
‘আত্মহত্যার সহজ কোনো উপায় তোমার জানা আছে নাকি?’ একটু কেশে নিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন আপনি।
‘সহজ বলতে আপনে কী বুঝাইতে চাচ্ছেন সেইটা আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার।’
‘সহজেরও আবার ধরন-টরন আছে নাকি!’
‘আছে না আবার! অবশ্যই আছে।’
‘তাহলে তুমিই বরং পরিষ্কার করে বলো, সহজের ধরন বলতে কী বোঝাতে চাও?’
‘যেমন ধরেন, সহজে আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে আপনি আসলে কী চান⸺কম কষ্টে মারা যাওয়া নাকি মারা যাইতে সময় কম লাগা? কম কষ্টে মারা যাইতে গেলে সময়টা বেশি লাগতে পারে, আবার কম সময়ে মারা যাইতে গেলে কষ্ট বেশি হইতে পারে।’
‘এবার বিষয়টা পরিষ্কার। আচ্ছা, তুমি দুই ধরনেরই একটা করে উপায় বলো।’
‘একেবারে পরিষ্কার কোনো ধারণা নাই। তবে আন্দাজের ওপর কইতে পারি।’
‘কও, যা খুশি তার ওপর কও।’
‘অনেকগুলা ঘুমের ওষুধ খাইয়া মরতে পারলে কষ্ট কম হওয়ার কথা। আর দশতলা থেকে লাফ দিয়ে মরতে পারলে সময় কম লাগব। মানে দশ তলা থেকে নিচে পড়তে যতটুকু সময় লাগে আরকি।’
‘নাহ, ঠিক যুতসই মনে হচ্ছে না!’
‘ক্যান!’
‘এই ঘুমের ওষুধের ব্যাপারটা ছেলেমানুষী টাইপের হয়ে যায়। আমার বয়সের সাথে ঠিক যায় না। আর দশতলা থেকে লাফ দিয়ে পড়া⸺ওরে বাবা! ভয়ঙ্কর ব্যাপার! চরম বীভৎস!’
‘এইদিকে মরতে চান, আবার ভয়ও পান! কেমন আজগুবি হইয়া গেল না ব্যাপারটা!’
‘ভয় পাই দেখেই তো মরতে পারি না। নাহলে কবেই⸺’
‘আরও সহজ একটা উপায় আছে।’
‘সেইটা না আগে বলবা! কী সব আউল-ফাউল বলে সময় নষ্ট করো!’
‘একটু ঝামেলা আছে, এইজন্য আগে বলি নাই।’
‘ঝামেলা পরে দেখা যাবে, আগে উপায়টা বলো।’
‘ঘাড় মটকায় দেয়া!’
‘কী বলো এইসব! নিজের ঘাড় নিজে মটকাব কীভাবে?’
‘ওইটাই তো ঝামেলা! এর জন্য লোক ভাড়া করা লাগব। পেছন থেকে আচমকা আইসা ঘাড় মটকায় দিয়ে চলে যাবে। একেবারে চোখের পলকের মতো কম সময়ে তো মরতে পারবেনই, আবার কষ্টও বুঝতে পারবেন না! কোন ফাঁকে মইরা গেলেন নিজেই টের পাইলেন না⸺এইরকম!’
‘কী সব বলো! আমি আত্মহত্যা করতে চাইছি, খুন হতে না!’
‘আত্মহত্যা করলেও মরবেন, কেউ আইসা মাইরা ফেললেও মরবেন। আবার কিছু না করলেও একদিন না একদিন মরবেন! মরাটাই তো উদ্দেশ্য, নাকি?’
‘তাই বলে কেউ নিজেকে মারার জন্য নিজেই লোক ভাড়া করে কোনোদিন!’
‘কেউ কোনোদিন করে না বলে যে আপনি করতে পারবেন না এমন তো কোথাও লেখা নাই!’
‘ধুরো মিয়া! তুমি সমাধান দিতে না পারো, চুপ থাকো, ঝামেলা পাকাইও না!’
‘ঠিক আছে, আপনেরটা তাইলে আপনেই বুইঝা নেন।’
নীরবতা নামল কিছুক্ষণের জন্য।
‘লোক ভাড়া করার ব্যবস্থা কিন্তু আমিই কইরা দিতে পারি। আবার আপনি চাইলে আমি নিজেও কাজটা করতে পারি।’
চমকে ওঠেন আপনি। লোকটা আপনাকে খুন করতে চাইছে! আপনি কি বাস্তবেই কথাটা শুনলেন, নাকি ঘোরের ভেতর! ভয় ভয় অনুভূতির ভেতর মিনমিন করে শুধু বললেন, ‘নাহ, তোমার কিছু করা লাগবে না।’
কিন্তু ভয়ে ভয়ে সতর্ক হয়ে বসলেন আপনি। যদি লোকটা কিছু করে বসে!
‘রাগ না করলে কথাটা জিগাই⸺’
‘কী কথা!’
‘আপনে আত্মহত্যা করতে চাইতেছেন ক্যান?’
‘বউয়ের জ্বালায়! আর সহ্য হয় না এসব যন্ত্রণা!’ ভয় ঝেড়ে এবার অকপটে বলে ফেললেন আপনি।
‘আপনে যে বোকা সেইটা আমি প্রথমেই বুঝছি, কিন্তু আপনে যে বোকার হদ্দ এইটা এখন বুঝলাম! আপনারে শ্রেষ্ঠ বোকার হদ্দ পুরস্কার দেয়া উচিত।’
‘কী বলো আবোল-তাবোল!’
‘আপনে কখনো শুনছেন, মাথাব্যথা হইলে মানুষ মাথা কাইট্টা ফালায়!’
‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘বউয়ের জ্বালায় আপনে নিজে মরবেন ক্যান! মরতে হইলে বউ মরবো!’
‘তোমার এতো পণ্ডিতি মারাতে হবে না⸺’ মেজাজ জ্বলে ওঠে আপনার, ‘তুমি তোমার কাজ করো, রিকশাটা ঠিকমতো চালাও!’
‘দ্যাশে কি আর উচিত কথার ভাত আছে! পোড়াকপাল!’
কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকেন আপনি। লোকটা যদি রিকশাটা কোনো গাড়ির নিচে ফেলে দেয়! অবশ্য এই রোডে বড় আর ভারী কোনো গাড়ি চলে না। প্রাইভেটকারের নিচে পড়লে মরার আশঙ্কা কম থাকলেও, হাড়গোড় ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকার আশঙ্কা আছে। ব্যাপারটা আরও ভয়ঙ্কর। আপনি তাই সতর্ক থাকেন। মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছেন। মন-মেজাজ এতটাই বিক্ষিপ্ত ছিল যে এই মূর্খ রিকশাওয়ালার সাথে এমন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করতে হলো। আর এইটুকু পাত্তা পেয়ে মূর্খটা পণ্ডিতি করতে বসে গেছে। আর পাত্তা দিতে চাইলেন না তাকে।
কিন্তু বেশিক্ষণ এড়িয়েও থাকতে পারলেন না!
কিছুটা ইতস্তত করে গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বউরে মারার সহজ কোনো উপায় তোমার জানা আছে?’
ফিক করে হাসে রিকশাওয়ালা লোকটা, ‘জানতাম, লাইনে আসবেন।’
গা জ্বলে আপনার, ‘ফালতু প্যাঁচাল বাদ দাও। কাজের কথা থাকলে বলো।’
‘উপায় তো আছেই। ম্যালা উপায় আছে।’
‘আপাতত দুই-তিনটা কও। দেখি কোনটা যুতসই হয়।’
‘কাইল রাত এগারোটায় আপনার এলাকার ওই খালপাড়ে ভাঙা ব্রিজের নিচে আসেন। বলবোনি।’
‘কেন! কাল রাতে, তাও আবার খালপাড়ের মতো নির্জন জায়গায়, মতলব কী তোমার?’
‘আমার কোনো মতলব নাই। মতলব তো আপনার।’
‘এখন এইখানে বলতে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা নাই? আপনার মতো আমি বেকুব নাকি?’
‘হিসাব করে কথা কও মিয়া। পাত্তা দিচ্ছি বলে মাথায় উঠে বসতে চাইছ নাকি!’
‘রাইগেন না স্যার! না বুইঝা হুদাই রাগ কইরা লাভ নাই। শোনেন, এইসব খুন-খারাপির কথা কী এইরকম রাস্তাঘাটে কওয়া যায় নাকি! শোনেন নাই কখনো যে, দেয়ালেরও কান আছে! দেয়ালের কান থাকতে পারলে এই রাস্তার পিচের কান থাকতে পারে না! এই রিকশার লোহার কান থাকতে পারে না! এই রিকশা এখন আমি চালাইতাছি, কাইল সকালে আরেকজনে চালাইব, এই লোহার কান থেইকা আর কার কার কানে কথা চইলা যাইব তার ঠিক আছে!’
আপনার মন চাইল পেছন থেকে রিকশাওয়ালার মাথায় একটা গাড্ডা মারবেন। কিন্তু হাতটাকে সামলে নিলেন আপাতত।
রিকশাওয়ালা অবশ্য আপনার কিছু বলার অপেক্ষা করল না, ‘আপনার যদি দরকার থাকে তাইলে কাইল রাত এগারোটায় খালপাড়ে আসেন, দরকার না থাকলে বউয়ের জ্বালায় কাপুরুষের মতো আত্মহত্যার পথ খুঁইজা নিয়েন।’
এবার সত্যি সত্যিই আপনার ইচ্ছে হয়েছিল পেছন থেকে লাথি মেরে লোকটাকে রিকশার সামনে ফেলে দিবেন। পা উঠিয়েও তা নামিয়ে নিলেন। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে রিকশা। এখন আর তাকে ঘাটানোর দরকার নাই।
‘এই, ডানে সামনের ওই বাসাটায় রাখো।’
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার আগে চোখ কটমট করে তাকালেন, তারপর নিচু স্বরে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, এইসব পণ্ডিতিমার্কা কথাবার্তার জন্যই তোমার জীবনে কিছু হয় নাই। এমনকি এই রিকশা চালিয়ে খাওয়াও মনে হয় তোমার কপালে বেশিদিন নাই। সময় থাকতে ঠিক হয়ে যাও মিয়া।’ ভাড়া দিয়েই গেটের ভেতরে চলে গেলন আপনি।
রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলল, ‘নিজের নাই বুদ্ধি, মানুষেরটারে কয় পণ্ডিতি! মনে চাইলে আইসেন কইলাম কাইল…’
রাত ঠিক এগারোটায় আপনি খালপাড়ে ভাঙা ব্রিজের কাছে এসে দেখেন যে, জায়গাটা আসলে ময়লার একটা ভাগাড়। মাছির ভনভন ছাড়া জায়গাটা একেবারে নির্জন, অন্ধকারও যেন একটু বেশি। উৎকট গন্ধে গা ঘিনঘিন করে উঠছে আর মাথাটা বনবন করছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। রিকশাওয়ালা কি আপনাকে বোকা বানাল, নাকি সহজে আত্মহত্যার খায়েশ মিটিয়ে দিতে পেছন থেকে আচমকা এসে আপনার ঘাড় মটকে দেবে। লোকটা যেকোনো কিছুই করে ফেলতে পারে, আপনার তাতে সন্দেহ নেই। কেন এখানে এলেন, সেটা ভেবে নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে করছে আপনার। নিজে মরতে চাওয়া বা মরে যাওয়াটা এক বিষয়, কিন্তু বউরে মারতে গিয়ে যদি নিজেই কোনোভাবে ফেঁসে যান, তাহলে তো যেই লাউ সেই কদুই! এক ঝামেলা সরাতে গিয়ে আরেক আপদ ঘাড়ে নেওয়া! একারণেই একটা ভয় পিছু পিছু হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে আপনার। ভয় কিছুটা দূর করতে এবং আরেকটু সজাগ থাকতে মোবাইলে লাইট জ্বালাতেই চাপা একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আলোটা নিভায় দেন, স্যার।’
প্রথমে চমকে উঠলেও বুঝতে পারলেন রিকশাওয়ালার কণ্ঠ এটা। আচমকা এসে আপনার ঘাড় মটকে দেবে না, এটা নিশ্চিত হওয়া গেল।
কাছে এসে পাশে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা বলল, ‘আলো থাকলে মানুষের নজর পড়ব।’
‘তুমি এসেছ তাহলে? আমি তো ভাবলাম⸺’
চাপা স্বরে একগাল হেসে বলল রিকশাওয়ালা, ‘আসব না ক্যান স্যার! আমি তো জানতাম আপনি আইবেন!’
‘আচ্ছা, এখন কাজের কথা শুরু করো।’ আপনার কণ্ঠে দ্রুত কেটে পড়ার তাড়না, কোনো আইডিয়া নিয়ে যেতে পারলে সেটা বোনাস।
‘আপনের মোবাইলটা বন্ধ করেন আগে। এখানে খুন-খারাপির আলাপ শুইনা আপনার মোবাইলের গোগোল বাবা একটু পর থেইকা আপনার সামনে খালি এইগুলাই হাজির করতে থাকব। আমাগো প্রাইভেসিও নষ্ট হইব।’
‘ওইটা গুগল।’ একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন আপনি। অবাকও হলেন একটা রিকশাওয়ালার এই সেন্স দেখে।
মোবাইল ফোন বন্ধ করতে গিয়ে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন আপনি। গতকাল ঘাড় মটকানোর প্রসঙ্গে রিকশাওয়ালার আপনাকে খুন করতে চাওয়াটা মাথায় গেঁথে গেছে আপনার। প্রতিটা মুহূর্তে সন্দেহ হচ্ছে যে রিকশাওয়ালার কোনো মতলব আছে।
‘ডরান ক্যান, স্যার!’ আপনার ইতস্তত মুহূর্তের মাঝে বলে ওঠে রিকশাওয়ালা, ‘আমারে ডরানোর কী আছে?’
কিছু না বলে এবার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন আপনি।
‘হুম, এবার বলো।’
‘বউয়ের জ্বালা আর কী কমু স্যার, আমারও দিনে দুই-চাইরবার কইরা মনে হয় বেটিরে মাইরা ফালাই!’
‘মারো না কেন? আর নিজে পারো না অথচ মানুষরে বুদ্ধি দিতে আসছ! আদৌ কোনো আইডিয়া আছে তোমার এসব বিষয়ে? নাকি অন্য কোনো মতলব আছে তোমার!’
‘স্যার, সব এক পাল্লায় মাপা যায় না, স্যার। আমি বউরে মারতে পারি না মানে যে আমার কোনো আইডিয়া নাই তা মনে করবেন না। আমি মারি নাই কারণ দিনশেষে আবার মায়া জাইগা ওঠে। তারে ছাড়া মনে হয় আমার দুনিয়া আন্ধার! মহব্বতটা তখন বাইড়া যায় আরও।’
‘তোমার মায়া-মহব্বতের গল্প শুনতে আমি আসিনি। তুমি কাজের কথা বলো।’
‘এত পেরেশান হওয়ার কী আছে, স্যার। আমি আপনাদের গোগোল বাবার মতো মেশিন না যে “কীভাবে বউরে সহজে মারা যায়” লিইখা একটা চাপ দিবেন আর তরতর কইরা আইডিয়া আইসা পড়ব। হ্যাঁ, ওইখান থেইকা আইডিয়া আসব ঠিকই, একটাও কামে লাগব না। চাইলে একবার চেক কইরা দেখেন।’
আজ সারাদিন আপনি বিভিন্নভাবে গুগলে সার্চ করেছেন এ বিষয়ে, অনেক কিছু পেয়েছেন, কিন্তু যুতসই কিছু পাননি। এখন মনে পড়লো হিস্ট্রি ডিলিট করা হয়নি। মোবাইল ফোন চালু করে সবার আগে এ কাজটা করতে হবে।
‘তো, তুমি এখন কী চাইছ?’
‘আমারে তথ্য দেন। ম্যাডামের কোন কোন জায়গায় দুর্বলতা, কীসে কীসে ভয়⸺এইসব।’
‘এইটা মুশকিল ব্যাপার।’
‘ক্যান! মুশকিলের কী আছে!’
‘রাগে ওর ওপর থেকে আমার মন উঠে গেছে সেই কবেই। কতদিন হয় ওর দিকে সেভাবে তাকাই-ই না, ওর বিষয়ে মাথা ঘামাই না।’
‘তাতে কী। আগের কথা মনে করেন।’
‘উমম⸺’ মনে করার চেষ্টা করেন আপনি, ‘তেলাপোকা⸺হ্যাঁ, তেলাপোকা সে ভয় পায়। আর টিকটিকি সে চরম ঘৃণা করে।’
‘স্যার⸺’ রিকশাওয়ালাকে হতাশ দেখায়, ‘তেলাপোকার ভয় দিয়া কী করব আমি! হাজার হাজার তেলাপোকা ছাইড়া দিয়া ভয় দেখাইয়া মারব? সম্ভব?’
‘তুমি যেমন জানতে চাইলে তেমনই তো বললাম।’
‘দুর্বলতা বা ভয় বলতে সেইসব যা কাজে লাগায়া আমরা ম্যাডামরে মারতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা যেন দুর্ঘটনা মনে হয়। এমনি এমনি মাইরা ফেললে তো আমি আপনি ফাঁইসা যাব!’
‘পরিষ্কার করে বলবা না আগে! তার মানে বলতে চাইছ, আমরা এমন কিছু করব যেন সেটা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যায়।’
‘জি স্যার। বলতে পারেন, এইটা সবচেয়ে সহজ উপায়। এইটাই আমার প্ল্যান। এখন শুধু বাহির করা লাগব যে, ম্যাডামের কোন দুর্বলতা দিয়া তারে ঘায়েল করতে পারি। ব্যাপারটা এমন হবে যে, ম্যাডাম নিজেও বুঝতে পারব না তার দুর্ঘটনা আগে থেকেই প্ল্যান করা।’
‘গ্রেট। এই এতক্ষণ পরে এসে তুমি একটা কাজের কথা বলেছ। এর আগ পর্যন্ত একবারও মনে হয়নি যে তোমার মাথায় আসলেই কিছু আছে।’
অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না, তবে মনে হলো রিকশাওয়ালা মুচকি হাসল।
‘তাইলে এখন ঝেড়ে কাশেন।’
‘আচ্ছা, তোমার ম্যাডাম কিন্তু সাইকেল চালায়। প্রায়ই বাসার সামনের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়ে।’ বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন আপনি, ‘একটা ট্রাক ভাড়া করলে কেমন হয়? সাইকেল চালানোর সময় পেছন থেকে চাপা দিবে। মামলা শেষ!’
রিকশাওয়ালা রেগে যায়, ‘আপনার এই বেকুব মার্কা মাথাটা খাটায়েন না তো! এখানে বুদ্ধি দেয়ার কাজটা আমার, আপনে আজাইরা বুদ্ধি দিয়া প্যাঁচ লাগায়েন না!’
আপনিও রেগে উঠতে চেয়েছিলেন, সুযোগ পেলেন না রিকশাওয়ালা কথা চালিয়ে যাওয়ায়।
‘আমাগো এই প্ল্যানে তৃতীয় কোনো পক্ষরে জড়ানো যাইব না। সাক্ষী-সবুত রাইখা বিপদ ঘাড়ে নিয়া ঘুরব নাকি!’
চুপসে যেতে হলো আপনাকে। রিকশাওয়ালার কথার যুক্তিতে গলে গেলেন।
‘আচ্ছা, রেগো না, সরি।’
রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ ভাব ধরে থাকে। তারপর কিছুটা হতাশার সুরে বলে, ‘ম্যাডাম যেহেতু সাইকেল চালাইতে পারে, তাইলে নিশ্চয় সাঁতারও জানে। সাঁতারটা না জানলে খাপে খাপ মিল্ল্যা যাওয়ার মতো একটা আইডিয়া ছিল।’
‘তোমারে কে বলেছে যে, কেউ সাইকেল চালাতে জানলে সাঁতারও জানবে!’
‘ম্যাডাম সাঁতার জানে না?’
‘না।’
‘ঠিক কইরা বলেন স্যার, একটু আগে কিন্তু ম্যাডাম সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলতে পারতেছিলেন না!’
‘কিন্তু এইটা একদম নিশ্চিত। সে সাঁতার জানে না। বিয়ের পর পরই আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সে পানিতে পা-ই দেয়নি, সাঁতার জানে না এই ভয়ে!’
‘আহরে! এক্কেবারে খাপে খাপ, মুন্তাজের বাপ!’
উচ্ছ্বাসে দুজন হাই ফাইভ দিলেন।
কৌতূহলী হয়ে আপনি জানতে চাইলেন, ‘এই মুন্তাজের বাপটা কে?’
খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকে রিকশাওয়ালা বলল, ‘কইতে পারি না!’
‘আচ্ছা, বাদ দাও। এখন বলো কীভাবে কী করবা? তাড়াতাড়ি বলো।’
‘কাজ একদম সহজ। আপনে ম্যাডামরে রাজি করাইয়া নৌকাভ্রমণে নিয়া যাবেন। নৌকার ব্যবস্থা আমার হাতে ছাইড়া দেন। ওই নৌকার মাঝিও আমি থাকমু। ওই যে কইছিলাম, তৃতীয় কেউ জানব না এই জন্য⸺’
‘তুমি নৌকা চালাতে পারো?’
‘পিলেন ছাড়া সব চালাইতে পারি।’
‘জাহাজ, ট্রেন, ট্রাক⸺সব!’
‘হুদা প্যাঁচাল রাখেন। কাজের কথা শুনেন…’
‘আচ্ছা, বলো, বলো…’
‘আপনি, ম্যাডাম আর আমি⸺নৌকাভ্রমণ⸺মাঝনদীতে নৌকা⸺নৌকা দুলে উঠবে⸺তাল সামলাইতে না পাইরা আপনেরা দুইজন পইড়া যাবেন নদীতে⸺মাঝনদীর পাগলা ঢেউ⸺চিৎকার-চেঁচামেচি⸺আপনি চিল্লাইবেন⸺ম্যাডাম চিল্লাইব⸺আমিও চিল্লামু⸺বাঁচাও বাঁচাও⸺ম্যাডামের দিকে বৈঠা বাড়াইয়া উদ্ধারের ভান করুম, কিন্তু ম্যাডাম নাগাল পাইব না⸺ম্যাডাম ডুইবা গেলেই আমি আপনারে টাইনা নৌকায় তুলব। ব্যাস! খেল খতম! সবাই ভাবব, সাঁতার না-জানা মানুষ, আতঙ্কে হাত-পা ছড়াইয়া ডুইবা গ্যাছে! আর আমিও একলা মানুষ, দুইজনরে একলগে উদ্ধার করতে পারি নাই। তবে, আপনারে কইলাম সেই লেভেলের আহাজারির অ্যাক্টিং করা লাগব কিন্তু…’
‘থামো মিয়া, থামো। একদম ফালতু একটা আইডিয়া⸺’
‘ক্যান! কী সমস্যা?’
‘আরে মিয়া, তুমি কী আমারেই মারতে চাও? মতলব কী তোমার?’
‘খুইলা কন, সমস্যা কোন জায়গায়?’
‘আরে, আমি নিজেও সাঁতার জানি না!’
‘এই স্যার, এই! জীবনে আপনে শিখছেন কী? সামান্য সাঁতার শিখতে পারেন নাই? আমরা তো মায়ের প্যাট থেইকাই সাঁতার শিখা আসছি!’
‘এত বাড়ায়-চাড়ায় কথা কইও না। সমাধান কও।’
‘আপনে কি কিছুক্ষণ ভাইসা থাকতেও পারবেন না?’ রিকশাওয়ালার কাতর কণ্ঠ, ‘ম্যাডাম ডুইবা যাওয়া পর্যন্ত ভাইসা থাকতে পারলেই হবে। বাকিটা আমার ওপর ছাইড়া দিবেন নিশ্চিন্তে।’
‘না, সেটাও সম্ভব না।’
‘ক্যান! এইটুকু কষ্ট করতে, ঝুঁকি নিতে না পারলে হইবো! ভালো কিছু পাইতে কিছু তো ছাড় দেয়া লাগে!’
‘আরে মিয়া, তুমি বুঝতে পারছ না। তোমার ম্যাডামের ওজন ৫৭ কেজি আর আমার ৯৫! হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোমার ম্যাডাম যতক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে ততক্ষণে আমি ডুবে শেষ!’
‘ইস! খাওন-দাওনের সময় যদি একটু হুঁশ রাখতেন ম্যাডামের মতো, তাইলে আজ আপনের ফুর্তির দিন হইত!’
একটু চিন্তা করে রিকশাওয়ালা বলল, ‘যাই হোক, বুদ্ধি থাকলে চিন্তার কিছু নাই। আপনে কাইল থেইকা একদিকে জিমে ভর্তি হবেন, আরেকদিকে সাঁতার শিক্ষার কোচিংয়ে। মাসখানেক কষ্ট কইরা ওজন কমান আর সাঁতারডা শিখেন⸺সাঁতার শেখা খুব কঠিন কিছু না⸺মাসখানেক পর আমরা নৌকাভ্রমণে যাব, কোনো অসুবিধা নাই।’
‘কেন? নৌকা-পানি এইসব ছাড়া কোনো উপায় নাই?’
‘আছে। কিন্তু এইরকম আর কোনো দুর্বলতা ম্যাডামের আছে কিনা সেইটা মনে করেন।’
‘না, মনে পড়ে না।’
‘তাহলে ক্যামনে কী হইবো?’
‘পাহাড়ে নিয়ে গেলে হয় না? পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে⸺’
‘হয়, সেটাও হয়। দশ-বিশতলার ছাদ থেকেও একই কাজ করতে পারবেন। কিন্তু নদীর মাঝখানে নির্জনতা আর লোকচক্ষুর যতটা আড়াল পাওয়া যাইব সেখানে এইগুলাতে ততটা পাইবেন না। মানে পাহাড় বা ছাদ থেইকা ফেইলা দিলে যত প্রশ্ন উঠব, যতটা সন্দেহ থাকব, নদীর পানিতে ডুইবা মরলে তত প্রশ্ন উঠব না, সন্দেহও তেমন থাকব না। সুতরাং, এর চেয়ে সহজ ও ভালো বুদ্ধি আর নাই। দেরি না কইরা জিম আর সাঁতার শিখতে লাইগা পড়েন। একমাস পর এইখানে এই সময়ে আবার দেখা করেন।’
অন্ধকারে চোখের পলকে রিকশাওয়ালা মিলিয়ে গেল। রাত হয়ে গেছে অনেক। ফোনও বন্ধ। বাসার দিকে দ্রুত রওনা হলেন আপনি।
এত রাতে বাইরে গিয়ে আবার আরও কিছুটা রাত করে চেহারায় একটা কেমন কেমন ভাব নিয়ে ফিরে আসার পর আপনার স্ত্রীর চোখে-মুখে যে রকম সন্দেহের অভিব্যক্তি থাকার কথা সে রকম না থাকাটা আপনার কাছে সন্দেহজনক মনে হলো। আপনি যে আপনার স্ত্রীকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছেন আপনার চোখে-মুখে তার ছায়া পড়ে আছে কিনা এবং আপনার স্ত্রী তা বুঝে ফেলছে কিনা তা নিয়ে আপনি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। চোরের মন পুলিশ পুলিশ করলে যেমন হয় আর-কী! এর চেয়ে যদি আপনি ঘরে ঢুকতেই আপনার স্ত্রী হুংকার দিয়ে উঠত, ‘আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হইছে তোর! এত রাতে পিরিত করতে গেছিলি!’ তারপর কথা কাটাকাটি, ঝগড়া ও হট্টগোলের মাঝে দুই-তিনটা গ্লাস বা প্লেট শহীদ হতো, তবু হয়তো আপনার অস্বস্তির বোধটা থাকত না! ব্যতিক্রম হওয়ায় রাতভর আপনার ভেতরে অস্বস্তি কাজ করতে থাকল আর একটু চোখটা বুজে আসতে নিলেই মনে হতে লাগল যে, আপনার স্ত্রী রান্নাঘর থেকে মাংস কাটার চাপাতিটা হাতে নিয়ে আপনার গলার কাছে পোজ দিয়ে ধরে হুংকার দিয়ে উঠছে, ‘কীসের ফন্দি আঁটছিস তুই আমাকে নিয়ে! বাইড়া গেছস! খুব বেশি বাইড়া গেছস! এক পোচে তোর গলার রগ কেটে হাতে ধরায় দিব!’ তারপর ধড়ফড় করে উঠছেন আপনি। পানি খাচ্ছেন, টয়লেটে যাচ্ছেন, ঘুমাতে আর পারছেন না!
সকালে নাস্তার টেবিলে অবশ্য আপনার প্রত্যাশা পূরণ হলো। ব্রেড টোস্টে বাটার মাখাতে মাখাতে সন্দেহের দৃষ্টিতে আপনার স্ত্রী জানতে চাইল, ‘গতকাল অত রাতে কই গেছিলা?’
প্রথমে খেই হারিয়ে ফেললেন আপনি, থতমত খেয়ে গেলে যেমন হয় আর-কী। কারণ, এমন প্রশ্নের মুখে পড়লে কী উত্তর দেবেন রাতে ফেরার সময় তা ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু রাত পেরিয়ে সকালে এসে এই প্রশ্নের সম্মুখীন আপনাকে হতে হবে সে বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা ছিল না। আপনার ধারণা ছিল, এ প্রসঙ্গ আপনার স্ত্রী আর তুলবে না! সারারাত প্রায় নির্ঘুম থাকার পর তাই আচমকা এই প্রশ্নে আপনি সরাসরি উত্তর দিতে পারেন না। তোতলাতে থাকেন আর অন্ধকারে হাতড়ে খোঁজার মতো করে উত্তর খুঁজতে থাকেন। অবশেষে রাতে ফেরার সময় প্রস্তুত করে রাখা উত্তরটা মনে পড়লে বলেন, ‘ওই একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম। অনেকদিন তেমন হাঁটা-টাটা হয় না তো! জানোই তো, আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল।’
সন্দেহের দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই আপনার স্ত্রী বলল, ‘হঠাৎ হাঁটাহাটির উদ্দেশ্য কী?’
এই উদ্দেশ্য শব্দটা আপনার কানে মতলব হিসেবে বাজল এবং শব্দটা শুনতেই আপনার বুক ধক করে উঠল। আপনি আমতা আমতা করেই বললেন, ‘উদ্দেশ্য আর কী, দেখছ না, কেমন হাতির মতো ফুলে যাচ্ছি! তাই একটু হেলথ কনসাস হতে চাইছি!’
‘হুহ⸺’ আপনার স্ত্রী তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘যতসব ভণ্ডামি!’
অন্য সময় হলে এখন আপনার সামনে থাকা নাস্তার প্লেটটাকে তার জীবন বিলিয়ে দিতে হতো। কিন্তু আজ তার হায়াত আছে। আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে আজ আর লাগতে চাইলেন না। আপাতত কিছুদিন লাগবেনও না। যাওয়ার আগে রিকশাওয়ালা বলে গেছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আপাতত স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না। সম্পর্ক স্বাভাবিক না থাকলে সে আর আপনার সাথে নৌকাভ্রমণে যেতে রাজি হবে না, বা রাজি করাতে আপনাকে আবার অন্য কোনো ফন্দি আঁটতে হবে। জিম আর সাঁতারের পাশাপাশি স্ত্রীর সাথে কোমল সম্পর্ক বজায় রাখাও এখন আপনার একটা মিশন।
আপনার জবাব না পেয়ে যেন আপনার স্ত্রীর সন্দেহ আরও বাড়ল। কিন্তু আপনি নাস্তা সেরে দ্রুতই বেরিয়ে পড়লেন। আপনার স্ত্রী আর কোনো কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না।
জিম ও সাঁতারের মিশন অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলেন না আপনি। প্রথম দুইদিন আসলে ভেবে ভেবেই কাটালেন, আসলেই আপনি ঠিক করছেন কিনা। রিকোওয়ালা আপনার জন্যই আবার কোনো ফাঁদ পাতছে কিনা, সে বিষয়ে মনটা খচখচ করছে। তৃতীয় দিনে গিয়ে আপনার খচখচানি দূর হলো, রিকশাওয়ালার সঙ্গে আপনার তো কোনো শত্রুতা নেই যে সে আপনার ক্ষতি করবে! মন থেকেও সাড়া এল, একবার দেখা যাক না চেষ্টা করে, ভালো কিছুও তো হতে পারে। তৃতীয় দিনে গিয়ে আপনি জিম আর সুইমিং পুলের খোঁজ করতে শুরু করলেন।
আপনার ভেতরে একটা দুঃখবোধ চাড়া দিয়ে উঠল। এতদিন ধরে শরীরে জমানো দামি চর্বিগুলো এভাবে ঝেড়ে ফেলতে হবে! শরীরের এই চর্বির পেছনে আপনার অনেক ইনভেস্টমেন্ট। ভাজাপোড়াসহ দামি বিরিয়ানি, ফাস্টফুডের বিনিময়েই এই চর্বির গুদাম হয়েছে আপনার শরীরে। সব ইনভেস্টমেন্ট বিফলে যাচ্ছে। আবার এত টাকা ইনভেস্ট করে জমানো চর্বি ঝরাতেও আপনাকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। লোকসানের এই হিসাব ভেবে প্রথমদিন জিমে গিয়েই ফিরে এলেন আপনি। এমনকি দ্বিতীয় দিনেও! এরপর লাভের একটা অঙ্ক মনে পড়ায় আপনার ভেতরে উদ্যম ফিরে আসে। কিছু চর্বি ঝরানোর বিনিময়ে যদি বউরে জীবন থেকে সরানো যায় তাহলে তো লাভ আর লাভ!
প্রতিদিন অফিস সেরে আপনি জিমে যাচ্ছেন, এরপর সুইমিংপুলে। জিম ট্রেইনারের নির্দেশনা অনুযায়ী কসরত করে যাচ্ছেন। সেখানে তেমন কোনো অসুবিধা নেই, তবে হাঁপিয়ে ওঠেন দ্রুতই। ট্রেইনার আপনাকে তেমন ঘাটায় না। সমস্যায় পড়েন সুইমিংপুলে। সুইমিং ট্রেইনারের নির্দেশনা অনুযায়ী সাঁতারের চেষ্টা করতে গেলে পানিতে হাত-পা নাড়িয়ে তিড়িংবিড়িং শুরু করেন, হাবুডুবু খেতে থাকেন। পানির ভেতরে ওলট-পালট খেয়ে আপনার অবস্থা প্রায়ই মরো মরো হয়ে যায়। পানির নিচ থেকে আপনাকে টেনে তুলে আনতে হয় আপনার ট্রেইনারকে। এরপর তিনি বেশ রেগে যান আপনার ওপর। এভাবে আপনাকে বেশ বিব্রতকর দিন পার করে যেতে হচ্ছে।
খুব দ্রুতই যেন মাসটা পেরিয়ে গেল। অগ্রগতি হলো না তেমন। ওজন কমল মাত্র দুই কেজি। আর সাঁতার শেখা তো দূর, রিং টিউব ছাড়া ত্রিশ সেকেন্ডও আপনি ভেসে থাকতে পারেন না। অথচ শুরু করার আগে আপনার বিশ্বাস ছিল, ওজন কমাতে পারেন আর না পারেন, সাঁতারটা অন্তত শিখে ফেলবেন। কিন্তু বাস্তবে আপনার বিশ্বাস ধাক্কা খেয়ে গেল। সুইমিংপুল থেকে কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বাসায় ফিরছেন প্রতিদিন। বাসায় একজোড়া সন্দেহের দৃষ্টি আপনাকে যেন পর্যবেক্ষণে রেখেছে, সাথে তাচ্ছিল্য এবং তা হজম করে যাওয়া⸺নিজের প্রতি আপনি নিজেই হতাশ বোধ করেন।
হিসাবমতে, আজ রাত এগারোটায় আপনার খালপাড়ে যাওয়ার কথা। এই একমাসে রিকশাওয়ালা দেখা করার কথা মনে রেখেছে কিনা তা নিয়ে আপনার সন্দেহ জাগল। সন্দেহ অবশ্য বেশিক্ষণ থাকল না। কারণ, আপনার ধারণা, এ বিষয়ে আপনার নিজের যত না আগ্রহ, রিকশাওয়ালার তার চেয়ে বেশিই আগ্রহ। কেন, কে জানে! বিনিময়ে কোনো কিছু চায় কিনা, সে বিষয়ে কিছুই বলেনি সে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার বলে ভেবে রাখলেন আপনি।
কিছুটা সংশয় নিয়ে খালপাড়ে এসে দেখেন রিকশাওয়ালা আগে থেকেই সেখানে এসে বসে আছে। আপনাকে দেখে মুচকি হাসল, চাপা স্বরে বলল, ‘আসছেন স্যার?’
আপনিও মুচকি হাসলেন, ‘কী খবর তোমার?’
‘আমাগো আর খবর, স্যার!’
‘মন খারাপ?’
‘না স্যার, আমাগো আর মন-টন কীয়ের?’
‘এত উদাসীন কথাবার্তা বলছ, ঘটনা কী কও তো।’
‘কোনো ঘটনা নাই স্যার, সব ঠিক আছে। আপনে কন, কদ্দূর কী করলেন?’
আপনি কোনো জবাব দেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। রিকশাওয়ালা আপনাকে পর্যবেক্ষণ করে, ‘ওজন তো মনে হয় কমে নাই আপনের। বাড়ান নাই তো আবার!’
‘নাহ। দুই কেজি কমেছে।’
‘তা যাই কমুক, সাঁতারডা তো শিখে ফেলছেন, নাকি?’
আপনি আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, ‘নাহ!’
‘কী কন! একমাসেও আপনে সাঁতারডা শিখতে পারেন নাই!’
আপনি চুপ।
‘কার কাছে গেছেন আপনে সাঁতার শিখতে? আমি শিখাইলে তো দুইদিন লাগব না, সাঁতার দিয়া নদীর এপার-ওপার করতে পারবেন!’
আপনার গা জ্বলে। কিন্তু চুপ করে থাকেন।
‘আচ্ছা, সাঁতার না শিখলেও কিছুক্ষণ ভাইসা থাকতে পারবেন তো?’
‘কতক্ষণ?’
‘এই ধরেন, তিন-চাইর মিনিট…’
‘নাহ!’
‘এইডাও পারবেন না? কী কন!’
‘ত্রিশ সেকেন্ড ভেসে থাকতেই জীবন যায় যায় অবস্থা হয় আমার!’
‘নাহ! আপনে যার কাছে সাঁতার শিখতে গেছেন, সেই ব্যাডা নিজেও মনে হয় সাঁতার জানে না! আপনারে বোকা পাইয়া পকেট কাটছে!’
‘না জেনে ফালতু কথা বলো কেন?’ ধমকে ওঠেন আপনি, ‘শহরের বেস্ট সুইমিংপুলে বেস্ট ট্রেইনারের কাছে গিয়েছি আমি। শিখতে পারি নাই, এইটা আমার ব্যর্থতা।’
‘আইচ্ছা, বুঝলাম স্যার। কিন্তু কোনোমতে তিন-চাইর মিনিটও যদি ভাইসা থাকতে পারেন তাহলেই কাজ হয়ে যায়। তা না হলে তো⸺’
‘তুমি প্ল্যান-বি রেডি করো। নৌকা এমনভাবে দুলাইবা যেন শুধু তোমার ম্যাডাম পানিতে পড়ে। আমি পানিতে নামতে পারব না।’
‘তাতে সন্দেহ থাইকা যাইব। রিস্ক রাইখা কাজ করা যাইব না।’
‘তাহলে পানি বাদে অন্য কোনো প্ল্যান করো।’
‘ওইদিন না আমরা হিসাব কইরা দেখলাম, এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় নাই। আপনে সাঁতারডা না শিখতে পারেন, অন্তত তিন-চাইর মিনিট ভাইসা থাকা শিখেন।’
‘তুমি কীভাবে নিশ্চিত যে, তিন-চার মিনিটই যথেষ্ট? এর বেশি লাগলে?’
‘দ্যাখেন স্যার, আপনি ভাইসা থাকবেন এইটা জেনে যে, ম্যাডাম ডুইবা গেলেই আপনাকে আমি তুইলা আনব। আপনে থাকবেন প্রস্তুত আর নিশ্চিন্ত। কিন্তু ম্যাডাম তো মোটেও প্রস্তুত থাকব না, পানিতে পড়েই সে আতঙ্কে ছটফট শুরু করবে, হাত-পা এদিক-সেদিক নাড়াইয়া দিশা হারায় ফেলবে। সাঁতার না-জানা মানুষ হঠাৎ পানিতে পইড়া গেলে ভয়ে আর আতঙ্কেই অর্ধেক ডুইবা যায়। সেক্ষেত্রে দুই মিনিটও লাগবো না ম্যাডামের ডুইবা যাইতে।’
‘তারপরও যদি সে কোনোভাবে সারভাইব করে ফেলে! যাই বলো, একটা প্ল্যান-বি থাকা লাগবেই।’
‘কোনো বি-সি-ডি লাগব না স্যার। ভরসা রাখেন।’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল আপনার, ‘আচ্ছা, আমাকে একটা কথা কও তো।’
‘কী স্যার?’
‘আমি আমার বউরে পানিতে ডুবিয়ে মারলে তোমার লাভ কী?’
‘এইডা কী কন স্যার? আমার আবার লাভ-ক্ষতি কীয়ের?’
‘তাহলে কেন তুমি চাইছ আমি আমার বউরে পানিতে ডুবিয়ে মারি?’
‘আমি আবার কখন চাইলাম? চাইছিলেন তো আপনে?’
‘কথা ঘুরিয়ো না। তুমিই বলেছিলে আমার বউকে মারা উচিত।’
‘সেইটা তো আমি বলছিলাম, আপনে নিজে আত্মহত্যা করতে চাইছিলেন বউয়ের জ্বালায়, তাই।’
‘আমি তো সেটাই বলছি, আমার বউকে মারার ব্যাপারে তোমার এত উৎসাহ কেন?’
‘আপনে বারবার ভুল করতাছেন স্যার, আমি আপনারে শুধু বুদ্ধি দিয়া হেল্প করতে চাইতাছি, আর কিছু না।’
‘কেন তুমি বুদ্ধি দিচ্ছ? এটাই তো জানতে চাইছি।’
‘আপনের সাথে কথা বইলা মনে হইছিল, আপনে সাদা-সিধা মানুষ, বুদ্ধিশুদ্ধি কম, বউয়ের জ্বালায় নিজে মরতে চাইছিলেন, এইজন্য আপনারে বাঁচাইতে, আপনের ভালো করতে বুদ্ধি দিতে আসছিলাম। এখন আপনের যদি মন না চায় বা আমারে আর ভালো না লাগে, তাহলে বলেন, চইলা যাই…’
‘ব্যাপারটা চলে যাওয়া বা থাকার নারে পাগলা! ধরো, তুমি যেমন প্ল্যান সাজিয়েছ সেভাইে সব ঠিকঠাক হলো, আমার বউ পানিতে ডুবে মরল, এর বিনিময়ে আমার কাছে তুমি কী চাও?’
‘আমি কিচ্ছু চাই না স্যার। খুশি হইয়া আপনের যা খুশি দিয়েন।’
‘যদি কিছু না দিই?’
‘না দিলে না দিবেন, আমি তো কিছু দাবি করি নাই!’
এই হিসাবটাই আপনি মেলাতে পারলেন না। কোনো কিছু চাওয়া নাই, দাবি নাই, তারপরও কেন সে আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছে? কেন আপনার জন্য কাজ করছে? তারপরও আপনি আর তাকে ঘাটাতে চাইলেন না। এতদূর আসার পর ফিরে যাওয়া বা তাকে ফিরিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হলো না আপনার।
রিকশাওয়ালা তাগাদা দিল, ‘স্যার, রাইত বাড়তাছে⸺’
‘কী করা যায় এখন, বলো?’
‘আপনেই বলেন স্যার, কী করতে চান?’
‘অন্য কোনো উপায় কী বের করা যায় না?’
‘কেন যাইব না, অনেক উপায়ই তো বাহির করা যায়। কিন্তু একটা প্ল্যান কইরা এতদিন খরচ কইরা আবার নতুন কইরা শুরু করবেন? নতুনটাও যদি কয়দিন পর আর ভালো না লাগে, এভাবে দিনের পর দিন যাইতেই থাকব। তার চেয়ে এই একটাতেই থাকেন। আর কয়টা দিন সময় নেন, পানিতে কিছুক্ষণ ভাইসা থাকাটা শিখেন শুধু।’
‘আচ্ছা, তা নাহয় চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারপরও বিকল্প একটা ভাবো। ধরো, আমি যতটুকু সময় ভেসে থাকতে পারলাম, তোমার ম্যাডাম তার চেয়ে বেশি সময় পর ডুবল, অন্তত এইটা মাথায় রেখে একটা বিকল্প কিছু রাখো। তা নাহলে দেখা যাবে আতঙ্কে তোমার ম্যাডামের আগে আমিই⸺’
‘অত চিন্তা কইরেন না তো ঘোড়ার ডিম! আইচ্ছা, দাঁড়ান⸺’
আপনি দাঁড়িয়ে পড়তেই রিকশাওয়ালা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আরে, আপনারে দাঁড়াতে বলি নাই তো!’
আপনি লজ্জা পেয়ে গেলেন।
রিকশাওয়ালা একটু ভেবে বলল, ‘আইচ্ছা, ধরেন ভাইসা থাকতে গিয়া আপনের দম ফুরায় গেল। আপনে আর ভাইসা থাকতে পারতাছেন না, ডুইবা যাবেন এমন ভাব, ওই সময় আপনে একটা কোড উচ্চারণ করবেন⸺ধরেন, আমরা একটা কোড ঠিক করলাম, “আল্লাগো!” ⸺আপনে “আল্লাগো!” বইলা উঠলেই আপনারে আমি পানি থেইকা নৌকায় টাইনা তুলব। আপনারে টাইনা তুলতে যে সময় লাগব ওই সময়ে নিশ্চিতভাবেই ম্যাডাম ডুইবা যাইব। আর পরে যদি প্রশ্ন ওঠে আমি আপনারে তুলতে পারলাম, ম্যাডামরে কেন পারলাম না, তাইলে আমি বলব যে, আপনে নাগালের ভেতরে ছিলেন আর আপনের যে ওজন এই জন্য আপনারে টাইনা তুলতেই আমার জীবন জেরবার অবস্থা। আর আমি একলা মানুষ, দুইজরে তো একলগে তুলতে পারা সম্ভব না, আপনার ভারী শরীলডা তুলতে গিয়া যে সময় আর শ্রম লাগছে এই ফাঁকে ম্যাডাম ডুইবা গ্যাছে। আমার কিছু করার ছিল না।’
আপনি রিকশাওয়ালার পিঠে একটা কিল দিয়ে বললেন, ‘এই তো, এতক্ষণে তুমি আসল কাজের একটা কথা বললা।’ তারপর নিশ্চয়তা দিলেন, ‘প্ল্যান যেটা আছে, এটাই ঠিক আছে। আমার আর কোনো ভয় নাই, এবার আমি নিশ্চিন্ত।’
‘আরও কয়টা দিন শিখেন তাইলে। সাতদিনে পারবেন? না দশদিন লাগব।’
‘দশদিনই থাকুক।’
‘তাইলে দশদিন পর আবার এইখানে একই সময়ে আসেন। আর এরমধ্যেই ম্যাডামকে নৌকাভ্রমণের জন্য রাজি কইরা দিন-তারিখ এবং কোন নদীর কোন ঘাট থেকে যাবেন তাও ঠিক কইরা আইসেন।’
‘কোন নদীর কোন ঘাট থেকে যাওয়া যায় সে ব্যাপারে তোমার কোনো সাজেশন আছে?’
‘এইটা আপনে ঘাটাঘাটি কইরা ঠিক করেন। শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী কিম্বা পদ্মার আশপাশে বেশ কিছু রিসোর্ট টাইপ ব্যাপার-স্যাপার আছে। এইরকম কোথাও নিয়া যাইতে পারেন। ম্যাডামের পছন্দমতো একটা জায়গা ঠিক কইরেন। আমি নৌকা নিয়া সেইখানে থাকব।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। শেষ বেলায় তার পছন্দ করা জায়গাতেই নিয়ে যাওয়া যায়। ভালো আইডিয়া।’
রিকশাওয়ালা মুচকি হেসে হাঁটা দিল। আপনিও একটা স্বস্তি ও নির্ভরতা নিয়ে ফিরে গেলেন।
ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকতেই আপনার স্ত্রী আপনাকে রিমান্ডে নিল, ‘কই যাও তুমি এত রাতে? মতলব কী?’
বলার ধরনে আপনার মেজাজ গরম হয়ে উঠতে চাইছিল। আপনি তা হতে দিলেন না। মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘ওই যে, হাঁটতে! কেন? বলেছিলাম না যে, কেমন হাতির মতো হয়ে যাচ্ছি, তাই⸺’
‘তো, প্রতিদিন যাও না কেন? এরকম হঠাৎ হঠাৎ কেন?’
‘কে বলল হঠাৎ হঠাৎ! প্রতিদিন অফিস শেষে হাঁটি। হঠাৎ একদিন এরকম রাতে হাঁটি।’
‘তুমি কি মনে করো এসব ভণ্ডামি আমি বুঝি না!’
আপনি চটে যাচ্ছিলেন প্রায়, শেষ মুহূর্তে সামলে নিলেন। আর অল্প কয়টা দিন, এ পর্যায়ে বউকে আর চটানো যাবে না, একটু সামলে নিতে হবে।
‘কী সব বলো আবোল-তাবোল⸺’ আপনি মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘দেখছ না, কত শুকিয়ে গেছি!’
‘কই শুকিয়েছ! আমার কাছে তো আরও মোটা মোটা লাগে!’ আপনার স্ত্রী বেশ রাগ ঝেড়ে বলল।
‘আসলে এত বেড়ে গিয়েছে যে, অল্প খানিক কমানোটা আর নজরে পড়ছে না!’
‘হুঁহ!’ মুখ ঝামটা দিয়ে বলেই আপনার স্ত্রী হনহন করে হেঁটে চলে গেল বেডরুমে।
আপনি একটু ধাতস্ত হতে ড্রয়িংরুমে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। আর মনে মনে ভাবলেন, নাহ, নিজেকে প্রস্তুত হতেই হবে। এর বেশি আর টলারেট করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
‘আল্লাগো’ কোডের ভয়সায় পরদিন থেকে উদ্যম আপনার আরও বেড়ে গেল। জিমে যাওয়া আর না যাওয়া একই ব্যাপার, আপনি তাই জিম বাদ দিলেন। ওই বাড়তি সময়টা সুইমিংপুলে দিলেন। আর এতে দুই দিনেই আপনি মোটামুটি তিন মিনিটের বেশি ভেসে থাকা আয়ত্ত করে ফেললেন। ভেসে থাকা কিছুটা আয়ত্ত হওয়ার পর আপনার মনে হলো এবার সাঁতারটাও দেওয়া সহজ হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু তা হলো না। হাত-পা নাড়িয়ে ভেসে থাকতে পারলেও, যেই আপনি সাঁতারের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে সামনে বাড়তে যান সেই ওলটপালট খেয়ে পানির মধ্যে ডিগবাজি খেয়ে ডুবতে বসেন। এ পর্যায়ে আপনি আর কিছুতেই তাল ফিরিয়ে আনতে পারেন না। তাল সামলে পুনরায় যে আবার স্থির হয়ে ভেসে থাকবেন তা আর পারেন না। আপনার ট্রেইনার কিংবা আশপাশের কাউকে এসে আপনাকে উদ্ধার করতে হয়। শেষ দুইদিন আপনি তাই আর বাড়তি কোনো কসরত করার পণ্ডিতি করলেন না। কেবল স্থির হয়ে ভেসে থাকা আয়ত্ত করে গেলেন এবং যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন যে, বাড়তি কোনো কসরত না করলে একটানা তিন-চার মিনিট ভেসে থাকা আপনার জন্য কোনো ব্যাপার না।
ভেসে থাকা আয়ত্ত করার ফাঁকে প্রতিদিনই আপনি আপনার স্ত্রীকে নৌকাভ্রমণের জন্য পটাতে থাকেন। কিন্তু সে পটতে চায় না। আপনি আবার চেষ্টা করেন। সে রাজি হয় না। শেষে আপনি কিছুটা ইমোশন ঢালেন, ‘দেখো, আমাদের সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেছে। এভাবে এক ছাদের নিচে কি বেঁচে থাকা যায়! আবার যতদিন বাঁচব আমাদের তো এক ছাদের নিচেই বাস করতে হবে। তো, এভাবেই তবে কেন? মাঝে মাঝে তাই একসাথে ভ্রমণে যেতে হয়, তাতে সম্পর্ক রিনিউ হয়। চলো, একসাথে একটা নৌকাভ্রমণে যাই। সম্পর্কটাকে একটু ঝালাই করে আনি।’
আপনার স্ত্রীও কিছুটা নরম হয়, ‘ভ্রমণে তো যাওয়াই যায়। তাই বলে নৌকাভ্রমণেই কেন? তুমি জানো না যে আমি সাঁতার জানি না!’
‘সাঁতার তো আমিও জানি না। তাতে কী? তুমি দেখো না, কত মানুষ নৌকাভ্রমণে যায়, সেন্টমার্টিনে যায়, নদীর ওপর দিয়ে সুন্দরবনে যায়⸺তারা সবাই কি সাঁতার জানে? সাঁতার জানা মানুষই কি কেবল এসব ভ্রমণে যায়? না, সাঁতার না-জানা মানুষই বেশি যায়। এত মানুষ যেতে পারলে আমাদের যেতে সমস্যা কী?’
‘তবুও আমার ভয় করে!’
‘ভয়ের কিছু নেই, সোনা।’ আপনি ভালোবাসায় গদগদ হতে চেষ্টা করেন, ‘আমরা একসাথে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বাসে চড়েছি, ট্রেন, প্লেন, রিকশা, কার⸺সবকিছুতেই চড়েছি। কখনো নৌকাভ্রমণে বা নদীপথে কোথাও যাইনি। একটু পরিবর্তন দরকার না, বলো?’
আপনার স্ত্রী একটু গলতে শুরু করে, ‘এটা তো মন্দ বলোনি!’
এই যে আপনার স্ত্রী একটু গলল, এতেই কাজ হয়ে গেল। আপনাদের নৌকাভ্রমণের দিন-ক্ষণ চূড়ান্ত করা হলো। আর আপনার বুকে শুরু হলো ধুকপুকানি, জীবনের প্রথম ইন্টারভিউতে কিংবা প্রথম চাকরির প্রথম প্রজেক্টের প্রথম প্রেজেন্টেশনে কিংবা জীবনের শেষ বিসিএসের ভাইভায় যেমন হয়, তেমন। কারণ, আপনার জন্য এ ভ্রমণ একদিকে প্রথম, অন্যদিকে চূড়ান্ত পরীক্ষা!
আপনার স্ত্রীর পছন্দে ঢাকার কাছেই ধলেশ্বরী নদীর কিনারে গড়ে ওঠা একটা রিসোর্টে আপনাদের ভ্রমণের স্থান নির্ধারণ করা হলো। সেই রিসোর্টে নদীর কিনারের ফুরফুরে বাতাস ও প্রাকৃতিক সবুজের আবহে আপনারা নিরিবিলি সময় কাটাবেন আর বিকেলের নরম রোদে নৌকায় করে নদীতে ঘুরবেন।
রাত এগারোটায় খালপাড়ে এসে রিকশাওয়ালাকে যখন জানালেন, আপনি মিনিট চারেক ভেসে থাকা আয়ত্ত করে ফেলেছেন এবং আপনার স্ত্রী নৌকাভ্রমণে যেতে রাজি হয়েছে, তখন যে উল্লাস প্রকাশ করল যেন সে যুদ্ধ জয় করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে! এবং আবারও মনে হলো সে-ই যেন আপনার চেয়ে বেশি খুশি। বউ মরবে আপনার, মুক্তি পাবেন আপনি, অথচ রিকশাওয়ালার এত খুশির কারণ কী কে জানে! আপনি অবশ্য তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না আর।
নৌকাভ্রমণের নির্ধারিত স্থান ও দিন জানিয়ে রিকশাওয়ালাকে হুঁশিয়ার করলেন আপনি, ‘দেইখো, সময়মতো ঠিক জায়গায় থেকো কিন্তু। কোনো এদিক-ওদিক যেন না হয়!’
‘আপনের আর কিছু চিন্তা করতে হইবো না, স্যার। বহুত পেরেশানি গেছে আপনার এ কয়দিন, আমি বুঝি এসব। আপনি এখন নিশ্চিন্তে বাকিটা আমার ওপর ছাইড়া দেন।’
আপনি তাই করলেন। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে এলেন।
আজ আর বাড়ি ফেরার পর আপনার স্ত্রী আপনাকে জেরা করল না। বরং ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল, ‘থাক, ওজন কমানোর জন্য এত পরিশ্রমের আর দরকার নাই। কী হবে একটু ওজন বেশি থাকলে!’
আপনি আহ্লাদে স্ত্রীর গাল টিপে দিয়ে একটু হাসেন। কিছু বলেন না। মনে মনে ভাবেন, এই তো, আর দুটো দিন। আসছে শুক্রবারেই তো এসব থেকে মুক্তি মিলছে।
বৃহস্পতিবার রাতে আপনার ঘুম ভালো হলো না। কেমন যেন ছটফটে ভাব হলো আপনার। কেমন যেন অস্বস্তিকর ভাব। শুক্রবার দিনটার শেষ ভাগে আপনার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। কেমন হবে সে অনুভূতি!
সকালে নাস্তার টেবিলে আনমনা ভাব কাটাতে পারছিলেন না আপনি। আপনার স্ত্রীও আপনাকে তেমন ঘাটাল না। রিসোর্টে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করেছেন। নাস্তা শেষ হতেই গাড়ি চলে এলে স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় আপনার অনুভূতি হলো, শেষবারের মতো স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাসার বাইরে বের হচ্ছেন!
রিসোর্টে পৌঁছাতে বেশ সময় লেগে গেল আপনাদের। এই ঢাকা শহরে শুক্রবারেও একটু বেলা হয়ে গেলেই জ্যামের ঝক্কি পোহাতে হয়। এরকম অনেকবার জ্যামে আটকে গিয়ে প্রায় দুপুর হয়ে গেল পৌঁছাতে। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ায় গাড়িতে আপনি ঘুমিয়ে পড়ছিলেন বারবার। আর অস্বস্তিকর কিছু স্বপ্ন ভিড় জমাচ্ছিল আপনার ঘুমের ভেতরে। খানিক পরপরই তাই ধড়ফড় করে জেগে উঠছিলেন আপনি। তারপর কয়েক মুহূর্ত কিছু চিনতে পারছিলেন না, মনে করতে পারছিলেন না⸺কোথায় আপনি আছেন আর কোথায় এখন যাচ্ছেন। কিছুটা ধাতস্থ হলেই আবার ঘুম জড়িয়ে ধরছিল আপনাকে, আবার ধড়ফড় করে উঠছিলেন। বিরক্ত হয়ে মাঝে একবার ভাবছিলেন, বাসায় ফিরে যাবেন কিনা! কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন এই ভেবে, এতদিনের এইসব পরিশ্রমের শেষ পরিণতি আজ দেখে ছাড়বেন!
রিসোর্টে এসে বসার পর অবশ্য আপনার অস্বস্তি অনেকটাই কেটে গেল। পরিবেশটা আসলেই মনোরম। চারদিকে সবুজ আর থইথই পানি। সাথে শীতল বাতাস আর পাখির কিচিরমিচির। আপনার স্ত্রীও বেশ ফুরফুরে বোধ করল। অনেকদিন পর সে আপনার বুকের কাছাকাছি এসে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। আপনার বুকের ভেতরে তাতে জেগে উঠল হাহাকার। এ বন্ধন আজ ছিন্ন হবে, আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই। হাহাকারের ভেতর কিছুটা মায়াও যেন জেগে উঠল আবার। আপনার ভাবনা ওলটপালট খাওয়া শুরু হলো, কিছুটা যেন খেই হারিয়ে ফেলার মতো। আদৌ আপনি ঠিক পথে এগুচ্ছেন কিনা, সে খচখচানি আপনাকে বিদ্ধ করছে। তারপরও আপনার ভেতর থেকেই আপনাকে আবার সাহস ও উদ্দীপনা যোগাচ্ছে যে, ‘এতদূর এসে এ সুযোগ আর ছাড়িস না পাগলা!’
আপনার ভেতরে জেগে ওঠা মায়া-মহব্বতের গলা তাই টিপে দিতে হচ্ছে আপনাকে। আপনার আচরণের অস্বাভাবিকতা আপনার স্ত্রীর নজরে পড়ছে কিনা তা আবার আপনার নজরে পড়ছে না। আপনি এসব নিয়ে ভাবার স্থিরতা পাচ্ছেন না। আপনার স্ত্রী প্রাণোচ্ছল তরুণীর মতো ছুটছে প্রকৃতির ছোঁয়ায়। আপনি অগোছালোভাবে সঙ্গ দিচ্ছেন তাকে। আর এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন, কোথাও রিকশাওয়ালাকে মাঝিরূপে দেখা যাচ্ছে কিনা। তাকে দেখতে না পাওয়াই হয়তো আপনার বাড়তি অস্থিরতার কারণ।
রিসোর্টের প্রতিটা কটেজ একেবারে নদীর পাড় ঘেঁষা। প্রতিটা কটেজের কমন একটা করিডোর এবং তা আবার নদীর সাথে লাগোয়া। এখান থেকেই সরাসরি নদীর ঘাটে নামা যায় এবং সেখানে তিনটি নৌকা ভেড়ানো আছে। প্রতিটাতেই রিসোর্টের নাম লেখা। আপনি চিন্তায় আছেন, এই তিনটি নৌকার কোনো একটাতেই কি রিকশাওয়ালা হাজির হবে, নাকি অন্য কোনো নৌকা নিয়ে দূর দিগন্ত থেকে উদয় হবে।
নদীর পানিতে বেশ ছন্দময় ঢেউ খেলছে। বর্ষার শেষ ভাগের টইটম্বুর নদী। অন্য অনেক নৌকা ও ট্রলার ভেসে যাচ্ছে আপনার চোখের সামনে দিয়ে। এর প্রতিটাতেই আপনার চোখ ঘুরছে, খুঁজছে আপনার কাঙ্ক্ষিত নৌকা। কিন্তু তার দেখা মিলছে না।
দুপুরের খাবার আয়োজন করা হলো। বেশ বাহারি খাবার। কিন্তু সেভাবে উপভোগ করতে পারলেন না। কিন্তু আপনার স্ত্রী বেশ উপভোগ করল। খাবারের শেষ পর্যায়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমরা কখন নৌকায় ঘুরব?’
আপনি কিছুটা অনমনস্ক ছিলেন, তাই চট করে উত্তর দিতে পারলেন না। আপনার স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করতে হলো, তখন আপনি বললেন, ‘বেলা পড়ুক, বিকেলের দিকে আমরা নৌকায় ঘুরব।’
আপনার স্ত্রী ঠোঁট উল্টে আহ্লাদ করে বলল, ‘আমার তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে।’
মনে মনে আপনি ভাবলেন, ‘তর তো আমারও সইছে না। কিন্তু হালার পুত রিকশাওলায়াটা কই? শেষপর্যন্ত কি সে মজা নিল আমার সাথে?’
দুপুরে খাওয়ার পর আবার নদীর পাড়ের করিডোরে গিয়ে বসলেন আপনারা দুজন। ফুরফুরে বাতাসটাতে শরীরে বেশ আরাম লাগছে। ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা নৌকা তিনটার দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন একটাতে বসে আছে আপনার সেই রিকশাওয়ালা। আপনাকে দেখলেও এমন ভাব করল যেন সে চেনেই না আপনাকে। ঠিক সেভাবে তাকালও না আপনার দিকে। নৌকার এক মাথায় বসে থাকল উদাস-নির্বিকার ভঙ্গিতে।
আপনার জানে কিছুটা পানি ফিরে এল। বুক ধরফড়ও শুরু হলো আবার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব কিছু প্রায় প্রস্তুত এখন। আগের চেয়ে নার্ভাসনেস যেন বাড়ল। আপনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন।
স্ত্রীর ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘একটু আগেভাগেই বের হতে চাও নাকি নৌকায় ঘুরতে?’
‘হুম, নিশ্চয়ই। আমি তো থ্রিল ফিল করছি জীবনে প্রথম এরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স নেওয়ার জন্য।’ আপনার স্ত্রী বেশ উচ্ছ্বসিত। তাতে আপনারও স্বস্তি জাগে।
করিডোরে আর অল্প কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ালেন আপনি, ‘চলো তাহলে, ঘুরে আসি।’
‘হুম, চলো।’ আপনার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল আপনার স্ত্রী।
আপনি এগিয়ে গেলেন রিকশাওয়ালা বসে থাকা নৌকার দিকে। আপনার সাথে তাল মেলাল আপনার স্ত্রী।
‘ওই মিয়া, যাইবা নাকি?’ মাঝিরূপে বসে থাকা রিকশাওয়ালাকে বললেন আপনি, সরাসরি তাকালেন না তার দিকে।
‘কী কন স্যার, যামু না মানে? আপনাগো জন্যই তো বইসা আছি!’ মুচকি মুচকি হাসল মাঝি।
‘তাহলে চলো, আমাদের একটু নৌকায় করে নদীতে ঘুরিয়ে আনো।’
বলতে বলতে আপনি উঠে পড়লেন নৌকায়। তারপর হাত ধরে টেনে তুললেন আপনার স্ত্রীকে। আপনার স্ত্রী নৌকায় পা দিতেই নৌকা দুলে উঠল। চমকে গিয়ে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল আপনার স্ত্রী। আপনি তাকে জড়িয়ে ধরে তাল সামলালেন। আপনার স্ত্রী হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, ‘দেখেছ! আর একটু হলেই তো পানিতে পড়ে যেতাম! কী হতো তখন?’
আপনি স্ত্রীর গাল টিপে দিয়ে আহ্লাদ করে বললেন, ‘আমি আছি না, পানির তল থেকে তোমাকে উদ্ধার করে আনতাম!’
‘হুঁহ, কী আমার বাহাদুর! নিজেই তো সাঁতার জানো না!’ তারপর দুজনেই ফিক করে হেসে দিলেন। মুখ ফসকে আপনি অবশ্য বলতে নিয়েছিলেন, ‘আরে, গত দেড় মাসের চেষ্টায় আমি পানিতে ভেসে থাকা শিখেছি তো!’ কিন্তু সময়মতো ঢোক গিলে আপনি কথাটাকে পেটের ভেতরে চালান করে দিতে পেরেছিলেন।
নৌকায় উঠে বসার পর মাঝি জানতে চাইল, ‘কতদূর যাইবেন, স্যার?’
‘যেতে থাকো। যতক্ষণ ইচ্ছে করবে ঘুরব। যতদূর ইচ্ছে ততদূর চলে যাব।’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বলো, ঠিক আছে না?’
আপনার স্ত্রী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
নৌকা বয়ে চলছে। রিসোর্টের ঘাট থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। নদীটা খুব বেশি বড় নয়। প্রায় মাঝনদী থেকে দুই পাড়ই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফুরফুরে বাতাস বইছে। চতুর্পাশে অথই জল। আপনার স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ। আর আপনার মনের ভেতর দোল খাচ্ছে এই ভাবনা, আপনারা একসাথে আপনাদের জীবনের শেষ বেলার মুহূর্ত যাপন করছেন। আর অল্পক্ষণ পরেই আপনারা দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়ে যাবেন। আপনাদের শেষ সময়ে কেমন এক গুমোট ভাব বিরাজ করছে বলে মনে হলো আপনার।
মাঝনদী দিয়ে নৌকা চলতে চলতে অনেকটা দূরে চলে এসেছে নৌকা। দুপুর এবং বিকেলের মধ্যবর্তী এ সময়ে খুব নিকটে অন্য কোনো নৌকা বা ট্রলার দেখা যাচ্ছে না নদীতে। দুই পাড়ে দৃষ্টিসীমার ভেতরে কোনো মানুষও দেখা যাচ্ছে না। এরকম সময়ে সেলফি তোলার বাহানায় আপনি আপনার স্ত্রীকে নৌকার একপাশে কিনারে নিয়ে গেলেন। নৌকা হালকা হেলে যেতেই মাঝি তার কেরামতিতে নৌকা আরও দুলিয়ে আপনাদের দুজনকে পানিতে ফেলে দিল।
পানিতে পড়েই দুজন হাউকাউ শুরু করে দিলেন। আপনার চেয়ে আপনার স্ত্রীর হাউকাউ বেশি বাজল। নৌকা থেকে মাঝিরও হাউকাউ শোনা গেল, ‘হায় আল্লা! কী হয়্যা গেল!’
আপনি স্ত্রীর চেয়ে কিছুটা দূরত্বে ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন। মাঝি কৌশলে নৌকাটিকে কিছুটা দূরে রেখেছে। পরিকল্পনামতো সে দূরত্ব বজায় রেখে আপনার স্ত্রীর দিকে বৈঠা এগিয়ে দিয়ে উদ্ধারের ভান করছে। আর আপনার স্ত্রী হাত-পা ছড়িয়ে আর্তনাদ করতে করতে আপনার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘হাতটা বাড়াও প্লিজ, আমাকে ধরো, আমি ডুবে যাচ্ছি!’
আপনি নীরব।
‘কী হলো! ডুবে যাচ্ছি তো আমি! উদ্ধার করো। প্লিজ! হাতটা বাড়াও! আমাকে ধরো!’ হাবুডুবু খেতে খেতে আপনার স্ত্রী একটনা আর্তনাদ করতে থাকে।
আপনি দূরত্ব বজায় রেখে হাত-পা নাড়িয়ে ভেসে থাকার চেষ্টায় আছেন কেবল। নদীতে বেশ ভালোই ঢেউ। তাল সামলানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আপনি বাড়তি কোনো কেরামতি করার চেষ্টা না করে শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সুইমিংপুলে কোনো ঢেউ ছিল না, সেখানেই আপনি একটু কেরামতি করতে গেলেই পানির নিচে হাবুডুবু খেয়ে তাল হারিয়ে ফেলতেন। এখানে একবার তাল হারিয়ে ফেললে ‘আল্লাগো’ বলারও ফুরসত পাবেন না। তাই স্ত্রীর দিকে হাত বাড়ানোর ভান করতেও চাইছেন না আপনি।
আপনার মনে হলো আর একটু হলেই আপনার স্ত্রী ডুবে যাবে। এতক্ষণ হাত-পা নাড়িয়ে আর্তনাদ করতে করতে এরইমধ্যে সে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। সে আর্তনাদ করে সেভাবে আর কথা বলতে পারছে না। শুধু ‘বাঁচাও’, ‘ধরো’, এরকম শব্দ উচ্চারণ করছে কোনোমতে। আপনিও দাঁত-মুখ শক্ত করে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ঠিক যখন মনে হলো আপনার স্ত্রী এইবার ডুবে গেল বলে, তখনই আপনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। যা দেখলেন তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না! কীভাবে সম্ভব এটা! আপনার স্ত্রী ওই অবস্থা থেকে তড়িৎ সাঁতার দিয়ে গিয়ে নিজে নিজেই নৌকায় উঠে পড়ল!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাঝিও ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকল, একবার আপনার দিকে, আরেকবার আপনার স্ত্রীর দিকে। আপনিও ভ্যাবলার মতো একবার মাঝির দিকে, আরেকবার আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন অবিশ্বাসমাখা দৃষ্টিতে! আর আপনার স্ত্রী দুষ্টুমির মুচকি হাসি দিয়ে আপনাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
মাঝি অবিশ্বাস আর আতঙ্ক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘ম্যাডাম! আপনে⸺’
‘কী! অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘না, মানে, হিসাবটা কেমন য্যানো হয়্যা গেল!’
‘কীসের হিসাব?’
‘আপনের তো সাঁতার জানার কথা ছিল না! ক্যামনে কী!’
আপনার স্ত্রী দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ‘আসলে হয়েছে কী, যে সময় ব্যয় করে তোমার স্যার শুধু ভেসে থাকা শিখেছে, সে সময়ে আমি সাঁতারটাই শিখে নিয়েছি!’
আপনি হাত-পা নাড়াতে ভুলে গেলেন। দম ফুরিয়ে এসেছে আপনার। ভুলে গেছেন ‘আল্লাগো’ কোডটাও। মাঝিও কী করবে বুঝতে পারছে না। বৈঠাটা হাতে নিয়ে অবশ হয়ে যাওয়ার মতো স্থির দাঁড়িয়ে সে একবার আপনার দিকে, আরেকবার আপনার স্ত্রী দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। ডুবে যাওয়ার আগে আপনি কিছু বলার আর সুযোগ পেলেন না। তবে আপনার স্ত্রীর কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেলেন আর দেখতে পেলেন আপনার দিকে মেলে রাখা কটাক্ষের দৃষ্টিটা!