোনাঝরা ভোরে উমেশ বাবার সঙ্গে বসে গুরুপ্রণাম স্তব উচ্চারণ করছে, “ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া; চক্ষুরুন্মিলিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবেই নমঃ।” বাবা শ্রী নারায়ণ চন্দ্র বর্মন শ্লোকের অনুবাদ করছেন, ‘যিনি অজ্ঞান-অন্ধকারাচ্ছন্ন শিষ্যের চোখ জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা দিয়ে খুলে দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে ভক্তিভরে প্রণাম করি।’ বাবার সাথে সাথে উমেশও দুহাতে প্রণাম করল। বাপ-বেটার এ রোজকার নিয়ম। কাক ডাকা ভোরে আহ্নিক সেরে গীতাপাঠে মগ্ন হয় দুজন। বাড়ির অন্য সদস্যদের অবশ্য এমন সময়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এমন হিমধরা প্রভাতে সবাই যে ঘুমের রাজ্যে!
গীতাপাঠ শেষ হওয়ার পূর্বলগ্নে নারায়ণবাবুর খাবার টেবিলে থাকা চাই। এঘরে প্রায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ঈশ্বরপুর মডেল হাই স্কুলের এই সহকারী শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায় তার প্রায় সব গুণই নারায়ণবাবুর মধ্যে বিদ্যমান। কথায় কথায় প্রবচন শোনানো তার রক্তে মিশে আছে। ভীষণ মারকুটে মাস্টার বলে বেশ নামডাক। বেত্রপাণি উপাধিও জুটেছে কপালে। ইদানীং যদিও সরকার বেতের ব্যবহার বন্ধ করতে রুল জারি করেছে। নারায়ণবাবু এতে বেশ বিরক্তও বটে। মেরে দুচারটা গাধার পিঠের ছাল উঠাতে না পারলে কীসের আবার শিক্ষক হলেন! ঈশ্বরপুর গ্রাম তো বটেই পাশের নানুয়ারহাট, বিরামপুরের এমন কোনো প্রাক্তন ছাত্র নেই যে কিনা নারায়ণবাবুর মার না খেয়ে মানুষ হয়েছে। বেতের ভয় কমে যাওয়াতেই তো এখনকার ছেলেপেলেরা এতটা বেলাল্লা হচ্ছে। যাক সে কথা, সকাল সকাল নাস্তা খাবার সেরে বাবু ছাতা মাথায় বের হন স্কুলের উদ্দেশে। দশটায় স্কুল শুরু হলেও তার আগে একটা প্রাইভেট টিউশন করান মাস্টারবাবু। স্কুল ছুটির পর আরও দুটো। যে টাকা মাইনে পান তাতে কিছু উপরি আয় না থাকলে সংসার ধর্মের পাঠ চুকানো বড় মুশকিল।
সকালের টিউশন শেষে ঠিক পৌনে দশটায় স্কুলে পৌঁছে যান। অতঃপর হাজিরাখাতা বগলদাবা করে ধীর লয়ে হাঁটতে থাকেন নবম শ্রেণির কক্ষে। পদার্থবিজ্ঞানের ভ্রাম্যমাণ ভাণ্ডারকে আসতে দেখে আগে থেকেই নিজেদের সিটে সুশীল হয়ে বসে পড়ে ছাত্ররা। মাস্টারবাবুর ক্লাসে প্রবেশ মাত্র সকলে উঠে দাঁড়ায়। অন্য স্যারদের বেলায় ছাত্ররা বসে পড়ে; কিন্তু নারায়ণ স্যারের ক্লাসে উনার অনুমতি ছাড়া বসা নিষেধ। টেবিলের ওপর হাজিরা খাতা রেখে পুরো ক্লাস একবার চক্কর দেওয়া তাঁর অভ্যাস। পিনপতন নীরবতা গ্রাস করে তখন। ছাত্রদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এরপর স্যারের হুংকারে সবার মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণহস্ত সামনের দিকে উপরে উঠে আসে। সমস্বরে সবাই বলে, ‘আমি শপথ করছি যে আজকের সকল ক্লাসে আমি মনযোগী হইব এবং সর্বোচ্চ জ্ঞান আহরণে সর্বদা সচেষ্ট থাকিব।’ এরপর সবাইকে বসতে বলে মাস্টারবাবু হাজিরাখাতায় উপস্থিতি মার্ক করেন। বিচিত্রই বটে এই বিজ্ঞ বিজ্ঞান শিক্ষক!
দিনের প্রথম ক্লাস বিজ্ঞান দেওয়াতে অনেক সিনিয়র শিক্ষকদেরও আপত্তি ছিল। তবে নারায়ণবাবুর এককথা সকাল সকাল ছেলেদের মাথা ফ্রেশ থাকে এতে বিজ্ঞান শিক্ষা ওদের জন্য সহজতর হবে। শিক্ষায় আনন্দ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবুও স্কুলের অনেক শিক্ষকের সাথেই তাঁর মতের অমিল থেকে যায়। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক একলাসউদ্দীন সাহেবের। নারায়ণবাবুর সাথে তার মানসিক দ্বন্দ্বও চরমে। স্কুল কমিটির অর্থ সম্পদক নারায়ণবাবু হওয়ায় তহবিলের টাকা ভাগবাটোয়ারাতে ভীষণ সমস্যা হয়। বেহেড হেডমাস্টারের যারপরনাই বেগড়বাই প্রশ্রয় না দেওয়াটাই হয়তো তাঁদের দ্বন্দ্বের মূল কারণ। নারায়ণবাবুর সব কথায় কাউন্টার দেওয়া যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে হেডমাস্টারের। সবাই বুঝেও চুপ করে থাকে। তবে সেদিন বেদম লেগে গিয়েছিল দুজনে; স্কুল পুকুরের মাছ বিক্রির টাকা স্কুল ফান্ডে দেওয়ার পরিবর্তে যখন হেডমাস্টার আর সভাপতি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চাইলেন। ভাগের এক অংশ নারায়ণবাবুর পকেটে দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন সভাপতি সুবল মিশ্র। সকলে আড়ালে ওকে চামার বলে। কথাও সত্য। নারায়ণবাবুর আপত্তিতে পুরো টাকা ফান্ডে দিতে হলো। কাঁচা টাকা হাত ফসকে গেলে হেডমাস্টার হেসে হেসে বলল, ‘শালা মালু কাভি নেহি আচ্ছা; যো ভি আচ্ছা ও ভি শুয়র কি বাচ্চা!’ শুনেই তেলে বেগুনে ক্ষিপ্র হয়ে উঠলেন নারায়ণবাবু। এককথায় দুকথায় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছালে কয়েকজনের হস্তক্ষেপে সেদিনকার মতো যুদ্ধ বন্ধ হলো। চামার সুবল পরিস্থিতির আঁচ বুঝে আগেই কেটে পড়েছে। নারায়ণবাবু মাঝে মাঝে ভাবে এই সব সুবলবাবুর মতো হিন্দুদের কারণে দেশে তাদের কোনো মূল্য নেই। এমন নির্লজ্জ মানুষ কীভাবে হয়?
স্কুল ছুটির পর ইকবাল সওদাগরের বাড়িতে যেতে হয় প্রাইভেট পড়াতে। বাজারের বড় ব্যবসায়ী ইকবাল সওদাগরের টাকার অভাব নেই। ঈশ্বরপুর বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সে। বৈদগ্ধ্য নারায়ণবাবুর মাঝে মাঝে মনে হয় সওদাগর ব্যাটা কিছু টাকা নিশ্চয় তার ঢাউস সাইজের ভুড়িতেও লুকিয়ে রেখেছে। সারাদিন পান চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতের পাটি ক্ষয়ে গেছে। মাস্টার জানে সওদাগর বৈড়ালব্রত পালন করে। এই সমাজের আসল বুর্জোয়া তো এই ইকবাল সওদাগররাই; অথচ সব জেনেও সবাই ওদের সাফাই গাইতে ব্যস্ত। ছেলেও হয়েছে একটা; একেবারে গোবর-গণেশ। মাথাভর্তি কাউডাং! নিজের নামটা যে মনে রাখতে পারে তাই অনেক। সওদাগরপত্নী স্বামীর টাকায় উর্বশী সেজে থাকে সবসময়। মাঝে মাঝে হিন্দি সিরিয়াল দেখলে মাস্টারবাবুর বাড়াবাড়ি লাগে; সিরিয়ালের নায়িকারা মরতে গেলেও ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগায় আর মুখ ভর্তি আটা ময়দা সুজি! সওদাগরপত্নীকে দেখলে হিন্দি নায়িকাদের মতোই লাগে। পতিদেবের অর্থের জোরে সর্বদা বুক ফুলিয়ে চলেন মহিলা। তবে ছেলে আর যাই হোক মাস্টারবাবুকে খুব সম্মান করে। ঘরে পা রাখার সাথে সাথে তিনবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে। মাস্টারবাবু যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণই একলব্যের মতো গুরুচরণে নিজেকে সমর্পণ করে। মাস্টারের বৃন্দার বচন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে। ছাত্রের এমন আগ্রহই মূলত নারায়ণবাবুকে এই টিউশনে আটকে রেখেছে; সাথে কিছু টাকাও পকেটে আসে।
সেদিন ক্লাসে সৌরজগত নিয়ে আলোচনা করছেন নারায়ণবাবু। আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, অভিকর্ষ, মহাকর্ষ ইত্যাদি; আলোচনার ফাঁকে এক ছাত্র প্রশ্ন করে বসল, ‘স্যার আপনাদের ধর্ম তো বিজ্ঞানসম্মত নয়; তাহলে এমন ধর্ম পালন করে কী লাভ?’
ছাত্রের এমন স্পর্ধাপূর্ণ প্রশ্নে ভীষণ অবাক হলেন মাস্টারবাবু। হাতে বেত থাকলে নিশ্চয় একচোট হয়ে যেত। বিজ্ঞান ক্লাসে এমন প্রশ্ন তো তিনি কখনোই আশা করেন না। যতটা সম্ভব নিজের ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, ‘হঠাৎ তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ?’
কোনোরকমের ভীতি ছাড়াই ছেলেটা বলল, ‘স্যার আপনাদের ধর্মে তো কোথাও বলা আছে, পৃথিবী হাতির পিঠে বসে আছে। কোথাও বলা আছে পৃথিবী আপনাদের ভগবানের হাতের তালুতে, আবার কোথাও বলা আছে কোনো এক অবতারের নাকের ডগায় পৃথিবী…।’
নারায়ণবাবু চিন্তা করে দেখলেন বিষয়টা বা ছেলেটার কথাগুলো মোটেও অমূলক নয়। তবে ধর্ম তো তাত্ত্বিক জ্ঞান মাত্র। অধিকাংশ ধর্মই উপমানির্ভর। আর প্রতিটা কথার পিছে যে গল্প লুকিয়ে থাকে সেটা না জানলে তো যে কারওরই মনে হতে পারে ধর্ম বুজরুকি গল্পের আধার। কিন্তু এদের এসব বলে লাভ নেই। ভাবলেন সহজভাবে বুঝিয়ে বলাই শ্রেয়। ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন বিদ্যালংকার মশাই। এই উপাধি পেয়েছেন বেহেড হেডমাস্টারের থেকে; একদিন তাচ্ছিল্য করেই বলেছিলেন, আপনি তো মশাই এই স্কুলের বিদ্যালংকার। তাচ্ছিল্য করুন আর যাই করুন উপাধিটা বেশ মনে ধরেছিল নারায়ণবাবুর। টেবিলে হেলান দিয়ে চশমা খুলে মুখ হা করে কাচ দুটো বাষ্পায়িত করলেন। পকেট থেকে মিহি সুতির রুমালে পরিষ্কার করে বললেন, ‘দেখ পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে সবগুলোই কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সমাজের সমসাময়িক বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে ধর্মগুলোতে। সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে, বিপথগামিতা থেকে সমাজকে রক্ষা করতেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। কিছু কিছু ভুল বা ভ্রান্ত মতবাদ সবধর্মেই আছে।’
এমন সময় অন্য এক ছাত্র প্রতিবাদ করে উঠল, ‘না স্যার, আমাদের ধর্মে কোনো ভুল নেই; আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না।’
মাস্টারবাবু একবার ছেলেটার দিকে চোখ তুলে চাইতেই ছেলেটার তেজ কেমন যেন মিইয়ে গেল, ‘দেখ আমি কোনো ধর্মকে ভুল বলছি না। তবে কিছু কিছু বিষয় তখনকার দৃষ্টিতে সঠিক মনে করা হতো পরবর্তীকালে এসে দেখা গেল বিষয়টা আসলে ঠিক তেমন না। যেমন ধরো, কোথাও লেখা আছে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। আবার কোথাও লেখা আছে সূর্য আল্লাহকে সেজদা দেয়। ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? বিজ্ঞান তো তা বলে না। বলে কি?’
স্যারের প্রশ্ন শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ছেলেটার, তবুও যেন মনের অস্থিরতা কাটে না। ওর এমন বৈক্লব্য অবস্থা দেখে হাসি পেল মাস্টারবাবুর। হেসেই বললেন, ‘এসব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই। এটা বিজ্ঞান ক্লাস, ধর্মের ক্লাসে আরও স্বচ্ছ উত্তর পাবে আশা করি। এখন আমরা আপাতত বিজ্ঞানের ভাষায় সৌরজগতের কথা শুনি।’
ক্লাস শেষে সেদিন শিক্ষকদের কক্ষে এসে পরবর্তী ক্লাসের জন্য কিছু বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন নারায়ণবাবু। এরমধ্যেই এলাকার কিছু বৃষস্কন্ধ যুবককে নিয়ে চেয়ারম্যান টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মালাউনের বাচ্চা নারায়ণ কোথায়?’ পৈশাচিক আচরণে ফোঁস ফোঁস করছে লোকটা। এমন বীপ্সায় হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মাস্টারবাবু। অন্য শিক্ষকরাও ইতোমধ্যে জড়ো হয়েছেন শিক্ষকদের কক্ষে। ব্যাপার কী কেউ বুঝতে পারছে না। চেয়ারম্যানের এমন বেপরোয়া আচরণে কিছুটা ভীতিও সৃষ্টি হয়েছে সবার মনে। শুধু বেহেড হেডমাস্টারের মুখে মৃদু হাসি ছলকে উঠছে। উনিই আঙুল উঁচিয়ে টেবিলের সর্বদক্ষিণে এক কোণায় দেখালেন, ‘ওই, ওই যে নারায়ণবাবু।’
চেয়ারম্যান হুংকার দিয়ে বলল, ‘এত সাহস কই পাস, মালাউনের বাচ্চা? আমাগো কিতাবকে ভুল বলার সাহস পাস কই? আমাগো দেশে থাকবি আর আমাগো ইমোশন নিয়া খেলবি? হারামি মালাউনের বাচ্চা; বুতপরস্তির ভূত; ইন্ডিয়ার দালাল…’ বলেই নারায়ণবাবুর দিকে বুলেটের বেগে তেড়ে এলেন। আর কিছুটা দেরি হলেই কিল-ঘুষিও হয়তো দিয়ে দিতেন। নারায়ণবাবু কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না; এমন কী হলো? বাইরে থেকে ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিচ্ছে উদ্ভ্রান্ত এলাকাবাসী। মাস্টারবাবু খেয়াল করলেন ক্ষিপ্ত জনতার মাঝে তো তাঁর প্রাণেশ ছাত্ররাও আছে যাদের তিনি এতটাকাল বেহদ্দ ভালোবাসতেন। ইসলাম ধর্মের শিক্ষক মাসুদ সাহেব এসে নারায়ণ বাবুর ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন নয়তো যেকোনো অঘটন ঘটে যাবে। অবস্থা সংকটাপন্ন ভেবে কেউ লোকাল থানায় খবর দিতেই পুলিশও এসে হাজির। এতক্ষণে নারায়ণবাবু বুঝতে পারলেন কী সর্বনাশটা ঘটে গেছে। ক্লাসে কেউ একজন আজকের বলা কিছু কথা মোবাইলে ভিডিও করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। পুরো বক্তব্য নেই ভিডিওতে; আর তাতেই উত্তাল হয়ে উঠেছে ঈশ্বরপুর। একলাসউদ্দিনের মুখে শকুনির হাসিই বলে দিচ্ছে এসবই তার পাশা খেলার চাল। আর কেউ বুঝতে পারুক আর না পারুক নারায়ণবাবু বুঝতে পারছেন কী জঘন্য ফাঁদে পড়েছেন তিনি। নিরাপত্তার স্বার্থেই পুলিশ নারায়ণবাবুকে সাথে নিয়ে গেল।
সেদিনের পর থেকে শিশিরস্নাত ভোরে উমেশের বাবার সাথে গীতাপাঠ করা হয় না। বাবাও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছেন। প্রায় দেড়মাস বাবাকে পুলিশ আটকে রেখেছিল থানায়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সোচ্চার ভূমিকায় অবশেষে মুক্তি পায় নারায়ণবাবু। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ইকবাল সওদাগরের বাড়িতে টিউশন নিতে গেলে সওদাগর সাফ জানিয়ে দেয়, ‘অনেক আক্কেলসেলামি দিয়েছি। নাকে খতও দিয়েছি। আর কোনো মালাউনের বাচ্চাকে এবাড়িতে ঢুকতে দিব না। আপনি দয়া করে বিদায় হোন।’
শুনে মাস্টারবাবুর হৃদয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। উনি লক্ষ করেন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সওদাগরের ছেলে কাঁদছে; টপটপ জল ঝরে পড়ছে। সে জানে ওইদিন ক্লাসে স্যার কোনো ধর্মকেই ছোট করেননি।
ভোরবেলায় যখন উমেশ গুরু প্রণাম স্তব পাঠ করে নারায়ণবাবু নিশ্চুপ থাকেন। চোখ দুটো অনড় থাকে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে শুধু। আগের সেই পণ্ডিত নারায়ণবাবুকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। উমেশ উচ্চৈস্বরে পাঠ করে, ‘ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব। ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব। ত্বমেব বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব। ত্বমেব সর্ব্বং মম দেবদেব। অর্থাৎ হে গুরুদেব, তুমিই আমার মাতা, তুমিই আমার পিতা। তুমিই বন্ধু, তুমিই সখা। তুমিই আমার বিদ্যাবুদ্ধি, তুমিই আমার ধনৈশ্বর্য, তুমিই আমার জীবনের যথাসর্বস্ব।’
পার্থ প্রতিম দে
গত শতকের আশির দশকে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার বিনাজুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে সাহিত্যে প্রবল আগ্রহ থেকেই কবিতা ও ছোটগল্প লেখার শুরু। ছাত্রজীবন থেকে তার লেখা কবিতা-গল্প বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গল্প, উপন্যাস ও কবিতা লিখতে ভালোবাসেন; কলম হাতে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন লেখক।
বর্তমানে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত আছেন।
প্রকাশিত বই : জীবন চিত্রের ছন্দমালা (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৯), খোলা হাওয়া (উপন্যাস, ২০২০), শ্রাবণধারা (উপন্যাস, ২০২১), চতুর্দশী চাঁদ (গল্পগ্রন্থ, ২০২২), রাইপুরাণ (কাব্যগ্রন্থ, ২০২৩), ক্যাটস্ আই (প্যারাসাইকোলজিক্যাল কিশোর উপন্যাস, ২০২৩), চন্দ্রডুবি (গল্পগ্রন্থ, ২০২৪)।