অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্ণব আইচ -
রাস্তা

আজকাল না রাস্তায় বেরোতেই ঝামেলা লাগে। কিছু না কিছু চোখের সামনে পড়ে যায়। তারপর তা নিয়েই নিজে থেকে মাথায় মহাকাব্য রচে যায়। সেইসাথে বাড়ে মাথাব্যথা। একসময় মাথা ছিঁড়ে-ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়। ভাবনার সবটাই যে অযৌক্তিক— এমনটাও না অবশ্য, কয়েকটা ভালো ভালো পয়েন্টেও চিন্তাভাবনা করা হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু যখনই বাসায় গিয়ে ভাবি কাগজে নামাব চিন্তাগুলো তখনই হুশশশসসস… কোথায় হারিয়ে যায় চিন্তাগুলো। আচ্ছা, সমস্যা না?

সন্ধ্যে ছ’টা। মা পাগলের মতো ডাকছে। বাজার নিতে বেরোতে হবে। মানে রাস্তায় নামতে হবে আবারো। ভাবতেই পিঠ দিয়ে শিরশিরে একটা স্রোত বয়ে গেল। আজকাল রাস্তার নাম শুনতেই এমনটা হচ্ছে! আচ্ছা, আস্তে আস্তে কোনো ফোবিয়া সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে না তো? রাস্তা ভয় পাওয়া নিয়ে কোনো মেন্টাল ডিসঅর্ডার বা অসুখ আছে নাকি কে জানে! যাওয়ার সময় একবার সত্যেনের বাসা দিয়ে ঘুরে যাওয়া যায়। তখন ব্যাপারটা জিজ্ঞেসও করে নেওয়া যাবে। সত্যেন ছেলেটা ভীষণ পড়াকু। ওই ব্যাটা জানে না এমন কিছু নেই মনে হয়। যেতেই যখন হবে… অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। বাজারের ব্যাগটা খুঁজে হাতে নিলাম। জুতো পরলাম। মায়ের কাছ থেকে খুচরো টাকা হিসাব করে গুনে নিলাম। দরজাটা খুলে বেরোলাম।

বাসার বাইরে গলি ধরে হাঁটছি… গলির মাথা শেষ। তারপর…? রাআআস্তাআ…!

এদিক সেদিক উপর নিচ কোনোদিকে তাকাচ্ছি না। মানে, তাকাতে তো হচ্ছেই। নাহলে তো বুক ফুলিয়ে ছুটতে থাকা ট্রাক লরিগুলোর নিচে পিষ্ট হওয়া থেকে আমাকে বাঁচানোর সাধ্য কারও নেই। তবু চাচ্ছি যাতে কোনো চিন্তাসূত্রক ঘটনা চোখে না পড়ে। নাহলে মাথা আবার হিজিবিজি চিন্তায় ভরে যাবে রে বাপ!

কিন্তু ওই যে, যা হওয়ার তা হবেই। ওই নিয়ে সংস্কৃততে একটা লাইন ছিল। ধুত্তরি ছাই, মনেও পড়ছে না। মূল সড়কে নেমে বড়জোর পনেরো কি ষোলো কদম এগিয়েছি, চোখে পড়লো রাস্তার পাশে একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে ভিক্ষা করছে। বলতে গেলে আমারই বয়সী। ছেলেটার চোখ কোটরের ভেতরে ঢোকানো, হাওয়াই মিঠাইয়ে কেউ দু’আঙ্গুল ভেতরে ঢুকিয়ে বের করে আনলে যেমনটা দেখতে হবে ঠিক তেমন। বুকের পাঁজরটা… থাকুক। আর অপ্রয়োজনীয় বর্ণনার বন্যায় ভাসতে হবে না। ঘর থেকে বেড়িয়ে মহাসড়কে নামলে এমন দুয়েকজনকে চোখে আপনার পড়বেই। তেমন একজনই এই ছেলেটা। আলাদা কিছু নয়। কিন্তু এইদিকে আমার মাথায় রাষ্ট্রনীতির চচ্চড়ির রন্ধন আর গণতন্ত্রের লৌহকপাট ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এক এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যপারটা মাথায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু কোনো দিক থেকেই আমার নিজের পক্ষে যুক্তি পাচ্ছি না। আচ্ছা, আমি যদি এখান থেকে বাসায় গিয়ে আগুনঝরা দামে করা বাজার দিয়ে ভালোমন্দ খেতে পারি তাহলে এই ছেলেটা কেন তা পারবে না? সে কেন রাস্তায় ধুলোতে কেশে আধপেটা হয়ে মরবে? তার অবস্থানে তো আমিও থাকতে পারতাম আর আমার অবস্থানে সে। আমিও তো জন্মাতে পারতাম এভাবে রাস্তার কোলে। মুখোমুখি বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে সে আমাকে নিয়ে ঠিক এইভাবেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে গবেষণা করতে পারত। আমাদের দুজনের মাঝে এই সমতার যে ব্যর্থতা সেটাকে কার ঘাড়ে তুলে দেওয়া যায়? যদি রাষ্ট্রের ঘাড়ে তুলে দিই? উহু, রাষ্ট্রের এখানে কী করণীয় সেটাও মেলাতে পারছি না। হ্যাঁ, সর্বসমতার অর্থঘাটতি হিসেবে এনে সব বাবু সাহেবদের ঘাড়ে দোষ ফেলে দেওয়া যায়। তবে সেসব যোজন যোজন দূরের ব্যাপার। আর অনেকাংশে অর্থহীনও।

আচ্ছা, স্পিরিচুয়াল দিক থেকে যদি দেখি? সেই ছেলেকে তো আমি চিনিও না। ওকে পেছনে ফেলে মোড় পেরিয়ে চলেও এসেছি অনেকটা। ধরে নিলাম যে সে ব্যাটা ধার্মিক, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ে। আর এদিকে আমি অভাগা সারাদিন ধর্মকর্মের নামও যদি না নিই… তাহলেও তো এমন জীবন আমার না পেয়ে ওর পাওয়ার কথা। আমি পেলাম কেন? এইদিক থেকেও হিসাব মিলছে না। আরও কিছু অ্যাঙ্গেল থেকে ভাবলাম ব্যাপারটা।

উহু, মিলছে না। স্যাটিসফ্যাক্টরি কোনো জবাব পাচ্ছি না। ব্যাপারটা কোনো দিক দিয়ে মেলাতে না পেরে মাথাটা ভীষণ চটে যাচ্ছে। এইসব জিনিস আসলে মেলানো যায় না। আমি মেলাতে পারিনি কোনো সময়ই। তবে মগজে সবসময় দৃশ্যমান থেকে এইসব ব্যাপার অপরাধবোধ আর চিন্তা দুটোই বাড়িয়েছে প্রতিবার। এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে বাজারের টাকার একাংশ দান করে দিয়ে এলাম। ছেলেটা কিছুটা খুশি হলো। মনে হয় কিছুটা লজ্জাও পেলো তার বয়েসী একজন থেকে টাকা নিতে। যাই হোক, অপরাধবোধ পুরোপুরি না কমলেও কিছুটা ধামাচাপা দেওয়া গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ আর পারা যাবে না। এখনই এইসব সাত-পাঁচ ভাবা না থামালে প্রতিবারের মতোই খারাপ অবস্থা হবে। মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে ইতোমধ্যেই। বাজার এখনো অনেক দূর। এইভাবে চলতে থাকলে আমাকে আর কিছুক্ষণ পর খুঁজে পাওয়া যাবে না। নির্ঘাত কোনো গাড়ির তলায় নইলে কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রেইন স্ট্রোক কনফার্মড।

ওই রিকশা, যাবা?

কনে?

কাঁচাবাজার।

যামু।

কত?

৮০ টাকার চেয়ে কম যামু না। রাস্তায় পচ্চুর জ্যাম। এক ভাড়ায় কভার নিতে হইব। নাহলে যাইতাম না।

একটা টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে রাজকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছেন রিকশাওয়ালা মামা। চক্রান্ত করে প্রায় ৩০-৪০ টাকা বাড়িয়ে বলেছেন মামা। তার সাথে দরাদরি করার শক্তি বা ইচ্ছা এই মুহূর্তে কোনোটাই আমার নেই। আবার এইসব ক্ষেত্রে দরাদরি না করলেও সমস্যা। তখন আবার বাঙালি হিসেবে সমাজে নাম টিকিয়ে রাখা দায়। তারপরও সাথে যখন দেখার মতো কেউ নেই উঠে পড়লাম রিকশায়।

টান দেন মামা।

রিকশাওয়ালা মামা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দাঁত খুঁটানোর কাজটা চলমান। মনে হয় আমি যে দরদাম করিনি সেইটা নিয়ে তিনিও খুব হতাশ। তার দৃষ্টিতেও হয়তো প্রকৃত বাঙালি হিসেবে আমি ফেল। সুযোগ থাকলে নতুন বউয়ের মতো নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোমটা টেনে লজ্জা পাওয়ার ভান করতাম। অবশেষে মুখ থেকে বড়সড় এক আওয়াজ করে থুতু ফেললেন মামাটা আর সাউথের হিরোর মতো তিন আঙ্গুল ইউজ করে টুথপিকটা সরাসরি সুনিপুণভাবে ফেললেন পাশের ড্রেনে। এরপর রিকশায় উঠেই টান।

আচ্ছা, রিকশাওয়ালাদের নিয়েও তো গবেষণা চালানোর মতো স্কোপ আছে। কেউ চালায় না কেন? শহরে যতটা না পাখি তার চেয়েও বেশি হয়তো রিকশাওয়ালার সংখ্যা। রিকশাওয়ালার সবটাই যেন অসাধারণ। রিকশাওয়ালার রিকশা চালাতে চালাতে গল্প করা থেকে শুরু করে দাম নিয়ে কথা চালাচালি করা। সবখানেই আর্ট। জীবনে মৃত্যুকে কাছাকাছি যতবার দেখেছি ততবারই তা আমাকে এই রিকশাওয়ালারাই দেখিয়েছে। এই যে গত পরশুদিনও আরেকটু হলেই বিআরটিসি-র এক বাস এসে প্রায় দুমড়িয়ে দিচ্ছিল, কোনোমতে বাঁচা। অনেক বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন, সবাই একযোগে জুরি বোর্ড বসিয়ে যথোপযুক্ত কারণ দেখিয়ে রায় দিলেন দোষটা আমাকে ধারণ করা রিকশার চালকেরই। আর বিচারকার্য শেষ হলো আধা মিনিটেরও কম সময়ে। তাতেই ক্ষান্ত নন, তারা ‘অ্যাকশন’-এ চলে যেতেও রাজি। আমি মনে মনে তাদের বিচারকার্যের তৎপরতা দেখে জাস্ট মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। আমাদের শাসনব্যবস্থার জনগণের থেকে কিছু শেখা উচিত। একেকটা কেসে যে কী পরিমাণ ডিলেই করে তারা। এদের মতো ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ হতে পারলে তবেই না!

রিকশাওয়ালা মামাটা কিছুক্ষণ আগেও আমারে তার গান শোনাচ্ছিলেন। আহা বেচারা মামা কিছু না বলে মেইন রোড ছেড়ে চলে এলেন। গলিতে উঠতেই তার পাংশু মুখে হাসি ভরতে শুধু বললাম, আপনার তেমন একটা দোষ ছিল না আসলে কিন্তু…।

শেষ। শেষ মানে শেষ; ধ্বংস। তার মুখের দুঃখী দুঃখী ভাবটা একদম নিমেষে ধ্বংস।

ঠিক কইসো মামা, একমাত্র তুমিই বুঝলা আমারে, বাস গেসে সিগন্যাল ভেঙে আগাইয়া। আমি কী করুম… হেনতেন।

যদিও এদেশে সিগন্যাল যে কেউ মানে তা আমার জানা ছিল না। সে যাই হোক, এইদিকে আমি ভাবছিলাম এত সুন্দর কেন? মানে কাউকে খুশি করা এত্ত সহজ? এরপর আমরা দুইজনে স্বর মিলিয়ে একযোগে বাসওয়ালাকে ইচ্ছামতো গালি দিই কিছুক্ষণ।

এইসব রিকশাওয়ালার কাহিনী শুনতে আমি পাঁচ মিনিটের হাঁটার রাস্তাতেও রিকশা নিই প্রায়। তারপরও একজন বা দুজন ছাড়া কোনো রিকশাওয়ালাকে দ্বিতীয়বার দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমি শুধু ভাবি কী পরিমাণ রিকশাওয়ালা আছে এই শহরে। ধুর মাথা! আমি আবারো শুরু করেছি ছাতার মাথা চিন্তাগুলো। এইদিকে আমাকে ধারণকারী বর্তমান রিকশাওয়ালাও কথা শুরু করে দিয়েছে অনেক আগে। খেয়াল নেই আমার। বাতাসের দাপটে শুনতেও পাচ্ছি না মামার কথা খুব একটা। মামার অস্পষ্ট গোঙানির শব্দের বিপরীতে হু হু করে হাওয়ায় প্রতিউত্তর ছুড়ে দিচ্ছি। আজ গল্প শুনতে ইচ্ছেও করছে না। মাথার যন্ত্রণাটা আরো বেড়েছে। এইদিকে রিকশাও যে কখন জ্যামে আটকেছে বিন্দুমাত্র খবর নেই। তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অনেক্ষন হয়েছে। সামনে লাইন ও অনেক বড়। কেমনে কী ভাই!

এইদিকে পাশের রিকশাতেই এক মা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মা-টাকে দেখছি আস্তে আস্তে ঝিমুচ্ছে। তাহলে তো জ্যাম লেগেছে আসলেই অনেকক্ষণ বোধহয়। মা-টা বোরকা পরেছে, তবে তারপরও কপাল আর চোখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে বয়সটা তেমন বেশি নয়। এই পঁচিশের আশপাশে। বাচ্চা মেয়েটার বয়স হবে ৭-৮ বছর বড়জোর। এসব কথা জরুরি না। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছোট্ট মেয়েটার চোখ দুটো। এত সুন্দর কেন? চোখ দুটো বিরক্তির সুরে শুধু এদিক-ওদিক ছুটছে। মনে হচ্ছে শুধু মেয়েটার শরীরটাই শুধু তার মায়ের কোলে বসে আছে। মনে মনে সে পুরো রাস্তাটা চষছে। আমার দিকে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ পড়ল। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে একটা বিরাট হাসি দিল। আহা, ছোট্ট মেয়েটার হাসিটাও কী যে সুন্দর। মাথাব্যথাটাও যেন এই হাসি দেখে পালিয়েছে। মনে হলো এইসব জ্যাম, ওর মা, আমার রিকশাওয়ালা, এই রাস্তা, হর্নের প্যাঁ পুঁ… সবকিছু মোহ। ওর মুখের হাসিটা নিয়ে দৌড় দিই। অনেক দূরে চলে যাই। তারপর যক্ষের মতো শুধু সেই হাসিটাকে আগলে রাখব। কিন্তু সেটা করার তো আর উপায় নেই। বাচ্চা মেয়েটা হয়তো আমার মতো এইরকম আজব প্রাণী তেমন একটা দেখে না এই শহরে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখের চঞ্চল ভাবটা কমেছে। কৌতূহলতা টাইপ কিছু একটা বোঝা যাচ্ছে। তার রিকশাটা আমার রিকশার প্রায় কাছেই। আমার হাত বাড়িয়ে গালটা টেনে দিতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। করা উচিত হবে নাকি বুঝছিলাম না। অবশেষে সাত-পাঁচ না ভেবে টেনেই দিলাম। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো পরম সাদরে আমার আদরটা গ্রহণ করেছে।

এত আদুরে জিনিসও পৃথিবীতে থাকে?

জ্যামটা যেন এই ঘটনাটার জন্যেই আটকে ছিল এতক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে জ্যাম খুলে গেল। আশপাশে সবকটা গাড়ির কয়েক মিনিটের পেতে রাখা সংসারে ভাঙন ধরল। ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটা যানবাহনে। মেয়েটার রিকশাতেও টান পড়ল। মেয়েটা আমার দিকে হেসে তাকিয়ে জোরে জোরে হাত নাড়ছিল। ও-ও বুঝতে পেরেছে যে বিদায় নেওয়ার সময় চলে এসেছে। এদিকে রিকশার দেওয়া টানে মেয়েটার মায়ের ঝিমুঝিমু ভাব উড়ুউড়ু হয়ে গেছে। জ্যাম ছেড়ে যাওয়ায় তার মুখে হয়তো খুশি খুশি ভাব থাকার কথা। তবে অপরিচিত এক ব্যক্তির দিকে তার মেয়ে হাত নাড়ছে দেখে তার কিছুটা…; জানি না কিছু একটা অনুভূত হলো হয়তো। মেয়ের হাতটা ধরে নামিয়ে দিয়ে তাকে ছোট্ট করে একটা বকে দিল। তার রিকশাওয়ালাটাও কী বুঝল কে জানে বা হয়তো এমনিই, আমার রিকশার দ্বিগুণ ত্বরণে ত্বরান্বিত হয়ে এগিয়ে গেল সামনে। ব্যস এতটুকুই।

তাও ভালো, মেয়েটার বয়স ৭-৮ বছর ছিল। এই মেয়েটা কয়েক বছর পর আরেকটু বড় হবে। তখন তার দিকে আর সোজা চোখে তাকানো যাবে না। কাছে গিয়ে কথা বলা, আদর করে দেওয়া দূরের কথা, সে যতই আদুরে হোক না কেন। কেন? ছোট্ট মানুষ; আদর আর কামের পার্থক্য বুঝবে না তো সে। গুলিয়ে ফেলবে, কারও স্নেহ কে কাম ভাববে আর কারও কামকে স্নেহ! ছোট্ট বলে না, বড়দেরও বুঝতে কষ্ট হয় ব্যাপারটা। তাই ফলস্বরূপ, সবকিছুর জন্যই তার জীবনে একটা তালা গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সেই তালার ভার আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে আর একসময় প্রচণ্ড ভারে ঘাড় যাবে নুয়ে।

হেডলাইন : সমাজপ্রদত্ত তালার অসহ ভারে মাতৃপ্রদত্ত স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে কিশোরীর আত্মার মৃত্যু! সামনের মানুষগুলোর মাঝেও নিজের থেকেই জন্ম নেবে এক সংকোচের পর্দা। আমিও তো আর ওদের ব্যতিক্রম কিছু নই। আমার মতো ব্যতিব্যস্ত মানুষ হলে তো আর কথাই নেই। সংকোচের পর্দাটা নিজে থেকেই গায়ে জড়িয়ে উল্টোদিকে দৌড় দেব। শুধু মেয়েদের নয়, এই বয়সী ছেলেদের মধ্যেও আস্তে আস্তে দাম্ভীর্যতা জন্ম নিতে শুরু করে। স্নেহ নিয়ে এদের কাছে ঘেঁষাই দায়। মোদ্দাকথা ছেলে বুড়ো কারও কাছেই যেন এখন হাসিমুখে এপ্রোচ করা দায়। প্রশ্ন আর সন্দেহের জালে বিদ্ধ হওয়া লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই জন্যই ঈশ্বর অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। গঠনে মানবেতর কিন্তু অন্তরে মানুষোর্ধ্ব। ওদের আদর করতে কিন্তু কোনো সংকোচ লাগে না। ইচ্ছামতো কাছে ঘেঁষা যায়। এরপরও একদল মানুষ যখন জিজ্ঞেস করে সারাদিন কুকুর বিড়ালের কাছে ঘেঁষে থাকিস কেন? আমি হাসি। মনে মনে নায়ক জসীমের ভং ধরে বলি তোমাদের কাছে যেন খুব ঘেঁষা যায়…।

এই মামা, আরে এই মামা। বাইর হন, বাইর হন খেয়ালের দুনিয়ার ত্থেইক্কা। কাঁচাবাজার আইসসা গেসি তো।

ওহ্ সরি মামা, খেয়াল করি নাই। মামা দশটা মিনিট বসবেন? তাহলে আবার বাজার নিয়া মফস্বলপাড়া চলে যাব।

আচ্ছা আসো।

বাজারের জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি সহনীয়। যাক, নাহলে মগজে আবার রাষ্ট্রনীতির চচ্চরি ঘাটা শুরু হয়ে যেত। সাথে মূল্যস্ফীতির জগাখিচুড়ি…।

মামা টান দেন।

রিকশার টান।

রাস্তায় জাম ছিল না আসার সময়। (আসলে ছিল, অনেককিছুর রন্ধনও হয়েছিল মাথায়। তবে পরিষ্কার করে মনে নেই আসার সময়ের ভাবনাগুলো।ওই যে বললাম এইসব জগাখিচুরির সবটুকু মনে থাকে না)।

একটানে বাসার গলি।

মামা থ্যাংক য়ু। ধরেন, বলে একশো ষাট টাকা এগিয়ে দিলাম।

টাকাগুলো নিয়ে মামা আমার দিকে আরেকটাবার স্টাইলিশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, শুনো মামা, তোমারে দুইটা কথা কই।

খেয়াল করে দেখলাম মামার মুখে আরেকটা টুথপিক চলে এসেছে কোথা থেকে জানি।

জিন্দেগিতে এত সরল, ভ্যাবাগেলা হইয়ো না। টিকতে পারবা না। তুমারে দেইখ্যা বুঝা যায় যে তুমি পোলা ভালা। তোমার জন্য তাই অফার এই রফিক মামার পক্ষ থিইক্যা। পরের বার যদি তোমার লগে আবার দেখা হয় তোমারে আমি ফ্রি রাইড দিমু। এখন বাসায় যাও, আমিও যাই।

বলে মামা প্যাডেল চালিয়ে দিলেন জোরসে টান। এই রিকশাওয়ালার আগা টু গোড়া পুরোটাই সোয়্যাগ। সুযোগ পেলে হয়তো উনিও রাজনীকান্ত টাইপের কিছু একটা হয়ে যেতেন।

সরাসরি বাসায় ঢুকলাম না। সত্যেনের বাসায় ঢুঁ দিলাম। সত্যেন বাসায় নেই। কোথায় জিজ্ঞেস করতেই আন্টি গলাটা সপ্তমসুরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কোথায় আবার? এত রাতে বাজারে গেছে ছাইপাশ পানি কিনতে। (ছাইপাশের পানি বলতে আন্টি বইকে বোঝাচ্ছেন। আরও ডেফিনিট করে বলতে গেলে ‘আউটবই’কে।) হতচ্ছাড়া, আজ রাতের মধ্যে ওটা না পেলে নাকি দেশের বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। যুবসমাজ নাকি অনেক বড় সম্পদ হারাবে। আজ আসুক হতচ্ছাড়া, হাঁটুর নলা ভেঙ্গে দোবো। স্কুলবইয়ের সাথে সারাদিন সাক্ষাৎ নেই। ছুটেছে দেশকে তুলতে।’

গলাটা আবার প্রথম কি দ্বিতীয় সুরে নামিয়ে এনে আন্টি বললেন, ‘তোমার খুব প্রয়োজন হলে নিউমার্কেটের দিকে গেলেই পাবে হয়তো ওকে। দোকানগুলো তো চেনোই।’

তার মানে? আবার বাজার? রাস্তা? নারে বাপ, ঘাট হয়েছে। বাড়ির দিকে দৌড় দিয়ে দরজা সাঁটছি। আপাতত ঘর থেকে আর বেরোবার ইচ্ছে নেই।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি

Read Next

শিল্পপথের দুর্ভাগা যাত্রী তারেক মাহমুদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *