অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রণিত ভৌমিক -
ক্রাইম ফাইলস : কেসেস অফ সিরিয়াল কিলিং
কেস নম্বর-১ : বোলপুর ডায়েরিজ

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

খুন! হ্যাঁ, আবারও খুন। পঁচিশে বৈশাখের দিন ফের কোপাই নদীতে দেখা গেল এক বছর পাঁচেকের শিশুর মৃতদেহ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশুটি সদ্য বিশ্বভারতীতে আসা সাহিত্যের অধ্যাপক ড. রাজেন দত্তের একমাত্র সন্তান। প্রত্যেক বছর এই দিনে শিশুহত্যার ঘটনা বারবার ঘটতে থাকায়, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় লোকেদের মনে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। উত্তেজনা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বোলপুরজুড়ে। কিন্তু কে বা কারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা পুলিশের কাছে আজও অজানা।

—বন্ধ কর। টিভি দেখা বন্ধ কর। এই সমস্ত খবরের চ্যানেলের জন্য মানুষ পুলিশের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে, এরা যেন পুলিশকে অক্ষম প্রমাণ করা ছাড়া আর কিছুই পারে না করতে। ওদের টিআরপি এই করেই বাড়ে।

—ওরে গুপ্ত, এইভাবে অন্যকে দোষারোপ করে আর কতদিন চলবে বলত! কিছু অপদার্থ পুলিশ কর্মীর কারণে আমাদের গোটা ডিপার্টমেন্টটা বদনাম হয়ে যাচ্ছে।

আমার দিকে তাকিয়ে গুপ্ত বলল, হুম, সেটা তুই ঠিকই বলেছিস। আসলে কয়েকটা কেসে পলিটিকাল অ্যাঙ্গেলটা এমনভাবে কাজ করে যে অনেক সময় আমাদেরও হাত-পা বাঁধা পড়ে যায়।

গুপ্তকে এরপর কিছুটা চুপ করে বসে থাকতে দেখে আমি বলতে লাগলাম, আমার কিন্তু কেসটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছে। ছোট্ট শিশুদের মেরে কোপাই নদীতে ফেলে দিচ্ছে তাও আবার পঁচিশে বৈশাখের দিন। এর পেছনে কী হতে পারে বলত?

আমাকে থামিয়ে গুপ্ত বলে উঠল— এই দাঁড়া, এতে আবার তুই নাক গলাতে যাস না। সবে নর্থ বেঙ্গলের কেসটা মিটিয়ে ফিরেছিস। এখন এইসব নিয়ে তাই আর মাথা ঘামাস না।

আমার আর গুপ্তর কথোপকথনের মাঝেই ফোনটা বেজে উঠল এবং ফোন কলটা রিসিভ করতেই অপ্রান্ত থেকে এসপি সাহেবের গলার স্বর ভেসে এল— সুমন, খুব দরকারে তোমাকে কল করলাম। আসলে এমন একটা ক্রাইসিসের মধ্যে পড়ে গেছি যে তোমায় কী বলব!

আমি সেই মুহূর্তে ওনাকে বললাম, কী হয়েছে স্যার? আমায় বলতে পারেন। আপনার ক্রাইসিস মানে তো আমাদেরও ক্রাইসিস। সুতরাং আপনি বিনা দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন।

—ইয়েস, মাই ডিয়ার। কিন্তু তুমি সবে তদন্ত শেষ করে নর্থ বেঙ্গল থেকে ফিরেছ তাই আবার তোমাকে কোনো কিছুতে জড়াতে একটু দ্বিধাবোধ করছি।

—আপনি প্লিজ এইভাবে বলবেন না স্যার। আমাদের কাজই হল মানুষের সেবায় নিজেদের সর্বদা নিযুক্ত করা।

—ওকে। তুমি তাহলে আজ বিকেলের দিকে ভবানী ভবন চলে এসো। আমার চেম্বারে বসেই সমস্ত কথা হবে।

—ওকে, স্যার।

এই বলে আমি ফোনটা রাখার পর পাশ থেকে গুপ্ত আমার উদ্দেশ্যে বলল, আবার নিশ্চয়ই কোনো কেস নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তাই তোকে ডেকে পাঠাল। উপফফ! যেমন তুই, তেমন স্যার। না, এইবার দেখছি কাকিমাকে বলে তোর বিয়েটা দিয়ে দিতেই হচ্ছে।

কথাটা শুনে আমি হেসে উঠলাম। সেই সঙ্গে বললাম, হা হা হা! তাহলে বারুইপুর থানার ওসি বিনয় গুপ্ত, কি এবার পুলিশের চাকরি ছেড়ে ঘটকালির কাজ করবে ভাবছে?

একটু রেগে গুপ্ত বলল, মস্করা করিস না, সুমন। লাইফে সবাই সেটেল হতে চায়। কাকিমার বয়স হচ্ছে সুতরাং সেদিকটাও তো তোকে দেখতে হবে নাকি!

এই শেষের কথাটা কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও আমায় আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। হ্যাঁ, কারণ আজও আমি পিয়ালিকে নিজের মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারিনি। কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে আইপিএস পরীক্ষা দেওয়া, সর্বদাই ওকে আমার পাশে পেয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ গোয়েন্দা বিভাগে কর্মী রূপে নিয়োগ হওয়ার পর থেকে ওর মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম। নিজের কাজের প্রতি এতটাই দায়বদ্ধ হয়ে পড়লাম যে বাকি সম্পর্কগুলোকে সেই অর্থে সময় দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। ফলে, যা হওয়ার সেটাই হলো। প্রথমে একে অপরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, তারপর দূরত্ব সৃষ্টি এবং সর্বশেষ চিরজীবনের জন্য সম্পর্ক বিচ্ছেদ।

গাড়ি ড্রাইভ করে যখন দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়ে ভবানী ভবনের দিকে যাচ্ছি, তখন রেডিও বাজছিল ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি আর গ্রীষ্মের ওই পড়ন্ত বিকেলের মনোরম হাওয়ায় মনটা যেন এক মুহূর্তও চুপ করে বসে থাকতে চাইছিল না। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ডানা মেলে উড়ে বেরাতে চাইছিল। কলকাতাকে বহুবার বহু নামে ডাকা হয়— ‘সিটি অব প্যালেস’ বা ‘সিটি অব জয়’ কিন্তু এর মধ্যেই আমি খুঁজে পাই কলকাতার প্রকৃত নাম— ‘সিটি অব টেগোর’।

যাই হোক, ভবানী ভবনে পৌঁছানোর পর আমি সোজা এসপি সাহেবের ঘরে ওনার সঙ্গে দেখা করতে ঢুকলাম। আমাকে দেখে উনি একগাল হাসি নিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস, সুমন। তুমি না এলে আমি সত্যি চাপে পড়ে যেতাম। বীরভূমের একটা কেস নিয়ে বলতে পারো আমাদের গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নাজেহাল হয়ে আছে।

আমি কৌতূহলপূর্বক প্রশ্ন করে বসলাম, কোপাই নদীর বিষয়টা নিয়ে কি স্যার?

—ইয়েস, ইয়েস! ওই কেসটাই। নিউজ মিডিয়া যেভাবে আমাদের দিকে আঙুল তুলছে, তাতে মিনিস্ট্রি লেভেল অবধি সবাই বিরক্ত। উপর মহল থেকে চাপ আসছে সুতরাং এই কেসটা এবার ক্লোজ করতে হবেই। আর তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো।

—স্যার, কাকতালীয়ও ভাবে আজ সকালে নিউজ চ্যানেলে খবরটা দেখা মাত্র আমি আর আমার আরেক পুলিশ বন্ধু বিনয় গুপ্ত ঠিক এই কেসটা নিয়েই কথা শুরু করেছিলাম। যেটুকু জেনেছি, তা থেকে বলতে পারি কেসটা আমার ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছে।

—ইয়েস, বাট সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় কি জানো? বিগত কিছু বছর ধরে প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখের দিন কোপাই নদীতে যে সকল শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাদের বুকে খোদাই করে কেউ লিখে যায় রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার প্রথম দুটি লাইন— ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

—মাই গড! কী বলছেন স্যার?

—ইয়েস, সুমন। পঁচিশে বৈশাখ, বছর পাঁচেকের শিশু, কোপাই নদী, রবীন্দ্রনাথ এবং তার এই কবিতার দুটি লাইনই হলো এই কেসের কমন ফ্যাক্টর।

—কিন্তু স্যার, প্রত্যেক বছর খুন হচ্ছে অথচ বোলপুরের পুলিশ আজও এই কেসের কিনারা করতে পারছে না? এক একটা মৃত্যু সঠিকভাবে ট্র্যাক করলে কিছু তো সূত্র পাওয়া যাবে।

—হ্যাঁ, ওরা এই কমন ফ্যাক্টরগুলো খুঁজে বের করেছে। আর তাছাড়া তুমি তো জানো, বীরভূম যেমন নানান ধর্মীয় স্থান সহ কবিগুরুর জন্য বিখ্যাত একইভাবে রাজনৈতিক নানান কর্মকাণ্ডের জন্যও বটে। সবসময় খবরের শিরোনামে থাকে উত্তেজনাপূর্বক জেলা বীরভূম।

—স্যার, আমি মানছি আপনার কথা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এই কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলা খুনির মোটিভ বোঝার জন্য এই কয়েকটা কমন ফ্যাক্টর জানলেই শুধু হবে না। আমার মনে হচ্ছে আরও কয়েকটা বিষয় আছে যা আমরা ধরতে পারছি না। সুতরাং এই কেসটায় হাত দেওয়ার আগে আমার আরও অনেক ইনফরমেশন লাগবে।

—বেশ, ঠিক আছে। কি প্রয়োজন তোমার আমাকে বলতে পারো। যে কোনো সময়, যে কোনো মুহূর্তে।

—থ্যাংক ইউ, স্যার। তাহলে আগামীকাল সকালেই আমি বোলপুরের উদ্দেশে রওনা হতে চাই। আপনি প্লিজ সব ব্যবস্থা করে ফেলুন। সেই রবীন্দ্রনাথপ্রেমী ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়ার লোভ আমি আর সামলাতে পারছি না।

—ওকে, সুমন। তোমার কথামত আমি বোলপুর থানায় জানিয়ে রাখছি। আশা করি ওদের থেকে তুমি সবরকম সাহায্য পাবে। ওখানকার দায়িত্বে থাকা ওসি খুব ভালো মানুষ। এতদিন এই কেসটা ওই দেখছিল।

কথাটা শুনে নিজের মনে হেসে বললাম— ভালো মানুষ হতে নয়, ভালো অফিসার হতেই আমার এই ডিপার্টমেন্ট জয়েন করা।

যাওয়ার আগে স্যার বললেন, আমার সঙ্গে রোজ ফোনে যোগাযোগ রেখো, সুমন। অ্যান্ড উইশ ইউ অল থে বেস্ট।

ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললাম— অবশ্যই স্যার। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ।

পরদিন ভোরবেলা অফিসের গাড়িতেই রওনা দিলাম বোলপুরের উদ্দেশ্যে। প্রায়শই লাল মাটির দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হয় এই বীরভূমকে। সেই লাল মাটির পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে বোলপুরের দিকে।

‘বোলপুর’ নামটি ‘বোলি-পুর’ শব্দটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘বোলি’ শব্দের অর্থ হলো ‘বধ’ এবং ‘পুর’ শব্দের অর্থ হল ‘শহর’। বীরভূম জেলার একটি মহকুমা শহর ও পৌরসভা এলাকা এই বোলপুর। প্রধানত, এই স্থান বৈচিত্র্যময় ভূসংস্থানের পাশাপাশি চমৎকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। ইতিহাসে বীরভূম জেলায় একাধিকবার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এই জেলার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান।

বোলপুর পৌঁছে আগে পুলিশ কোয়ার্টারে গিয়ে উঠলাম এবং তারপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বোলপুর থানার উদ্দেশ্যে। বোলপুর থানা মূলত বোলপুর শ্রীনিকেতন সমষ্টি উন্নয়নের ব্লকের অন্তর্গত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে থাকে। আর এই থানার অধীনেই রয়েছে সেই কোপাই নদীর উল্লেখিত স্থানটি।

বোলপুর থানার ওসি প্রতাপ মাঝিকে প্রথম দেখে মনে হল বড্ড ভীতু গোছের লোক। আর এই অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হল যত আমাদের মধ্যে এই কেস নিয়ে কথাবার্তা এগোল।

—দেখুন, স্যার। এমনিতে বোলপুর ও এখানকার সংলগ্ন এলাকাগুলো হামেশা কিছু না কিছু নিয়ে খবরের শিরোনামে থাকে। কখনও বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ ঝামেলা নয়তো এখানকার সমাজবিরোধী লোকেদের কার্যকলাপের কারণে। তাই অনেক সময় উপায় নেই দেখে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করি। তবে, আপনি যেই কেসের তদন্ত করতে এসেছেন, এটা বড্ড আলাদা।

—আলাদা বলতে? (আমার প্রশ্ন)।

—আরে, স্যার। হিন্দি সিনেমা দেখেন তো? অনেকটা সিরিয়াল কিলিংয়ের মতো বিষয়। প্রত্যেক বছর একটা করে শিশুকে মেরে নদীতে ফেলে যাচ্ছে আর বুকে লিখে যাচ্ছে রবি ঠাকুরের ওই কী একটা কবিতার আছে যেন, তার দুটো লাইন।

—আপনি এই কেসের দায়িত্বে ছিলেন তো? তা কবিতার লাইন দুটো মনে নেই? ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে; বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই দুটো লাইন। আসলে নানান কাজে থাকি তো, তাই পেটে আসছিল মুখে আসছিল না।

—বুঝলাম, তা প্রত্যেক বছর যে মৃত্যুগুলো হয়েছে তার এফআইআর বা জিডি রিপোর্টগুলো দেখা যায় কি?

আমার কথা শেষ হতেই ওসি প্রতাপবাবুকে কিঞ্চিত দ্বিধায় পড়ে যেতে দেখলাম এবং এদিক-ওদিক তাকে চাইতে দেখে আমি ফের বললাম, কোনো কেস ডায়েরি আছে কি? তৈরি করেছেন?

আমার কথাটা শুনে তাকে ওমনি একগাল হাসি নিয়ে বলতে শুনলাম, আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার। সেটা আছে।

এই বলে মহাদেব ওরফে হেড কনস্টেবলকে সে নির্দেশ দিতেই মহাদেব একটা খাতা এনে আমার হাতে তুলে দিল। সেই খাতা খুলে বুঝলাম কাজ যতটা হওয়ার তার অধিকাংশই বাকি রয়ে গেছে। একটা প্রকৃত কেস ডায়েরি বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা একেবারেই আমার মনে হলো না। ফলে, আমি বললাম, প্রতাপবাবু, আপনাকে আমি একটা গোটা দিন দিচ্ছি। আগামীকালের মধ্যে যে করে হোক ডায়েরিতে লেখা প্রত্যেকটা মৃত শিশুর বাড়ির ঠিকানা এবং তাদের বাড়ির লোকেদের সমস্ত ইনফরমেশন আমাকে এনে দিন। এই কেসের মীমাংসা করতে হলে এই সমস্ত তথ্য আমার ভীষণ প্রয়োজন।

কাঁচুমাচু মুখে প্রতাপবাবুকে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে দেখলাম, ঠিক আছে, স্যার।

থানা থেকে বেরিয়ে আমি আর তখন পুলিশ কোয়ার্টারে না ফিরে, চলে গেলাম সোজা গাড়ি নিয়ে কোপাই নদীর পারে। হ্যাঁ, যেই নদীকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এখানে আমার প্রতিবেশিনী কোপাই নদী’। আঁকাবাঁকা বয়ে চলা কোপাই সত্যিই এমন এক জলধারা যার মোহে ধরা দিয়েছেন স্বয়ং কবিগুরুও। বোলপুরের লালমাটিকে সাক্ষী রেখে, তরুবিরল অঞ্চলের সিঁথি হয়ে যুগ-যুগ ধরে বইছে এই নদী। কোপাই যে নদীটির উপনদী, সেই ময়ূরাক্ষী নদীতে বইছে ত্রিকুট পাহাড়ের প্রাণোচ্ছলতা। আঁকাবাঁকা চলনে বহু মানুষের জীবনযাপনের শরিক হয়ে কোপাই শান্তিনিকেতন, লাভপুর আর কঙ্কালীতলা দিয়ে নিজের গতিপথ এঁকেছে। আঞ্চলিক নাম শাল। কিন্তু এক অদ্ভুত প্রেমময়তার জন্যে কোপাই নামটি বহুল ব্যবহৃত। গ্রীষ্মে শান্ত, লাজুক মেয়ের মতন এই নদী স্বল্পবাক।

সেতু দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা রঙচটা মুচড়ে পড়ে টিনের বোর্ড আর তাতে লেখা রয়েছে কোপাইকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত পদ্যটির লাইন দুটো— ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে; বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’।

ওই মুহূর্তে কেন জানি না চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ানক দৃশ্য। জলের পরিবর্তে নদী তখন রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে ভাসছে মৃত শিশুদের মুখ।

মাথা ঘুরে কখন যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলাম, তার হুঁশ ছিল না। হ্যাঁ, কারণ রবি ঠাকুরের এই নদীকে কেন্দ্র করেই বিগত কিছু বছর ধরে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত রহস্য, এতগুলো শিশুর মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গেছে।

—স্যার, শুনতে পাচ্ছেন? ও স্যার…।

দূর থেকে কার যেন আওয়াজ শুনতে পেলাম, তখনও সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরেনি। তারপর চোখে জলের ঝাপটা পড়তেই ধীরে ধীরে চেয়ে দেখি সামনে আমার গাড়ির ড্রাইভার সুশান্ত দাঁড়িয়ে।

—স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?

—হ্যাঁ, কিন্তু আমি…।

আমাকে কথাটা শেষ করতে দেওয়ার আগেই সুশান্ত বলে উঠল, আপনাকে দূর থেকে হঠাৎ করে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এলাম এবং অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করেও যখন আপনার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না, শেষে তাই জলের ঝাঁপটা মেরে আপনার জ্ঞান ফেরালাম।

—একটু জল হবে সুশান্ত?

—আজ্ঞে, স্যার। আমার কাছে যা জল ছিল সবটাই তো শেষ। তবে, সামনে মনে হচ্ছে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে জল অবশ্যই পেয়ে যাব।

—বেশ, চল তাহলে।

আমাকে ধরে তুলল সুশান্ত। জামা-প্যান্টে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে হাঁটতে লাগলাম সেতুর ওপর দিকের সেই দোকানটার দিকে। টিনের ছােউনি দেওয়া এক বয়স্ক লোক দোকান থেকে মাথা বের করে বলল, বাবু, চা দিব নাকি কফি?

—না, না। তুমি চা-ই দাও। তবে, তার আগে একটু জল হলে ভালো হয়।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিন না।

এই বলে তাকে একটা জলের বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিতে দেখলাম এবং সেই জলের দ্বারা নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে একটু বসলাম। চায়ে তখনও ঠোঁট ভেজেনি। পড়ন্ত বিকেলে ওই কোপাই নদীর ধারে এক বাউল গাছের তোলায় বসে গান ধরল—

মানুষ বড়ই স্বার্থপর রে, বড়ই স্বার্থপর;

বুকের মাঝে জায়গা দিলে যতন কইরা ভাঙেরে অন্তর।

আহা! সেই গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। পুলিশ কোয়ার্টারে ফিরে আসার পর রাতে কয়েকটা কাজ নিয়ে বসেছিলাম এবং কাজ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা আর বুঝতে পারিনি।

পরদিন সকালে তৈরি হয়ে থানায় ঢোকার পর দেখি আগের দিনের চেয়ে সেদিন সবাই বেশ নিজের কাজ সম্বন্ধে যথেষ্ট তৎপর। কিছু বলার আগেই ওসি প্রতাপ মাঝি আমার টেবিলের উপর একটা ফাইল রেখে বলল, স্যার, আপনার কথামতো মৃত শিশুদের পরিবারের সকলের নামসহ ঠিকানা এবং কে কী করে, তার সমস্ত ইনফরমেশন সংগ্রহ করে এর মধ্যে রেখেছি। আপনি দেখে নিতে পারেন।

—গুড। এমন কাজই তো আপনাদের কাছে প্রত্যাশিত, প্রতাপবাবু।

আমি ফাইলটা খুলে মন দিয়ে সেই সকল তথ্য খুঁটিয়ে পড়তে লাগলাম এবং যত এগচ্ছি ততই যেন বিস্মিত হচ্ছি। প্রত্যেকটা শিশুর বয়স বছর পাঁচ থেকে ছয়ের মধ্যে। আর তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হলো তাদের প্রত্যেকের পরিবারের কেউ না কেউ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এখনও যুক্ত বা যুক্ত ছিলেন।

লিস্ট মিলিয়ে দেখা গেল যে প্রথম পাঁচ বছরে যেই শিশুদের খুন করা হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্য হচ্ছেন— মি. সান্যাল, মি. পাইন, মি. চট্টরাজ, মি. পাত্র ও মি. গুহ। এনারা প্রত্যেকেই বছর পাঁচেক আগে রিটায়ার করেছেন। মি. পাইন, মি. চট্টরাজ ও মি. পাত্র তো মৃতের দাদু। আর বাকি দুজন অর্থাৎ মি. সান্যাল ও মি. গুহ ছিলেন মৃতদের জ্যাঠা ও মেসোমশাই।

ইনভেস্টিগেশন শুরু হলো এবং আমরা একে একে পৌঁছে গেলাম মি. সান্যাল, মি. পাইন, মি. চট্টরাজ, মি. পাত্র ও মি. গুহর বাড়ি। বলে রাখি, এনাদের প্রত্যেকের বাড়ি বীরভূম জেলার মধ্যেই। পর পর পাঁচদিন পাঁচজনের জবানবন্দি নিয়ে যখন ষষ্ঠ দিনের মাথায় থানায় আমি আর ওসি প্রতাপবাবু বিশ্লেষণ করতে বসলাম, তখন একটা ব্যাপার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলো যে প্রত্যেকের বাড়িতে পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন কোনো এক সেলসম্যান রবীন্দ্রনাথের মূর্তিসমেত সহজ পাঠ বই বিক্রি করতে গিয়েছিল এবং যথাযথভাবে বাচ্ছাদের সঙ্গে ভাব জমায় আর এরপরই অদ্ভুতভাবে শিশু সমেত সেই ব্যক্তি কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যায়। পরদিন অর্থাৎ পঁচিশে বৈশাখের সকালে কোপাই নদীতে সেই বাচ্ছার মৃতদেহ দেখা যায় এবং বুকে সেই দুটি লাইন, যা সহজ পাঠ বইয়ের কবিতার একটি অংশ।

—স্যার, এদের ব্যাপারে তো অনেক জানা হলো, এবার বাকিদেরটা আগামীকাল থেকে শুরু করে দিই নাকি?

ফাইলের পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে বললাম— এত তাড়াহুড়ো করছেন যে প্রতাপবাবু? এদের ব্যাপারে কি আপনার সবটা বোঝা হয়ে গেছে?

আমার প্রশ্ন শুনে তাকে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলতে শুনলাম, হে-হে! কী যে বলেন, স্যার। আমি যদি সব বুঝে যেতাম তাহলে আজ আপনার জায়গায় আমি হতাম। আমি অত বুদ্ধিমান নই আপনার মতো। আর তাছাড়া এই চাকরি পেয়েছি আমাদের গ্রামের প্রধানের সুপারিশে।

ফাইলের ফাঁক দিয়ে এবার তার দিকে তাকিয়ে বললাম— ও আচ্ছা! তা আপনাদের গ্রামটি কোথায়, প্রতাপবাবু?

—আজ্ঞে, স্যার। আমাদের গ্রাম ওই লাভপুরের দিকে।

—বুঝলাম। তা সেই মহান গ্রামের প্রধানের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হলে ভালো হতো।

—একী! না, মানে কেন স্যার? ওনার সঙ্গে কী দরকার? এই কেসের সঙ্গে তো উনি কোনোভাবেই জড়িত নন। তাহলে?

এইবার আমি ফাইল হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বললাম, না, ভুল। আমার মনে হয় আপনাদের প্রধান একটু হলেও জড়িত থাকতে পারে।

—একী, স্যার। এটা কী বলছেন? কীভাবে সম্ভব?

—দেখুন, আপনাকে প্রধান মশাই সুপারিশ দ্বারা পুলিশের ওসি বানিয়েছে এবং এই কেসটা প্রথমে আপনিই দেখছিলেন। তাহলে?

কাঁচুমাচু মুখে বলল ওসি— কী তাহলে, স্যার?

—ওই যে মিলল একটা যোগসূত্র। অতএব একটু হলেও আপনাদের প্রধান এই কেসের সঙ্গে জড়িত। বুঝলেন?

আবারও হেসে ওসি বলল— হে হে স্যার, এটা আপনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন।

—যাক! বুঝেছেন। আপনার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে, দেখছি। একটু আগে তাহলে অমন বিনয়ী হচ্ছিলেন কেন?

—না, মানে…।

—আর মানে জেনে কাজ নেই, প্রতাপবাবু। আমি বেরোলাম। কোনো দরকার হলে ফোনে আপনাকে জানাব।

কথা শেষ করে আমি থানা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম আবারও কোপাই নদীর ঘাটে। সেতু পেরিয়ে সেই চায়ের দোকানে এক কাপ গরম চায়ে নিজের ঠোঁট ভেজাতে ভেজাতে বাউল গান শোনাটা যেন আমার এই কদিনে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

হাসতে শিখায় যেই মানুষটা তার হাসি নেয় কেরে

সুযোগ পাইলে বিষ ঢেলে দেয় সাজানো সংসারে

যারে তুমি ভাবো আপন তার তো নাই তোমায় প্রয়োজন

তোমার বুকে রাইখা মাথা খুঁড়তাছে কবর রে

খুঁড়তাছে কবর

মানুষ বড়ই স্বার্থপর রে, বড়ই স্বার্থপর

বুকের মাঝে জায়গা দিলে যতন কইরা ভাঙেরে অন্তর।

গানের মাঝেই আমাকে তার দিকে এগোতে দেখে সেই বাউল গান থামিয়ে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? রোজ আমার গান শোনেন একই সময় একই স্থানে এসে?

উত্তর দিলাম— আমি আইপিএস সুমন চৌধুরী। গোয়েন্দা বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।

—সাহেব, আমি মূর্খ মানুষ। সারাদিন গান গেয়ে বেড়াই। তাই আমার কাছে ওই নামটাই যথেষ্ট। আপনার মতো গুণীজন আমার গান শোনে রোজ এসে এটাই আমার পরম প্রাপ্তি।

—আরে, না, না! ওইভাবে বলবেন না। আপনি সত্যিই ভালো গান।

—ধন্যবাদ, সাহেব। আসলে এই স্থানে গান ছাড়া আর কিছুই শোভা পায় না। এই স্থান কবিগুরুর স্থান। বাংলা মাটির গানের স্থান। কিন্তু মানুষ আর কদর দেয় কোথায়? গল্পে কাব্যে পড়া বাঁশবাদি গ্রামের কন্যেদের মনে পড়ে? কোপাই ঠিক তাদের মতো। আপাত শান্ত, কিন্তু মাঝে মাঝে বন্যা আসে। সব ভাসিয়ে কোপাই তখন নিজের খেয়ালে ভাঙতে থাকে চারপাশ। ভাঙনের সময় না এলে চেনাই সম্ভব না কোপাইকে।

—আপনি কোপাই নদীকে খুব ভালোবাসেন তাই না?

মৃদু হেসে বলল বাউল— হ্যাঁ, সেই ছোট্ট বয়স থেকেই এটা মোর বাপ-মা।

এরপর থেকে ফের বলতে দেখলাম— জানেন সাহেব, বেশ কিছু বছর আগে পর্যন্তও কোপাই এবং আঞ্চলিক বসবাসকারীদের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল, সেটায় এখন বড়সড় ফাটল দেখা দিয়েছে। আজ মানুষ জীবন যাপনের জন্যে কোপাইয়ের ওপর আর নির্ভরশীল নয়। বলা ভালো, তাদেরকে নদীর সঙ্গে লেপ্টে থাকা জীবনযাপন ত্যাগ করতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছে। অবহেলায় নদীর জলে দূষণ বেড়েছে। রুদ্ধ হয়েছে তার স্বাভাবিক গতিপথও। যে কোপাইকে নিয়ে সাধারণ মানুষেরা বছরের নানান সময়ে উৎসবে মেতে থাকত, আজ সেই প্রাণে কিছুটা স্তিমিত হয়েছে আলোর উচ্ছলতা।

—সরকারকে জানাননি আপনারা? এই ঐতিহ্যকে তো বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কেবল একটা শ্রেণির মানুষের নয়। বরং সবার। বাউল সমাজও তো নেহাত ছোট নয়। অভিযোগ জানালে নিশ্চয়ই তার সমাধান হবে।

—হাসালে গো, সাহেব। আমাদের বাউল সমাজের মধ্যেও যে দল ভাগাভগি রয়েছে। কেউ সরকারের হয়ে কথা কয়, তো আবার কেউ তাদের বিরোধীদলের হয়ে। আখিরে কোপাই রয়ে গেছে একই অবস্থায়, ধ্বংস অবস্থায়। কোপাইয়ের ধারে অসংখ্য ইটভাটা তৈরি হওয়ার ফলে বিপুল প্রভাব পড়েছে তার জীববৈচিত্রে, পলিমাটির প্রকৃতিতে। নদীর দু’ধারেই বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ ভয়াবহ রকমে বেড়েই চলেছে। এরই সঙ্গে সমস্যা আরও গভীর করেছে নদীর ওপরে বাঁধ, যা নদীর সংস্কারের কাজ ব্যাহত করেছে। চারিপাশের পরিবেশ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আঞ্চলিক মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, সবাইকেই সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

—বুঝলাম কিন্তু…।

আমাকে কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে দিল না সেই বাউল। মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওইসব কথা থাক। আজ আমি চলি সাহেব। তবে, যাওয়ার আগে একটাই কথা বলে যাব। কোপাই বেঁচে থাকবে রবি ঠাকুরের লেখায়, মোদের সুরে ও গানে।

—আচ্ছা, আপনার নামটা জানা হলো না। আপনার নাম?

পেছন ফিরে তাকে বলতে শুনলাম, কোপাই নদীর ঘাটে মোর বাস, অধমের নাম বাউল নির্মাল্য দাস।

একতারা হাতে সেই বাউল তারপর যেন অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আলোয় মিশে গেল কোপাই নদীর পারে। তাকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না। দিনের শেষটা যেন আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে গেল ওই মানুষটির সৌজন্যে।

—হ্যালো, স্যার। আমি ওসি প্রতাপ মাঝি বলছি। আপনাকে এত রাতে ফোন করার জন্য আমি দুঃখিত।

—না, ঠিক আছে। বলুন।

—আসলে স্যার, আগামীকাল ভোরে আমাকে একটু অন্য একটা কাজে বেরোতে হবে তাই আপনার সঙ্গে আমার পরিবর্তে হেড কনস্টেবল, মহাদেব থাকবে।

—সে ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন, সেটা বলা যায় কি?

—হ্যাঁ, আপনাকে না বলার কি আছে স্যার, আসলে গরু পাচারকাণ্ডে এখানকার দাপুটে নেতা যতই হাজতে থাকুক, বীরভূম জেলায় এখনও গরু পাচারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত শনিবারই গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল লাভপুর থেকে। পাশাপাশি বাজেয়াপ্ত করা হয় ২৮টি গরু। অতএব আগামীকাল দ্বিতীয় শুনানির জন্য ধৃতদের রামপুরহাট মহকুমা আদালতে পেশ করতে হবে।

সবটা শুনে বললাম, বেশ। আপনি ওদিকটা ভালো ভাবে মেটান। আমি এই ব্যাপারটা দেখছি।

ফোনটা রেখে দেওয়ার পর আর কিছুতেই ঘুম এল না। বিছানার পাশে থাকা স্টাডি ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে একটা বই নিয়ে বসলাম। আমার চোখ যতই বইয়ের পাতায় থাকুক না কেন, মন কিন্তু ছিল অন্য জায়গায়।

হ্যাঁ, কেসটা নিয়ে আমি আবারও রাতেই পড়াশোনা শুরু করে দিলাম। আর অদ্ভুতভাবে বাকি পাঁচজনের মধ্যে আশিস মল্লিকের নামটা দেখে তৎক্ষণাৎ ফোন করলাম গুপ্তকে— হ্যালো, গুপ্ত।

ঘুমচোখে গুপ্ত বলল— হ্যাঁ, বল। এত রাতে আমাকে…।

—আরে, ভাই একটা দরকারে ফোন করেছি। একটু হেল্প করতে পারবি?

—হুম, বল শুনছি।
—আশিস মল্লিক নামটা আগে কোথাও শুনেছিস?

—এত রাতে কার নাম বলছিস ভাই?

একটু রেগে বললাম— একটা চাঁটি মারব। আমি মজা করছি না, ঘুম থেকে উঠে আমাকে এই আশিস মল্লিক নামক ব্যক্তিটির সম্বন্ধে জানা খুব দরকার আছে। আমার মনে হচ্ছে এই নামটা আমরা এর আগেও কোথাও একটা শুনেছি।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। দাঁড়া, আমায় একটু মনে করতে দে।

—শোন, তোকে আমি আবার সকাল দশটায় ফোন করব। এই বিষয় যা মনে পড়বে আমায় তখন বলবি। আমি এখন রাখছি।

এই বলে ফোনটা কেটে দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম এবং ভোর হতেই বেরিয়ে পড়লাম অজানা সত্যের সন্ধানে। অধ্যাপক ড. রাজেন দত্তের বাড়ি বিশ্বভারতীর সংলগ্ন এলাকার মধ্যে। অত ভোরে পুলিশের লোক বাড়িতে হানা দেওয়ায় প্রথমে ওনারা একটু বিরক্ত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ছেলের মৃত্যুর অনুসন্ধানে এসেছি শুনে ওনারা আমাকে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করেননি।

—স্যার, আমার ছেলের মৃত্যুটাও একই ধরনের। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন এক সেলসম্যান রবীন্দ্রনাথের মূর্তিসমেত সহজ পাঠ বই বিক্রি করতে এসেছিল বাড়িতে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। স্ত্রী আর ছেলে ছিল। আর যথাযথভাবে সেলসম্যানটি ছেলের সঙ্গে ভাব জমায় আর আমার স্ত্রীর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে সে ছেলে সমেত উধাও হয়ে যায়। পরদিন সকালে কোপাই নদীতে বাবুনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল বলতে বুকে লেখা ওই দুটি লাইন।

কথায় কথায় এও জানতে পারলাম যে ড. রাজেন দত্তর শ্বশুর অর্থাৎ সুদীপ অধিকারী ছিলেন বিশ্বভারতীর কোনো কমিটির সদস্য। এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে আমি থানা গেলাম এবং সকালের জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম বিশ্বভারতীর উদ্দেশে। বিশ্বভারতীতে পৌঁছে ওখানকার ম্যানেজমেন্টের লোকেদের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের পর, তাদের থেকে কিছু পুরোনো ডকুমেন্ট পড়ে একটা চিত্র পরিষ্কার হলো যে প্রত্যেকটা মৃত শিশুর পরিবারের সেই সকল ব্যক্তি ছিলেন ১৯৯০ সালে নির্মিত বিশ্বভারতীর নিয়োগ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। তথ্য ঘেঁটে আরও জানা যায় যে এই দশজনের কমিটি কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙে দেওয়া হয়।

ফিরে এলাম থানায় এবং হেড কনস্টেবল, মহাদেবকে বললাম বাকি রয়ে যাওয়া পরিবারদের জবানবন্দি নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে। ওদিকে, বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলল তাও গুপ্তর কোনো ফোন নেই দেখে ওকে একবার নিজে থেকেই ফোন করলাম আর ফোন ধরে ও যা বলল শুনে আমি চমকে উঠলাম।

—সুমন, আশিস মল্লিক ছিলেন ১৯৯০ সালে বিশ্বভারতীর নিয়োগ উপদেষ্টা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা। ওনাকে পরবর্তী সময়ে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত করা হয় এবং পুরো কমিটিকে তারপর বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। আদালতে দু’বছর আগে এই কেসটার শুনানির সময় আমরাও কলকাতা হাইকোর্টে উপস্থিত ছিলাম হাতকাটা রতনের খুনের কেসটার শুনানির জন্য। সত্যি বলতে, এর বেশি আর তেমন কিছু মনে পড়ছে না ভাই।

—ওকে, ব্রাদার। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

গুপ্তর দেওয়া তথ্য এবং আমার নিকট আসা সমস্ত তথ্যগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে কেসটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। রহস্যের জাল আর কোথায় কোথায় মাকড়শার জালের মতো বিস্তার হয়ে আছে, সেটা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুসন্ধান না করা অবধি বোঝা যাবে না।

বীরভূমকে পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হলেও, বিগত কিছু বছর ধরে বীরভূম বারবার গরু পাচারসহ অনেক দুর্নীতিমূলক কাজকর্মের জন্য খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। আজ থানায় বসে যখন এই কেস ডায়েরিটা সাজাচ্ছিলাম, তখনই আবার খবর এল রামপুরহাট থানার এলাকা থেকে গরু পাচারের অভিযোগে ৩৬টি গরুবোঝাই লরি আটক করেছে রামপুরহাট থানার পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে দু’জনকে এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা দুজনেই ওখানকার বেশ ডাকসাইটে নেতা। রামপুরহাটে কয়েক জায়াগায় এটাকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছে। সেই দুই নেতা গ্রেফতার হওয়ায়, তাদের অনুরাগীরা থানা ঘেরাও করে বোমাবাজি করছে বলেও শোনা গেছে। আর ঠিক সেই কারণে রামপুরহাট থানার পুলিশদের সাহায্যে আমাদের কয়েকজনকে ওখানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল উপর মহল থেকে।

আমি তাড়াতাড়ি হেড কনস্টেবল মহাদেবকে ফিরে আসতে বললাম এবং তারপর বাকিদের কাজ বুঝিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রামপুরহাটের উদ্দেশ্যে। আমরা ওখানে গিয়ে তো অবাক, দেখি ওসি প্রতাপ মাঝিও সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এল— আজ্ঞে, স্যার। উপর মহল থেকে বলল আপনাকে সাহায্য করতে এখানে চলে আসতে। তাই কাজ শেষে চলে এলাম।

—আপনার ওদিকের কাজ মিটল?

—হ্যাঁ, স্যার। আজকের মতো মিটল কিন্তু রায়টা এখনও ঝুলে থাকল আগামী শুনানি অবধি। ওই লম্পট দুটো যতদিন না সাজা পাবে এই বীরভূম এমনই অশান্তির মধ্যে থাকবে।

আমাদের ওইদিন রামপুরহাট থেকে ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে গেছিল। গেস্ট হাউসে তখন সবে পা রেখেছি, এমন সময় গুপ্তর ফোন।

—হ্যালো, সুমন।

—হ্যাঁ, বল। এত সকালে ফোন করলি? কিছু হয়েছে?

—আরে না রে। আমি গতকাল রাতেই তোকে ফোন করতাম কিন্তু খবরের চ্যানেলে রামপুরহাটে ঝামেলার ঘটনা দেখে অনুমান করেছিলাম তুই ওখানেই ব্যস্ত থাকবি। তাই আর কী।

—বল, কী হয়ে হয়েছে।

—বুঝলি, সুমন। আমি ওই আশিস মল্লিকের বিষয় আরও বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। শোনা যায় ওনাকে নাকি মিথ্যে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল। আর সেই চক্রান্ত করেছিল বাকি দশজন সদস্য মিলে।

—এই দাঁড়া, দাঁড়া। বাকি দশজন মানে? কমিটিতে ওনাকে নিয়েই তো মোট দশজন ছিল।

—নো, স্যার। উনি ছিলেন হেড অফ দা কমিটি। ওনাকে ছাড়া বাকি সদস্য ছিল দশজন। তাহলে মোট এগারো জন হল।

—সেটা তো ফাইলের মধ্যে কোথাও উল্লেখ নেই, গুপ্ত। এই বাড়তি একজন ব্যক্তির ব্যাপারে জানব কীভাবে? ইনার বিষয় না বিশ্বভারতীর পুরোনো রেকর্ডে আছে, না আছে কেস ডায়েরিতে।

—বন্ধু, ভারতবর্ষে এমন কেস প্রায়শই ঘটে। পুলিশকে যতটা অক্ষম মনে করা হয়, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি আক্ষম করে দেওয়া হয় তাদের। এই সমস্ত তথ্য লোপাট করে সঠিক তদন্ত করা থেকে আমাদের আটকানো হয়। এবার বাকিটা মন দিয়ে শোন।

এই বলে ফোনের একপাশে আমাকে চুপ করে শুনতে বলে গুপ্ত বাকি কথা বলতে লাগল, আশিস মল্লিকের মিথ্যে অভিযোগে সাজা হওয়ায়, ওনার স্ত্রী লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে কোপাই নদীর ঘাটে আত্মহত্যা করেন। শোনা যায়, জেলের ভেতর আশিস মল্লিকের মৃত্যুটাও বেশ রহস্যজনক। অনেকের মতে তাকে নাকি জেলের ভেতরই খাদ্যে বিষক্রিয়া দ্বারা খুন করা হয়েছিল।

—হুম! বুঝলাম। এটা কেস অফ রিভেঞ্জও হতে পারে।

—কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? না ওনার স্ত্রী আজ বেঁচে আছে, না ওনার দুই সন্তান।

—গুপ্ত, আরও একটা সূত্র পাওয়া গেছে রে। তোর কথা যদি সঠিক হয়ে তাহলে মৃত শিশুগুলোর বয়স ওই ৫-৬ বছর আর আশিস মল্লিকের দুই সন্তানের বয়সও অনুমান করা যেতে পারে সেই সময় ৫-৬ বছরই ছিল।

—গ্রেট। এই তো। ৫-৬ বছরের শিশুকেই কেন মারা হচ্ছিল, সেটা এখন তাহলে পরিষ্কার হয়ে গেল।

হ্যাঁ, গুপ্তর কথা শুনে এই বিষয়টা পরিষ্কার হলো ঠিকই। কিন্তু সবটাই অনুমান কারণ আশিস মল্লিকের দুই সন্তানসহ ওনার স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা বা সেই দশমতম ব্যক্তিটি কে, সেটা এখনও উহ্য থেকে গেছে।

সেদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেড কনস্টেবল মহাদেবকে নির্দেশ দিলাম মনোজ যে কিনা ভালো স্কেচ করে, তাকে সঙ্গে নিয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক ড. রাজেন দত্তের বাড়ি সহ লিস্টে থাকা সেই সকল ভিক্টিমের বাড়ি গিয়ে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ওই সেলসম্যানের একটা স্কেচ করে আনতে।

আমার কথামতো হেড কনস্টেবল মহাদেব মনোজকে ফোন করে ডেকে নিয়ে সোজা চলে গেল সাহিত্যের অধ্যাপক ড. রাজেন দত্তের বাড়ি। তারপর ধীরে ধীরে একে একে সবার বাড়ি ঘুরে, তাদের বর্ণনাসহ স্কেচ সংগ্রহ করে ফিরে এল।

প্রত্যেকটা স্কেচ দেখে একটা জিনিস পরিষ্কার হলো যে সবার বাড়িতে ওই একজনই সেলসম্যানের বেশে গেছিল। স্কেচ অনুযায়ী মুখের বর্ণনা বলতে গেলে গোল আঁকার। নিচের ঠোঁট ডানদিকে কুঞ্চিত। আর বাম দিকে গাল ও কানের লতির মাঝা-মাঝি জায়গাটা কেমন যেন খাবলা করে মাংস বের করা।

আর এই বিষয়েই আমার খটকা লাগল। এমন কাউকে দেখেছি কিনা ভেবে উঠতে পারছিলাম না। কখনও মনে হচ্ছে দেখেছি, আবার কখনও না। এই দ্বিধা মনে নিয়ে রাতে গেস্ট হাউসে শুয়ে বারবার আমার বোলপুর আসার পর থেকে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বা নিকট সংস্পর্শে এসেছে, তাদের প্রত্যেকের মুখটা একবার করে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। অনেকক্ষণ ভাবার পর, স্রেফ একজনের মুখের একটা অংশ যেটা কিনা সর্বদা দাঁড়ির ও কাপড়ের ফেট্টির তোলায় ঢাকা থাকত, তাঁর সঙ্গেই মিল খুঁজে পাওয়ার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো।

আর ওইটুকু সম্ভাবনা সৃষ্টি হতেই, আমি আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। সকালে সূর্যের আলো বেশি প্রকট হতে না হতেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম।

কোপাই নদীর পারে যেই মানুষটির মুখটা আমি চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাকে একবারের জন্যও সেদিন ওই তল্লাটে দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেই বয়স্ক লোকটির চায়ের দোকান হোক কিংবা সেতুর ধারে ওই বটবৃক্ষের তলায়। কোথাও সে নেই।

হ্যাঁ, আমি বউল নির্মাল্য দাসের কথাই এখানে বলছি। এদিকে, থানা থেকে কয়েকবার ফোন এসেছে বলেই আমার অনুমান কারণ বেশ কয়েকবার প্যান্টের পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠেছিল। কিন্তু আমি? না, ফোন ধরার মতো সময় আমার ছিল না ওই মুহূর্তে। বলা ভালো সেই বাউলের খোঁজে আমি এতটাই বিভোর হয়ে গেছিলাম যে বাকি কিছু আর মাথায় ছিল না।

কিছুটা দূরত্বে চোখে পড়ল কোপাই নদীর পাড়ে হাট বসছে। শনিবার ও রবিবার এই হাটের দিন। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই কম বেশি হাট বসে। অন্যদিকে, সকাল সকাল একদল আদিবাসীরা পর্যটকদের বিনোদনের স্বার্থে নাচ আরম্ভ করছে। আমারও ইচ্ছা করছিল তাদের সাথে মিশে যেতে। কিন্তু অনেক কিছু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হয় না। ফলে, সেই নাচ দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম। নদীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই মনটা আবারও শীতল হয়ে গেল। বর্ষাকালে শুনেছি কোপাই নদী জেগে ওঠে। বর্ষা এসেছে গেছে, ধীরে ধীরে নদীও জেগে উঠছে। ছোটবেলায় সহজ পাঠে যতবার কবিতাটি পড়তাম, ততবার ভাবতাম এটি কোন নদী নিয়ে লেখা। কখনো কখনো মনে হতো আমাদের পাশের নদীটা নয় তো। এই কোপাই নদীর বাঁকগুলি অনেকটা হাঁসুলী আকৃতিবিশিষ্ট।

আমি নদীর পাশে একটা পাথরের উপর বসে সবে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে রেখেছি, পেছন থেকে কার যেন গলার স্বর শুনতে পেলাম বলে মনে হলো। কেউ যেন আমাকেই ডাকছে।

—সাহেব, আমাকে খুঁজছেন?

চেনা কণ্ঠস্বর শুনে আমি তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তাকাতে চাইলাম। আর যেই না তাকাতে গেলাম, ওমনি একটা ভারি লাঠির আঘাত অনুভব করলাম মাথার ডানদিকে এবং নিমেষের মধ্যে আমার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। চোখ বোজার আগে কেবল দেখতে পেয়েছিলাম একটা অস্পষ্ট মানুষের ছায়া।

জ্ঞান যখন ফিরল, তখন চোখ চেয়ে দেখি আমি যেন একটা পুরোনো বাড়ির ভেতর একটা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় রয়েছি। আর সামনে একতারা হাতে বসে সেই বাউল। হ্যাঁ, যাকে আমি খুঁজতেই কোপাই নদীর তল্লাটে গেছিলাম। বাউল নির্মাল্য দাস।

কাঁপা গলায় বললাম— একী, আমাকে এইভাবে এখানে বেঁধে রাখার মানে কী? কেন বেঁধেছেন আমায়?

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের একতারা বাজিয়ে সে গাইতে আরম্ভ করল—

পিরিতির রীতি জানো না

আরে করলে পীরিত হয় বিপরীত,

পরে ঘটবে যন্ত্রণা

যেমন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে

ও যেমন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে

ও পিঁপড়ে নড়তে চড়তে পারে না

গোলেমালে গোলেমালে পীরিত করো না

গোলেমালে গোলেমালে পীরিত করো না…

—থামুন, থামুন। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। কেন আমাকে এইভাবে এখানে বেঁধে রেখেছেন?

আমাকে রেগে যেতে দেখে বাউল নিজের গান থামাল এবং উঠে এসে আমাকে বলল— সাহেব, আপনি তো আমাকেই খুঁজছিলেন। আপনাকে তাই আমার বাসায় অতিথি করে আনলাম।

—আমি জানি আপনিই সেই লোক। গানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এতগুলো শিশুর খুনের অপরাধী আপনি।

—ধীরে, ধীরে। এত ছটফট করলে যে পুরো গল্পটা আপনার শোনা হবে না সাহেব।

—কী গল্প? তাছাড়া আপনার আসল পরিচয় কী?

—বলছি, বলছি।

তারপর একটা দীর্ঘ অধ্যায়ের কথা সে তুলে ধরল আমার সামনে।

সে বলতে শুরু করল— আমার বয়স তখন সবে পাঁচ বছর। বাপ-মা হারা ছেলেটাকে নিজের নাম দেয় আশিস মল্লিক নামক একজন ব্যক্তি। যার সেই সময় বিশ্বভারতীতে বেশ নামডাক ছিল। নিজের ছেলে থাকা সত্ত্বেও আমাকে সে নিজের বড় ছেলের পরিচয় দেন। মা অর্থাৎ ওনার স্ত্রীও আমাকে নিজের বড় ছেলের মতোই দেখতেন। কিন্তু ১৯৯২ সালের পঁচিশে বৈশাখ তারিখটা আমার তথা আমাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় রূপে নেমে আসে। ঘুষ নেওয়ার মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বাবাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার ঘটনাটা মা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি তাই পাঁচ বছরের ভাই এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে বিষ খেয়ে এই কোপাই নদীতে আত্মহত্যা করে। মা আর ভাই মারা গেলেও, আমি কোনোভাবে বেঁচে যাই। আমার বয়স তখন আট। সেই থেকে বাবাকে যারা ফাঁসিয়ে এমন ঘটনা ঘটতে বাধ্য করল এবং আমাদের পরিবারটা ছারখার করে দিল, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে আমি বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলাম। একে একে সেই কমিটির প্রতারকদের নামসহ পরিবারের তালিকা তৈরি করলাম এবং তারপর থেকে প্রত্যেক বছর পঁচিশে বৈশাখের দিন একটি করে সেই সব পরিবারের শিশু যার বয়স ৫-৬ হবে, তাদের অর্ঘ্য দিয়ে আসছি এই কোপাই নদীতে। কারণ আমার ভাইয়েরও বয়স ছিল ৫ বছর যখন তাকে এই নিষ্ঠুর কার্যের বলি হতে হয়েছিল। এইভাবেই আমি প্রতি বছর বাবা-মা ও ভাইয়ের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি যাপন করি।

—এইভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি যাপন করা যায় না। আপনি ভুল করছেন।

—আমি ভুল করছি? কিন্তু যারা আমার পরিবারের সঙ্গে ভুল করল তারা? ওদের ভুলের কোনো সাজা হয়নি সাহেব। মিথ্যে দোষে সাজা পেয়েছে কেবল আমার বাবা।

—আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে একজনের অপরাধের সাজা আপনি অন্য একজনকে দেবেন? সেই প্রতারকদের সাজা পাওয়া উচিত ছিল আমিও মানি। কিন্তু তাদের পরিবারের ওই শিশুগুলোর কি দোষ বলতে পারেন?

—ওই শিশুগুলোর মতো আমার ভাই এবং মাও কেন এই প্রতারণার শিকার হল বলতে পারবেন? তারা সবাই মিলে আমার বাবাকে ফাঁসাল এবং একজনকে ফাঁসিয়ে তারা আমাদের পরিবারের সবাইকে ছারখার করে দিয়েছে। তাই সেই দিক থেকে দেখলে, পরিবারের একজনের দোষের সাজা তাদের উপরও বর্তায়।

—আপনার একার পক্ষে এই কাজ করা কখনই সম্ভব নয়। বিশেষ করে বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করা। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিশেষ কেউ জড়িত আছে। আর সেটা কে, আপনাকে বলতেই হবে। আপনার সঙ্গে কে আছে। বলুন।

—আজ্ঞে, স্যার। এত উত্তেজিত হবেন না। বাকি গল্পটা না হয় আমার মুখ থেকে শুনবেন।

কথাটা কানে আসতেই পাশ ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই লক্ষ করলাম আমাদের বোলপুর থানার সেই বোকা ওসি প্রতাপ মাঝি মুখে একগাল হাসি নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে এল।

—একী, আপনি এখানে? কীভাবে?

—স্যার, আমার খোঁজ করছেন অথচ আমি আসতেই আমাকে দেখে চমকে উঠছেন? এটা কেমন অন্যায় স্যার।

—আপনিই!

—হ্যাঁ, আমিই সেই ব্যক্তি। আমিই নির্মাল্য দাসকে এই কাজে সাহায্য করতাম। আমাকে দেখে বলদ মনে হলেও, সেটা আদতে আমি নই। ওই বিশ্বভারতীর কাগজপত্র ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে এতদিন এই কেসটা হিমঘরে রাখা। সবটাই আমার সৌজন্যে।

আমি প্রতাপবাবুর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এমন বোকা দেখতে মানুষের পক্ষেও এমন কর্মকাণ্ড ঘটানো সম্ভব, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমাকে অবাক হতে দেখে ওনাকে আরও বলতে শুনলাম,

স্যার, আপনি মনে হয় গোয়েন্দা গল্প পড়েন না। যদি পড়তেন, তাহলে আমাকে বোকা ভেবে সহজেই উড়িয়ে দিতে পারতেন না। একবার ভেবে দেখবেন, এতবছর ধরে ঘটে চলা খুনের কোনো সাক্ষী বা ডায়েরি কিছুই সঠিকভাবে তৈরি নেই, এটা কি আদৌ সম্ভব?

—ছি। প্রতাপবাবু। আপনি পুলিশের কর্মী হয়ে দিনের পর দিন এমন কাজ করে চলেছেন, ভাবতেও লজ্জা করছে।

—স্যার, নির্মাল্য দাসকে আমি খুনি ভাবি না। আর বন্ধুকে তার প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করাতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখি না।

ভুরু দুটো যতটা সম্ভব উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলাম আমি— বন্ধু?

—হ্যাঁ, বন্ধু। আমার বাবা স্বর্গীয় তপন মাঝি ছিলেন পুলিশের খোঁচর। নির্মাল্যকে তিনি কোনো ক্রমে পায় এবং লাভপুরে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার পর ওর চিকিৎসা করানো হয়। তারপর থেকে ওর বেড়ে ওঠা সমস্তটাই লাভপুরে। পরে আমি পড়াশোনা করে মোড়লের সুপারিশে বোলপুর থানার ওসি হয়ে গেলেও, নির্মাল্য আর পড়াশোনার দিকে যায়নি। ছোট থেকে গান ও রবীন্দ্রনাথ ওর শরীরে মিশে থাকায়, এই কোপাই নদীর কাছে সে নিজের আস্তানা গড়ে নেয়। ব্যস, সেই থেকে সবার কাছে ও বাউল নির্মাল্য দাস হয়ে ওঠে। আর রাতের অন্ধকারে মেতে ওঠে প্রতিশোধের নেশায়। সঙ্গী বা সাক্ষী বলতে গেলে শুধুই আমি, ওর প্রিয় বন্ধু প্রতাপ।

—আমার এখনও একটা বিষয় পরিষ্কার নয়। আমাকে এখানে এইভাবে নিয়ে আসার কারণ কী?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখলাম বাউল নির্মাল্য দাস এগিয়ে এল— সাহেব, আপনাকে পুরো ঘটনাটা জানানোই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ আমরা দুজনে বুঝতে পারছিলাম যে আপনি এই রহস্য উন্মোচনের খুব কাছে এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না ধরা পড়া আর ধরা দেওয়ার মধ্যে একটা বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই ধরা পড়ার আগে নিজেই আপনার কাছে ধরা দিলাম।

—মানে?

—মানে আর কিছু নয়, স্যার।

পাশ থেকে বললেন প্রতাপবাবু ও আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন একটা ঘুম পাড়ানোর মতো ওষুধ মেশানো পাউডার। এরপর যখন চোখ খুললাম, দেখি আমার বাঁধন খোলা। দড়িটা মাটিতে পড়ে এবং যেটা না বললেই নয়, সেটা হলো প্রতাপবাবু ও বাউল নির্মাল্য দাসের কথা। হ্যাঁ, দুজনেই অচেতন অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। দুজনের মাথা দিয়েই তখন গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।

চেয়ার ছেড়ে মাটিতে বসে দুজনের হাতের কাছে দুটো পিস্তল দেখে বুঝলাম যে তারা দুজনেই আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু এইরূপ নিজেদের পরিণতি তারা ঠিক করলেন কেন, সেটা টের পেলাম খানিকক্ষণ পর যখন কিছুটা দূরত্বে রাখা বাউল নির্মাল্য দাসের সেই একতারার নিচে ওই রক্তের দাগ লেগে থাকা সাদা পাতার চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

১০

মাননীয় সুমন সাহেব,

আপনি যখন এই চিঠিটা হাতে পাবেন, ততক্ষণে আমি ও প্রতাপ ইহজগৎ ত্যাগ করেছি। ছোটবেলায় বাপ-মা হীন এক বালককে যারা পরিচয় দিয়েছিল, তাদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ আমি যা করেছি তার জন্য আমি একবিন্দুও অনুতপ্ত নই। বরং প্রতিশোধ নিতে পেরে আমি আজ তৃপ্ত। আমার কারণে প্রতাপ যে রূপ বলিদান দিয়েছে তার জন্য আমি ওর কাছে আগামী জন্মতেও কৃতজ্ঞ থাকব।

আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা ধরা দিয়েও, কেন এমনভাবে নিজেদের শেষ করে ফেললাম। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য এতদিনে সফল হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম আপনাকে এই সমস্ত ঘটনাটা জানিয়ে যেতে। প্রতিশোধ নেওয়ার পালা এই পঁচিশে বৈশাখে ড. রাজেন দত্তের একমাত্র সন্তানকে মেরেই মিটে গেছে। কিন্তু সেই দশমতম ব্যক্তির পরিচয়, তার কথা, সবটাই অজানা ছিল। তবে, সেটা আমাদের কাছে নয়। একমাত্র আপনার কাছে।

হ্যাঁ, দশমতম ব্যক্তি আর কেউ নয় স্বয়ং আপনার দাদু অনিমেষ গঙ্গোপাধ্যায়। আমাকে আপনার দাদু সেই রাতে কোপাই নদীর পারে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায় এবং অচেতন অবস্থায় শুধু নিঃশ্বাসটুকু পড়ছিল দেখে উনি তপন মাঝি ওরফে প্রতাপের বাবাকে আমার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে চলে যান। উনি আমার প্রাণ সেই রাতে না বাঁচালে হয়তো আমার পক্ষে এতকিছু করা সম্ভবপর হতো না। সুতরাং আমার কর্তব্য অনুযায়ী প্রতাপের সাহায্যে সর্বপ্রথম আমি বিশ্বভারতীর সকল নথিপত্র থেকে আপনার দাদুর নামটা মুছে দিই। যার ফলে, সেই দশমতম ব্যক্তির পরিচয়, আজীবন গোপন রয়ে গেছে। আপনার দাদু আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন এবং সেইসময় একমাত্র তিনিই ছিলেন আমার বাবার হয়ে কথা বলার মতো ব্যক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ওনার পরিবারের স্বার্থে ওনাকে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

এবার আশা করি আপনার মনের সব কৌতূহল দূর করতে সক্ষম হয়েছি। শেষে তাই একটাই অনুরোধ, পারলে আমাদের দেহগুলো আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় কোপাই নদীর পারে দাহ করবেন। আমাদের গল্প ওখানেই শুরু হয়েছিল, আর ওখানেই শেষ হোক।

ইতি—

নির্মাল্য দাস

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

কৃষ্ণচূড়া

Read Next

ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ : ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *