অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রশান্ত গিরি -
মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

“দাদুভাই, আমার হাতখানা একটু ধরবে? সিঁড়িটা বড্ড অন্ধকার।”

“হ্যাঁ দাদু, ধরুন আমার হাত।” বলে হাতখানা বাড়ালাম। একটি শীর্ণ, জরাগ্রস্ত হাত আমার দিকে এগিয়ে এল। দেখলাম খুব বৃদ্ধ এক ব্যক্তি, চোখে চশমা, পরনে লুঙ্গি ও সাদা মলিন জামা, অন্ধকারে বয়স ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না তবে আশির কম হবে না।

এখন রাত দশটা দশ, আমি অফিস থেকে মেসে ফিরছি, আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, ক্যানিং লোকাল থেকে নেমে স্টেশন থেকে বেরোব এমন সময় এল ডাকটি।

ভদ্রলোক চোখে প্রায় দেখেন না বললে চলে, রেলওয়ের সিঁড়ি দিয়ে নামলাম, উনাকেও নামালাম, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, এবার রাস্তা একটু অন্ধকার, খেলার মাঠের ধার দিয়ে সোজা একটু হাঁটলেই আমার মেস।

“দাদু রাতে কেন বেরিয়েছেন?”

“ওই একটু গল্প করতে স্টেশনে আসি, আজকে একটু দেরি হয়ে গেল, যদুটা মরে গেল গত পরশু, তাই…। তুমি যাও, আমি এবার চলে যাব।” উনি বললেন আমায়।

আমি এগোলাম কিন্তু মনে খটকা লাগল, উনি সত্যি একা যেতে পারবেন তো? ফিরে দেখি উনি হোঁচট খেয়ে পড়তে যাচ্ছেন, আমি ছুটে গিয়ে ধরলাম।

“আরে কী যে করেন না আপনি, বললে তো আমি ধরে এগিয়ে দিতাম, পড়ে গেলে কী হতো?”

রাস্তায় লোকজন খুব কমে এসেছে, সাড়ে দশটার ডায়মন্ড হারবার লোকাল বেরিয়ে গেল।

“কোথায় যাবেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ওই খালপাড়ের পাশেই থাকি আমি।” বললেন।

“চলুন। আপনাকে দিয়ে আসি।”

বৃদ্ধের চোখ যেন চকচক করে উঠলো, যেন এটাই আশা করেছিলেন কিন্তু চক্ষুলজ্জা হেতু বলতে পারছিলেন না।

এক হাতে মোবাইল ফোন জ্বালিয়ে অন্য হাতে উনাকে ধরে এগোতে থাকলাম, এক একটা পা ফেলে যেতে হচ্ছে, জোরে হাঁটতে পারছেন না, একটু হেঁটেই হাঁপানির চোটে একটু দাঁড়িয়ে পড়ছেন, খেলার মাঠের পাশ দিয়ে একটু গিয়ে ডান দিকে বেঁকে সোজা এগোলে খালপাড়। আমার ক্লান্তি লাগছিল খুব কিন্তু তা বুঝতে দিতে পারছিলাম না পাছে উনি আরও বিব্রত বোধ করেন।

তবে বুড়োর বোধবুদ্ধি দেখে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম… হাঁটতে পারে না, চোখে ভালো দেখে না, কী দরকার বাপু এই রাতে-বিরেতে ঘর থেকে একা বেরোনোর?

বললাম, “দাদু রাতে এভাবে বেরোবেন না একা, যদি বেরোতেই হয় সঙ্গে নেবেন কাউকে”।

“কেউ থাকলে তো সঙ্গে নেব ভাই, যাকগে তুমি যাও। আমি এবার একা চলে যাব।” হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন কথাগুলো।

আমরা খালপাড়ে পৌঁছে গেছি, এদিকে কিছুটা আলো আছে, এই প্রথম বৃদ্ধের মুখটি দেখলাম, জীবন যুদ্ধের প্রতিটা অধ্যায় সারা মুখের বলিষ্ঠ বলি রেখায় প্রতীয়মান। চশমার ভেতরের চোখ দুটো বড্ড মায়াময়, কোমল, ওই কঠিন মুখমণ্ডলের থেকে একদম আলাদা, যেন ধু ধু প্রান্তরে একলা বট, মরুভূমির মরুদ্যান, বিকট গ্রীষ্মে একফোঁটা বৃষ্টি।

বৃদ্ধ একটি রুটি-তরকারি দোকানের দিকে হাত দেখালেন, বললেন, “ওই দোকানে আমি খাওয়ার নেব, তুমি এবার চলে যাও, কত দেরি হয়ে গেল। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন, খুব উপকার করলে দাদু ভাই। আশীর্বাদ করি বড় হও।”

আমার মনটা এতক্ষণে শান্ত হয়ে গেছে, সামান্য যে বিরক্তি ছিল তা হারিয়ে গেছে, একটা মানসিক শান্তি অনুভব করছি, আমি উনার হাত ছাড়লাম না, দোকান অব্ধি নিয়ে গেলাম, দোকানির ভাব দেখে মনে হলো উনি চেনা লোক, সঙ্গে সঙ্গে রুটি-তরকারি প্যাক করে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি নিয়ে এলে?”

“হ্যাঁ।” আমি উত্তর দিলাম।

“তবে ভাই একটু বাড়ি অব্ধি দিয়ে আসো না, নইলে কোথায় পড়বে না পড়বে তার ঠিক নেই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।” আমি রাজি হলাম।

“না দাদুভাই, আমি চলে যাব আস্তে আস্তে।”

বুঝলাম উনার স্বাভিমান আমায় আর কষ্ট দিতে চাইছে না, কারণ রাস্তায় জেনে নিয়েছেন অফিস থেকে ফিরছি, সেই সকালে বেরিয়েছি ইত্যাদি।

বললাম, “চলুন পৌঁছে দি, এতটা যখন চলে এসেছি।”

বৃদ্ধের মুখখানা খুশিতে, কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল, রুক্ষ কঠিন মুখে একটু হাসি দেখলাম। এই হাসি অনেক অর্থবহ, যেন বহু অবসর বাদে আজ একটু বিকশিত হওয়ার অবকাশ পেল।

“গতমাসে আমার স্ত্রী গত হয়েছেন, সেই থেকে একা, রাতে এই রুটি তরকারি খাই, দিনে দূরসম্পর্কের এক ভাইঝি খাবার দিয়ে যায়, কাছেই থাকে, সারাদিন একাই থাকি, সন্ধ্যা হলে একটু স্টেশনের দিকে বেরোই, বন্ধু যারা বেঁচে আছে তাদের দুএকজন আসে, গল্প করি। ফেরার পথে খাওয়ার নিয়ে বাড়ি যাই, আজ একটু দেরি হয়ে গেল।”

“আজকে কি খুব গল্প হচ্ছিল?” আমি বললাম।

“না। আজকে আর কেউ আসেনি।” স্বরে দীর্ঘশ্বাস।

“তবে এত দেরি কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“আসলে যদুটা গত পরশু মরে গেল, সেই আসত নিয়মিত, বাকিরা তো মাঝে মাঝে আসে, হঠাৎ চলে গেল…, তার আগের দিন কত গল্প করলাম দুজনে! তাই একলা বসে এটা ওটা কী সব ভাবতে ভাবতে এত দেরি হয়ে গেছে টের পাইনি দাদুভাই। আর তোমাকে বেশ সমস্যায় ফেললাম।”

“না না, সমস্যা কেন বলছেন! এটা তো সামান্য ব্যাপার…।” আমি অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলাম। আসলে উনার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি যেন আমার ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করছিলাম, আজকে হাজারো বন্ধু-বান্ধব, কত কিছু ঘিরে আছে আমায়…। এক সময় কেউ থাকবে না, কথা বলার লোকটিও খুঁজে বেড়াতে হবে… শুধুই নিঃসঙ্গতা!

“নাতিটাকে অনেক দিন দেখিনি, ওরা আমার কাছে থাকে না, মাঝে মাঝে আসে… ওর ঠাকুমা মারা গেলেও আসতে পারেনি বেচারা। কী পরীক্ষা নাকি ছিল, বৌমা বলল। আজকাল যা পড়াশোনার চাপ তুমি তো ভালোই জানো।”

“এই বয়সে একা থাকেন, এটা ঠিক নয়।” বললাম।

“কার সাথে থাকব? কে কাছে রাখবে আমায়?”

আমার কাছে কোনো উত্তর ছিল না, থাকার কথা নয়। জীবনের এত কঠিন রূপ আমি আগে দেখিনি, তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই।

“দাঁড়াও। একটু দম নি।” হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।

এখন রাত এগারোটা পনেরো, আর একটা গেল পিন লোকাল হর্ন দিতে দিতে ছুটে যাচ্ছে, এখানে সব ট্রেন দাঁড়ায় না…. জীবনটাও ওই ট্রেনটির মতো… কোথায় ও কখন চলা শুরু হবে, কোথায় দাঁড়াবে, কোথায় পৌঁছাবে তা পূর্ব নির্ধারিত…. কেউ যেন সাদা পাতায় তোমার শুরু থেকে শেষ লিখে রেখেছে, তুমি তোমার জীবন দিয়ে তা পালন করছ মাত্র।

যাকগে কী বলতে কী বলে ফেলছি…। এখন রাস্তা সুনসান, দু’একটা মাতাল ছাড়া পাড়ার কুকুরগুলো আমাদের উপর নজরদারি চালাচ্ছে।

“রিকশা চালিয়ে ছেলে মানুষ করলাম, বিয়ে দিলাম…। বৌ-ছেলের সাথে ও এখন আলাদা থাকে। আমরা একা… হয়তো ছেলে মানুষ করায় কিছু ভুল হয়েছে।” উনি বললেন।

আমার সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। আমরা পায়ে পায়ে এগোতে থাকলাম। রাস্তার শেষে একটা ভাঙাচোরা টালির চালের বাড়ি দেখতে পেলাম।

“দাঁড়াও, এসে গেছি।”

কোমর থেকে চাবি গোছা দিয়ে গেট খুললেন, আমি মোবাইলে আলো দেখালাম। সামনের গেট খুলে যেখানে পড়লাম তা রীতিমতো জঙ্গল, ঘাস-আগাছায় ভর্তি উঠোন, একপাশে একটা আম গাছ, বেশ ফলবতী, রাতেও দেখতে পেলাম বেশকিছু আম ঝুলে আছে, উল্টোদিকে বাঁধানো তুলসি মঞ্চ, কিছু ফুল গাছ… তবে আগাছাগুলো এখন ওদেরকে শাসন করছে, এই গরিব কুটির যে এককালে প্রাণবন্ত ছিল তার দৃষ্টান্ত প্রতি পদে প্রতীয়মান। টিনের দরজা সশব্দে খুলে, হাতড়ে সুইচ টিপতেই একটা এক কামরার ঘর দেখা দিল, একপাশে খাট পাতা, মলিন বিছানা, শত ছিন্ন মশারি, দারিদ্র্য এখানে বুক ফুলিয়ে বিরাজমান, দেওয়ালে এক জন বয়স্কা নারীর ছবি টাঙানো, যত্নে মালা দেওয়া, পরিষ্কার… মনে হলো এই ঘরের যাবতীয় জিনিসের ভিড়ে এই বস্তুটি বিশেষ পরিচর্যা পেয়ে উজ্জ্বল। এক কোণে বাসনপত্র, রান্নার সামগ্রী, বোঝা যাচ্ছে বহুদিন অব্যবহৃত হয়ে অভিমান করে আছে, দু’একটা থালাবাটি এখনো এঁটো লেগে… দুপুরে খাওয়ার পর পরিষ্কার হয়নি। পাখার সুইচ বারখানেক অফ অন করার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সশব্দে প্রতিবাদ জানিয়ে ঘুরতে লাগল।

“দাদুভাই, একটু বসো। এতটা এলে… একটু বসে যাও।”

“না দাদু আজ অনেক রাত হলো, কাল অফিস আছে। পরে আসব একদিন।” বলেই পা বাড়ালাম বাইরে।

“দাঁড়াও একটু।” দেখলাম খাটের নিচ থেকে একটা বালতি বের করলেন, দেখলাম ওতে কিছু আম, নেড়ে নেড়ে দেখলেন বেশির ভাগই পচা।

“যা ভালোগুলো তবে মালতি নিয়ে গেছে।” বুঝলাম এই মালতি উনাকে খাওয়ার দেয়।

“তোমাকে একটা আমও দিতে পারলাম না ভাই, কী যে পোড়া কপাল।”

“আমি পরে একদিন এসে আম খেয়ে যাব, কথা দিলাম। আপনি এর জন্য ব্যস্ত হবেন না।” বললাম।

“কবে আসবে?”

“শনি ও রবিবার আমার অফিস থাকে না।”

“তবে শনিবার এসো। আসবে তো দাদু ভাই? কথা দিলে কিন্তু…।”

“আসবো দাদু, আসবই…।”

“ভগবান তোমার মঙ্গল করুন, তুমি বড় হও।” উনি আশীর্বাদ করলেন আমায়।

উনার থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরছি, মন ভালো নেই। তবে একজনকে একটু সাহায্য করায় যে মানবিক প্রশান্তি আসে তার কারণে একটু ভালোও লাগছে… আবার ক্ষণে ক্ষণে কোনও এক অজানা ব্যথা আমায় গ্রাস করছে।

মেসে ফিরলাম।

শনিবারে তিন বেলাই আমার পড়ানো থাকে, চাকরি পাওয়ার আগে টিউশন করিয়ে কিছু উপার্জন করতাম, বাবার কিছু সাহায্য হতো, সেই পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারিনি তাই এখনো পড়াই। তবে রবিবার ফাঁকা রাখি নিজের জন্য। সুতরাং আজকে যাওয়া হবে না উনার সাথে দেখা করতে। কিন্তু উনি তো শনিবার যেতে বলেছিলেন, যাকগে কাল গিয়ে মাফ চেয়ে নেব, আর যাব যখন উনার জন্য কিছু খাবার নিতে হবে, আজকে পড়ানোর পর আর এনার্জি পাব না। কালকেই যাব ঠিক করলাম।

আজকে রবিবার, ঘুম থেকে উঠে দেখি আটটা বাজে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হলাম, বাজারে গিয়ে কিছু খাওয়ার কিনে নতুন পাওয়া দাদুর আদর খেতে রওনা হলাম। সেই দিনের পর থেকে কেন জানি না মনটা ওই অশীতিপর বৃদ্ধের ভাঙা দ্বারে পড়ে আছে।

সেদিন রাতে এসেছিলাম, রাস্তা চিনতে অসুবিধা হবে তবে ওই টালির চাল, আম গাছ আমি দেখলেই চিনতে পারব এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ঐ তো আম গাছ, টালির চাল। কিন্তু…।

বাড়ির সামনে এলাম, একজন উঠোনের ঘাস-আগাছা কেটে পরিষ্কার করছে, বছর চল্লিশের এক জন এগিয়ে এল, “কাকে চাই?”

“এখানে একজন বয়স্ক লোক থাকতেন, নামটা জানি না।”

“হুম, উনি গতকাল সন্ধ্যায় মারা গিয়েছেন। আমি উনার ছেলে, কোনো কিছু দরকার ছিল?”

“না, মানে… এমনি। পরিচয় হয়েছিল তাই…।” আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব, আমার হাতের খাবারের প্যাকেট যেন ধীরে ধীরে ভারী হয়ে হাত থেকে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে, আমি স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে আছি, কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না, কিছু ভুল হচ্ছে নাকি? আমি কি ভুল জায়গায় এলাম? না সেই আম গাছ, সেই তুলসী তলা… আমাকে দেখে যেন ব্যঙ্গ করছে… ভুল হতেই পারে না, ভুল শুধু একটাই হয়েছে। তা আমার দ্বারা, আজকে রবিবার কথা ছিল শনিবারে।

আমি ফিরছি। দাদু আমার আম খাওয়া হলো না, তুমিও কথা রাখোনি… হুম আমার ভুল আছে। তা বলে তুমিও প্রতিশ্রুতি রাখোনি… একটা দিনও কি অপেক্ষা করা গেল না দাদু?

Chandiberia, near ankur club, kestopur, Newtown, Kol-700102

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *