
পুজোর আগের এই সময়টাতে আকাশটার দিকে তাকালে, কেমন যেন কান্না পায় বাবলুর। রোদ বৃষ্টি মিলে কেমন যেন একটা লুকোচুরি ভাব। বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষের দিকের দুপুরে, যখন দূরের আসমান চাচা দের পালংখেত কিংবা বোসেদের পুরোনো খিড়কি পেরিয়ে যে পানের বরজ, তার উপর দিয়ে গুড়গুড় ঢাকের শব্দে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসে, তখন পুজোর দিনগুলোর কথা ভেবে ভারি মন খারাপ হয় বাবলুর। বছর দুয়েক আগের এরকম এক দুগ্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিনে ওর বাবা মারা গেছেন হঠাৎ করে। সেই থেকে বাড়িতে মা-ভাই-বোন কে রেখে এসময়টা সে গ্রামে আসে একা, ধান ঝাড়াতে। জমার পুকুরে জাল দেওয়া হলে সে মাছ স্থানীয় আড়তে বেচে টাকা নিয়ে ফেরে। স্টেশনে নেমে মাঠের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইটাচুনা, মান্দারণ, বড় সরসা ডিঙোতে ক্রোশ দুয়েক পথ কখন যে পেরিয়ে যায়, খেয়াল থাকে না বাবলুর। পেটের ভেতর তখন তার যেন কয়েকশ ইঁদুর ‘ওরাম কৈ’ ‘ওরাম কৈ’ করতে থাকে। সকালের খেয়ে বেরোনো পাউরুটি-ঘুগনী ততক্ষণে পুরোটাই হাওয়া হয়ে গেছে। বর্ষা পেরিয়ে এসময়টা সকালের দিকে সূর্যের তাত অত গায়ে লাগে না। খেতের দিক থেকে আসা মেঠো হাওয়া গায়ে মেখে হাঁটতে কষ্ট হয় না বাবলুর। সামনেই বৈকুণ্ঠের মাঠ। বারো বিঘের ক্যানেলের উপরের সাঁকোটা পেরিয়ে বাঁ দিক নেয় ও। এই ক্যানেলের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে গেলে, তালনা পেরিয়ে বেলতলা। এটাই বাবলুদের পূর্বপুরুষের ভিটে। বাবার মুখে শুনেছে, ওর দাদু সওদাগরী আপিসের চাকরি নিয়ে এই গ্রাম থেকে মফস্বলের দিকে চলে গিয়েছিলেন সেই কোনকালে। এখনো দেশের শরিকী জমি-পুকুরের কিছু ভাগ আছে ওদের নামে, সেই দিয়েই এখন ওদের দিন গুজরান হয় এক প্রকার। ক্যানেলের পাশ দিয়ে আসার পথে একটা শ্মশান পড়ে। শ্মশানের পাশে বাবলুদের কিছুটা খেতি জমি আছে। প্রমাণ সাইজের থেকে কিছু ছোট তিলের গাছগুলোয় ফুল এসেছে, পুবের হাওয়ায় দোল খেয়ে হাঁটার পথের মানুষের গায়ে এসে পরে সুড়সুড়ি দেয়। আসার পথে ওদের ভাগচাষি ঝগরু আর তার ছেলে লাখাইকে দল বেঁধে কাজ করতে দেখল বাবলু। লাখাই ওকে দূর থেকে দেখে হাসল, বয়সে সে বাবলুর থেকে কিছুটা ছোটই হবে। এ বছর স্কুল ফাইনাল দেবে বাবলু। আজ বিকেলে ফুটবল মাঠে লাখাইকে নিয়ে নামবে ও। ব্যাটাচ্ছেলে বল নিয়ে ভয়ানক দৌড়ায়, বাবলু ওর সঙ্গে দৌড়ে পেরে ওঠে না।
তেনাইয়ের মোর পেরিয়ে বাঁদা ঘাসের বনটাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল বাবলু। সামনেই বামুন পুকুর, তার পারেই ওদের বাড়ি। মোল্লার ঘাট থেকেই হাঁক পারে বাবলু, ‘সেজ্ ঠাকমা ও সেজ্ ঠাকমা, কোথায় গেলে গো সবাই? ও সুরি পিসি? ও রমা পিসি? আমি বাবলু গো।’
বাবলুর বাবার সেজ কাকার মেয়ে রমা, বাড়ির বেড়ার গেট খুলে এগিয়ে আসেন। পরনে তার আটপৌরে শাড়ি, মাথায় দুদিকে বিনুনী করা। বাবলুকে দেখে এগিয়ে এসে গাল টিপে দেন তিনি। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘কিরে বাবলা, এবারে দেরি করলি যে বড়! আয় ভেতরে আয়।’
ভেতর থেকে অশীতিপর এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসেন, হাতে অষ্টাবক্র লাঠিতে ঠকঠক করে আওয়াজ হয় মাটিতে, চোখে ঝাপসা কাচের চশমা। ‘ক্যা রে? ক্যা এলি? বাবলা?’
বাবলু গিয়ে প্রণাম করে ‘হ্যাঁ ঠাকমা, কেমন আছ গো তুমি?’
‘তা এবারে এতো দেরি করলি কেন বাপ? বারোয়ারী তলায় কাঠামোয় খড় বাঁধা হয়ে গেল তো, এক মেটেও শেষ হয়ে গেল বোধহয়।’
‘ইস্কুলে টেস্ট পরীক্ষা ছিল গো ঠাকমা, এবার তো ফাইনাল দেব গো!’
‘ও তাই বল, আমি ভাবি ভাদ্দরের মাঝ হতে চলল, বাবলাটা এখনো এলুনি, হারুটাকে বললুম খবর দেতে, লক্ষ্মীপুজোয় তালবড়া করেছিলুম, ছেলেটাকে কটা দিতে পারলুমনি, তা বাছা তেঁতে পুড়ে এয়েচিস, মাদুরটা বিছিয়ে নিয়ে বস দিকিনি। ও সুরী, একটু জল বাতাসা নিয়ে আয় না মা।’
ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে আরেক তরুণী বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাবলুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন ‘বাবলা, একটু জিরিয়ে নিয়ে বামুন পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আয় দিকিনি, আমি ভাত বাড়ছি।’
বিকেলের দিকে হাফপ্যান্ট আর গেল বছরের একটা জামা গায়ে দিয়ে, বাবলু বেড়াতে বেরোল। ঝাঁপানতলার মাঠের দিকে যাবে একবার। কচুর লতা মাড়িয়ে, জুলু ঘাসের পথ বেয়ে এগোতে গিয়ে, প্যান্টের সেলাইয়ে একটা টান অনুভব করলো বাবলু। দু পায়ের মাঝের জোরের জায়গাটা আবার সেলাই করতে হবে। সঙ্গে করে আর বেশি জামা-কাপড়ও আনতে পারেনি ও। আনবেইবা কী করে? সর্বসাকুল্যে মোট দুজোড়া জামা-কাপড় ওর। বাবা মারা যাওয়ার পর কাকার অন্নে যৌথ পরিবারে ঠাঁই হয়েছে ওদের। বেঁচে থাকার জন্য নিদারুণ জীবন সংগ্রাম আর খাদ্যকষ্ট এখন ওদের নিত্যসঙ্গী। সংসারে আয় বলতে শুধু কাকা আর ভরসা এই দেশের ধান, আলু আর মাছ বেচার কটা টাকা, তাতেও আবার কতগুলো ভাগ। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় বাবলু, চোখ তার কখন খোলা আকাশের দিকে চলে গেছে। সেনেদের বাড়ির উঠোনের কামিনী গাছটা ভরে গেছে থোকা থোকা ফুলে, একটা মন কেমন করা মিষ্টি গন্ধ আসছে সেখান থেকে। পাশের মিত্তিরদের বাগান থেকে একটা টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। বাবলুর কিশোর মনে ইচ্ছে হয় ওদের বাসাগুলো দেখবার। ও যখন আরেকটু ছোট ছিল, তখন রমা পিসি আর সরলা পিসির সঙ্গে একবার মিত্তিরদের বাগানের বড় জাম গাছটাতে উঠে, টিয়া পাখির বাসায় ছোট ছোট ছানা দেখেছিল। ছানাগুলোর তখনও চোখ ফোটেনি। হঠাৎ কে যেন মাথায় রামগাঁট্টা বসাল, পেছনে অনেক পাখির কচরমচর, আর তলায় সুরী পিসিদের খিলখিলানি হাসি, এর বেশি কিছু আর মনে নেই তার। ঝাপানতলার মাঠের দিকে যাওয়ার পথে ঝগরুদের পাড়া। এই গাঁয়ে প্রায় দুটো আদিবাসীপাড়া বোসেদের দান করা। ঝগরুরা বেসরা, কোল সম্প্রদায়ের লোক। শীতের সময় ধান ঝাড়াতে এলে, বাবলু ওদের টুসু পরব দেখেছে। কেমন আদিবাসী মেয়ে-বউরা লাল পেড়ে শাড়ি জড়িয়ে, খোঁপায় লাল প্যারা ফুল লাগিয়ে, ক্যানেলের ধারে জমা হয়ে গান করে, নাচ করে। নতুন রোদে কালো শরীর এর উপর, নতুন সাদা পোশাকগুলো ঝলমলিয়ে ওঠে। ঝগরুর বাবা ডমরু সর্দার। গাঁয়ের লোকে ওকে এই নামেই ডাকে। খামোকা দড়ির মতন চেহারার বুড়ো লোকটাকে সবাই সর্দার বলে কেন, সেই নিয়ে বাবলুর মনে খুব কৌতূহল জাগে। সর্দার তো সাধারণত ডাকাত দলের মাথাকে বলে, বাবলু তাই জানে, তবে কি ডমরু ডাকাত? নাকি ও এই আদিবাসী বস্তির মাথা? প্রায় নব্বইয়ের কাছে বয়স, কিন্তু এখনও কি শক্ত শরীর লোকটার! লাখাই আর অন্যান্য সাঁওতাল ছেলেরা যখন মাঠে ফুটবল খেলে, ডমরুও তখন মাঠের ধারে বসে থাকে, চোখ লাল করে। লোকটা মনে হয় আফিমের নেশা করে কিংবা ছিলিমে করে গ্যাঁজা খায়। বাবলু শুনেছে এসব করলে লোকের চোখ লাল হয়। চৈত্র মাসে ঝাঁপানতলায় ডমরু চরকে ওঠে, পিঠ পেট ফুটো করে উঁচু মাচার উপর থেকে শূন্যে ঝুলে পড়ে। বাঁদনা পরবের দিনে এই ডমরুকেই সে দেখেছে সাদা ফতুয়া আর খাটো ধুতি পরে, কপালে লাল তিলক কেটে মোরগ লড়াই করাতে। তাকে ঘিরে তখন পুরুষ মহিলা মেশানো একটা দল ঘুরে ঘুরে, মাদল বাজিয়ে নাচ গান করে। বারোয়ারী তলার পুজোতে অনেক আগে পাঁঠা বলি হতো। এই ডমরুই নাকি বলি দিত। বড় বড় পাঁচ ছয় কিলোর পাঁঠা একাই চ্যাংদোলা করে হাড়িকাঠে ঢোকাত, তারপর হাঁসুলীর এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিত। সেসময় নাকি তার চোখ দুটো জ্বলত, বলির রক্ত পাঁচ আঙুলে করে কপালে মাখা, সে যেন সাক্ষাৎ অসুর! এসবই বাবলু ঠাকুমাদের থেকে শুনেছে। ঝগরুদের বাড়িটার গায়ে কী সুন্দর লতাপাতা আঁকা, কী সুন্দর তার রং। দেখে বাবলুর মফস্বলের ওদের বাড়ির কাছে, পোটোপাড়ার কথা মনে পরে। বামুনপুকুরে আজ নাইতে গিয়ে বাবলুর সঙ্গে সেই কচ্ছপটার দেখা হলো। এ ব্যাটা জলের অনেক নিচে থাকে, উপরের দিকে আসে না চট করে। তবে বাবলু দেখেছে ও বামুনপুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন কোমরে গামছা জড়ায়, কচ্ছপটা ঠিক জলের অনেক তলা থেকে উঠে এসে মুখ বের করে। তারপর আস্তে আস্তে পাড়ে উঠে আসে চার পা বেয়ে। কচ্ছপটার এই বামুনপুকুরে অনেক দিনের বাস। এই চত্বরের জমিদার কুণ্ডুরা কোন এক রাসপূর্ণিমার আগে, ওকে এই পুকুরে ছেড়েছিল। এখনও রাসের সময় দেশে এলে, বাবলু দেখতে পায় কুণ্ডুদের কুলপুরোহিত মাথায় পেছনে বিশাল টিকি দুলিয়ে, কপালে লম্বা তিলক এঁকে, বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে আর রাজবাড়ির লোকেরা একটা বিশাল ছাতা মাথায় দিয়ে, পুকুরে চারামাছ আর কচ্ছপ ছাড়ছে। এই পুকুরে বাবলুদের মানে বেলতলার বোসেদের একটা ভাগ আছে। কিন্তু এই পুকুরে মাছ ধরা বারণ। বাবলু কচ্ছপটার জন্য বাড়ি থেকে লুকিয়ে শসা, গাজর নিয়ে আসে। প্রথম প্রথম ও ভয় পেত। এখন কচ্ছপটা ওর বন্ধু হয়ে গেছে, বাবলু শসাগুলো ওর মুখের কাছে ধরে আর কচ্ছপটা মুখ বাড়িয়ে ওর নরম মাড়ির দাঁত দিয়ে সেগুলো চিবোয়। আস্তে আস্তে ওদের বন্ধুত্বের এই সমীকরণ কিন্তু গড়ে উঠেছে, লোকচক্ষুর আড়ালে। ওকে দেখলেই হয়তো আদিবাসী ছেলেরা খোঁচায় তাই ও সবসময় দেখা দেয় না। বাবলু তো ওর বন্ধু এখন। এই পুকুরের হাঁসগুলোকে চৈ চৈ বলে ডাকলেই বাবলুর দিকে চলে আসে সব দল বেঁধে। ডাকটা ও সুরিপিসির থেকে শিখে নিয়েছে। এই পুকুরে দুটো প্রমাণ সাইজের পোষা কাতলা মাছ আছে, নাকে রুপোর নথ পড়ানো। বছরে দু একবার ওদের জালে ধরে, মুখে ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দেয় কুণ্ডুদের জেলে। বাবলু ওদের মাঝে মাঝে দেখতে পায়, গায়ে একরাশ শ্যাওলার মাঝে রুপোলি ঝলক তুলে মাছগুলো যেন ওর মন খারাপের দিনে এসে কথা বলে যায় ওর সঙ্গে। এই পুকুর, এই মাছ, এই কচ্ছপ-হাঁসের দল দেশে আসার অন্যতম আকর্ষণ বাবলুর কাছে। হঠাৎ বাবলুর মনে পরে বারোয়ারী তলার কথা। আসার পথে একবার ঢুঁ মেরেছিল, কানাই কুমোর একমেটে শেষ করে এনেছে প্রায়। খেতের এঁটেল মাটির সঙ্গে ক্যানেল পাড়ের বালি মিশিয়ে, ছাঁচে পুরে রেখেছে। সামনের মজে যাওয়া পুকুর আর তার বুড়ো হয়ে যাওয়া শানবাঁধানো পাড়ের মাথার উপর দিয়ে আঁচল টেনে, সন্ধে নামছে সবে। গৃহস্থের বেড়া বেয়ে উপচে পড়ছে সাদা জবার দল। মনটা একটা অবোধ আনন্দে নেচে ওঠে বাবলুর। এই পথে, মাঠের শেষ প্রান্তে বুড়ো বটগাছটার প্রকাণ্ড শরীরের ডাল পালা পেরিয়ে ধর্মরাজ মন্দির পরে। বটগাছটার শরীর বেয়ে নেমে আসা ছায়ার মতো ঝুড়িগুলো বেয়ে, কয়েকটা কালো শরীর ওকে এদিক পানে আসতে দেখে, ধুপধাপ মাটিতে লাফ মারে। একটা হাফ প্যান্ট পরা ছেলে, আদুর গায়ে সাইকেলে হাফ প্যাডেল করতে করতে, বাবলুর ঠিক পেছনে এসে বেল দেয়। বাবলুর খুব রাগ হয়। বটগাছের লাগোয়া একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের তলায়, একটা গোল মতন পাথরকে সিঁদুর পরিয়ে, লাল সুতো জড়িয়ে রাখা। সামনে অনেকগুলো মাটির ঘোড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। ছোট ঠাকমা বলে, ‘ধম্ম রাজের থানে মানত করলে, রাজার মতন ছেলে হয়।’
ভাদ্র সংক্রান্তিতে ঘোড়া দিয়ে মানত করতে হয়, রাতভোর পুজোর পর ভোরের প্রথম আলোয় যার মানতের ঘোড়ার একটা পা ভাঙা পাওয়া যাবে, ধর্ম ঠাকুর তার ঘরে সাক্ষাৎ সন্তানরূপে বিরাজ করবেন। বাবলুর ভারি হাসি পায়। ধম্মঠাকুর বুঝি ছোট ছেলে! সারা রাত ধরে মাটির ঘোড়াগুলো নিয়ে খেলা করে, একটার পা-ই ভেঙে ফেলে! ঠাকমার মুখে বাবলু শুনেছে, ওর বাবাও নাকি এই থানের দোর ধরা। চড়কের দিনে, এই ধর্মরাজের থানে আলাদা গাজন বসে। ক্যানেলের ওপারে মহানাদ, এখানকার লোকে বলে ‘মানাদে’। সেখানে জাগ্রত মহা শ্মশান থেকে যত অঘোরী তান্ত্রিকরা এসে যোগ দেয় সেই গাঁজনে। এই গাঁয়ের যত দুলে-বাগদী-কিস্কু-ওঁরাও দলে দলে সব যোগ দেয়। হাতে মরার খুলি নিয়ে নৃত্য করে, দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়।
বারোয়ারী তলায় বাবলু যখন এসে পৌঁছাল, তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে। একটা ৪০ ওয়াটের বালব ঝুলছে, কানাই কুমোর সে দিনের কাজ সেরে হাত ধুতে গেছে। অন্ধকারে দা খুড়ো সাক্ষাৎ ভূতের মত, একটা হুঁকো নিয়ে তাতে তামাক সাজছে। খিদে খিদে পাচ্ছিল বাবলুর, রাস্তার উল্টোদিকেই ওদের একটা ধানের পরা আছে। এদিককার জমির ধান এখানেই ঝাড়া হয়। সন্ধ্যেবেলাতে সেখানে খ্যাপাদা তেলেভাজা ভাজে। বাবলু সেখান থেকে দু পয়সার মুড়ি আর খান চারেক গরম গরম বেগুনি নিয়ে খুড়োর পাশটায় গিয়ে বসলো একটা নড়বড়ে বেঞ্চিতে। দা খুঁড়ো বাবলুকে ছোট থেকেই দেখছে। খুঁড়োর মেয়ে সুরী পিসিদের সঙ্গে খেলতে আসত। খুঁড়ো নিজে আগে জমিদার বাড়িতে গোমস্তার কাজ করত, এখন কিছু জমি করেছে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কিষেন দিয়ে চাষ করায়। বাবলুকে দেখে হুঁকোটা মুখ থেকে নামিয়ে খুঁড়ো বলে ওঠে, ‘কীরে বাবলা এত দেরি করলি কেনে? মাঠের ধান ঝাড়া সারা হয় গিল তো!’
একমুঠো মুড়ি মুখে বাবলু জবাব দেয়, ‘ইস্কুলে ছুটি পড়ার পর কয়েকদিনের জন্য মামাবাড়ি গিছলাম গো! তাই দেরি হলো একটু। খুঁড়ো তুমি আছ কেমন? বিলি পিসিরা সব কেমন আছে?’
হুঁকোয় টান দিতে দিতে খুঁড়ো উত্তর দেয়, ‘তা আছে একরকম!’
গ্রামের দিকে সন্ধ্যে নামলে ঝুপ করে আঁধার ঘনিয়ে আসে, আশপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসে। বাবলুর মনে হয় এসময় যদি খুঁড়োর কাছ থেকে একটা গপ্পো পাওয়া যেত, বেশ হতো। খুঁড়ো গপ্পোও ফাঁদে দারুণ। সাহস করে বাবলু বলে ফেলে সে কথা, ‘খুঁড়ো, অনেক বছর আগে এ গাঁয়ের রাজবাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল না? শোনাও না গপ্পোটা।’ খুঁড়ো গাঁয়ের অনেক পুরোনো লোক, অনেক কথা জানে। চোখের ছানি, মাথার টাক তো আর এমনি আসেনি। দা খুঁড়ো কোনো কথা বলে না, হাতের হুঁকোটা নিয়ে ফুঁকফুঁক ধোঁয়া ছাড়ে শুধু। বাবলু বোঝে আজ আর হবে না, খুঁড়োর মেজাজ নেই। হাতের ঠোঙাটা শেষ করে মুড়িয়ে পেছন দিকে ফেলে দিয়ে উঠে পরে বাবলু, পেছন থেকে দা খুঁড়োর গলা শুনতে পায়, ‘সে কয়েক যুগ পুব্বের কথা রে, বাবলা। গাঁয়ে সেবার পোবল খরা, পুরা বোশেখ জষ্ঠিজুড়ে ঝড় জল হয় নাই, মাঠ কে মাঠ ফসল জ্বলি গেছে। তখন তো ক্যানেলটাও ছিল নি, এদিকে রায় নারায়ণের কড়া হুকুম, খাজনা ফাঁকি দেওয়া চলবেক নি। যদি একঘর পেজ্জ্বাও খাজনা কম দেয় তো, লাগাও চাবুক! তুলে নিয়ে এস ঘরের মেয়ে বৌগুলাকে। এই কুণ্ডুদের দপদপা তখন! রাজবাড়ির সুমুখ দিয়া পায়ে জুতা দিয়া যাওয়ার অনুমতি নাই, জুতা মাথায় করি যেতি হবে। এইরাম এক জষ্ঠির দিনে রাজ পেয়াদায় গিয়া হাজির হইলো ডমরুর বাড়ি। চাষ বাবদ কিছু কজ্জ ছিল খাজাঞ্চিতে। ডমরু তখন জোয়ান মুরোদ, ধনুকের ছিলার মতন লিকলিকে চেহারা। ঘরে তার জোয়ান বৌ। বৌটারে তুলে নিয়া গেলো কুণ্ডুদের নাচঘরে, পিছমোড়া করে চাবুক চালাল ডমরুর পিঠে, লাঠির ঘায়ে তার মাথা ফাটাল। তার কোঁকড়া চুল বাইয়া তখন তাজা রক্ত চুঁইয়ে পরতিসে। পরদিন বৌটার লাশ ভাসি উঠলো লাল দিঘির চড়ায়। ডমরু তো সেই থিকে নিখোঁজ! তার পর সংক্রান্তির দিনে আকাশজুড়ে সবে জল ভরা মেঘে আনাগোনা শুরু করিছে। সেবার ছিল অমাবস্যার রাত, হঠাৎ আদিবাসীপাড়া জাগি উঠল। কালো আকাশডাতে শুধু লাল আর লাল! মশাল হাতে রাতের আঁধার চিরে সবার আগে ডমরু। কবে যেন ফিরে আসিছে, কেউ টের পায় নাই, তলে তলে সে বস্তির সর্দার হইছে। হাতে বর্শা, বল্লম, তীর ধনুক আর টাঙ্গি নিয়ে পর পর দুটো পাড়া ঝাঁপায়ে পড়ল কুণ্ডুদের ধানের গোলার উপর। ডমরুর চোখ যেন বনবিড়ালের মত জ্বলতিসে, সে চোখ শুধু রায় নারায়ণরে চায়! কিন্তু তার পথ আটকায়ে দাঁড়াল কালান্তক যম, ‘ভৈরব’। রায়নারায়ণ তার আস্তাবল থিকে পোষা হাতিটারে ছাড়ি দিসেন ডমরুদের উপর। মনিবের জান বাঁচাতি ভৈরব তার বিশাল বপু নিয়ে ঝাঁপায়ে পরিছে, পায়ে করে দলতিসে ডমরুর দলের লোকেদের। হঠাৎ হাতের কুঠারটা বিদ্যুতের মতন হাতিটার মাথার ঠিক মাঝখানে বসায়ে দিল ডমরু। একটা বিকট আওয়াজ কইরে জন্তুটা মাটিতে পইরে গেল। পরদিন কাক ভোরে রাজবাড়ির ফটকে, রায়নারায়ণের মুণ্ডু ঝুলতি দেখা গিসলো। সেই থেকে আসে পাশের গেরামে ডমরু সর্দার আর তার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর কথা চাউর হুই গেল, জমিদার জোতদারদের গোলা লুঠত আর গরিব দুঃখীদের মাঝে বিলায়ে দ্যাত। পেরায় ৮০টা খুনের মামলা সিলো উহার নামে, ডমরু সর্দারের মাথায় ইনাম ছিল তখখনকার দিনে ১০০০ টাকা। ইদিকে ভৈরবের মাহুত হাতিডার শোকে পাগল হুইয়া গিসলো। দিনরাত বিড় বিড় করি বিলাপ করত আর ডমরুরে শাপ কাড়ত। খুব ছোট বয়সে হাতিডারে নিয়া আসাম থেকি এই গায়ে আসিছিল তো, হাতিডারে নিজের মেয়ির মতো করি আগলাত মাহুতডা। তারপর একদিন ডমরু ধরা পড়ল, দলেরই কে যেন ধরায়ে দিল, ফাঁসির হুকুম হইল। কী কইরা জানি সে সাজা মুকুবও হইয়া গেল। যাবজ্জেবন খাটি আবার ফেরল একদিন গাঁয়ে। সে তখন অন্য ডমরু, চোখে আর সেই আগুন নাই, চেহারায় ভাঙ্গন ধরসে। জেলে থাকতি ফাঁসুড়েদের কাছ থেকি কবচ তাবিজ শ্যাখছিল। এখন গাঁয়ের লোকেদের সেই তাবিজ দেয়, পাঁচজনায় কয় কাজও দেয় ওর তাবিজে, গাঁয়ের লোকে আজও ওরে সর্দার বলে মান্যি-গন্যি করে।’
একটানা এতক্ষণ ধরে বলে খুঁড়ো এবার থামল, একটা শুকনো দমকা কাশি এসেছে, ধরা গলার একটু বিশ্রাম চাই বোধহয়। প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনছিল বাবলু। উঠে পড়ল এবার, কাল কাক ভোরে জেলেরা দিঘিতে জাল দেবে, ওকে হাজির থাকতে হবে সেখানে।
এর অনেক পর বর্গা রেকর্ডের সময়, ওদের জমিজমা সব তেভাগা হয়ে গেছিল ভাগচাষিদের ভেতর। ঝগরু, লাখাই সবাই সমানভাগ পেয়েছিল। আজ প্রায় ৩৪ বছর পর প্রৌঢ় চোখে সে সব স্মৃতি ভেসে ওঠে পদ্মপাতায় জমা বর্ষার জলের মতো, যেন এই আছে এই নেই। এত বছর পর পুজোর সময় দেশে এসে, বারোয়ারীতলার তামসী দুর্গামূর্তির প্রতি নতজানু হয়ে ধর্মতলার দিকে এগোতে থাকে বাবলু। বারো বিঘের ক্যানেলটা প্রায় শুকিয়ে গেছে, সেখানে এখন দিব্যি ধান চাষ হয়, গরু চড়ে, ছেলেপিলেরা খেলাধুলা করে। সেই বিশাল বটগাছটা আর নেই। চৈত্রের কোনো এক অনিবার্য ঝড়ে পড়ে গেছে বোধহয়! ঝগরুদের বাড়িটা একইরকম আছে। বাড়িটার চাল বেয়ে একটা চালকুমড়ো গাছ বাইছে নধর ফ্যাকরার জাল বুনে। একটি আদিবাসী রমণী যাপন শৈলীর দাগ রেখে উঠোনে গোবর নিকোতে ব্যস্ত। ঝগরু আর নেই, সে খবর বাবলু আগেই পেয়েছিল। বাড়িটার সামনে গিয়ে ধরা গলায় বাবলু ডাকে ‘লাখাই, লাখাই আছিস ঘরটো?’
দু তিনবার ডাকবার পর বাড়ির ভেতর থেকে শিরদাঁড়া নুইয়ে একটা ন্যূব্জ চেহারা, লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসে। ‘অরে বাবলা দাদা না? কেতো বুড়া হইন গেছিস রে?’
চেহারাটা বাবলু চিনতে পারে অতীতের স্মৃতি থেকে। আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে এই চেহারাটাকেই এ গাঁয়ের লোক ডমরু সর্দার বলে ডাকত।