
১.
শীতলক্ষ্যা নদীর পাশঘেঁষা সরু রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি কালো প্রাইভেট। নিঃশব্দে। সামনের লাইট দুটি নেভানো। কংক্রিটের রাস্তায় পড়ে থাকা নুড়ি পাথরগুলো পিষতে পিষতে অন্ধকারের শূন্যতায় মিশে যাচ্ছে গাড়িটা। গাড়ির ভেতর দুজন মানব মানবী বসা। একজন মৃদু আওয়াজে কান্না করছে। বেয়ে পড়া অশ্রুতে এলোমেলো চুলগুলো মাঝেমধ্যে লেপটে যাচ্ছে গালের সাথে। ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ আর কান্নার আওয়াজ মিলে এক রহস্য সৃষ্টি হচ্ছে গাড়ির ভেতর। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থেমে যায়। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। অন্ধকারের দেয়াল ভেদ করে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ তারার ক্ষীণ আলো। দূরে কোথাও শিয়ালের দল একসাথে হাঁক ছাড়ছে। অন্ধকারের রহস্যপুরীকে আরও রহস্যজনক করে তুলছে। এবার সব নীরবতা ভঙ্গ করে মানবী মিনতির স্বরে বলে উঠল, আসিফ আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি এ ভুল কখনো আর করব না।
ড্রাইভিং সিটে বসে থেকে আসিফ নামক লোকটি কিছুই বলল না। শুধু ক্রমাগত চোয়ালের হাড় শক্ত করতে লাগল। রাগে তার কপালে রগগুলো দপদপ করে ফুলতে লাগল। চোখ দুটো কেমন হিংস্র হায়নার মতো লাল। মুখে ফুটে উঠল ব্যঙ্গাত্মক হাসি। মানবী আবারও মিনতির স্বরে বলতে লাগল— আসিফ, লক্ষ্মী আমার এবারের মতো আমায় ক্ষমা করে দাও। এ ভুল জীবন ও আর করব না। আমি তোমার ভালোবাসার কদর করতে পারিনি। আরেকটিবার সুযোগ দাও প্লিজ লক্ষ্মী। আমি সব ঠিক করে দেব। আমাদের আবার স্বপ্নের মতো সংসার হবে, তুমি দেখো। আমি আর কারও সাথে কথা বলব না। সত্যি বলছি আর আর মোবাইল ফোন চালাব না। তুমি আমায় একটিবার সুযোগ দাও, প্লিজ।
এবার আসিফের রক্তের নেই লালচক্ষু থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মূর্তির ন্যয় স্তব্ধ হয়ে যায় তার দেহ। পলকহীন নয়ন আটকে যায় ধু ধু অন্ধকারের মাজারে। আফসানা পাশে বসে থাকা মানবীর নাম। আসিফের স্ত্রী। পরকীয়াই জড়িয়ে আসিফের সোনার সংসার ধ্বংস করে দেয় সে। আজ আসিফ তাকে শাস্তি দিতে এই নির্জন নিরালায় নিয়ে এসেছে। আসিফের গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে দিতে যেই হাত বাড়ালো আফসানা— অমনি আসিফ বাধা দিয়ে বলল, আফসানা, আমি এই রাত দুপুরের নির্জনতায় তোমায় খুন করলাম। অন্ধকারের কাফন পরিয়ে এই আঁধারে দাফন করলাম। তুমি আমার গাড়ি থেকে নেমে যাও। আজ থেকে তুমি আমার কাছে মৃত। আমি আর এক মুহূর্ত তোমায় সহ্য করতে পারছি না।
আফসানা বিমূঢ় হয়ে যায়। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বড় বড় করে চেয়ে থাকে আসিফের দিকে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে তার। আসিফ আবার বলল, নেমে যাও আফসানা।
এবার তার কণ্ঠ অন্যরকম শোনা যায়। কেমন মরা মরা। আফসানা অন্ধকারে নেমে পরে। তার মুখের উপর দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আফসানা ঝাপসা চোখে আধারে মিলিয়ে যাওয়া গাড়ির পিছনের লাল লাইট দুটো দেখতে পায়। টলতে থাকে সে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। প্রচণ্ড মাথা ঘুরছে তার। এক পর্যায়ে মাটিতে বসে পড়ে সে। আর ভাবে, আসিফ আমায় এই শাস্তি দিল। এর থেকে ভালো হতো যদি সে আমার হত্যা করত। চারদিকে অন্ধকারের দেয়াল। আকাশের কোনো মেঘের নিচে লুকিয়ে আছে চাঁদও। তারা তো আরও দেখা যাচ্ছে না। দূরে কোথাও ডেকে চলছে শিয়ালের দল। নিচে সশব্দে বয়ে চলা শীতলক্ষ্যা নদীর পানির আওয়াজ হচ্ছে। যেন কাউকে ডাকছে। আফসানা সে ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিকে হাঁটা দিল।
২.
জমাটবদ্ধ বরফের মতো চোখের পাতা জমে আছে। ঘুম নেই দু’চোখে। সারা রাত বিছানায় এপিঠ-ওপিঠ করে শেষ হয়ে গেল। ঘুমের ওষুধ খেয়েও যে ঘুম আসে না এটা আসিফের কাছে নতুন। অসহ্য বেদনা হচ্ছে মাথায়। তিনদিন ধরে কোনো কাজকর্মেই মন বসছে না। অফিসেও যাওয়া হচ্ছে না ঠিকমতো। সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেল। ভালোবাসায় যত্নে গড়া সংসারটা ধ্বংস হয়ে গেল। আজ আসিফ-আফসানার দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। লাভ ম্যারেজ তাদের। তিন বছর কলেজের প্রেমের পাঠ চুকিয়ে অবশেষে বিয়ে। কত স্বপ্ন নিয়ে গড়া সংসার। কিন্তু আফসানা সব শেষ করে দিল। ধ্বংস করে দিল। আসিফের এতো ব্যস্ততা। এত কাজ এগুলো কার জন্য ছিল? কার জন্য ছিল রাত-দিনের এত পরিশ্রম? সব তো তাদের সুখের কথা ভেবেই। কিন্তু আফসানা সব শেষ করে দিল। আসিফের ব্যস্ততার সুযোগ গ্রহণ করেছে সে। বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে পারিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই রাত পেরিয়ে যায়। যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করে তার কথা ততই ঘুরে ফিরে শুধু তার কথাই মাথায় ঘুরপাক খায়। আসিফ বিছানা থেকে উঠে খোলা জানালার ধারে চলে আসে। এখনো আঁধারে ঢাকা পড়ে আছে পৃথিবী। পূর্ব দিকে একটু একটু ফর্সার ভাব নিয়েছি। কোথাও কোথাও থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখিদের কলরব আর কিছুক্ষণ পরেই হয়ত সুবহে সাদেক হবে। নতুন দিনের শুরু হবে নতুন যাত্রায়। এই সময় আসিফের মনে হলো — আচ্ছা, আরেকটিবার সুযোগ কি দেওয়া যেত না আফসানাকে? তার ওই কান্না এত আকুতি মিনুতি সবই কি মিথ্যা ছিল? সবই কি সাজানো নাটক? মানুষ ভুল করতেই পারে। কিন্তু তাকে তো সংশোধনের একটিবার সুযোগ দেওয়া উচিত। আসিফের কেমন অপরাধবোধ হতে থাকে। এক আচ্ছন্নতায় ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে। এক সময় আজান হয়। ভোরের আজান। মসজিদের মুয়াজ্জিন বলতে থাকে ঘুম থেকে নামাজ ভালো। আসিফ অনেকদিন পরে এই ডাকে সাড়া দেয়। ভালো করে ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়। কেমন স্নিগ্ধ ভাব চলে আসে মনে।
নিজেকে একটু হালকা হালকা মনে হয়। নামাজের পর অনেক কান্না করে সে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় যেন সব ঠিক হয়ে যায় আবার। আচ্ছা, আফসানা কি ভালো আছে? নাকি তার কিছু হয়েছে? নাকি সে চলে গেছে তার নতুন প্রেমিকার কাছে? আহ্ অসহ্য বেদনা, কিছুই ভাবতে মন চায় না। বাইরের সব আলোকিত হয়ে গেছে। মানুষজন অলসতার চাদর ফেলে দিয়ে আবার কর্মব্যস্ততার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। আসিফ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়ে শীতলক্ষ্যার উদ্দেশ্য। সেই সরু রাস্তা। অনেকটাই পরিচিত। কলেজে পড়ার সময় অনেকবার আসা হয়েছে এদিকে। তখন অবশ্য গাড়ি ছিল না। রিকশা দিয়া মেইন রাস্তা পর্যন্ত আসা যেত। পরে বাকি পথ হেঁটে। সূর্যের সোনালি আলো গাড়ির গ্লাস ভেদ করে আসিফের চোখে মুখে লাগছে। এই আলোয় চোখ পড়ল সেদিন ফেলে দেওয়া আফসানার মোবাইল ফোনের দিকে। সেদিনের পর গাড়িতে ওঠা হয় না বলে মোবাইল ফোনটি আর চোখে পড়েনি এতদিন।
হাত উৎফুল্লময় শরীরে বিষাদের তেল মেখে দিল কেউ। আসিফ মোবাইল ফোনটি রেখে দিল আগের জায়গায়। গাড়িটি সেদিনের জায়গায় এসে থামল। চারিদিক জনশূন্য। কিছু পাখি নদীর বুকে উড়াউড়ি করছে। ঘাটে বাঁধা কয়েকটি নৌকা ঢেউয়ের সাথে খেলা করছিল। আসিফ আশপাশে তাকাতে লাগল। অপরাধবোধ তাকে পীড়া দিচ্ছে। সেদিন সেই অমানুষিক নিষ্ঠুর ব্যবহার না করলে হয়তো চলত। আসিফ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল গভীর দৃষ্টিতে। একটু দূরে চোখে পড়লো একজোড়া সোনালি জুতা। মেয়েদের। রোদে চিকচিক করছে। আফসানার ঠিক এরকম জুতা ছিল। আসিফ কাছে গিয়ে জুতা হাতে নিল। নিশ্চিত আফসানা জুতা। এবার আসিফ ব্যাকুল হয়ে নদীর আশেপাশে তাকাতে লাগল। অজানা আতঙ্কে বুক ধরধর করছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। নদীর দিকে এগিয়ে গেল সে। একটু দূরে পাড়ের দিকের একটি গর্তে কে যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। উপর থেকে তাকালে বোঝা যায় না এখানে কেউ শুয়ে আছে। আসিফ এগিয়ে গেল। একটু এগোতেই বুঝতে পারল এটা আফসানা! বিস্ফারিত চোখে আফসানার দিকে তাকিয়ে আছে। নীল কাগজের উপর সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছি। শরীর ওড়না দিয়ে ঢাকা। মুখের উপর এলোমেলো চুল। আসিফের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে সে এক দৌড় দিয়ে আফসানার কাছে এল। গায়ে হাত দিতে চমকে উঠল। প্রচণ্ড জ্বর শরীরে। মুখটা কেমন রক্তশূন্য ফ্যাকাস হয়ে গেছে। ঠোঁটে জমে যাওয়া রক্তের কালো দাগ। আসিফ আফসানা বলে কয়েকবার ডাক দিল। আফসানা আস্তে আস্তে চোখ মেলল। কিছু দেখতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না। ক্ষীণভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। একটু পর অস্পষ্ট স্বরে বলল, কেউ আমায় ছোঁবে না। আমি মারা গেছি। কেউ ধরবে না আমায়। আসিফ এবার একটু শব্দ করে কেঁদে উঠল। আফসানাকে পাঁজাকোলা করে গাড়ি দিকে ছুটল৷
৩.
হাসপাতালের প্রশস্ত বারান্দা। ছাদের কার্নিশ বেয়ে ঝুলন্ত কিছু ফুলের টপ বারান্দার শোভা বাড়াচ্ছে৷ এর নিচে সারি সারি কিছু স্টিলের চেয়ার পাতা। আসিফ তার একটির মধ্যে উৎসুক হয়ে বসে রয়েছে। তিনদিন পর গত রাতে আফসানার জ্ঞান ফিরেছে। একটু পর আসিফ রুমে প্রবেশ করল। আবছা আঁধারে ঢাকা পুরো রুম। আসিফ এগিয়ে এসে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দিল। স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে গোটা রুম সূর্যের ফকফকে আলোয় ভরে গেল। বেডে আফসান এখনো ঘুমোচ্ছে। আসমানি কালার একটি চাদরে তার গলা পর্যন্ত ঢাকা। এক চিলতে সূর্যের আলো এসে মুখে চিকচিক করছে। রক্তশূন্য ফ্যাকাস হয়ে আছে মুখাবয়ব। চোখের নিচের সেই কালির দাগগুলো নেই। একগুচ্ছ চুল ছড়িয়ে আছে কপালে। আসিফ একটি মোড়া নিয়ে আফসানার পাশে বসল। এক হাত দিয়ে পরম মমতায় সরে দিল এলোমেলো চুলগুলো। শীতল হাতের স্পর্শে একটু নড়ে উঠল আফসানা। একটু পর আস্তে আস্তে চোখের পত্র মেলে আসিফকে দেখে যেন চমকে উঠল। মুহূর্তেই যেন মনে পড়ে গেল সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। এক ঝটকায় মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরল। আসিফের মুষ্টিবদ্ধ হাতে থাকা আফসানার ইনহেলার লাগানো হাতটিও টানাটানি করল। কিন্তু দুর্বলতার কারণে ছাড়িয়ে নিতে পারল না। আসিফ অন্য পাশে বসে থেকেও বুঝতে পারছে যে আফসানা নিঃশব্দে কান্না করছে। আসিফ কানের কাছে মুখ নিয়ে বিষণ্ন স্বরে বলল — আফসানা, আমায় ক্ষমা করা যায় না? রাগের মাথায় অন্ধ হয়ে অনেক বড় একটি ভুল করে ফেলেছি। প্লিজ, আমায় ক্ষমা করে দাও।
কিছুক্ষণ পর আফসানা অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, কিন্তু আমি তো অনেক আগেই মারা গেছি। সেই অন্ধকার রাতে আমার কবর আমি নিজ হাতে খোদাই করি।
আসিফ আফসানার হাতের মাথা রেখে অঝোরে কান্না করতে লাগল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, আমার সেই পাষণ্ড আচরণই তো আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে আফসানা! তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমি হয়তো সত্যি সত্যিই মারা যাব।
এবার আফসানা আসিফের দিকে তাকাল। উদ্ভ্রান্ত চেহারা। এলোমেলো চুল। চোখের নিচে স্পষ্ট রাত জাগার দাগ। এই কয়দিনেই চোয়ালের হাড় ভেসে উঠেছে। আফসানা চেপে রাখা কান্না আর থামিয়ে রাখতে পারল না। সশব্দে কান্না করছে দুজনই। দুজনের চোখের পানিতে যেন নতুন স্বপ্নের সেতু তৈরি হতে লাগল। খানিক পর আফসানা আসিফের হাতটি টেনে গালের সাথে লাগাল। একটু পর বলল, তুমি মরে গেলে আমাকে বাঁচিয়ে তুলবে কে?