অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তারিকুল আমিন -
শহরবাসী

‘আজকের রাতটা যাতে শেষ না হয়। আর এই মেহেদীর রঙ!’

‘আমি চাই যাতে আমাদের প্রতিটা দিন এমন রাতের মত অতিবাহিত হয়। আজকের রাতটা প্রতিদিন বহুরূপে আসুক আমাদের ছোট্ট কুটিরে।’

‘আমাদের সকল মলিনতার ছোপ ছোপ কষ্টগুলো ভর না করুক। হাসি, আনন্দে পরিপূর্ণ থাক আমাদের দ্বীপ-দিপার ফুলকাননে।’

দ্বীপ আর দিপা থাকে বরিশালের একটি অজপাড়াগাঁয়ে। সদ্য বিবাহিত তারা দুজন। এক স্কুলেই পড়াশোনা করেছে। কলেজে উঠে দুজন আলাদা হলেও ভালোবাসা কমেনি। দ্বীপ ও দিপার পড়াশোনা শেষ। দুজনেই চাকরি খোঁজে। তবে দু’পরিবারের সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা।

রাত প্রায় আটটা বাজে। লঞ্চের হুইসেল। দ্বীপ আর দিপাকে বিদায় দিতে আসে পরিবার-পরিজন। পেটের দায়ে শহরে পাড়ি জমাতে হয় এমন হাজারো পরিবারকে। গড়ে ওঠে একক পরিবার। ভেঙে যায় যৌথ পরিবার। লঞ্চ ছেড়ে দেয়। চোখের পানিতে বিদায় জানায় দু’পরিবার। রাত ৯টা। একটি কেবিন নেয়। ঘুরতে আসে ছাদে। দ্বীপ আর দিপা লঞ্চের কোনায় আসে। দুজন যেনো রোমান্টিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। দুজন দুজনকে টাইটানিকের মুভির নায়ক-নায়িকা ভাবছে।

‘ভাই কিছু মনে না করলে আমাদের দুজনের একটি ছবি যদি তুলে দিতেন।’

‘অবশ্যই!’

লোকটি নেহাত ভালো। ভদ্রলোকটি অসাধারণ কয়েকটি ভালো মুর্হূতের ছবি তুলে দেন। এবং পোস্ট কীভাবে দিবে তাও দেখিয়ে দেয়। ভদ্রলোকটির ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে। এবং শুধু একটি ছবি তুলে দেন মোবাইল ফোন দিয়ে। তিনজন মিলে পরে চা পান করেন। গল্প হয়। হয় দীর্ঘ সময় আড্ডা। মজার বিষয় ভদ্রলোকেরও নতুন বিয়ে। এবং একই তারিখে!

দিপা বলল, ‘এই জানো, আমাদের গ্রামে এরপর ট্রেন আর বাসে যাওয়া যাবে?’

দ্বীপ বলল, ‘হ্যাঁ দিপা। আমাদের পদ্মা সেতু হচ্ছে। এরপর ছুটি পেলে দুজনে বাসে করে বাড়ি যাব।’

অনেকক্ষণ তারা ছাদে রয়েছে। ছবি তুলে দেওয়া লোকটিও তার কেবিনে চলে যায়। দূরে দেখা যায় পদ্মাসেতু। দিপা দেখিয়ে বলল, ‘ঐ দেখ আমাদের পদ্মা সেতু। কী সুন্দর তাই না?’

দিপার এই আনন্দ দেখে ভালো লাগছে দ্বীপের। এই প্রথম দিপা গায়ের বাতাস ছেড়ে শহরের বাতাস লাগাবে। এরপর চলে যায় ওরা ওদের কেবিনে। ঢেউ খেলা করছে। লঞ্চ দুলছে। হুইসেল বাজে। যাত্রীদের চেঁচামেচির শব্দ। থালা-বাসনের আওয়াজ। কল চাপার শব্দ। রাতটা এভাবেই কেটেছে ওদের।

সকাল হয়েছে। আজানের শব্দ। পাখি ডাকছে। লঞ্চের লোকদের হাঁক।

‘ঐ ঢাকা! ঢাকা চইল্লা আইসে! সবাই নামেন।’

ওদের জন্য অপেক্ষা করছে খালাতো ভাই অরূপ। তিনজন একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে চলে আসে ঢাকা উদ্যানে। সেখানে একটি ফ্লাটে ওর খালার সাথে ওরা থাকবে। মাসে মাসে ভাড়া দুই পরিবার মিলে দেবে।

ভালো একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে দ্বীপের। আর দিপা একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকের চাকরি জুটিয়ে নেয়। প্রায় ২ মাস দেখতে দেখতে কেটে যায়। ওদের বিয়ের বয়স মাত্র তিন মাস।

সকালে নাস্তা খেয়ে বের হয়। সাথে একটি টিফিন বাটিতে করে খাবার নেয়। গাড়ির শব্দ। হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ের চিৎকার। বাসস্টান্ডে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, হই হই করতে করতে তেড়ে আসে।

‘ছেলে ধরা, নির্ঘাত ছেলেধরা — মার ব্যাটাকে, মেরে ছাল তুলে ফেল।’

সেই সময় ঢাকায় ছেলেধরার ভীষণ হিড়িক চলছে। সবার মুখে মুখে পদ্মাসেতুতে বাচ্চা ছেলে-মেয়ের মাথা লাগবে। এমন গুঞ্জন ছিল তখন। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে হাতজোড় করে কাতর সুরে বোঝাতে থাকে— কোনো মন্দ অভিসন্ধি নেই, আমি শুধু…!

কিন্তু কে কার কথা শোনে। ততক্ষণে মুষলধারায় কিল, ঘুষি পড়তে শুরু করেছে। একদল মানুষ তার কথা না শুনে রাস্তা থেকে ঢিল, খোয়া, ভাঙা ইট তুলে ছুড়ছে। আরেক দল ভাইরালের নেশায় ভিডিও করতে ব্যস্ত। তারা এটাকে ফেসবুক, ইউটিউবে ছেড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করবে। নিরুপায় হয়ে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিবে তার উপায় নেই। একটা পর্যায়ে ব্যাগ ছিটকে পড়ে। চশমাটা একজনের পায়ের তলায় পিষে যায়।

এক ছেঁচড়া লোক সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। ব্যাগ খুলে দেখে কিছু আছে নাকি। পরে খাবারের বাটি ছুড়ে মারে। ভেতর থেকে জিনিসগুলো বের করে। যা পায় নিয়ে নেয়। ভদ্রলোক বেশে চোর বাকি জিনিসগুলো ফেলে পালিয়ে যায়।

মার খাচ্ছে। ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে রিং বাজে…! পকেট থেকে ফোন বের করবে সেই সুযোগ পায় না। অনেকে মারতে মারতে হয়রান হয়। কেউ চলে যায়। পরে পুলিশের কাছে এক ভদ্রলোক তুলে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ দেখে লোকটি নামী একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে।

—হ্যালো!

—হ্যাঁ বল?

—আমি পুলিশ বলছি। আপনারা দ্রুত চলে আসুন তো। সরকারি শহীদ সোহরাওয়াদী হাসপাতালে।

দ্বীপের খালা, দিপা ও অরূপ চলে আসে হাসপাতালে। এসে দেখে দ্বীপ একটি সাদা পেজে লিখছে—

প্রিয় দিপা,

তোমায় নিয়ে পদ্মাসেতুতে করে বাড়ি যাওয়া বুঝি আর হলো না আমার। কী অভাগা আমি। ছোট্ট কুটিরে ছোপ ছোপ কষ্ট নয় বিরাট একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

প্রিয় শহরবাসী,

আমি ছেলেধরা নই। আমি বাচ্চাটিকে গাড়ির চাপা হতে বাঁচিয়েছি। তা না হলে মেয়েটা মরে যেত। আপনাদের একটি ভুলের জন্য আমার দুটো পরিবার আজ… ধ…!

হয়তো ধ্বংস শব্দটি লিখত। তবে কথাটি শেষ করে যেতে পারেনি দ্বীপ। কলমটি পড়ে যায়। দিপার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দ্বীপ। দিপার চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতাল।

লেখক পরিচিত

তারিকুল আমিন

ডাকনাম টারজান। তুরাগ নদীর পাশে মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেটে ১৯৯৫ সালের ৮ আগস্ট জন্ম। পিতা কবি অথই নূরুল আমিন। বরাবর মোহনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঢাকা উদ্যান পাবলিক স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করি। তারপর ঢাকা উদ্যান সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করি। পরে সরকারি শহীদ সোহরাওয়র্দী কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাত্তক ও মাস্টার্স শেষ করেছি। বর্তমানে ফাতেমা ল কলেজে অধ্যয়নরত। কবিতা, প্রবন্ধ আর গল্প লিখছি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। ১৯৯৮ সাল থেকে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেছি। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সব টিভি চ্যানেলে অভিনয় করেছি।

অভিনীত নাটক— আকরাম খান পরিচালিত ‘নাবিলা চরিত্র’ (ধারাবাহিক), ফেরারি পাখি (একক), সাগর জাহান পরিচালিত ‘প্রথম প্রেম টোকাই’ (একক), জাকির হোসেন পরিচালিত ‘গলির ধারের ছেলেটি’ (একক), আবুল হায়াত পরিচালিত ‘আলো আমার আলো’ (ধারাবাহিক), রংধনু (ধারাবাহিক), শফিউল আযম শফিক পরিচালিত নাটক ‘আরাধনা’, ‘মা’, এস এম আক্তার পরিচালিত ‘নাও খেলা’, জাকির হোসেন জাকি পরিচালিত ‘আয়নায় মুখ’, ‘নেক্রা ৫-১১৪’, ‘ছেলে আমার ছেলে’, ‘যুবরাজ’ (বিটিভি), ‘পালক লালীর মন’, ‘গ্রামটির নাম খঞ্জনা’, ‘ইট কাঠের খাঁচা’, ‘কাগজের রঙিন ফুল’, মিজানুর রহমান পরিচালিত ‘বড় আশা করে’ ইত্যাদি।

অভিনীত বিজ্ঞাপন— ‘ম্যাজিক টুথ পাউডার’ (আমার নাম মফিজ, ভাড়া হচ্ছে ৩০), ‘গ্রামীণ ফোন’, ‘গাজী ট্যাংক’, ‘সিটিসেল’, ‘বাংলালিংক’, ‘জাগো মানুষ জাগো’, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ বিজ্ঞাপন’ ইত্যাদি।

অভিনীত সিনেমা— ‘ভাড়াটিয়া প্রেমিক’, ‘মনের মানুষ’; সোহেল রানা বয়াতি পরিচালিত ‘নয়া মানুষ’ ইত্যাদি।

অভিনীত মঞ্চ নাটক— টোকাই নাট্য দল পরিবেশনায় (রোজিনা, নূরজাহান, উপলব্ধি, শুভবুদ্ধি, রংধনু, পানা)। নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায় আয়োজিত নাটক দল ‘ক্লিপেট্রা’, ‘রাজা বাহাদুর শাহ’, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘নৃপতি’, পরিবেশ থিয়েটার আয়োজিত রায়ের বাজার বদ্ধভূমির ইতিহাস নিয়ে নাটক ‘চোখবাঁধা মাইক্রোবাস’ ইত্যাদি।

প্রকাশিত প্রথম বই ‘এলিয়েন খাবে পান্তাভাত’, প্রকাশক : ছোটদের সময়

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *