অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১৪, ২০২৫
৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১৪, ২০২৫
৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাহাব উদ্দিন হিজল -
নদীতীরের এজাজ মিয়া

ঘাসের ভার নিয়ে এজাজ মিয়া নদীর ভাঙাপাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। দু-টোপা ভর্তি দুবলা ঘাস দিয়ে সে ভার সাজিয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমটায় তার গা ঘেমে চুপসে গেছে। নাক কপাল কপোল থুতনি থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চুইয়ে নিচের দিকে নেমে কোমড়ে গোঁজা লুঙ্গির নিকট ঠেকে প্রায় সবটুকু লুঙ্গিই ভিজে উঠেছে। এমনও মনে হতে পারে সে নদীর পানিতে নেমে গা ডুবিয়ে উঠে এসে ভার কাঁধে নিয়েছে।

তাকে দেখে কি কারও বা কোনো লেখকের বলার সাধ্য আছে—এ প্রায় শ্যামলা লোকটি পূর্বে ফরসা ছিল কিংবা এত কষ্টসহিষ্ণু ছিল না? অথবা নদীর এ পারের চেহারা দেখে বলতে পারবে বা অনুমান করতে পারবে, এ পাড় চার বছর আগে কত শত গজ পূর্বে ছিল? তখনকার নদী-পাড়ের লোকজন এখন কোথায় বসবাস করে? যে এলাকা নদীতে বিলীন হতে এক বছর সময় লেগেছে, তার আওতার লোকজনের তথ্য সংগ্রহ করতে চারগুণ সময় লাগবে—নিঃসন্দেহে।

তাকে ঘাস নিয়ে বর্তমান ঠিকানা নদীর পশ্চিম পাড়ে মথুরাপাড়ায় অবস্থিত ওয়াপদার বাঁধে যেতে হবে। ওখানে বাঁধের বাম পেটে তার দুটি ছোনের-বনের ঘর আছে। অপেক্ষাকৃত বড়টি তাদের এবং ছোটটি গরুদের। স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণের ন্যায় গরুদেরও সমান হারে যত্নআত্তি করতে হয়। তা না হলে তো তারা ফলবান হবে না, দুধ দেবে না, অর্থ আসবে না। আর অর্থ উপার্জন করতে না পারলে সংসারের ব্যয় বহন করবে কীভাবে? ছেলে-মেয়ে দুটি স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে। তাদের স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। বই খাতা কলম কিনে দিতে হবে। এ সবই তো গাইয়ের দুধের ওপর নির্ভরশীল।

এজাজ মিয়াকে ঘাস নিয়ে নৌকাযোগে নদী পার হতে হবে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে এখনো অনেকখানি পথ বাকি। নৌকাঘাটের আশপাশে এখন কোনো ঘাস অবশিষ্ট নেই। নিকটের সুবিধার জন্য সবাই প্রথমে সেখান থেকে ঘাস তুলে নিয়েছে। এখন যেতে হয় অনেক দূরে, যেখানে কোনো পারাপারের ব্যবস্থা নেই। তাই তো ঘাস পাচুন দিয়ে তুলে ঝাঁকিয়ে মাটি ছাড়িয়ে টোপা ভর্তি করে নৌকাঘাট পর্যন্ত কাঁধে করে নিয়ে আসতে হয়।

ভাঙা পাড়ের কিনারে অবস্থিত আধমরা ছাতিম গাছটির নিকট গিয়ে এজাজ মিয়া জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ভার নামাল। আধমরা এজন্য যে, গাছটির অধিকাংশ শিকড়বাকড় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এবং কিছু শিকড় ভাঙা পাড়ের গায়ে হাড়-হাড্ডির ন্যায় দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে আছে। কোমরের গামছাটি খুলে সে হাত-মুখের ঘাম মুছে মৃতপ্রায় ঘাসের ওপর ছাতিম গাছের গোড়ায় বসল। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা বাতাসে তার শরীর উজ্জীবিত হতে লাগল এবং চোখে নিদ্রাপরি ভর করে ফেলল। গাছটির সঙ্গে হেলান দিয়ে সত্যি সত্যি সে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখল : সে নাদুসনুদুস একজোড়া বলদের গাড়িতে ধানের আঁটি বোঝাই দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়িতে। গাড়িতে আঁটির ভার বেশি হওয়ায় গাড়ি ক্যারক্যার শব্দ তুলে গরুর সাথে এগুচ্ছে। সে পান্টি ঝাঁকিয়ে গরুদের তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য; হেট হেট যা-যা হেট হেট…। এ সময় কয়েকটি শালিক পাখি তার ভারের নিকট এসে খামচাখামচি ঝগড়াঝাটি করে উঠলে সে চক্ষু মেলে। সোজা হয়ে বসে দু-হাতের চেটোয় দু-চোখ রগড়িয়ে যমুনার স্রোতের প্রতি তাকিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে ভাবুক মনে বলে, বাবার আমলের সেই গরুর গাড়িতে…।

বাড়ি জমাজমি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পূর্বে ওই গরুর গাড়িতে করেই এজাজ মিয়া চড়ার জমি থেকে ধানের আঁটি বাড়িতে নিয়ে আসত। ওই বলদ দুটিসহ তাদের বাড়িতে বারোমাস সাত/আটটি গরু থাকত। সারাবছর কোনো না কোনো গাভী দুধ দিত। বাবা সে দুধ বাজারে নিতে দিত না। তারা কয়েক ভাই-বোন মিলে খেয়ে ফেলত। বড়লোক না হলেও তাদের সংসারে কোনো অভাব অনটন ছিল না। জমির যে ফসল ফলত তা দিয়ে ভালোভাবেই তাদের সংসার চলত। নদীতে সবকিছু বিলীন হয়ে তারা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেনি। কেননা নদী তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিল। এতো দূরত্ব ঘুচে শূন্যতে এসে ঠেকবে—বলাই বাহুল্য। আজ তার নুন আনতে পানতা ফুরায়। একটিমাত্র গাইয়ের দুধ থেকে টানাটানি করে তার সংসার চলে। ছোট ভাই দুটি পড়ালেখা করেছিল, তাই তাদের হালে পানি আছে। তার হালের পানি কখনো শুকিয়ে বালিতে গড়াগড়ি খায়। তখন সুযোগ বুঝে অন্যের বাড়ি দিনহাজিরা কামলা খেটে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়।

অত সুন্দর নাদুসনুদুস সেই বলদ আর গরুর গাড়ি চোখের পর্দায় ভাসতে থাকলে বিপর্যয়ের হোতা পাশ দিয়ে বয়ে চলা যমুনার বুকে একদলা ঘৃণার থুতু সজোরে নিক্ষেপ করে। সে থুতু পানিতে না পড়ে ছাতিম গাছের হাড্ডি-মতো বেরিয়ে থাকা একটি শিকড়ের ওপর পড়ে বাদুরের ন্যায় শুধাশুধি ঝুলতে লাগল। মনে হলো সেও তেমনি বর্তমানে ওয়াপদার বাঁধে উচ্ছিষ্টের ন্যায় ঝুলে আছে।

সেই আষাঢ়ে যমুনার রুদ্রমূর্তি চোখে চোখে ভাসে। তাদের পুরো পাড়াটা নিজের অধিকারে না নিয়ে কর্মযজ্ঞে ক্ষান্ত দেয়নি। তাদের ঘর-বাড়ি ভেঙে নিয়ে স্কুলের মাঠে প্রথমে শুয়ে রেখেছিল। তারপর খুঁটি পুঁতে টিনের চালাগুলো ছাপড়া আকৃতি বানিয়ে কোনোরকমে নিজেদের ও গরুগুলোর রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করেছিল। পরবর্তীকালে ভাইদের যেটুকু পড়ালেখা চালান ছিল তা নিয়ে চাকরির খোঁজে ধারদেনা করে শহরে চলে গেল আর নিজে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে ওয়াপদার বাঁধে ঠাঁই নিয়েছিল। আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, ধারদেনা শোধ করতে গিয়ে প্রথমেই বলদ দুটির গলায় দড়ি পড়ল। বাবার ভগ্‌ণ শরীর এত বিপর্যয় সহ্য করতে পারল না। সে আমাদের ফেলে চলে গেল। রাগের চোটে এজাজ আরও একদলা থুতু যমুনার বুকে ছুড়ে মারে। বেহায়া বেশ্যা মাগি, তুই হামাগারে কাঙাল বানাচু!

দৃষ্টি অনেক দূর পশ্চিম পাড়ের দিকে পানির ওপর দিয়ে তাকিয়ে এজাজ মিয়ার ভাবান্তর হয়, নদীকে ব্যোকে কী নাব? ওর তো কুনু বোধশক্তি নাই, জ্ঞানবুদ্ধি নাই। বর্ষায় বাড়তি পানির চাপে ওর মাথা আওলাঝাওলা অয়া যায়। অত পানি যে তহুন কুাট থ্যান অ্যাসে?

বাঁক হাতে নিয়ে কাঁধে তুলতে গেলে এক পাশের টোপার দড়ি বিচ্ছিন্ন হলে বাম হাত দিয়ে বাঁক ধরে থেকে ডান হাতে টোপার রশি বাঁকে আটকে কাঁধে তুলে এগুতে লাগল। একটু সামনে যেতেই দেখা হলো মানুর সাথে। মাথায় গামছা বাঁধা। হাতে বৈঠ্যা। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এজাজ ভাই ভালো আছাও? কতদিন অইল তোমাক দেকিন্যা। হামাগারে বাড়ি একদিন যাইয়ো ভাই।

এজাজ ভার মাটিতে নামিয়ে বলে, যামু রে মানু তুই হামাগারে বাড়িত য্যাস, ব্যেইর‌্যা আসিস। তোর সংসার কেংক্যা চোলিচ্ছে?

চোলিচ্ছে না ভাই। তুমি তো জানো যবুনায় বাড়ি ভাইঙ্গ্যা যাওয়ার পর হামাগারে আর কুনু কিছুই নাই। কাইল্যা ব্যাপারির বাড়ির পিচনে জঙ্গলের ধারত্ একখান ঘর তুইল্যা আছি। তারজন্য ব্যাপারির নায়ে খাইট্যা মোরিচ্ছি। দিনপাত চলে না ভাই। বিতৃষ্ণা-স্রোতে হাবুডুবু খেতে খেতে কথাগুলো বলে তাদের গায়ের মানু।

যমুনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এজাজ বলে, এই যবুনা প্রত্তিক বছর হামাগারে কতো মানুষের জীবন লষ্ট কইর‌্যা দিচ্ছে, তাউ হাউস মেটে না।

মিটবি এজাজ ভাই মিটবি, হুনল্যাম নদীর পাড় পাথর দিয়া ব্যান্দ্যা দিবি। তহুন আর নদী হাউস মিট্যাব্যার পারবিল্লয়।

কোকগ্যা, ওসব কিছু না, নদী ভাঙবিই। দ্যাহোস না, অত্তো শক্ত গ্রোইন তাউ ভ্যাঙ্যা য্যায়।

তাই তো ভাই, গ্রোইন তো জমশক্ত, তাউ ভ্যাঙ্যা নদী গিল্যা খাচ্ছে। আহা হামাগারে দুক্ষু কুনুদিন ফুরাবিল্লয়!

অগত্যা আশ্বাস দিয়ে এজাজ মিয়া বলে, ফুরাবিরে মানু দুক্ষু অবশ্যই ফুরাবি। দ্যাহোস না কতো মানুষ খ্যাটাখুট্যা ট্যাক্যা যুগায়্যা অনেক দূরে খিয়ারত কম দামের য্যাগা কিনা বাড়ি করিচ্ছে। হামাগারেও ওংক্যা চেষ্টা কোরতি হবি।

তা তো বুঝল্যাম এজাজ ভাই, কিন্তুক অতো ট্যাক্যা…।

চেষ্টা কোরতি হবি মানু। এ্যানা এ্যানা কোর‌্যা যোগাতি হবি। এ্যাছাড়া তো কুনু পথ নাই। মানু ভয় কোরলি চলবিন্যা, দ্যাহোস না ফাঁসিতলা কতোদূরের রাস্তা, তাউ হ্যাট্যা যাতি যাতি একসোমায় ফাঁসিতালা পাওয়া যায়। সেংক্যা হামাগারে দুঃখের পথও একসময় ফুরাবি।

হ ভাই, উপরালা ভরসা, যাই।

মানু যেতে থাকলে পেছন থেকে এজাজ মিয়া বলে, মনে রাখিস ভয় কোরলি চলবিল্লয়।

একটু ঘুরে পেছন তাকিয়ে মানু উত্তর দেয়, হ ভাই।

এজাজ মিয়া ভার কাঁধে তুলে নিয়ে আবার যেতে থাকে নদী পারাপারের নৌকার দিকে। ভাবে, মানু বাড়ি-ঘর জমাজমি হারিয়ে কাইল্যা ব্যাপারির বাড়ির পেছনে গাছতলায় ছাপরা ঘর তলে থাকার ব্যবস্থা করেছে আর সে নিজে সাথে সাথে ব্যাপারির নায়ে নামেমাত্র বেতনে নিয়মিত কামলা খাটছে। ওখানে থাকলে তো সে সারাজীবনেও টাকা ডান করতে পারবে না। শুধু খেটে খেটে মরবে। যমুনা কী না করতে পারে! হাজারো মানুকে জিম্মি করে খাটিয়ে নিচ্ছে। অথচ তাদের অবস্থা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ তেমন ছিল না। গরু-লাঙল ছিল। নিজের এবং বর্গা কিছু জমি চাষ করে সংসার চালাত। এখন তেমন কোনো সুযোগ হাতে নেই। জমির সাথে সাথে গরু-ছাগল, লাঙল-জোয়াল, মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু ধীরে ধীরে বিলীন হয়েছে। ভাবে, তার নিজের অবস্থাও তো মানুর চাইতে কোনোক্রইে ভালো বলা যায় না। কেবল মনোবল সম্বলটুকুই তাকে শক্ত হাতে বোঠে চালাতে সাহস জোগাচ্ছে। তা না হলে মাঝ নদীতে হাল ভেঙে মানুর মতো ঘুরপাক খেতে হতো।

ওই বাঁধের একচিলতে জায়গা ঘর তোলার জন্য আয়ত্ত করতে তাকে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট গিয়ে বাবা ও দাদার পরিচয় তুলে ধরে নিজের বিপর্যয়ের বিষয় উপস্থাপন করতে হয়েছিল। হঠাৎ বাস্তুভিটা হারা হলে চোখের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়। যেন চোখে দলদলা কাদামাটি ছুড়ে মারা হয়েছে। এরপর চেয়ারম্যানের হাত ধরে কান্নাকাটি করেছিল; না হলে তাকে নদী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পরিশেষে জনদরদি চেয়ারম্যান তাকে বাঁধের জায়গায় ঘর তোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। এজাজ তার জন্য চেয়ারম্যানকে অনেক দোয়া করেছেন। তিনি যেনো বারবার চেয়ারম্যান হতে পারেন। যেন আরও বেশি বেশি জনগণের খেদমত করতে পারেন।

এজাজ মিয়া নৌকা থেকে নেমে নদীর পাড় দিয়ে বাড়ির দিকে এগুতে লাগল। অল্প পথ ভার কাঁধে করে নিয়ে গেলেই বাড়ি পাবে। ঘাসের ভার খড়ের পাজার নিকট রেখে কিছু ঘাস নিয়ে আগে গরুকে খেতে দেবে তারপর নিজে গা-ধুয়ে খেতে বসবে। সেই সাতসকালে চারডো পান্তা খেয়ে টোপা-পাচুন নিয়ে বেড়িয়েছে। এখন ব্যালা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।

দুপুর গড়ে গেছে। বউ ছেলে-মেয়ে দুটিকে হয়তো খাইয়েছে। কিন্তু সে না যাওয়া পর্যন্ত বউ অপেক্ষা করবে। তাকে কাছে বসে খাওয়াবে তারপর নিজে খাবে। কতবার এজাজ বলেছে, বসো একসাথে দুজনে খাই, তা খাবে না। দাদি ও মাকে যেমনটি দেখে এসেছে সেও তেমনি করবে। তাছাড়া সংসারে অমঙ্গল হবে। এজন্য সে আর অ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সংসার কল্যাণময় থাকুক এটা কে না চায়?

একটু এগিয়ে তাদের পাড়ার দিকে দৃষ্টি পড়তেই নজরে এলো, নদীপারে মানুষের জটলা। কেউ পানিতে পড়েনি তো? না না তা হবে কেন? অলুক্ষণে কিছু ভাবতে নেই। তবে নদীর তীরে ভাঙন ধরেছে কী? ভাঙন ধরলে পাড়ার লোক নদীর সর্বনাশা খেলা দেখতে এগিয়ে আসে। মনে হলো পাড় ভেঙে তাদের বাড়ির প্রায় নিকটে এসেছে। তার বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। এজাজ মিয়া অপেক্ষকৃত জোরকদমে এগুতে লাগল। নদীর কোথাও ভাঙন ধরলে সহজে থামে না। যেবার তাদের ঘর-বাড়ি নদী কেড়ে নিল সেবার থেমে থেমে একদিন একরাত সময়ে তাদের গ্রামের অর্ধেকখানি গ্রাস করে ফেলেছিল। কেউ কেউ নিজেদের ঘর-বাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে পারলেও অনেকেই গাছগাছালি সরিয়ে নিতে পারেনি; নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গফুর দাদা বলত, পানির নিচে নদীর শত শত দানব-দানবী কামলা আছে। তারা নদীর হুকুম মতো নিচ থেকে মাটি কেটে পানিতে ভাসাতে থাকে। তখন পাড় ভেঙে নদীর জোত বাড়তে থাকে। এটা নদীর খেলা। তার বাবা পানির নিচে কামলার মাটি কাটার কথা কখনো বিশ্বাস করতো না। বলতো, পানির স্রোতেই পাড় ভাঙে। আমিও তা বিশ্বাস করি, পানির বাড়তি চাপেই নদী ভাঙে। আজ সকালে যাওয়ার সময়ও এজাজ মিয়া লক্ষ করছিল, পানি কমতে থাকলেও তাদের পাড়ার পাড়ের নিকট দিয়ে প্রবাহিত স্রোত অত্যন্ত প্রবল। তবে নদীর পাড় ভেঙে যাবে—তা ভাবতে পারেনি। কারণ সবসময় তেমনটি প্রতিফলিত হয় না।

এজাজ মিয়া অদূরে ভার নমিয়ে রেখে অকুস্থানে এগিয়ে গেল। দুমাদুম পাড় ভেঙে নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে; পানি ছিটকে ফোয়ারার ন্যায় চতুর্দিকে লাফিয়ে পড়ছে উৎসবের আহ্লাদে। আর পানির নিচ থেকে ভুটভুটি উঠে ফেনায় রূপান্তরিত হয়ে ভাটির দিকে ছুটে যাচ্ছে। মনে হলো তার মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফেনা হয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। আবার নতুন নতুন চির ধরছে ভাঙার জন্যে। অনেকেই এগিয়ে গিয়ে নদী ভাঙার বেল্লিক খেলা দর্শন করছে। অবশ্য এতে তাদের সবার চোখ ছলছল করে ওঠে না। দু-এক দিনে তাদের বাঁধের ঠিকানাও নিশ্চয় নদীর খেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে! আবার কচুরিপানার ন্যায় ভাসতে ভাসতে নতুন ঠিকানায় এগুতে হবে!

ভাঙনের চিত্র দেখতে দেখতে এজাজ মিয়া হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ অঙ্কিত হলো। তাকে সামনে যেতে হবে নাকি পেছনে? ছলছল নয়নে সে জল-স্রোতের আতশবাজি উৎসব দেখছে তো দেখছেই…। তাই মুখে জমা ঘৃণার থুথু নদীর মুখে, বুকে না পাছায় মারবে—খেই হারিয়ে ফেলে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *