অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫
২১শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫
২১শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সত্যজিৎ সিংহ -
ক্যাকটাসের ঘ্রাণ

নারী-পুরুষের যে মিলন হয়, জুবেদ শেখ তার ছোটবেলায় বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে টুকটাক চটি বই পড়তে গিয়ে জেনেছে, এইটার সুন্দর নাম হলো রতিমিলন, কিন্তু বড় হতে হতে এই ছাব্বিশ বছরে এসে পড়বার পর তাবৎ বাংলা সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় এই কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত তার মনে হচ্ছে— রিয়াজের সাথে দীর্ঘদিন দেখা করতে না পেরে দুর্ধর্ষ পিতা আহমদ শরীফের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কলেজের পেছন বারান্দা দিয়ে বুকের ওড়না ফেলে দিয়ে ডবকা দুধগুলো নাচাতে নাচাতে পূর্ণিমা যেভাবে ছুটে এসে রিয়াজের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেইটার নামও নাকি মিলন! যেভাবে পাবলিক বলে আর কী! আলিঙ্গন মিলন হয় কী করে— এইটা তার মাথায় আসে না। দুটো জিনিস কি এক! সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা জিনিসের এক নাম কী করে হয়!

গ্রামের ভাষায় রতিমিলনকে বলে চুদাচুদি। কিন্তু জুবেদ শেখের মনে হয়, চুদাচুদি শব্দটা দিয়ে পারস্পরিক শরীরের আনন্দ ভাগাভাগিটা একেবারেই ফুটে ওঠে না। শব্দটা একধরনের গালি বলে মনে হয় তার কাছে। যেমন কেউ যখন বলে, তোর মারে চুদছি, এই কথার মানে হলো— ঐ লোকটাকে চূড়ান্তভাবে অপমান করা। এর চেয়ে জঘন্য গালি বাংলা ভাষায় সম্ভবত আর নাই। আবার কেউ যখন বলে তোরে চুদার টাইম নাই। এরও মানে আগেরটার প্রায় কাছাকাছি। হতে পারে সেইটা, তোরে আমি নর্দমার পানিতে কিলবিল করা সাদা কৃমির মতোন দেখি। এরকম আর কী। তাহলে এই শব্দ ‘রতিমিলন’ শব্দের সমগোত্রীয় কী করে হয়!

ভাদো মাসের ঝলমল করা চন্নি রাইত, লিচু গাছের ঘন ছায়ার নিচে, ইন্দারার হিম হিম ঠাণ্ডা জলে চ্যাপচ্যাপা গরম, ঘাম আর লবণের ভারী ক্লান্তি তাড়াতে তাড়াতে, নতুন প্যাকেট খোলা কেয়া সাবানের ভুরভুরা খুশবাই রাতের বাতাসে ছড়িয়ে, অত্যন্ত চমৎকার একটা সঙ্গম পর্ব কাটানোর পর জুবেদ শেখের এইসব দু চারটা শব্দ নিয়ে ঘোর ঘোর ভাবনার মধ্যে প্রায় হঠাৎ করে, এই এক্ষুনি হঠাৎ করে মনে হয়— ‘রতিমিলন’ শব্দটাও যেন পর্যাপ্ত নয়।

আজকে শুরুটা হয়েছিল, সংগমের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে। শুরুর দিকে কয়েক ধাপ পেরোনোর পর মনটাকে একটু যদি এদিক সেদিক না সরানো যায়, যদি ধনুকের বাঁক থেকে সূচালো তীর তীব্র গতিবেগে বেরিয়ে পরে যদি বাতাসের আইনকানুন না মেনে সাঁ সাঁ করে পাখির মাথা লক্ষ করে ছুটতে থাকে, তবে নিশ্চিত থাকো সেই তীর পাখি অবধি যাওয়ার আগেই গোত্তা খেয়ে মাথা ঘুরে মাটির দিকে ধরাশায়ী হবে। তীর মারা জানতে হয়। মাঝপথে এসে তীরের ফলাকে হাওয়ার মধ্যে শূন্যে কিছুক্ষণ ভাসিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হয়। সঙ্গমের সময় দক্ষ পুরুষেরা টেকনিক খাটায়। জুবেদ শেখ নিজেকে এখনো অতটা দক্ষ মনে করে না। বয়স সবে ছাব্বিশ। খেলতে খেলতে খেলোয়াড়— তাই না! গোটা জীবন এখনো পড়ে আছে।

সঙ্গমের সময় কেবল জোশ লাগতে শুরু করেছে, এই সময় ঘোড়ার লাগাম খুব সাবধানে রাখতে হয়, আচমকা দৌড় লাগালে শেষ অবধি যেতে পারবে না ঘোড়া, এই সময় হলো সুখী রাজকুমারের মতোন ঘাড় ঘুরে ঘুরে নদীর তীর, শস্যখেত, গ্রামের ঘরবাড়ি দেখবার। জুবেদ শেখ ঘরের বর্গা, মাটির দেয়ালের উপর সারি সারি চলা কালো পিঁপড়ার সারি— এইসব দেখে, দেখতে দেখতে রতিমিলন শব্দটাকে মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। বলতে হয়, সে ইচ্ছা করেই কাজটা করে। ঘোড়ায় সওয়ারিকে শুধু গন্তব্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে চলে না। এই সময় নানান বিক্ষিপ্ত ভাবনায় মনটাকে সদাব্যস্ত রাখতে হয়।

সিতারা বানু সেই ধরনের নারী যে কিনা শুধু ভালোবাসা চায়। শুধু ভালোবাসা, আর কিছু না। এমন অনেক দিন গেছে জুবেদ শেখ নিজের কারবার, পুলিশি মামলা, নিজের বাচ্চাকাচ্চা, সংসারের খরচাপাতি— এইসব নিয়ে এট্টু আনমনা হওয়া মাত্রই চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়েছে। সিতারা বানুর জায়গায় অন্য নারী হলে এবং সে নারী যদি সিতারার মতোন অতীব সুন্দরী ও মেদচর্বি ছাড়া প্রফুল্ল যৌবনা কার্তিক মাসের মধ্যাহ্ন পরবর্তী টানটান রৌদ্র অথবা রৌদ্রের মতোন হয় এমনকি তার অর্ধেকেরও কম থাকে, জুবেদ শেখ মনে করে সে নিশ্চিত তখন সে নারীর লাত খেত, চোইত মাসের মরা উড়ির ঝাড়ের রূপ নেওয়া তার বউ হাসনা পর্যন্ত এমন অবস্থায় তাকে অনেকদিন কুদাকুদি করেছে। হাসনারও এমন হঠাৎ করে নায়িকা পূর্ণিমার মতোন নাক সিটকানো ভাব দেখে জুবেদ শেখের মাঝে-মধ্যে একা একা অট্টহাসি দিতে ইচ্ছা করত। কথায় আছে না— ঘোড়া গাতায় পরলে ব্যাঙেও লাত মারে! হা হা হা!

কিন্তু ব্যতিক্রম সিতারা বানু। জুবেদ শেখ সম্পর্কে তার দুঃসম্পর্কের ভাগিনা হয়। মানে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হলে একটা না একটা লতাপাতার লেজের অবশিষ্টাংশ যেহেতু তৈয়ার করে রাখতে হয় সেই অর্থে ভাগিনা আর কী! মৈ এমন একটা ডাক, যার সাথে দূরে বলে কিছু নাই। মায়ের পরেই মেয়ের জায়গা। সুতরাং এখানে অবিশ্বাসের প্রসঙ্গ এলে তা অনেকদূর গড়িয়ে যাওয়ার পর লোকে জট খুলতে বসে।

তার ভেতরের খবর কেমন করে যে সে জানে! যেদিন জুবেদ শেখের ভালোবাসতে আদর করতে মন বসে না, সেদিন সে জুবেদ শেখের সামান্য সময়ের চোখের দৃষ্টি দেখেই তাকে পড়ে ফেলতে পারে। অথচ তাদের দুজনের সম্পর্ক মাত্র এই কদিনের। হাসনার সাথে তার বিয়ের প্রায় বারো বছর চলে। প্রথম প্রথম হাসনাও তার এই মনের ভেতরের ভালো মন্দ বুঝতে পারত। কিন্তু একসাথে থাকতে থাকতে কাঁচির দুই বাহুতেও মরিচা পরে। অনেকদিন ব্যবহারের পর দেখা যায়, চাবি দিয়ে তালা খোলা যাচ্ছে না, অনেক কসরত করে খুলতে হয়। দুনিয়ার নিয়মই হয়তো এই। রোগে অসুখে সারাবছর ভোগা হাসনার জন্য তার মায়া হয়। শরীর ভালো থাকলে মনটাও ভালো থাকে। হাসনা যে সময় অসময়ে ছাঁৎ করে লাফ দেয়া শিখার মতো জ্বলে উঠে, যৌবন হারানো নদী আর যৌবন হারানো নারীর সাথে তার তুলনা দেওয়া যায়। যে নদী তীব্র বারিষার দিনেও হাঁটুর উপরে উঠতে পারে না, আচমকা এক শীতের বৃষ্টিতে তার পাড়ভাঙা স্রোত আলু, টমাটোর খেত ভাসিয়ে দিলে গিরস্তও তখন বিদ্রূপের হাসি হাসতে চায় নদীর দিকে চাইতে চাইতে।

তবে সিতারা বানু যেহেতু শুধু ভালোবাসা চায়, শরীরের সুখ সবদিন না পেলেও তার দিন চলে যাবে, হয়তো তার মনটাকে সে এইভাবে তৈরি করে রেখেছে হয়তো এরকম নাও হতে পারে— মানুষের মন বোঝা কি সহজে যায়! কিন্তু আগে যতবার জুবেদ শেখ মাঝপথে ছিটকে পড়েছে, অন্য নারী হলে নিশ্চিত তাকে গালাগালি করত, নিজের বউ যেখানে তাকে এক ইঞ্চি ছাড় দেয় না সেখানে সিতারা বানু তাকে বুকে তুলে নিয়েছে। মুমূর্ষু বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়ানোর মতোন ‘আমি নু তোর মা ব্যাটা! আমি নু তোর মা!’ যতবার সিতারা তাকে মায়ের রূপ ধরে পুত বলে ডেকেছে ততবারই সে কেঁপে কেঁপে উঠেছে। ‘আম্মা আম্মা’ বলে গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে কিছুক্ষণ। যেন পুরো পৃথিবী গোটা একটা পর্বতের নিচে চাপা পরে সহস্র বছরের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোন এক অপরাহ্নে তখন ঝাপসা চোখে দেখা যাবে সাগরের তীর ধরে ধরে একটা ল্যাংটা বালক হাতে একটা পিতলের ঘটি নিয়ে গ্রামের পথে আসছে। ঠিক যেভাবে মায়ের গর্ভ থেকে মানবসন্তান ধীর ক্লান্ত পায়ে পৃথিবীর পথে আসতে থাকে। এইসব দৃশ্য তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে। কতক্ষণ এইভাবে বিভ্রমে কেটে যায় কে জানে!

তারপর জুবেদ শেখ যথারীতি সিতারাকে আদর করতে গেছে। আচমকা মুখ থুবড়ে পড়া ঘোড়াটা ঈশান কোণে কেমন করে রক্তিম সিঁদুর দেখে কে জানে! এর পরের দৃশ্যে দেখা যাবে, তীব্র সুখে একে অপরে আঁকড়ে ধরে দুইটা আদিম জন্তু শীৎকার করতে করতে মরে যাওয়ার মতোন ডুবে গেছে স্রোতহীন কোনো জংলি নদীর অতল জলে। সেই সুখের কোনো তুলনা কারো সাথে দিতে চায় না জুবেদ শেখ।

মিষ্টির দোকানে বোলভরা শিরায় চিনিখেকো পিঁপড়ার ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়া দেখেছে কেউ! জুবেদ শেখ দেখেনি। তবে কল্পনা করলে পিঁপড়ার অনুভূতিটা সে বুঝতে পারে। তীব্র সুখে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করতে করতে মরণের পথে গমন। নারী পুরুষের দুই নগ্ন শরীরের পরস্পর একসাথে ডুবে যাওয়াটাও এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সহমরণ, যে মরণে নারী পুরুষ সবাই ঝাঁপ দিতে চায়— সেরকম আর কী! সিজনের পয়লা বৃষ্টিতে রসকষ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া কামিনী গাছটা হাত পা ছোড়াছুড়ি করে যেভাবে নাচতে নাচতে আকাশের অসীম পথে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়ফোড় আয়োজন করে— ঠিক সেরকম মরণের আনন্দের সাথে সঙ্গমের তুলনা দিতে চায় জুবেদ শেখ। রতিমিলন শব্দটা কোনোভাবেই সঙ্গমের আনন্দের প্রতিশব্দ হতে পারে না। অন্য বিকল্প কী শব্দ হতে পারে— জুবেদ শেখ তা জানে না। কিন্তু এটা সে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারে— রতিমিলন শব্দটা খুবই নিরীহ মনে হয় সঙ্গমের মতোন তীব্র এবং আনন্দকাতর শব্দের কাছে।

সিতারা বানুর মতোন একটা টাইট মালকে দিনের পর দিন মাসের পর মাস একা পাহাড়ের টিল্লায় অবহেলায় ফেলে রাখে যে ব্যাটামানুষ, তার পৌরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ একসময় ছিল জুবেদ শেখের। হতে পারে সে লোকটা চার বাচ্চার বাপ। কিন্তু বাপ বনে গেলেই যে মর্দা পুরুষ হয়ে গেল— বিষয়টা কি তাই! কিন্তু পরে সে বুঝতে পারে লোকটাও সিতারার মতন ভালোবাসার কাঙাল। সিতারা তাকে একদমই সহ্য করতে পারে না অথচ সিতারার জন্য সে পাগল! নায়ক বাপ্পারাজের প্রেমিকা ভালো না বাসলেও সারাজীবন সে ভালোবেসে যাবে— সেইরকম আর কী! কিন্তু জুবেদ শেখের কথা হলো, ভালো বাসলে দূরে থাকা কেন! লোকটাকে সে হয়তো ইচ্ছা করলে বলতে পারত মহান সাহিত্যিক শেক্সপিয়ারের অমর সেই লাইন, ‘আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড’। কাছ থেকে দূরে সরে গেলে মনটাও দূরে দূরে সরে যায়। কিন্তু আরও একটু চিন্তা করে দেখল, সে কেন বলতে যাবে! কারও সংসারের ভাঙাগড়ার দায়িত্ব কি কেউ তাকে সঁপে দিয়েছে! আর আরেকটা কারণ কী সেটা, যে তাদের দুজনের মধ্যে মিল না থাকলে জুবেদ শেখেরই লাভ! সিতারা তার স্বামীর ভালোবাসা পেলে কি জুবেদ শেখকে আর কেন জিগাতে যাবে, বগল কামিয়ে দিতে!

রুটি-রুজির জন্য সংসারে হাজারো কাজ আছে। হ্যাঁ, তুমি সংসারে একটাই কাজ জানো, সেইটা হাতির দাইদারি, এই তো! কিন্তু যে দাইদারের ঘরে অপূর্ব সুন্দরী বউ থাকে, তার কী উচিত হয় ঘর বাড়ি ফেলে গহিন পাহাড়ে যেয়ে হাতির ল্যাদার ঝাঁজাল গন্ধের নিচে থেকে মুখ হা করে রাতযাপন করা! জুবেদ শেখ কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারে না। সিতারার স্বামী দেখতে যতই বেখাটা, গরু দিরগা দেওয়ার মুগুরের মতোন হোক— স্বভাবে লোকটার ঘাউড়ামি একটা আছে। সংসারের হিসাব বড় জটিল। প্রেম-ভালোবাসার জন্য হলো একটা দেয়াল আর বিপরীতে যে দেয়াল আছে, সেখানে প্রেম-ভালোবাসার বিন্দুমাত্র জায়গা নাই। আছে ঘৃণা হিংসা রক্তপাত, নিষ্ঠুরতা এসব। জুবেদ শেখ যেভাবে শুধু কামনার জ্বালা মেটানোর জন্য সিতারার কাছে আসে, সেইরকম সিতারার প্রতি এক প্রকারের তীব্র ঘৃণা সে লোকটার চোখে-মুখে দেখতে পেয়েছে। ভালোবাসার আরেক নাম তো ঘৃণা— তাই না! সামান্য একটা দাইদার হয়ে এত রূপসী এক নারী তার জীবনে আসবে আর প্রকৃতি তাকে বিনয় দেখিয়ে ছেড়ে দেবে এতটা ঔদার্য বোধহয় প্রকৃতি কোনোকালেই করেনি, জুবেদ শেখের স্বল্পজ্ঞানে যেটুকু জানে আর কী!

জুবেদ শেখ যখন সিতারার জীবনে ঢেউয়ের তরঙ্গ লাগার মতোন তীরের কাছাকাছি এসে কেবল আসা-যাওয়া শুরু করেছে, তখনি সে বুঝতে পারে, সিতারা বানু সুখী নয়। এত রূপ থাকার পরও মানুষ যদি অসুখী হয়, তাইলে রূপ-সৌন্দর্য নাই এমন লক্ষ হাজার কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা বেদনা আর বিচ্ছেদ দিয়ে এত হাহাকার করা কেন ভাই! তাইলে কি এটাই সঠিক— সুন্দরী মাত্রই অসুখী আর অসুন্দররাই সুখী!

কিন্তু জুবেদ শেখের এইসব দার্শনিক বিলাপ তো ভ্রম মাত্র, তাই না! সে সামান্য গরুর দালাল। লেখাপড়া করেছিল কলেজ অবধি, পরে আর হয়ে ওঠেনি। অবসর পেলে এসব সুখ-অসুখ নিয়ে নানান ভাবনা ভাবতে পারে, বলা যায় এইসবে তাকে ঘিরে ফেলে। সামান্য লেখাপড়া করার এই হলো আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ— আল্লাহই জানেন ভালো। তবে সিতারার ব্যাপারে তার বেদনা কিংবা তার মনের দুর্বলতা এইসব বোধহয় খাটে না। দিনের পর দিন আসা-যাওয়া করতে করতে একটু দুর্বলতা তৈরি হতে পারত, যেটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু কি শরিলের যাবতীয় জ্বালা যন্ত্রণা ধুয়ে ফেলার জন্য সিতারার কাছে সে আসে! যেভাবে পুরুষমানুষ বেশ্যালয়ে যায়। সিতারা কি তার কাছে কেবলই একটা বেশ্যার মতোন নারী! যে পরিমাণ প্রেম-ভালোবাসা আদরযত্ন তার জন্য সিতারা উজাড় করে দিচ্ছে— এইসবের কি কোনো মূল্য নাই! বেশ্যাকেও তো শেষপর্যন্ত জমিদার পুত্র স্বীকার করে নেয়। তীব্র ভালোবাসার কাছে হার মানে। এই রকম গল্প কাহিনী তো জুবেদ শেখের নিশ্চই অজানা নয়।

কিন্তু অতদূর সে ভাবতে চায় না। আজ যদি সিতারার সাথে তার সম্পর্ক এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ হয়ে যায়, সে মনে করে তার খুব একটা মন খারাপ হবে না। গল্প উপন্যাস এক জীবনে প্রচুর পড়ার এই হলো আশীর্বাদ। সংসারে এইসব প্রেম-ভালোবাসা তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা— তাই না! কেউ কারও জন্য আটকায় না। বই পড়তে পড়তে জীবন সম্পর্কে সে যা জানে, জুবেদ শেখ মনে করে অতটুকুই চলার জন্য যথেষ্ট। হয়তো তার এই নির্মোহ স্বভাবের জন্যই হাসনা তাকে আজও পাগলের মতো ভালোবাসে। হয়তো সিতারাও এরকম।

সিতারা বানুকে যেদিন সে প্রথম দেখে, সারা শরীরজুড়ে যেন বিদ্যুৎগতিতে ঘুমন্ত সরিসৃপ দংশন করতে তেড়ে আসছে, এমনটা মনে হয়েছিল তার। এমন নারীকে যদি বিবেচনায় নিয়ে না যাওয়া যায়, তাইলে কীসের জীবন! ঘরে বসে বসে বাল ছেঁড়ার জন্য!

এক ভয়ংকর তুফানের রাইতে গোটা এলাকা যখন তছনছ হয়ে গেছে, বাজ পড়ছে একেকটা যেন কলিজা জ্বালিয়ে টাটকা ছাই না হওয়া পর্যন্ত রেহাই দেবে না কাউকে। এমন দিনে, ঘোর ঘুটঘুটা মধ্য রাইতে ঘর থেকে কারা বেরোয়? হাসনা কিছু বুঝে উঠবার আগেই জুবেদ শেখ উত্তেজনায় লাইট পর্যন্ত নিতে ভুলে গেছে। তার মাথায় শুধু ঐ একটাই চিন্তা, আজ এক্ষুনি যদি ঝড়-তুফান পরোয়া না করে নির্জন টিল্লার মধ্যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একা থাকা সিতারার কাছে যায়, নির্ঘাত সিতারা প্রচণ্ড খুশিতে আজই তাকে উজাড় করে সব দিয়ে দিতে পারে। মেয়েরা এইসব বিষয় নিয়া খুব সিরিয়াস থাকে। চরম বিপদের দিন সে যাকে কাছে পায়, তার প্রতি বিশ্বস্ততা রাখা ঐদিন থেকেই শুরু করে দেয়। সুযোগ তো তোমার মুখের সামনে আল্লাহ তুলে দেবেন না। ঐ এক চ্যুতি চান্স যারা কাজে লাগায়, তারাই দুনিয়াদারি ভোগ করে।

গিয়ে দেখে, সিতারার অবস্থা সে যেমনটা কল্পনা করেছিল, ঠিক সেরকম। টিনের চাল সবকটা উড়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টি পরতেছে ঝমঝমিয়ে। তিন কিলো পথ— এই বৃষ্টির মধ্যে, ছাতা নাই লাইট নাই! কেমন ঘোরগ্রস্ত প্রেমিক, নিজেকে একটিবার চিন্তা করে দেখুক জুবেদ শেখ! যদি সে টর্চলাইট আনত, আলো ঘোরালেই দেখতে পেত সিতারার ধবধবে সাদা মাংসল একটা পা হাঁটুর নিচ থেকে অনাবৃত হয়ে দরজার চৌকাঠের বাইরে, কেবলি পা-খানি দেখা যাইতেছে আর বাকি শরীর ঘরের ভেতরে। অন্ধকারে ঘোর বৃষ্টির মধ্যে এই দৃশ্যটা কল্পনা করে জুবেদ শেখ কি কামাতুর হতে শুরু করবে! বাইরে ঘোর বৃষ্টি, ঠাণ্ডা ভেজা বাতাসে শরীরে তীব্র কাঁপুনি ধরার মতো অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু তার শরীরের ভেতর শূন্য নাড়াখেতে আগুন জ্বলবার পর, বাতাসের ঝাপটায় আগুনের শিখা লাফ দিয়ে দিয়ে জঙ্গলের দিকে ধাওয়া করবার মতোন দাবানল জ্বলছে কেন! কামের আগুন কি এতটাই শক্তিশালী যে ঝড়-তুফানে সর্বস্বান্ত হওয়া একটা নারীর অসহায়ত্বকে পর্যন্ত নিস্তার দেবে না!

সিতারাকে তার বাচ্চাসমেত তার রান্ধাঘরের লাকড়ি রাখার মেচাঙের নিচে ভেজা জবুথুবু অবস্থায় আবিষ্কার করার আগে আগে জুবেদ শেখ অন্য একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এই যে গহিন অন্ধকারের রাতে ঘোর বৃষ্টির মধ্যে, ঠাটা পরে নগদ কাঁচা টাটকা মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে, গোটা একটা জনমানবহীন এলাকায় সে যে একা এল, হাতে তাও কিনা একটা টর্চ পর্যন্ত নাই— এখন যদি সিতারার ঘর থেকে সিতারাকে তার বাচ্চাসহ কাঁচা খেয়ে ফেলার পর সিতারার রূপ ধরে এই এলাকার ভয়াবহ ডাইনটা বেরিয়ে আসে! অসম্ভব বলে তো কিছু নাই! কিয়ারি বলো আর ডাইন বলো— এদের শত শত নিষ্ঠুরতার কাহিনী কে না জানে! তার পাশের বাড়ির চাচা মন্তাজ মিয়া এই তো গত বছর শীতের এক সন্ধ্যায় পাহাড় থেকে আসার পথে রাস্তার পাশে পরে তার লাশ আবিষ্কার করেছিল গ্রামের মানুষ। হার্ট এটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, সাপের কামড়— এইসব কিচ্ছু না। লাশকে গোসল করানোর সময় দেখা গেল, মন্তাজ মিয়ার পিঠে টাটকা পাঁচ আঙুলের দাগ! এই দাগ যে মানুষের না সেইটা একটা দুধের বাচ্চাও বলে দিতে পারবে। হাতের থাবার মধ্যে যেন গনগনে গরম লোহার টুকরা ফিটিং করা। পাঁচটা আঙুল এমন গভীর হয়ে বসেছে, কাছে গেলে সেই ক্ষতের ভেতরটা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা গেল। লাল লাল মাংসের চাকা পিঠের ভেতরে বুদবুদের মতোন ভাসছে। এইসব দেখবার পর মানুষের হুঁশ কি আর জায়গায় থাকে! জুবেদ শেখ মুহূর্তের মধ্যে তাকে আটকে ফেলা ভয় কাটানোর জন্য চিৎকার করে সিতারার নাম ধরে নাম ডাকতে পারে, তার বাচ্চাদের নাম ধরে ডাকতে পারে! জানে সিতারার দাইদার স্বামী বাড়িতে নাই, হোক তার বয়সে অনেক বড়— তবু চিক্কার করে হুসমতের বাইচ্চা, দাইদার কুত্তার বাইচ্চা বলে ডাকতে পারে! কিন্তু সে এইসব কিচ্ছু না করে কেবল মুচকি একটা হাসি দিয়ে কেন বলছে— ‘আমি কিতা রহস্য উপন্যাস লিখতে বইলাম নি, ল্যাওড়া!’

সে জানে যে, ঝড়-তুফান, গুর্দা ফেটে যাওয়ার মতোন প্রচণ্ড ঠাডা পড়ার রাতে সে কেন, তার মৃত বাপ-চাচারা যদি জিন্দা ফিরে তাকে লাঠি তলোয়ারসহ ঘের দিয়ে সিতারার বাড়ির উদ্দেশে নিয়ে যায়, তবু সে যাবে না। যে মানুষ হালকা ঠাডা পড়লেই ঘরের ভেতর তাড়া খাওয়া মুরগির মতোন পড়িমরি করে ঢোকে— সে কিনা মাঝরাইতে ঘুটঘুটা অন্ধকার পাড়ি দিয়ে তিন কিলো পথ কোনো রকম লাইট টাইট না নিয়ে দৌড়তে শুরু করবে! আর তার বউ হাসনা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া তার স্বামীর গন্তব্যের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখবে!

প্রায় প্রতিবারই কাহিনীটা এই ঝড়-তুফানের রাইতে এসে আটকে যায়। সিতারার ঘরেতো চোইত মাসি দুপুরবেলাও যাওয়া যায়। টাটকা খিরা পিস পিস করে কাটা, সাথে নুন মরিচমাখা। মাটির ঘরের খোলা জানলা দিয়ে হু হু বাতাস এসে ঢুকছে, বাইরে রোদের মাতম। বিচনায় পাশাপাশি বসে তারা খিরা খেতে খেতে একে অপরে প্রচণ্ড তৃষ্ণা নিয়ে চাওয়াচাওয়ি করতেছে। এই দৃশ্য কি বেমানান কিছু! অথবা হাওনমাসি ঝিরঝির বৃষ্টি পরব পরব ভাব, এর আগে চানা ডাইল আর আটা নিয়ে সিতারার ঘরে গিয়ে হাজির হওয়া যায়— ঝুমঝুম বৃষ্টির দিন গরম পরোটা আর চানা ডাইল খেতে খেতে সিতারার রান্ধাঘরে বসে তার ব্লাউজ উপচেপড়া স্তন দেখবার দৃশ্যও তো কল্পনা করা যায়— যায় না! কিন্তু মাথায় এসে কবে যে এই বৃষ্টি, তাও মধ্যরাতের ঘুটঘুটা অন্ধকারের মধ্যে, এইসবের সাথে তার সবচাইতে আতঙ্ক যে জিনিসটায় সেই ঠাডা পড়াটাও মিলে গেল— এখন কোনোভাবেই সে এই দৃশ্যটাকে অতিক্রম করে যেতে পারছে না। বড় লেখক হলে নিশ্চই পারত। কিন্তু সে তো সামান্য গরুর দালাল। তার মাথায় আর কতটুকুইবা লোড নিতে পারে! ঝাড়তেও পারছে না। একটা দৃশ্যকে সেন্সর করার জন্য সে তুতবাড়ি বাজারের পুব পার্শ্বে নির্জন টিলাগুলোতে কয়েকদিন পর্যন্ত গেছে। যেখানে রয়েছে সিতারার একলা বাড়ি। এত নির্জনে কেউ থাকতে পারে না, থাকবার কথাও নয়— এইসব কঠোর কথা বলে সিতারার বাড়িকে কাছাকাছি বসতির ধারে-কাছে কোথাও আনতে চেয়েছে। কিন্তু সেটা আনতে গিয়ে দেখেছে, ঝামেলা কমার তো প্রশ্ন নাই বরং বাড়ার আশঙ্কাই বেশি। তখন করতে হবে কি— হুসমত দাইদারের চরিত্রটাও পালটে দিতে হবে। নির্জনতার মধ্যে সিতারার নিসঙ্গতার বেদনা গভীরভাবে অনুভব করা যায়। বসতিতে নিয়ে গেলে সিতারা আর সিতারা থাকবে না। পুরা কাহিনীটাই তখন মাঠে মারা যাবে। তার চেয়ে যতটুকু সে এগিয়ে নিতে পেরেছে ততটুকুই থাকুক। মনকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া তার হাতে আর কিছুই করার নেই। আছে কি?

হাসনা এইসব মরে গেলেও বিশ্বাস করবে না। একটা মানুষ যে দুই দুইটা জীবন যাপন করছে, এটা তার জ্ঞানে ধরবে না। আবার বিপরীতে যদি চিন্তা করা যায়, এই যেমন জুবেদ শেখ যদি মনে করে, হাসনার ভেতরেও যদি তার মতো আরেকটা জীবন বসবাস করতে থাকে! জুবেদ শেখের থাকলে হাসনার থাকতে অসুবিধা কোথায়! থাকতে পারে না! হয়তো এইভাবে পৃথিবীর অগুনতি মানুষ একসাথে দুইটা জীবন চালিয়ে নিতেছে। কে জানে?

একেকদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে এতক্ষণ যাকে খোয়াবে দেখেছিল, সেই লিচু গাছের ছায়াপড়া উঠান, ঝিরঝির মোলায়েম বাতাস, শীতল ছায়াপড়া ইন্দারার পাড়ে গোসলরত তাকে ডাক দিয়ে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে ডিম দিয়ে লাউয়ের ঝোল নিয়ে বসা ম্যাক্সিপরা সিতারা— মনে হয় সিতারা অনেক দূর থেকে তাকে ডাক দিচ্ছে, এত কাছে থেকেও অনেক দূরে শোনার কারণ সে ততক্ষণে ঢুকে গেছে আরেক ধান্ধায়, গরুর তিনটা চালান একটু পরে মুগরিব বাদ এসে ঢুকতেছে দশটেকি লাইন দিয়ে, তারা তিনজন পাইকারের সর্বমোট বিশটা মাল, তার একার সাতটা, ওপাড় থেকে ইমো ভিডিও কলে গরুগুলির সাইজ দেখে সে ভীষণ খুশি, এইবার ভালো একটা দান মারা যাবে, এইবার আর মিস করবে না, হুন্ডা কিনেই ছাড়বে, নতুন হুন্ডা নিয়ে তাতানো রোইদের নিচে দুই পাশে সারি সারি শাল গজার বনাক— এইসব অতিক্রম করে শূন্যে চিলের ডিগবাজি খাওয়ার মতোন ভো চু ত ভো চু ত… যাহ চ্ছালা! এই জুবেদ শেখ তখন কাউকে কেয়ার করে নাকি! হুন্ডা একটা লগে থাকলে তুমি এই যুগের রাজা! আজকাল ফইন্নির বাচ্চারাও হুন্ডা দৌড়ায়! সবজিওয়ালা, মাছের মাইমল, রাজমিস্ত্রির জুগালি, বুংগা কারবারি, হোটেলের মেসিয়ার, বিদেশ থেকে ক্যানসেলড দুম্বার রাখাল— কে চালায় না হুন্ডা! বিছরাইতে যেয়ে দেখা যাবে, একা এক ভোদাই মার্কা জুবেদ শেখই অবশিষ্ট রয়ে গেছে! অথচ যে কিনা লাখ লাখ টাকার কারবার করে! তার উড়ন্ত গতির পিছন থেকে সিতারা যে তাকে ডিম দিয়ে লাউ তরকারি গরমাগরম খেতে ডাকছে, মনে হইতেছে অনেক দূর থেকে তাকে ডাকতেছে, সে পষ্ট শুনতেছে আবার শুনতেছে না— এই বেটিমানুষের আবার বড় দোষের একটা হলো, একবার ডাকলে তার কাছে যাওয়া ছাড়া রেহাই দেবে না, অথচ হুন্ডার গতি এখন ফুল গিয়ারে, এখন কেবল বাতাসে শিস দিলে ‘টুনির মা’ গানটা শুনা যাবে, ও টুনির মা/ তোমার টুনি কথা শুনে না/ যার তার লগে/ ডেটিং মারে/ আমায় চিনে না… উ… এই সময় এই উরাধুরা সুখের সময় কেউ এসে ডাকাডাকি করলে মেজাজের কি আর গতি ঠিক থাকে! সে তখন ‘এই বেটি চুপ থাক’ বলে চড়া গলায় ধমক দিতে যাবে, আর এইটা করতে গিয়ে সে তখন নিজেকে আবিষ্কার করবে— নিজের বাড়ির বিচনায় শূন্যে হাত-পা ছুড়ে সে প্রায় আধো অন্ধকারে দুইটা জীবনের মাঝখানে এট্টু সময়ের জন্য হাঁসফাঁস করছে, বাচ্চার ঝাঁজাল মুতের গন্ধ ততক্ষণে তাকে আসল জীবনে ফিরিয়ে আনলে সে দীর্ঘশ্বাস লম্বা করে ফেলে আধো অন্ধকারে দেয়ালের কাছে খাড়া করে রাখা আলমারির উপর পড়ে থাকা হাসনার বিয়ের লাল ময়লা সুটকেসটাকে পাশ ফিরতে ফিরতে দেখবে, প্রায় অস্ফুট স্বরে সে তখন বলবে, ‘হালার জীবন! পুঞ্জির সামান্য ছফা কামলা মস্ত বড় গরুর দলাল অইতো চায়!’ বিড়বিড় করে না বললেও চলত, ততক্ষণে হাসনা ভইষের মতোন ঘুমে কাদা, ভুসভুস করে শ্বাস ফেলছে, শুনে ফেলার কোনো ডর নাই কিন্তু সে বিড়বিড় করবে, হাসনা শুনা না শুনা, সেটা বিষয় না, সে বিড়বিড় করবে এইজন্য যে আল্লাহ যাতে শুনতে পান, তার ধারণা আল্লাহ একদিন তার স্বপ্ন পূরণ করে দেবেন।

ঘুম ভাঙার পর সে শিথানের কাছে রাখা ডার্বি সিগ্রেটের প্যাকেটে পড়ে থাকা সর্বশেষ সিগ্রেটটা হাতড়ে হাতড়ে বের করবে, কাছাকাছি লাইটারটাও যাবে পেয়ে— এইসব নিয়ে আলগোছে বিবেচনা থেকে উঠে সে, যেহেতু আধো অন্ধকারে প্রায় সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে, যেহেতু সে মাত্র ছাব্বিশ বছরের টনকা যুবক, ছাপান্ন বছরের বুড়া নয়, প্রায় নিঃশব্দে, দেয়াল টেয়াল ধরবার কোনো প্রয়োজন আছে কি! দরজার ছিটকারিটাও তার হাতের পরশ জানে, টিকিটিকির লেজের বারি মারার মতোন ‘চটাস’ করে মৃদু-মন্থর একটা শব্দ তোলে সে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাবে, এই মধ্যরাতে। মাথার উপর বরাবরের মতোন ঝলমলে চন্নি, কোনদিন চন্নির তেজ থাকে প্রায় নিভু নিভু, ঝাপসা, আলো ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়ার মতোন। হেঁটে হেঁটে সে তার বাড়ির পুকুরপাড় পর্যন্ত যাবে, ঐটুকুই সীমানা। বরইগাছের ছায়ার নিচে। কোদাল দিয়ে দুইদিন পরপর চেঁছে দেওয়া একটুকরো জায়গা, যেখানে সে প্রতি রাতে এসে বসে থাকে। এখানে সে ততক্ষণই বসবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা, মনের যাবতীয় দুঃখ, বেদনা— এইসবের উপশম হবে।

সিতারার সাথে তার সম্পর্কটাইবা কেমন! মুখে সে বলতেছে, তার অত দায় নাই। ভালোবেসে যদি সিতারা শোকে দুখে আকুল হয়, সেইটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এমন কোনো দিন এমনকি আছে এমন কোনো মুহূর্ত— যেখানে সিতারা ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারে! এই যে মাঝরাতে বিছানায় বউ বাচ্চা ফেলে এই নিস্তব্ধ রাত্রির নিচে এসে প্রায় প্রতিদিনই পৃথিবীর সমস্ত মনুষ্য প্রজাতি যখন গভীর নিদ্রায় অতল সাগরের তলদেশে ডুবে গেছে, সে কেন একা একা, পুকুরপাড়ে, বরইগাছের ছায়ায়, নিঃসঙ্গ চন্নির নিচে!

সিতারার মনের হদিস তার দরকার নাই কোনো, তার দরকার টসটসে কাঁঠালের কোয়ার মতোন পেলব শরিলটা— এই কথা মুখে যতই বলুক, এই যদি হয়— তাইলে ভাই কেন দিনজুড়ে কেবল বেদনার ক্ষীরে ডুবে যাওয়া!

সে যে সিতারাকে পালকা মা বনিয়ে চটি বইয়ের অজাচারি কাহিনীর মতোন প্রতিটি মুহূর্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে, সারাদিনের ক্লান্তির ভারটাকে লাঘব করার জন্য এই যে একটু পরে বরই গাছের নিচে বসে বসে নিঃসঙ্গ খোলা চন্নি আর নিঃসঙ্গ সে নিজে, রিপুর তাড়নায় ধীরে ধীরে নিজেকে শিথিল করে দেবে— এইসব না-হয় ঠিক আছে— কিন্তু এইসবের বাইরেও সিতারা কেবল একটা নারী হয়ে কি তাকে ইদানীং অনেকটা জায়গাজুড়ে বসছে না! আজকাল প্রায়ই একটা দৃশ্য দেখে সে, সিতারা আর সে লোকাল ট্রেনে চড়ে দূরে যাচ্ছে কোথাও। একসময় দেখা গেল, সিতারার বাদাম খাওয়ার ইচ্ছা হলে জুবেদ শেখ তাকে বাদাম কিনে দিচ্ছে, সেই বাদাম ভেঙে ভেঙে সিতারা খাইয়ে দিচ্ছে জুবেদ শেখকে। জাোলার বাইরে থেকে দমকা হাওয়া এসে সিতারার আচমকা খোঁপা ভেঙে চুলের বাঁধ খুলে দিলে জুবেদ শেখের চোখেমুখে রেশমি চুলের এমন মোলেম পরশ লাগছে! তার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সৌন্দর্য বড় ক্ষণস্থায়ী! আহা বড় ক্ষণস্থায়ী!

ইদানীং বরইগাছের নিচে এই মধ্যরাতে এসে সে বসে ঠিকই, কিন্তু এমনও দিন আছে যে, যে কাজের জন্য সে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে, দেখা যাচ্ছে কোনো কোনোদিন সে শরীর শিথিল করার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। যে ঘোরের মধ্যে সে থাকে, দেখা যেত, প্রায়ই সে ঝুপ করে গা ডুবিয়ে ঘরে ফিরে, মাঝে-মধ্যে তার বউ হাসনা তাকে ভেজা অবস্থায় দেখে বিরক্ত হয়ে যায়, ঘুরে-ফিরে ঐ কিছু কথাই বলে, ‘বউ তো ডেইট ওভার অই গেছে! পুরান জুতা আর পিন্দা যায় নি!’ অথবা ‘সংসারও বাসি অই গেলে আর দাম থাকে না’! শেষের বাক্যটা কেবল একটাই থাকে ‘স্বপ্নদোষে সুখ নেও!’

কিন্তু এই রুটিনগুলোতে ইদানীং ছেদ পড়তেছে। সে বরইগাছের নিচে বসতেছে ঠিকই, কিন্তু যে সিতারাকে পালকা মা বানিয়ে রতিক্রীড়া করত, দেখা যাইতেছে সিতারা ঐ পালকা মা’র চরিত্র ছেড়ে নিঃসঙ্গ, অসুখী এক গিরস্ত বউয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেছে। জুবেদ শেখের ঘোর তখন আরেকটা কাহিনী তৈরি করে নেয়। সে চোখের সামনে দেখতেছে এই চন্নি রাইতের অসীম নির্জনতার মধ্যে, সে একা পুকুরপাড় ধরে ধরে শুকনো পাতাছাতা মাড়িয়ে মরমর শব্দ তুলে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে।

গন্ত্যব্য সিতারার বাড়ি। দূর টিল্লার উপরে একা একটা ঘর। যেখানে এই মাঝরাতে একা একটা নারী তার ঘরের জানলা খুলে চন্নির আলোর মধ্যে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

কৃষ্ণচূড়া

Read Next

ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ : ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *