অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ১৩, ২০২৫
২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ১৩, ২০২৫
২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিলকিস ঝর্ণা -
প্রিজন ভ্যান

সকাল থেকেই মেঘে অন্ধকার আকাশ। যেন পৃথিবীর সব রং শুষে নিয়ে পৃথিবী ঘুমায়। কিছু বৃক্ষের অঙ্কুরোদগম হয়। কিছু ফুল ফোটে। আদালতপাড়ার আকাশ আরও নিচে নেমে আসে।
একদম নিচে।

প্রায় মানুষের কাছে।

তবুও ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ে আদালতপাড়ায়। মানুষের ভিড়। নারী-পুরুষের, শিশু-বৃদ্ধের অথবা অসুস্থ নগরীর।
যে নগরীর কিছু মানুষের প্রতিদিন একটা নীল প্রিজন ভ্যানের অপেক্ষায় ভোর ফেরে।

শহরের এ প্রান্তে সাধারণের আনাগোনা অনেকটাই কম। এখানে অপরাধীও হাসে। ফাঁসির মঞ্চের ভয়ে স্রষ্টার নাম জপে খুনি হজরত। মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতে পাগল সাজে তিন খুনের আসামি নির্ঝর।

অপরাধীর বিচারও হয়। স্বচ্ছ দিনের আলোয় পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে ছিঁচকে পকেটমার। তারপর চুলের মুঠি ধরে কিল-ঘুষি। চারপাশের মানুষ তৃপ্তির সাথে তামাশা দেখে।

কেও একজন ধমকে বলে— ছেড়ে দিন!

কখনও কখনও পুলিশ এসেও নজর দেয়। তার আয় রোজগার বাড়ে।

ফের অন্য এক ভিড়ে হল্লা হয়।

আমাদের বাঁধা সময় ধরে দৌড়াই। এ বিল্ডিং থেকে ও বিল্ডিং, দু’তলা থেকে তিন তলা, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে জজ কোর্ট।

দশটা বেজে গেল প্রায়।

জেলখানা থেকে আদালতপাড়ায় এসে থামে প্রিজন ভ্যান। ভাগে ভাগে আসামিদের যার যার নির্দিষ্ট কোর্টে নিয়ে যায়।

জঙ্গি আনিসের জামিনের জন্য কয়েকদিন যাবৎ যারপরনাই চেষ্টা চলছে। প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে আসে আনিসের মা। আজ আনিসকে কোর্টে আনবে।

আনিসের মায়ের হাতে একটা খাবারের প্যাকেট। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। আনিস মেধাবী ছাত্র। জঙ্গি সন্দেহে ধৃত আনিসের জামিন মিলছে না কোনোভাবেই।

অবশেষে কাস্টডিতে রেখেই পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দরকার। চলছে থাকে নিরলস প্রচেষ্টা। পরের দিন শুক্রবার। আজই শেষ কার্য দিবস। রবিবার দশটায় আনিসের পরীক্ষা।

আনিসকে নেওয়া হয় দায়রা জজ কোর্টের কাঠগড়ায়। আজ আনিসের মামলার P/W-সহ শুনানি।
ডিস্ট্রিক্ট জজ সাহেব আনিসের অর্ডার পরে দেওয়া হবে বলে পাশে রেখে দেওয়া হয় নথি। আনিসের জন্য নিয়ে আসা খাবারের প্যাকেট তখনও মায়ের হাতে।

আনিসের আজ খাওয়া হয়নি। মায়েরও না। আমি অনেকবার খেয়ে নিতে বললাম।

খায়নি সে।

বুঝতে পারছিলাম, ছেলেকে ছেড়ে কী করে খায়!

অনেক দৌড়াদৌড়ি কাঠখড় পোহায়ে বিকেলে খাস কামরায় আনিসের পরীক্ষা দেওয়ার পারমিশন অর্ডার হয়।

সেই অর্ডার শিট দ্রুত জেলারের হাতে পৌঁছানো দরকার।

কিন্তু প্রিজন ভ্যান কখন যাবে কাস্টরিতে? সেখান থেকে আনিসসহ কুমিল্লা জেলখানায়। অতঃপর পরীক্ষা কতৃপক্ষের কাছে পৌঁছালে পরীক্ষার বন্দোবস্ত।

অবশেষে যথেষ্ট কালক্ষেপণ করে আনিসের মায়ের আশঙ্কা ধীরে বয়ে চলছে প্রিজন ভ্যান।

ওই পাশে আবালবৃদ্ধাবনিতা একঝাঁক বেদে সম্প্রদায়। আগেও কয়েকবার ওদের দোতলায় দেখেছি। বারান্দায় অনেকটা জায়গা নিয়ে একসঙ্গে সবাই বসে আছে। হতে পারে একশজনেরও বেশি। কেউ কেউ গল্প করে, কেউ ঝগড়া, কেউবা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়।

আমি ওদের ছবি তুলি। ওরা পোজ দেয়।

আমি জিজ্ঞেস করি— কী হইছে তোমাদের?

ওরা নির্দ্বিধায় বলে— মারামারি লাগছে।

আমি বলি— কার সঙ্গে?

ওরা বলে— আমরা নিজেরাই।

আমি একটু হেসে আমার কাজে দৌড়াই।

আজ ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে। এছাড়াও একদম চুপচাপ।

আদালত প্রাঙ্গণ আজ বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থায়। বড় গেটের বাইরে প্রচুর লোকজন। ওখান থেকেই অতিরিক্ত পুলিশের ডিউটি চলছে। ভিতরে রিকশা-অটো প্রবেশ নিষেধ।

নুর হোসেনসহ পুলিশ ভ্যান রওনা দিয়েছে। সাত খুনের মামলার আসামি নুর হোসেনের অস্ত্র মামলার শুনানি আজ।

সাংবাদিক-ক্যামেরার স্ট্যান্ড সেকেন্ড এডিশনাল কোর্টের দরজায়-বারান্দায়। এই কোর্ট তিনতলায়।
বেদেদের আজ তাই বাইরেই বসতে হবে। প্রিজন ভ্যান বড় গেটে ঢুকতেই ছোট বাচ্চা কোলে দৌড়ে যায় একজন। পিছু আরও কজন। পুলিশ বাধা দেওয়ায় সবাই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

প্রিজন ভ্যান থেকে অনেকের সঙ্গে নামে কবিরও। তার বাচ্চাকে প্রায় ধরতে পেরেছিল। কিন্তু সবাইকে নিয়ে দায়িত্বে রত পুলিশগণ দ্রুত দোতলার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে চলে যায়। বাচ্চাকে নিয়ে মা তাদের পিছু পিছু দৌড়ায়। তার বাচ্চাকে যেন বাবা একটু আদর করে দিতে পারে। কবির তার বাচ্চাকে আর ছুঁয়ে দিতে পারে না একটুও।

অনেকক্ষণ পর আবারও দোতলার বারান্দা দিয়ে কাজে যাচ্ছিলাম। আমি দেখি, কবির বারান্দায় পুলিশের সঙ্গে বসে আছে। বাচ্চাটা তার কোলে। আর বাচ্চার মা কবিরকে খাইয়ে দিচ্ছে।

আমি পাশাপাশি মোবাইল ফোনে কথা বলার অজুহাতে দাঁড়াই। কবির বাচ্চার পায়ে আদর করে চুমু খায়।

মৃদু বাতাস বইছিল কোর্টের দোতলার এই পাশটায়। এখানে কিছুটা ফাঁকা। বৃষ্টিবেলায় এদিকের দেওয়ানি আদালতের হাজিরার লোকজন কম। একেবারে নেই বললেই চলে।

আকাশের মেঘগুলো আরও ভারি হয়ে নিচে নেমে আসছে।

যেন বৃষ্টিতে ভিজে যাক মর্ত্যের ছোট্ট এই পৃথিবী।

বানে ভাসুক যত নিষ্পেষিত ঘর।

ফের নতুন চরে শুরু হোক আর একটা নতুন ছোট্ট গল্প।

হঠাৎ একটু হৈচৈ। পুলিশ দ্রুত কবিরকে নিয়ে কোর্টের ভিতরে চলে যায়। কোর্ট রেডি। জজ সাহেব এসে পড়েছেন। শুনানি শুরু হবে।

বাচ্চা কোলে, অর্ধেক খাবারের বক্স হাতে নিয়ে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে কবিরের স্ত্রী।

অন্যদিকে নারী শিশু কোর্টের দরজায় অপেক্ষায় রাতুল। অনেকক্ষণ পর রাতুলের মামলা নাম্বার ডাকে। ভিড় ঠেলে সে ভেতরে ঢোকে। আসামির কাঠগড়ায় জামিনের প্রার্থনায় হাত জোড় করে দাঁড়ায় রাতুল। রাতুলের এডভোকেট বিনয়ের সাথে রাতুলের আত্মসমর্পণমূলক জামিনের প্রার্থনা করেন।
জামিনে আবেদন না মঞ্জুর হয়। রাতুলের সঙ্গে আরও দুজন আসামি। সহকর্মী সফিক আর ফিরোজ। ওরা ধর্ষকের সহায়ক আসামি। সবার জামিন মঞ্জুর হলেও এক নম্বর আসামি রাতুলের জামিন না মঞ্জুর হয়। রাতুলের মা হঠাৎ সব বাধা উপেক্ষা করে কাঠগড়ায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। পুলিশ অন্যরা টেনেহিঁচড়ে তাকে ছাড়িয়ে বাইরে নিয়ে যায়।

পুলিশ নিয়মমতো সঙ্গে সঙ্গে রাতুলের হাতে হ্যান্ডকাপ পরায়।

একের পর এক মামলার শুনানি চলতে থাকে। জজ সাহেব লাঞ্চের বিরতি নেন। একঘণ্টা পর ফের শুরু হয় অন্যসব মামলার সাক্ষী, নতুন মামলার ফাইলিং— রাতুলের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগ হয় আরও তিনজন আসামি, যাদের আপসের শর্তে প্রাপ্ত আগের জামিন বাতিল হলো। রাতুলের অন্ধকার অপেক্ষার পালা শুরু।
বাইরে বারান্দায় বসে রাতুলের মা, বোন আর বাবা। সঙ্গে দুজন আত্মীয়।

বিকেল সাড়ে চারটায় হঠাৎ আকাশবিদারী চিৎকার। সবাই চমকে উঠে।

আমার প্রশ্নদৃষ্টির কেউ একজন হেসে উত্তর দেয়— ঐ তো!

আমি বুঝতে পারি। রাতুলের মায়ের চিৎকার। সামনে এগিয়ে যাই। রাতুলকে সবার সঙ্গে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্রিজন ভ্যানের দিকে। পিছু পিছু রাতুলের মাকে সিঁড়ি দিয়ে কয়েকজন ধরে নামাচ্ছে। বোতলের ঠাণ্ডা পানি মুখে দিচ্ছে, মাথায় দিচ্ছে। রাতুলের মায়ের হঠাৎ জ্ঞান ফেরে। দৌড়ে রাতুলের পিছু ছোটে।

রাতুল প্রিজন ভ্যানের দরজায় দাঁড়ায়। অন্য সবার ভিড় ঠেলে চিৎকার করে রাতুলের মা ছেলেকে ডাকতে থাকে। কাছে গিয়ে রাতুলকে ধরতে চায়।

পুলিশ দ্রুত রাতুলকে ভেতরে ঢুকিয়ে প্রিজন ভ্যানের দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রিজন ভ্যান চলতে থাকে—।

তারও অনেক আগে রাতুলের মায়ের চিৎকারের শব্দ অন্যদের শব্দের ভেতর মিলিয়ে গেছে।
একসঙ্গে অনেকের চিৎকার চেঁচামেচি। রাতুল সুরক্ষিত ভ্যানের উঁচু জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে।
মা আর দাঁড়াতে পারছে না।

সবাই তার স্তব্ধ মাকে ধরে রেখেছে। প্রিজন ভ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে মা। ছেলেকে দেখতে পায় না। নির্বাক হয়ে দেখতে থাকে চলতে থাকা প্রিজন ভ্যান।

আদালতপাড়ায় অঝোরধারায় বৃষ্টি নামে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *