অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহিবুল আলম -
শহরটা যেভাবে প্রিয় হয়ে ওঠে

আমি যে গল্পটা বলছি, সেটা উনিশশ’ আটানব্বই সালের মাঝামাঝির গল্প। তখন আমি অকল্যান্ড শহরে বসবাস করি। একেবারে বেকার। এরই মধ্যে গাড়ি নেই। এক্সিডেন্ট করে রাইটঅফ হয়ে গেছে।

কিন্তু ভাগ্য ভালো, অকল্যান্ডে আসার কিছুদিন পর সিটির ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট ম্যাকডোনাল্ডস-এ চাকরি পেয়ে যাই। যদিও আমি বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়ে লেখাপড়া করেছি, আমার চাকরিটা সেটার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। প্রবাসে এসে প্রথম প্রথম অনেককেই নিজের ক্যারিয়ারের বাইরে অনেক ধরনের চাকরি করতে হয়। যেটাকে বলা হয় ‘অড জব’।

নিউজিল্যান্ডে একটা কথা আছে, ছত্রিশ লক্ষ লোকের বাহাত্তর লক্ষ গাড়ি। তার মানে প্রতিটা মানুষের দুটো করে গাড়ি। সেটা অবশ্য কথার কথা। তখন নিউজিল্যান্ডের মোটেও লোক সংখ্যা ছত্রিশ লক্ষ ছিল না, আরও বেশি ছিল। তখনই পঞ্চাশ লক্ষ। বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের লোক সংখ্যা প্রায় ষাট লক্ষের কাছাকাছি।

উনিশশ’ আটানব্বই সালের দিকে নিউজিল্যান্ডের প্রতিটি শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব দুর্বল ছিল। যার কারণে সবাইকেই গাড়ি কিনতে হতো। আমার গাড়ি রাইটঅফ, মানে গাড়ি নেই। নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই। তাই আমাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল।

ম্যাকডোনাল্ডস-এ আমার শিফট ছিল সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা। তখন আমি মাউন্ট ইডেন সাবার্বের ভিউ রোডে জাকারান্ডা লজ নামে একটা বোর্ডিং হাউজে থাকতাম। ভিউ রোডের মাথায় ডোমিনিয়ন রোড থেকে অকল্যান্ড সিটি সেন্টার পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস ছিল। আমি সকাল সাতটার বাস ধরতাম।

 

দুই

ভিউ রোড থেকে ডোমিনিয়ন রোডের বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব ছিল সাত-আট মিনিটের। এতটুকু রাস্তা আমি হেঁটেই যেতাম। ভিউ রোডটা পাহাড়ের উপর-নিচ বলে সকালের হাঁটাটা আমার ভালোই লাগত। শহরের দূরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি রাস্তার নিচের দিকে নেমে আসতাম।

এভাবে প্রতিদিন সকালে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হতো। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের ওপরে, পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর হতে পারে। ভদ্রলোক একটা জার্মান শ্যাফার্ড কুকুর নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হতো তখনই, যখন তিনি প্রাতঃভ্রমণ শেষে ভিউ রোড ধরে ওপরের দিকে উঠে আসতেন। আর আমি বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য নিচের দিকে নামতাম। পথের একটা নির্দিষ্ট স্থানে আমাদের দেখা হতো। ভদ্রলোককে দেখা মাত্রই আমি খুব সুন্দর করে সৌজন্যে বলতাম, গুড মর্নিং। হাউ আর ইউ?

কিন্তু ভদ্রলোক কোনো জবাব দিতেন না। মেজাজ খারাপ করে আমার দিকে তাকাতেন। এমন একটা ভাব করতেন, যেন আমি গুড মর্নিং বা হাউ আর ইউ বলে কোনো অন্যায় কাজ করে ফেলেছি।

প্রথম প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি আমার মেজাজ খারাপ হতো। মন খারাপ করে ভাবতাম, কী মানুষ রে, বাপ! আমি এত সুন্দর করে গুড মর্নিং বলি, আর তিনি মেজাজ খারাপ করে তাকান। কোনো জবাব দেন না!

এমনিতে নিউজিল্যান্ডে বর্ণ বিদ্বেষ নেই। দেশটা খুব সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়। মানুষগুলোও খুব অমায়িক। মানুষজন যে বর্ণেরই হোক, যে জাতিরই হোক, সবাই খুব মিলেমিশে থাকে।

নিউজিল্যান্ডে প্রধানত দুই বর্ণের মানুষের বাস। ইউরোপ থেকে যারা এসেছে, তাদেরকে বলা হয় পাকিহা। আর নিউজিল্যান্ডের যারা আদিবাসী, তাদেরকে বলা হয় মাউরি। মাউরি আদিবাসীদের গায়ের রঙ ও চলাচলতিতে আমাদের সঙ্গে বেশ মিল। আমরা যারা ভারতবর্ষ থেকে এসেছি, তাদের সংখ্যা উনিশশ’ সাতানব্বই সালে খুব কম ছিল। এশিয়ান খুব কম দেখা যেত। এখন অবশ্য ভারতবর্ষের মানুষ ও এশিয়ান নিউজিল্যান্ডে অনেক বেড়ে গেছে।

ভদ্রলোক ছিলেন সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান, পাকিহা।

আমার পরে জেদ চেপে যায়। আমি ভাবি, আমার গুড মর্নিংয়ের জবাবে যে করেই হোক ভদ্রলোকের মুখ থেকে গুড মর্নিং শুনতে হবে।

কিন্তু পুরো একটা বছর চেষ্টা করে আমার সব চেষ্টা বৃথা যায়। ভদ্রলোকের মুখ থেকে কখনই আমার গুড মর্নিং বলার প্রতি উত্তরে গুড মর্নিং শোনা হয়নি।

তিন

অকল্যান্ড ছেড়ে কয়েক মাসের জন্য হেস্টিংস শহরে চলে গিয়েছিলাম। হেস্টিংস শহর থেকে আবার অকল্যান্ড। পরে একদিন পেশা পরিবর্তন করার কারণে আমার আবার শহর পরিবর্তন করতে হয়। অকল্যান্ড ছেড়ে হ্যামিল্টন চলে আসি। হ্যামিল্টন ইস্ট সাবার্বে বাসা নিই।

সত্যি বলতে প্রথম দেখাতেই আমার হ্যামিল্টন শহরটা ভালো লেগে যায়। অকল্যান্ডের মতো এত বড় শহর না হলেও হ্যামিল্টন বেশ গোছালো শহর। এই শহরের বুক চিড়ে বয়ে গেছে ওয়াইকাটো নদী। যেটাকে বলা হয় নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় নদী। এর দুই পাশে অসংখ্য সবুজ গাছ ও বুক বের হওয়া বড় বড় পাথরের পাড়, আমার বেশ ভালো লাগে। ততদিনে আমি নতুন আরেকটা গাড়ি কিনেছি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আর ব্যবহার করতে হয় না। কিন্তু আমার ওয়াইকাটো নদীর ধারে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে। হ্যামিল্টন ইস্ট সাবার্বটা ওয়াইকাটো নদীর একেবারে গা ঘেঁষা।

আমি এক সকালে হ্যামিল্টন ইস্টে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট পেরিয়ে ওয়াইকাটো নদীর ধারে হাঁটতে বের হই। তখন দেখি, এক ভদ্রলোক একটা জার্মান শ্যাফার্ড কুকুর সঙ্গে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন। তিনি আমার উল্টো দিক থেকে আসছেন। আমি ভদ্রলোককে দেখে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, তাকে আমি গুড মর্নিং বলব না। আমি মনে প্রাণে না তাকানোর চেষ্টাও করি। কিন্তু হঠাৎ শুনি, গুড মর্নিং!

আমি চোখ তুলে তাকাই। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভদ্রলোকের গুড মর্নিং বলার প্রতি উত্তরে নিজে গুড মর্নিং বলতে ভুলে যাই।

ভদ্রলোক আবার বলেন, গুড মর্নিং। হাউ আর ইউ, মাই সান…!

আমি তাড়াতাড়ি বলি, গুড মর্নিং। গুড মর্নিং। আই অ্যাম ভেরি ফাইন।

সেই থেকে হ্যামিল্টন আমার প্রিয় শহর হয়ে ওঠে। প্রায় দেড় যুগ সেই শহরে বসবাস করে আসি।

গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *