অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাশিদুল হৃদয় -
সিঁড়ি

বলগা বলগা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মোটরসাইকেল চলছে। সরু কাঁচা মাটির ঢিলানো রাস্তা। একটা বিষণ্ন মোটরসাইকেলের পিঠে ওরা দুজন। চৈত্রের দগ্ধ দুপুরে গল্প তেমন আগায় না। প্রসঙ্গ ওঠে আর নামে। আলতাফ অযথা পিপপিপায়। খটখটে গলায় যতটুকু রসবোধ আনা যায় সেটুকু আনে কাদের। পড়শির ছিদ্র বেড়ায় চোখ রাখতে যেমন হাঁসের মতো গলা একপাশে কাত হয়ে সামনে ঝুঁকে আসে তেমনি করে পেছন থেকে গলা উজায় কাদের। আলতাফের কান বরাবর মুখ আনে সে।

—এত হরেন দেওয়ার কী আছে আলতাফ। গ্রামের দুপুর বেলা নিশ্চয়ই ঢাকার মতো জ্যাম পাইবা না।

‘টিপতে ভালো লাগে ভাই’ বলেই আবার মোটরসাইকেলের কান টিপে সঘন পিপপিপায়। ‘টিপতে ভালো লাগে’ কথাটার রসবোধে সে নিজেই হাসিটুকু ধরে রাখতে চায় ঠোঁটে। কিন্তু শুকনো ঠোঁটে কথা লেগে থাকে না। একবার কথা পড়ে গেলে আবার তোলা ভার। তাই সে মোটরসাইকেলের গিয়ার একধাপ নামিয়ে দিয়ে বলে, একটা কথা বুঝতে পারছি না ভাই। চৌধুরী সাহেব এত বড় শিল্পপতি। ঢাকায় তার অগুনতি ফ্লাটবাড়ি থাকতেও এই গ্রামে থাকছে কেন?

মোটরসাইকেলের ফটফটানি বন্ধ হলো তখন। রসুনের জমির এক কোনায় ঝকঝকে পানি উগড়ে দিচ্ছে মোটা প্লাস্টিকের পাইপ। গলা ভেজাতেই ওদিকে ছোটে ওরা। কাদের রুমাল ভিজিয়ে ঘাড়ে ধরে খানিকক্ষণ। পান শেষ কোরে মোটরসাইকেলে চড়ে বসে তারপর। কাদের দিগন্তে তাকায়।

—ক্রাইসিস জিনিসটাই গ্রামে নেই, দেখেছ। যত লেনাদেনা সব শালার রাজধানীজুড়ে। ঢাকার সেভেন্টি পারসেন্ট পুরুষের ম্যানিব্যাগ শূন্য, বিশ্বাস হয় আলতাফ?

আলতাফ মুখের সম্মতি হরেণে শোনায়। কথা হয় না তখন। কাদেরের পিঠের ব্যাগ ব্যাগের ফিতে তার গলা টিপে ঝুলে আছে। মূলত ব্যাগই ঝুলে আছে দুই কাঁধে। ব্যাগের ভেতরে নিকন ক্যামেরা, মিনি ট্রাইপড, দুইটা মাইক্রোফোন আর একটা গানলাইট। এরাও ঝুলছে। মোটরসাইকেল একবার থেমে আবার চলছে। এরা যখন চৌধুরী ভিলার সামনে থামল— নিয়ামত চৌধুরী তখন জোহর শেষ করে বাগানে। লিচুর ঘন পাতার ছায়া দুপুরেও প্রশান্তি আনছে। ভিলার প্রধান ফটকে বেতের বেড়ার সুনিপুণ কারসাজি। চৌদিকে ঘেরা বসার স্থানে আলতাফ আর কাদের। বাগান তদারকি শেষে নিয়ামত চৌধুরী ভেতরে চলে গেলেন। আলতাফ চটে গিয়ে বলল, শালার সব বড়লোক এক রকমের। আর কারও দাম দিতে যাবেই না এরা।

কাদের বলল, দাম দিতে গেলে এদের উইট থাকে না।

—উইটের গুষ্টি মারি। মানুষকে এরা কীভাবে দ্যাখে পরতে পরতে দেখেছি ভাই। এইসব লোকের গুণ গাওয়া যায় না। আলতাফ বোধ হলো বেশিই চটেছে। এই লিচু ছায়া তার শরীরের উষ্ণতা কমাতে পারছে না। কমদামি ইজি ব্র্যান্ডের টি-শার্ট ঘেমে তার প্রুফ দিচ্ছে। কাদের তাকিয়ে থেকে বলল, চরিত্রের গুণকীর্তন নিয়ে ঘুরলে এত বড় হওয়া যেত না আলতাফ। তোমার আরও পড়াশোনা করে আসতে হতো। এমন মাপের শিল্পপতির ইন্টারভিউ নিতে আসছ শিল্পের আগাগোড়া কিছুটা চোখ বোলানো লাগত।

আলতাফ বলল, যদি বলতেন কপাল, তাইলে কিছুটা মানা যেত ভাই। বই পড়ে উনি শিল্পের বাল ছিঁড়ছেন আমার তা মনে জাগে না।

—আলতাফ। উনি যে উপায়ে বালটা ছিঁড়ছেন তা জানতেই আসছি আমরা। ইনার মতো আর যারা এত বড় শিল্পপতি তারা বলবেন তারপর আমরা লিখব। এই লেখা পড়ে কেউ শিল্পপতি হবেন না। কিন্তু আমরা লিখব। ক্রাইসিসটা আমাদের। এখন চুপ কর।

এসময় রসশূন্য পাতা ঝরছে। লিচু, মেহগনির লালচে পাতারা নাচতে নাচতে নামছে। লোক দিয়ে ডাকানো হলো ওদের। লোকটা পথ ধরে নিয়ে যাবে তাই নির্দেশ। প্রধান ফটক পার হতেই সামনে তাকিয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওদের। দূরে পাহাড়চূড়ার মতো উঁচুতে কুটকুটে কালো রঙের মহলা বাড়ি। তার থেকেও ভয়াবহ ব্যাপার অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে সেখানে। নিচ থেকে সিঁড়ি বরাবর তাকালে বডি থেকে থুতনির দূরত্ব পূরক কোণের মতো দেখায়। লম্বা লম্বা শোয়ানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। লোকটা ফটফট শব্দ কোরে উঠছে। লোকটা বলল, আসেন।

আলতাফ সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। পাশেই কাদের। তার পিঠের ব্যাগ ফটকের ওখানে জমা আছে। চেক করে দেওয়া হবে। আলতাফ অসহায় হয়ে বলল, একটানা এত লম্বা সিঁড়ি কোথাও দেখছেন ভাই।

কাদের বলল, একটা এনিমেশন সিনেমায় দেখেছিলাম। বাস্তবে দেখা এইটাই হায়েস্ট (highest)।
উপরে উঠছে ওরা। একটু পরপর দেখে নিচ্ছে কতদূর এল এবং কতদূর আছে। কাদের লোকটাকে বলল, নিয়ামত চৌধুরী কি এই সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন?

লোকটি বলল উনার জন্য নিচেই লিফট করা আছে। কিন্তু চাইলে যে কেউ লিফটে যেতে পারে। মাঝপথে এই তথ্য পাওয়া সুখজনক না। আলতাফ মনে হয় গালি দিল লোকটাকে কাদেরের আন্দাজ। তবে ওরা অবশেষে উঠে এলো। সিঁড়ির উপরের মাথায় ফিল্টার বসানো তাতে বরফের টুকরা। লোকটা বলল, লেবুর শরবত করা। খেয়ে ওখানে বসুন। জুতা খুলে যাবেন। স্যার আসছেন।

লোকটি উধাও। আলতাফ গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, নিয়ামত সাহেবের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে অফিস থেকে সোমাকে পাঠানো উচিত ছিল আগে। বেচারি মহলটার ভালো একটা রিভিউ দিয়ে চাকরিটা পোক্ত করতে পারত।

—পোক্ত সে এমনই করতে পারে। শোয়া ছাড়া এখন কিছু হয় না, আলতাফ। কাদের বলল। আলতাফ চৌকো হাসি দিয়ে বলল, শরবত খেয়ে ভালো আছি। বসি চলেন। ব্যাগ তো আসে না ভাই?

—আসবে হয়তো। আবার আসতে না পারা অসম্ভব কিছু না।

—না এলে শ্যুট করবেন কীভাবে? এই কাজটা সম্পূর্ণ করতে না পারলে চাকরি নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে। শালা ভুটকুটা মেয়ে মানুষ দিয়ে অফিস ভরছে। কী পরিমাণে মাগীখাদক ভাবেন?

কাদের বলবে কিছু কিন্তু চৌধুরী সাহেব এলেন। ওরা উঠে দাঁড়াল। কাদের সালামও দিল। তখনকার লোকটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। কাদের বিনীতভাবে বলতে লাগল— স্যার, আমি কাদেরুল ইসলাম। ফেমাস নিউজ পত্রিকার রিপোর্টার। ও আলতাফ। যান্ত্রিক সহযোগী।

নিয়ামত চৌধুরী দূরের লোকটিকে বললেন, চা দিতে বল। তোমাদের খোঁজ নিয়ে আসা উচিত ছিল আমি সাক্ষাৎকার দিই না। চা খেয়ে চলে যাও।

কাদের কাচুমাচু হয়ে বলল, স্যার দু’একটা বিষয় জানতে আসছি। বেশিক্ষণ লাগার কথা না।

নিয়ামত চৌধুরী ঠোঁট টিপে অবজ্ঞা প্রকাশিলেন।

—দু’একটা বিষয় জানলেই হবে?

—মেইন থিমটা ক্যাচ করলেই হবে স্যার।

—তারপর নিজেদের মুখস্থ করা লাইন লাগিয়ে রিপোর্ট করবে তাই তো?

কাদের নিরাশ ভাব ঢাকতে চাইছে। একটা প্যাঁচ প্রথমেই বেঁধে যাবে এমন ধারণা তার হয়নি। আলতাফ বলল— স্যার, আপনার সাফল্যের উপর একটা হালকা ডকুমেন্টারি টাইপ নিউজ করতে চাই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শাটডাউন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এখন শিল্পপতিদের মনোবল গ্রোআপ করতে এই রিপোর্ট দেশের সার্থেই জরুরি। নিয়ামত চৌধুরী পা দোলাতে থাকলেন।

—শোনো ছেলে। দেশের জন্য কেউ কাজ করছে না। আর আমি বাকিদের শেখানোর দায়িত্ব নেইনি। কথা হবে না। তোমরা যাও।

তিনি যেতে বললে যেতে হয়। বসে থাকা যায় না। ওরা উঠে দাঁড়াল। দূরের লোকটি বলল, নিচে থেকে ব্যাগ চেয়ে নেবেন।

আলতাফ ভেঙে পড়েছে। অফিসে গেলে কাজ চাইবে। দিতে না পারলে ভুটকুটা বলবে নিউজ রিপোর্টার হিসেবে মেয়েদের গুণাবলি। এসব চাকরিতে ছেলেদের থেকে মেয়েরা বেটার তার দীর্ঘ লেকচার। কাজ বাগিয়ে আনতে মেয়েদের পটুত্ব— হেনতেন। কাদেরও ভাবছে চাকরি বাঁচবে না এবার। চৌধুরী সাহেবের উইট যে এমন পর্যায়ে কে জানত। কাদের লোকটাকে জানায় নামতে তারা সিঁড়ি ভাঙবে না। লোকটা লিফটে নিয়ে যায় ওদের। হুস করে এক মুহূর্তে নিচে নামে ওরা। উঠতে যে ভয়, আতঙ্ক ওদের পেয়েছিল, এক মুহূর্তে নামতে তেমন কিছুই মনে হলো না। এই নামার মাঝে কেবল তৃপ্তিদায়ক শরবত আর পাওয়া গেল না।

রাশিদুল হৃদয় 

লেখালেখি যাকে আষ্টেপৃষ্ঠে তাড়ায়— তাকে সবাই হৃদয় নামেই চেনে থাকে। সবার একটা দুইটা ভালো নাম যেহেতু আছে সেহেতু তার ভালো নাম রাশিদুল হৃদয়। ব্যক্তিগত জীবনে সর্বদাই ছাত্র। একাডেমিক অঙ্গনে সম্মান পেরিয়েছেন এবার। লেখালেখির পথে এখনো চেনা মাইলফলক হয়ে উঠতে পারেননি— তবে চব্বিশ বইমেলায় তার ২টি কবিতা ও ৩টি ছোটগল্প সংকলিত হয়ে আছে। এর বাইরেও তার অপ্রকাশিত কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প রয়েছে। জন্মের দিন তারিখ ২৪.০৬.২০০১। বাড়িঘর আপাতত চাটমোহর, পাবনায়।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *