অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জোনাকী দত্ত -
জীবন যেখানে যেমন

১.

‘এ্যাই ঝুমা, দেখ্ না। আমার পুতুলের কাপড় খুলে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই পরাতে পারছি না।’

নাকি কান্নার সুরে কথাগুলো বলল জয়া।

ছায়া বিরক্ত হয়ে বলল, আহ্ বেশি ঢং করিস না তো! নিজেরটা নিজে কর। দেখছিস না, ঝুমা আমাকে নতুন পুতুল বানিয়ে দিচ্ছে।

জয়া কান্না শুরু করে দিল।

ঝুমা তাড়াতাড়ি ছায়ার পুতুলটা রেখে জয়ার পুতুলটাকে কাপড় পরিয়ে দিয়ে বলল, কাঁদিস না জয়া। এই দেখ সব ঠিকঠাক করে দিলাম।

জয়া পুতুলটা নিয়ে খুশি হলো।

হঠাৎ বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনে ছায়া বলল— ঝুমা, জয়া, মনে হয় বরফ বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে কেমন টুপটাপ শব্দ। শুনতে পাচ্ছিস তোরা? ওরা একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ।

ঝুমা বলল, মাকে ডাকি, চল।

উঠানে একটা গামলা বসিয়ে দিলে বরফগুলো ওখানে পড়বে। তারপর তিন বোন পুতুল খেলা ফেলে বরফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

মা ওদেরকে বলল, ভিজে যাবি তো? অসুখ হবে যে।

ছায়া একটু চঞ্চল স্বভাবের। সে মায়ের কথা শুনে বলল, অসুখ হবে না, মা। এই বরফ খেলে অসুখ সেরে যায়।

ঝুমা বলল, চলে আয়, ছায়া। এগুলো এক টুকরো খেলে হয়ে যায়। বেশি খেলে গলা ব্যথা করবে।

জয়া মায়ের পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ওদের বৃষ্টিতে ভেজা দেখছে। ছায়া এসে ওকে এক টুকরো বরফ এনে খেতে দিল। ওরা তিন বোন আর এক ভাই মাকে নিয়ে থাকে।

দুই বছর আগে ওর বাবা একদিন অফিস থেকে এসে বলল, শরীর খারাপ লাগছে। মা তাড়াতাড়ি বড় জা আর ভাসুরকে ডেকে আনল। এরপর যখন হুঁশ চলে গেল তখন আর দেরি না করে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বাবাকে গাড়িতে তোলা হলো। ঝুমা মায়ের সাথে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ছায়া গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে কেঁদে বলছে, আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ও বাবা, তোমার কী হয়েছে?

জ্যাঠিমা ওকে টেনে এনে বলল, কাঁদিস না ছায়া, তোর বাবা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু ওদের বাবা আর ফিরে আসেনি। এখন ওর বাবার পেনশনের টাকা আর অল্প জমানো টাকা দিয়ে ওদের সংসার কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। তবে ওদের দাদাও এসএসসির পর আর লেখাপড়া না করে সংসারের হাল ধরেছে। যখন যে টেম্পোরারি চাকরি পাচ্ছে সেটা করছে। বয়সও তো তেমন বেশি না। তিন বোন স্কুলে পড়ে।

একদিন ছায়া বিশালের বাপের দোকান থেকে মুড়ি, চানাচুর কিনে আনল। এনে বলল, দেখেছ মা, বিশালের বাপটা বেশি কিপটা। কত কম দিল।

মা বলল, কী আর করবি। বাদ দে। এই ঝুমা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ মেখে ঝালমুড়ি তৈরি করে নে। আমি চা বানিয়ে নি। তোর দাদাও এখন এসে পড়বে।

জয়া বলল— জানিস ছায়া, তুই ঠিক বলেছিস। কাল জ্যাঠিমার ওখানে বাল্যশিক্ষায়ও পড়েছি বিশালের বাপ ভালো নয়। ঝুমা ঝালমুড়ি বানাতে বানাতে হেসে বলল, আরে পাগলি, এটা তুই ভুল পড়েছিস। সবাই একসাথে পড়েছিস তাই জ্যাঠিমা খেয়াল করেনি। না হলে তো তোকে বকা দিতো। ওটা হবে বিশৃঙ্খল ভাব ভালো নয়।

তখন ওদের দাদাও ঘরে ঢুকল। সেও কথাটা শুনে হাসতে লাগল। তারপর বলল, খুব সুন্দর কথা বলেছিস তো জয়া!

মা বলল, আচ্ছা বাবা, ও ছোট মানুষ, না হয় ভুল বুঝেছে। তোরা সবাই এবার খেয়ে নে তো!

জয়া মুখ গোমড়া করে বসে থাকল। সেটা দেখে ছায়া বলল— আরে জয়া, তুই তো ঠিক পড়েছিস। উনি তো এমনিও ভালো নয়। সব সময় মানুষকে ঠকায়। নে আয়। খুব মজা হয়েছে খাবি আয়।

জয়া তারপর খেতে এল। কত সহজেই ওরা আনন্দ খুঁজে নিতে পারে। ওরা বুঝে গেছে ওদের বেশি কিছু চাইতে নেই। দামি পোশাক, দামি খাবার, কোথাও বেড়াতে যাওয়া ওদের জন্য নয়। ওদের বাবা নেই। টানাপোড়েনের সংসার। মাস শেষ হতে না হতেই খাবারের স্বল্পতা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মধ্যবিত্তের সংসারে জীবন যেখানে যেমন সেখানে তেমন করে মানিয়ে নিতে হয়।

তিন বোন স্কুল থেকে এসে খেয়েদেয়ে দুপুরে ওদের ঘরের পেছনে নারিকেল আর সুপারি গাছতলে রান্নাবাটি খেলে। ওরা ওদের মায়ের কাপড় দিয়ে চারদিকে ঘেরাও করে ফেলে। তারপর নারকেলের যে ছোট ছোট ফুল পড়ে তা দিয়ে রান্না করে। ছায়া পুকুর থেকে কচুরিপানা নিয়ে আসে। ওগুলো দিয়ে হাঁস, মুরগি বানায়, ডিম বানায়।

একদিন ওদের খেলার সময় ছায়া পাশের বাড়ির তেঁতুল গাছের নিচ থেকে পাকা তেঁতুল কুড়িয়ে এনে ঝুমাকে দিল— এই ঝুমা, খেয়ে দেখ, কী মিষ্টি!

ঝুমা বলল, দাঁড়া ছায়া। তেঁতুলের খোসার মধ্যে গরম ভাত নিয়ে খেতে টকটক খুব মজা লাগে। তুই একটু করে ভাত নিয়ে আয়, মা ঘুমাচ্ছে। যাতে টের না পায়।

জয়া কচুরিপানার হাঁস, মুরগি নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, আজকে আমরা সত্যি সত্যি ভাত খাব ঝুমা?

ঝুমা বলল, হ্যাঁ। আগে তেঁতুলটা সাবধানে বের করি যাতে খোসা ভেঙ্গে না যায়।

তারপর ঝুমা তেঁতুলের খোসায় একটু একটু করে ভাত ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণ ঝাঁকিয়ে একটি বাটিতে ভাত বের করে তিন বোন সে টক টক ভাত খেল।

ছায়া বলল, বেশ ভালো হয়েছে ঝুমা।

ঝুমা বলল, এটা আমি সবিতার থেকে শিখেছি। জানিস স্কুল বন্ধের দিন সবিতা আর পূর্ণিমাও আসবে আমাদের সাথে খেলতে।

ছায়া বলল, কিন্তু বেশি চেঁচামেচি হলে তো জ্যাঠিমা আবার বকা দেবে। ঝুমা বলল, আমরা চুপিচুপি খেলব। আওয়াজ করব না।

মাঝে মাঝে ওরা আশেপাশের মেয়েদের সাথে বউচি, কানামাছি, লুকোচুরি, হাডুডু, ডাঙ্গুলি খেলাও খেলে। জয়া ছোট হওয়ায় সে ওদের সাথে খেলতে পারে না। পাড়ার অন্য ছোট মেয়েদের সাথে বসে বড়দের খেলা দেখে আনন্দ পায়।

একদিন জ্যাঠা ছায়াকে ডেকে বলল, ছায়া বরই যদি পাস নিয়ে আসিস তো। ভর্তা করে খেতে ইচ্ছা করছে।

যে বলা সেই কাজ। ছায়া দৌড়ে গিয়ে এ পাড়া, ও পাড়া থেকে কাঁচা, পাকা অনেকগুলো বরই কুড়িয়ে নিয়ে এল। জ্যাঠা বলল, বাঃ, এখানে তো অনেকগুলো! জ্যাঠিমা বলল, এই ছায়া, যা লেবু পাতা নিয়ে আয়। তারপর জ্যাঠিমা এগুলো হামানদিস্তায় ছেঁচে, গুড়ো করে তার সাথে পোড়া মরিচ, গুড়, লবণ, লেবু পাতা মিশিয়ে ভর্তা তৈরি করল। ঝুমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের বড় মেয়ে, ছায়া, জয়া, ওদের মা, ছোট জ্যাঠাতো ভাই, জ্যাঠা, জ্যাঠিমা সবাই মিলে চেটেপুটে বরইয়ের ভর্তা খেল।

ঝুমা যখন মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাজ করে তখন ছায়া আর জয়া পাড়ায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবেশী মেয়েদের সাথে খেলা করে, গল্প করে। কখনো মধুফুল নিয়ে মধু চুষে খায়।

একদিন ছায়া জয়াকে বলল— জানিস জয়া, ঝুমার বিয়ে হয়ে গেলে ওকে কিন্তু আমাদের দিদি বলে ডাকতে হবে। না হলে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদের খারাপ বলবে।

জয়া একটা মধুফুল নিয়ে চুষতে চুষতে বলল, তাই নাকি? কিন্তু আমরা যে সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকি। আর ঝুমা তো এখনো ছোট। আমাদের সাথে পুতুল খেলে, স্কুলে যায়। আমরা তো একসাথে মারামারিও করি। ওর কী করে বিয়ে হবে?

ছায়া বলল, কিন্তু ও তো আমাদের চেয়ে একটু বড়, তাই হয়তো। আমি সেদিন জ্যাঠিমা আর মায়ের কথা শুনেছি। ওরা বলছে আমাদের বাবা নেই। তাই ভালো ঘর পেলে ঝুমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। দেখিস জয়া এটা কাউকে বলিস না আবার।

জয়া মধুফুল থেকে একটা ছোট বিচি বের করে নাকে নাকফুল বানিয়ে দিয়ে বলল— না না, ঠিক আছে, কাউকে বলব না।

ছায়া আবার বলতে শুরু করল, জ্যাঠিমা মাকে বকা দিয়ে বলছে যে আমরা ঝুমাকে নাম ধরে ডাকার পরও মা আমাদের কেন শাসন করে না। বাইরের লোক শুনলে খারাপ ভাববে। এজন্য তোকে এসব বললাম। চল এবার। দেরি করে গেলে মা বকবে।

ঝুমা চৌদ্দ বছরের, ছায়া বারো, আর জয়া নয় বছর বয়সের। একদিন পুকুরে ঝুমা আর ছায়া সাঁতার কাটছে। জয়াকে ওর মা ঘাটে বসিয়ে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। পাশে বসে জয়ার বড় জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বউ বাসন মাজতে মাজতে বলল— কী রে জয়া, তোর সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে না?

জয়া বলল, না, আমার ভয় করে।

ওর মা গা মোছাতে মোছাতে বলল, কেন ভয় করবে? তুই আরেকটু বড় হলে এই ঘাট ধরে শিখে ফেলবি। দেখ না সবাই কী সুন্দর সাঁতার কাটছে।

ছায়া ঘাটে এসে বলল, মা উফ্ শীত লাগছে আমার, জামা আর গামছা দাও।

ঝুমাও এল। বৌদি বলল, এই ছায়া, পানি ছিটাস না। আমার গায়ে পড়ছে। ছায়া শুনে হেসে বলল, তুমি তো একটু পরে স্নান করবে।

মা ওকে গামছা দিয়ে বলল, তোর খালি পাল্টা জবাব। তাড়াতাড়ি মুছে জামা বদলিয়ে ঘরে চলে আয়।

তারপর সবাই স্নান সেরে দুপুরে খেতে বসল জ্যাঠিমাদের সাথে উঠানে। শীতের সময় রোদে বসে ভাত খেতে খুব মজা। সবাই একসাথে গল্প করতে করতে তরকারি ভাগাভাগি করে খায়।

ওদের পুকুরের ঐ পাড়ে একটি রেইনট্রি ও একটি খেজুর গাছ আছে। সেখানে তিন বোন পাড়ার মেয়েরাসহ বিকেলে মাঝে মাঝে খেলতে যায়।

ছায়া সেখানে খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুখ হা করে এক একফোঁটা রস খায়। জয়াও চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। সে রেইনট্রি গাছের সীম কুড়িয়ে নিয়ে খেলা করে। ঝুমা ওর বন্ধুদের সাথে গল্প করে। ছায়া খেজুর গাছে উঠে বসে থাকে। সে কিছু কিছু গাছে চড়তে পারে।

গরমের সময় ওরা তিন বোন বাতাস করলে বা বৃষ্টি হলে আম, জাম আর কাঁঠাল গাছ যেখানে আছে সেখানে ঘুরে ঘুরে যা পায় তা কুড়িয়ে এনে ভর্তা করে খায়। মা অনেক বকা দেয়। ওদের দাদাও পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো পছন্দ করে না। কিন্তু সারাদিন তো দাদা ঘরে থাকে না। তাই যতরকম দস্যিপনা আছে ওরা সন্ধ্যার আগে সেরে নেয়। তারপর দাদা আসলে দেখে ওরা হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেছে।

মাঝে মাঝে মা, জ্যাঠিমাদের সাথে সন্ধ্যায় প্রার্থনা, দুপুরে পুঁথি পাঠ এগুলো করে।

এভাবে ওদের তিন বোনের একসাথে ছেলেবেলার দিনগুলো আটকে থাকে স্মৃতির পাতায়। কারণ ঝুমার জন্য একটা ভালো পরিবার থেকে সম্বন্ধ এসেছে। তাই পনেরো বছর বয়সের ঝুমাকে বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ছায়া আর জয়ার সবচেয়ে বড় অবলম্বন ঝুমা ওদের ছেড়ে পরের ঘরে চলে যাবে। এটা ভেবেই দুই বোনের মুখ গোমড়া হয়ে আছে। আবার বিয়ের কথা শুনে মনে আনন্দও হচ্ছে।

আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা তুলে আর নিজেদের একটা জমি বিক্রি করে ঝুমার বিয়ে সম্পন্ন করা হলো। ঝুমা ছায়া আর জয়াকে ছেড়ে অনেক দূরে গ্রামে চলে গেল পরের ঘরে। এটাই মেয়েদের মেনে নিতে হয়।

ঝুমা শ্বশুরবাড়িতে এসে ঘরগৃহস্থালির কাজে লেগে গেল। ওদের বড় পরিবার। ঝুমার বড় দুই জা, দেবর, ননদ, ভাসুর, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে ওর সংসার।

কই রে ঝুমা, তোর হলো? আর কতক্ষণ? চা-নাস্তা দে। আমায় আবার গরুগুলোকে খাওয়াতে যেতে হবে।

বড় জা’র হাঁকডাকে ঝুমা হকচকিয়ে গেল। বলল, এই তো বড়দি, দিচ্ছি। মেজ জা রুটি বেলছে। আর ঝুমা ভাজি তৈরি করে বড় জা’কে রুটি দিয়ে খেতে দিল। দুইমুখী চুলার আগুনে ঝুমা একেবারে ঘেমে গেল। শাশুড়ি এসে বলল, কই গো সেজ বৌমা, তোমার শ্বশুরের গরম জল হয়েছে? উনি স্নান করে খেয়ে দেয়ে বের হবে তো।

ঝুমা বলল, হ্যাঁ মা, চা-টা নামিয়ে দিচ্ছি গরম জল। এর মধ্যে ঝুমার স্বামী, দুই ভাসুর গরম গরম ভাত আর তরকারি খেয়ে যার যার কাজে চলে গেছে। বড় জা মুখে পান দিতে দিতে বলল, এতদিন হয়ে গেল সংসার করছিস তারপরও তোকে প্রতিদিন তাড়া দিতে হয়। এত ধীর হলে চলে? আমি গেলাম মা, গরুগুলোকে খাইয়ে আসি।

ঝুমা কিছুই বুঝতে পারে না। এত ভোরে ঘুম থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করে তারপরও তার কাজ শেষ হয় না। ননদ আর দেবর এসে বলল, দেখি সেজ বৌদি, আমাদের ভাত দিয়ে দাও। কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঝুমা বলল, বস, দিচ্ছি। বাবাকে একটু গরম জলটা দিয়ে আসি।

শাশুড়ি বলল, মেজ বৌমা, আমাকে একটু চা দিয়ে দাও। আজ খেতে গিয়ে মরিচ গাছগুলো ঠিকমতো বড় হচ্ছে কিনা দেখে আসতে হবে। তাছাড়া বেগুন গাছেও পোকা আসছে।

মেজ বৌমা বলল, দিচ্ছি মা। আমার রুটি বানানো শেষ। ঝুমা এসে ননদ আর দেবরকে ভাত দিল। এর মধ্যে দুই জা’-এর দুই মেয়ে এসে বলল, সেজ মা, আমাদের স্কুলের জন্য তৈরি করে দাও। তখনো ঝুমার ছয় মাসের ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে সে ৯টা/১০টার আগে উঠে না। না হলে ঝুমার আরও কষ্ট বেড়ে যেত।

সবার কাজ সারতে সারতে নয়টা বেজে যায়। এরপর মেজ জা’র সাথে বসে ঝুমা চা খায়। ছেলে ঘুম থেকে উঠলে তাকে কিছু খাইয়ে খেলনা দিয়ে ওর পাশে বসিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে শাশুড়ির কোনো কাজ না থাকলে নাতির সাথে বসে খেলা করে। এতে ঝুমা কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকে।

তারপর শুরু হয় দুপুরে সবার জন্য রান্নাবান্না। মেজ জা তরকারি কেটে দেয়। ঝুমা বাটনা বেটে রান্না করতে বসে যায়। দুপুরে সবাই খাওয়ার পর ঝুমা একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়।

ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ভাবে সেই দিনগুলোর কথা। তারা তিন বোন মিলে পুতুল খেলছিল। হঠাৎ জ্যাঠা আর জ্যাঠিমা ঘরে এল। জ্যাঠা মাকে বলল, তোমার ঝুমার জন্য একটা ভালো ছেলে পেয়েছি। ব্যবসা করে। ওদের পৈতৃক ব্যবসা। যৌথ পরিবার। কিন্তু মা বলল, ওর তো এখনো মাত্র পনেরো বছর।

জ্যাঠা বলল, দেখ, ওর বাবাও নেই। ঝুমা দেখতে ভালো। তিনটা মেয়ে নিয়ে তুমি কষ্টে আছ। তোমার ছেলে গোপাল, সে তো কোনো রকমে একটা চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে। তার চেয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। একটার তো গতি হবে।

জ্যাঠিমা বলল, তাছাড়া তুমি তো জানো, গত মাসে সবিতা যে ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছে।

মা বলল, ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই শুনলাম ওদের মেনে নিয়েছে।

জ্যাঠিমা মাকে বকা দিয়ে বলল, আরে ছাড় তো! সবাই যে মেনে নেবে তার কি গ্যারান্টি আছে? ঝুমার তো ওর সাথে বন্ধুত্ব। তাই বলছি মানে সম্মানে মেয়েকে বিদায় কর।

জ্যাঠা বলল, দেখ, আমার ভাইটা অকালে মারা গেছে। আমরাও তোমাদের তেমন কিছু সাহায্য করতে পারছি না। আমাদের বড় সংসার। জ্যাঠিমা জ্যাঠার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, বাড়তি কথা রাখো তো। যেটা বলতে এসেছো সেটা নিয়ে আলোচনা করো। তাছাড়া আমরা কি ওদের পর নাকি? মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে আমরা কি ওদের পাশে থাকব না? মেয়ে বিয়ে দেওয়ার টাকা আছে? ওর বাবার অফিস থেকে যা পেয়েছে খেতে খেতে তো ফুরিয়ে যাচ্ছে।

মা কাচুমাচু হয়ে বলল, ঠিক আছে বড়দি, আপনারা যা ভালো বোঝেন।

পাশের ঘরে তিন বোন পুতুল খেলা ছেড়ে এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল। ছায়া আর জয়া হঠাৎ কেঁদে উঠল। জয়া বলল, এ্যাই ঝুমা, তোর বিয়ে হয়ে যাবে? আমরা তাহলে কার সাথে পুতুল খেলব?

ঝুমা দুই বোনকে জড়িয়ে ধরল। মুখে কোনো শব্দ বের হলো না।

বড় পরিবারের কথা শুনে মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আত্মীয়স্বজন সবাই যখন বলল, ওদের অনেক টাকাপয়সা। তোমার মেয়ে ভালো থাকবে। মা আর কোনো উপায় না দেখে রাজি হয়ে গেল।

এসব ভাবতে ভাবতে ঝুমা যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানে না। মেজ জা’র ডাকে ঘুম ভাঙল— কী রে ঝুমা, আর কতক্ষণ ঘুমাবি? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বড়দি গরু নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। চা না পেলে আবার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে। তাড়াতাড়ি আয়।সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে দে।

ঝুমা ধড়ফড় করে উঠে গেল। আবার কাজে লেগে গেল। সবাইকে খাবার দিয়ে রাতের রান্নার আয়োজন করতে বসল। তখন কাজ করতে করতে তিন জা বসে গল্প করে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাতে ঘুমাতে যায়।

ঝুমা যখনই বাপের বাড়িতে যায় কাজের ভয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসতে চায় না। মা সেটা বোঝে। কিন্তু কী করবে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে। পরের ঘরেই তো সারাজীবন সুখে দুঃখে কাটাতে হবে। মেয়েকে বোঝায়— দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঝুমা বলে, জানো মা, আমার কত মরিচ মসলা বাটতে হয়। আমার হাত জ্বালা করে। একদম ইচ্ছে করে না।

মা ঝুমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি দেখেছি তোর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে। একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর। দেখবি তোর আর এক দেবরের বিয়ে হলে তোর চাপ কিছুটা কমবে।

তখন জ্যাঠিমা এসে বলল, শোন ঝুমা, ভালো থাকতে গেলে একটু পরিশ্রম করতে হয়। তোর ছেলে কোথায়?

ঝুমা বলল, ছায়া আর জয়ার সাথে খেলছে।

জ্যাঠিমা একটা পিঁড়ি নিয়ে বসতে বসতে বলল, ওরা বাচ্চা খুব ভালোবাসে। আচ্ছা, যা বলছিলাম, শোন মা, এখানে তোরা ঠিক মতো খেতে পাসনি, পরতে পাসনি। ওখানে তো শুনেছি তোদের এলাহি খাওয়াদাওয়া। জামাই তোকে শাড়ি, গয়না কিনে দেয়। বড় সংসারে ওরকম একটু কাজ করতে হয়।

ঝুমা বলল, তুমি ঠিক বলেছ জ্যাঠিমা। খাওয়া-পরার কোনো অভাব নেই। কিন্তু সারাদিন এত কাজ যে শেষই হতে চায় না। কেউ মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে, কেউ মাঠে সবজি খেতে যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে আসছে। আর বলো না। ও আচ্ছা মা, শুনেছি পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছে। ও বাপের বাড়িতে আসছে কিনা জানো? একটু দেখা করতাম।

মা বলল, এসেছে, তবে এখন ওদের সবার মন ভালো নেই। তাই তোকে বলিনি।

জ্যাঠিমা কপাল কুঁচকে বলল, কেন রে ঝুমা, তুই কিছু শুনিসনি? তোর মা বলেনি?

ঝুমা অবাক হয়ে বলল, কীসের কথা বলছ জ্যাঠিমা?

মা বলল, আসলে বড়দি, ঝুমা এল আজ দুই দিন। ওর শ্বশুরবাড়ির কথা শুনতে শুনতে আর বলা হয়নি।

জ্যাঠিমা বলল, পূর্ণিমার জ্যাঠতুতো বোন বেবি গত সপ্তাহে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।

ঝুমা মুখে হাত দিয়ে বলল, কেমন করে?

জ্যাঠিমা বলল, বেবি এখানে বাপের বাড়িতে ছেলে আর জামাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল। পূর্ণিমাও এসেছে। সব বোনেরা মিলে বেবির জামাইয়ের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। আসার পথে দুর্ঘটনা হলো। জামাইও আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ভাগ্যিস ছেলেটাকে সেদিন ওদের সাথে নিয়ে যায়নি।

ঝুমার চোখ ছলছল করে উঠল। সে কান্না চেপে রেখে বলল, বেবিদি খুব ভালো ছিল। আমরা তিন বোন ওদের বাড়িতে গেলে বেবিদি আমাদের গাছ থেকে পেড়ে অনেক বরই দিত। আমি আজ বিকেলে যাব ওদের বাড়িতে।

জ্যাঠিমা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, হ্যাঁ যাস। উফ্ আমার কোমরের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। আমি যাই, বিছানায় শুয়ে দেখি কমে কিনা।

জয়া আর ছায়া ঝুমার ছেলেকে নিয়ে এল। জয়া বলল, এ্যাই বড়দি, তোমার ছেলে কান্না করছে। মনে হয় খিদে পেয়েছে। ছায়া বলল, না না, ওর ঘুম পেয়েছে। ঝুমা বলল, এখন তো দুপুরের খাবার সময় হলো। আমি ওকে স্নান করিয়ে আনি। মা ওর জন্য একটু ভাত নাও। একেবারে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখব।

জয়া বলল, এ্যাই মেজদি চল, আমরাও স্নান করিগে।

ছায়া বলল— জানো বড়দি, জয়া এখন সাঁতার কাটতে পারে।

ঝুমা বলল, বাহ্ খুব ভালো।

ওরা যাওয়ার পর মা ঝুমাকে নিয়ে মনে মনে ভাবে, মেয়েকে কোনোদিন চুলার আগুনে যেতে দেয়নি। সেই মেয়ে আজ কতজনের জন্য রান্না করে। আশীর্বাদ করি মা, তোর সংসারে তুই একদিন ঠিক খাপ খাইয়ে যাবি। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকবি।

দুই বছর পর।

মা, মাগো, এবার যেতে দাও না আমায়। সবাই যাচ্ছে পিকনিকে। আমার স্কুলের বন্ধুরাও তাদের মা-বাবার সাথে যাচ্ছে। আমাকে জ্যাঠা, জ্যাঠিমার সাথে যেতে দাও না মা। জয়া তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেই যাচ্ছে। মা একসময় বিরক্ত হয়ে বলল— আ, বেশি জ্বালাস না তো। ঠিকমতো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। তার উপর তোর এত বায়না কীসের?

জয়া কেঁদে কেঁদে বলল, কখনো কোথাও যেতে পারি না। সবাই বেড়াতে যায়। শুধু আমরা পারি না।

মা জয়াকে বোঝাতে লাগল— দেখ মা, তোর বাবা হঠাৎ মারা যাওয়াতে আমরা খুব সমস্যায় পড়ে গেছি। তোর দাদা অনেক কষ্টে সামান্য একটা চাকরি করে। ছায়া লেখা পড়ায় দুর্বল তাই সে আর লেখাপড়া করছে না। আমার কাজে সাহায্য করে। তোর লেখা পড়া, ঝুমার শ্বশুরবাড়ি থেকে মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজন আসে ওদের জন্য খরচ, এগুলো অনেক কষ্টে সামলাতে হয়। শোন, যখন গোপাল একটা বড় চাকরি পাবে তখন তোর সব বায়না শুনব। এখন আমাকে কাজ করতে দে।

জয়া তারপরও বলতে লাগল, কিন্তু মা, তুমি তো প্রতিবছর এটা বল। এখন আমি সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠব। আর কত বড় হলে যেতে পারব।

মা বলল, আচ্ছা তুই যে পিকনিকে যাবি বলছিস, তোর তো একটা ভালো গরম জামা চাই। তাই না? কিন্তু তেমন ভালো গরম জামা তো তোর নেই। এখন যা ঠাণ্ডা পড়েছে।

জয়া বলল, ঠিক আছে, তাহলে এবার গরম জামা কিনে দেবে, পরের বছর পিকনিকে যাব। মা বলল, দেখি তোর দাদার সাথে কথা বলব। তারপর জয়া সেখান থেকে মুখ গোমড়া করে চলে গেল।

জয়া সবার ছোট, তাই সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। লেখাপড়ায় ওর খুব আগ্রহ। ওর দাদা অফিস থেকে এসে ওকে পড়ায়। ওর জ্যাঠিমাদের অবস্থা ভালো। কিন্তু তবুও মা ওদের থেকে কোনো সাহায্য বা যে কোনো ব্যাপারে কিছু বলতে সঙ্কোচ বোধ করে।

ছায়া পুকুর থেকে থালা বাসন ধুয়ে এসে জয়ার পিকনিকে যাওয়ার কথা শুনে মাকে বলল, আচ্ছা মা, আমরা না হয় গরিব। কিন্তু জ্যাঠিমা চাইলে তো উনার সাথে জয়াকে নিতে পারত। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে নানা সংগঠন থেকে সবাই পিকনিকে যায়। আমাদেরও তো ইচ্ছে করে। কিন্তু আমরা যেটা বুঝি জয়া তো ছোট, সে বোঝে না।

মা বলল, এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য করে না। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীও দূরে সরে যায়। অনেক আত্মীয় তো আমাদের পরিচয় দিতেও লজ্জা পায়। তাছাড়া ওরা জয়াকে নেবেইবা কেন? অন্যের মেয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক সমস্যা।

ছায়া হেসে বলল— মা, তুমি সবসময় ওদের দোষ ঢেকে রাখ।

এমন সময় জয়ার দাদা ঘরে ঢুকল। ওর সামনে ওরা তেমন কোনো কথা বলে না, চুপ থাকে। কারণ সে অনেক পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছে। তাই তাকে বাড়তি কোনো কথা শোনায় না। কিন্তু আজ সে এসে তাদের কথা শুনে বলল, আমাদের কাউকে পরিচয় দিতে হবে না মা। আমরা যেমন, ঠিক তেমনিই থাকব। আমাদের তো দুটো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। তবে দেখ, জয়া একদিন লেখাপড়া করে অনেক নাম করবে এটা আমার বিশ্বাস।

মা বলল, তুই এসব ভাবিস না। বাদ দে মানুষের কথা। হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি খাবার দিচ্ছি। ছায়া চা বানাতে চলে গেল। এমন সময় দাদার গলা শুনে জয়া তাড়াতাড়ি পড়তে বসে গেল। মা ছেলেকে জয়ার পিকনিকে যাওয়ার কথা বলল। তখন সে বলল, তুমি কিছু ভেবো না মা, আমি ওকে ঠিক বুঝিয়ে দেব।

তারপর সে যখন জয়াকে পড়াতে বসল তখন বলল— আচ্ছা জয়া, তোর তো বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন মিনুর থেকে অষ্টম শ্রেণির যে বইগুলো এনেছিস অংকগুলো বুঝতে পারছিস?

জয়া প্রতি বছর ওর মাসতুতো বোনের কাছ থেকে পুরোনো বই এনে পড়ে। নতুন বই কখনো সে পড়তে পারেনি। তাতে তার কোনো দুঃখ নেই। বই পড়তে পারলেই সে খুশি।

জয়া বাংলা বইয়ের একটা অধ্যায় পড়তে পড়তে বলল— না দাদা, সব বুঝতে পারছি না।

দাদা বলল, ঠিক আছে, আমি বুঝিয়ে দেব। আচ্ছা তোদের প্রাইমারি স্কুলে যে প্রবাল স্যার ছিলেন শুনেছি উনি ট্রান্সফার হয়ে গেছেন? খুব ভালো স্যার ছিলেন। তোর মনে আছে জয়া, পঞ্চম শ্রেণিতে উনি তোকে ‘কোনো এক মাকে’ কবিতাটি আবৃত্তি করা শিখিয়েছিলেন?

জয়া বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার মনে আছে। তুমি আর স্যার মিলে আমাকে কবিতাটি কীভাবে অভিনয় করে বলতে হবে সেটা শিখিয়েছিলে। আর আমি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম। আসলে উনি খুব ভালো ছিলেন।

ছায়া চা আর জলরুটি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, কেন আমাদের হাই স্কুলের সুজন স্যারও তো বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তোর অভিনয় দেখে বলেছিলেন তোকে টিভিতে অভিনয় করাবেন।

জয়া একটা রুটি নিয়ে খেতে খেতে বলল, উনি তো পরের বছর বন্দরে চাকরি পেয়ে চলে গেছেন।

দাদা চা রুটি খেয়ে বলল, ভালো স্যারগুলো তাড়াতাড়ি ট্রান্সফার হয়ে যায়। আচ্ছা ওসব বাদ দে, শোন জয়া, তুই নাকি পিকনিকে যেতে চাস? জানিস, অন্যের সাথে পিকনিকে গিয়ে কোনো মজা নেই। নিজের পরিবারের সাথে যে কোনো জায়গায় গেলে তুই যে আনন্দ পাবি অন্য কোথাও সেটা পাবি না।

জয়া মাথা চুলকিয়ে বলল, না দাদা, আমার সব বন্ধুরা যাচ্ছে তো। ওরা বলে, আমি নাকি কোনো বছর যাই না। আমাকে কিপ্টে ডাকে।

দাদা বলল, দেখ, অনেকে অনেক কিছু বলবে, কারও কথা শুনতে নেই। আমরা একটা কাজ করব। এই মাসের শেষে আমরা সবাই একদিন ঝুমার বাড়িতে বেড়াতে যাব।

জয়া খুশি হয়ে বলল, সত্যি বলছ দাদা?

দাদা বলল, হ্যাঁ রে সত্যি। আর তুই যদি এবার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করিস তোকে সুন্দর একটা সোয়েটার কিনে দেব।

জয়া খুশিতে ডেকে উঠল— মা, মেজদি, এদিকে এসো। শোন, দাদা কী বলছে।

জয়া ঝুমার বিয়ের পর থেকে ওর বড় দুই বোনকে আর নাম ধরে ডাকে না। রান্নাঘর থেকে মা আর মেজদি দৌড়ে এল।

সব শুনে জয়াকে জড়িয়ে ধরে মা বলল, এই তো আমার মেয়ের মুখে হাসি ফুটেছে। তারপর মনে মনে ভাবল, আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়ের বায়না কত সহজেই মেটানো যায়।

এরপর ডিসেম্বরের শেষে ওরা সবাই মিলে ঝুমার বাড়িতে বেড়াতে গেল। ঝুমা তো খুব খুশি। গোপাল একদিন থেকে চলে এল— ওর অফিস খোলা তাই। মা ভাসুরের ছেলের বৌকে দুই দিনের জিনিস দিয়ে এল যাতে গোপালকে একটু রান্না করে দেয়।

জয়া, ছায়া দিদির বাড়িতে এসে এখানে ওখানে বেড়াচ্ছে। সিনেমা দেখতে গেল সবাই মিলে। তারপর ওদের মার্কেটে নিয়ে জামা কিনে দিল। ওরা মহাখুশি। কিন্তু ওদের মায়ের মন পড়ে আছে ছেলের জন্য। বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। ঝুমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওদেরকে আরও কিছু দিন থাকার জন্য অনুরোধ করলেও ওর মা নারাজ। অগত্যা ঝুমার স্বামী ওদেরকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিল।

সেদিন ছিল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল— সোমবার। সারাদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সবাই বলছে সিগন্যাল দিয়েছে। বন্যা হতে পারে। জয়া এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। জয়ার মা ওকে স্কুলে যেতে বারণ করেছে। কিন্তু তারপরও সে স্কুলে গেল।

সেদিন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান ছিল। ক্লাস তেমন হয়নি। বাড়িতে ফেরার পথে জয়া ওর বন্ধুদের সাথে বলাবলি করছিল বন্যা হবে প্রতিবার বলে কিন্তু হয় না। একবারও বন্যা দেখিনি। এবার হলে দেখতে পারব।

আঁখি বলল, ঠিক বলেছিস। ইস্ বৃষ্টিতে একটু ভিজতে পারতাম কিন্তু মা বকা দেবে।

জয়া বলল, হ্যাঁ রে। চল আর দেরি করিস না, বৃষ্টি বাড়ছে।

দুপুরে খেয়েদেয়ে জয়া শুয়ে পড়ল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখল বৃষ্টি একটুও কমেনি। মনে মনে একটু ভয় পেল সে। বন্যা কি তাহলে সত্যি সত্যি হবে? মাকে বিকেলে বলল— মা, আজকে লুচি বানাও।

ছায়া রেগে বলল, মানুষ আছে মানুষের জ্বালায়, তোর খাওয়ার কথা, না?

মা বলল, তোরা ঝগড়া করিস না। আমি বানাচ্ছি।

আজ ওদের দাদাও অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এল। এসে একই কথা বলছে। সে কাপড়চোপড় ছেড়ে দরকারি সব জিনিসপত্র ওদের ঘরের ছাদের উপর তুলে রাখছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এল। বৃষ্টির সাথে সাথে দমকা বাতাস বইছে। টেলিভিশনের খবরে বারবার বলছে ১০ নম্বর সিগন্যাল। বন্যার পূর্বে এবং পরে কি করতে হবে তা টিভিতে দেখাচ্ছে। সবাই ঘরে ঘরে সতর্ক হয়ে গেল।

রাতে ভাত খেয়ে ওরা শুতে এল। জ্যাঠিমা শুধু ঠাকুরকে স্মরণ করে যাচ্ছে। গোপাল এ ঘর থেকে ও ঘরে পায়চারি করছে এবং বারবার সামনে দরজা খুলে দেখছে। জয়া আর ছায়া বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। মা বিছানায় বসে আছে আর মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করছে।

যখন বারোটা বাজল তখন গোপাল হঠাৎ দরজা খুলে চিৎকার করে উঠল— মা, পানি পানি।

মা তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দেখল সত্যি সত্যি বন্যার পানি ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে গেছে। সাথে প্রবল বেগে ঢেউ। মা তখন জয়া আর ছায়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। গোপাল ওদেরকে পাশের বাসার দোতলার ছাদে দিয়ে এল। সে জ্যাঠতুতো ভাইদের সবাইকে জাগিয়ে দিল। তারপর যাদের ছাদে ওরা গেল তাদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে জাগাল। এভাবে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে ছাদে চলে এল।

পানি তখন ঘরে ঢুকে গেছে। জয়ার বড় জ্যাঠতুতো ভাইয়ের মেয়ে দুটি ওদের টিনের চাল বেয়ে ছাদে উঠে এল। সবাই ভিজে চৌচির। কারণ বন্যার পানির সাথে সাথে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল আর বাতাস প্রবল বেগে বইছিল। মাঝে মাঝে অগ্নিবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। জয়া তখন শীতে কাঁপছে। আর মনে মনে ভাবছে, ইস বিছানা থেকে কাঁথাটা সাথে নিয়ে এলে হয়তো ঠাণ্ডা লাগতো না। ওর ছোট জ্যাঠতুতো ভাই রেডিও কানে দিয়ে বসে আছে। মহিলারা এক পাশে বসা আর পুরুষরা পায়চারি করছে। ওরা দেখছে পানি কতটুকু উঠছে। সবাই এই তুফান আর বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃদ্ধ, যুবক, শিশু সবাই।

মাঝে মাঝে নারিকেল গাছ থেকে ছাদে নারিকেল পড়ছে। একপর্যায়ে দেখা গেল পানিতে জয়াদের ঘর সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। বৃষ্টি, দমকা হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে অন্ধকারে সবাই আতঙ্কে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে কখন ভোরের আলো ফুটবে। এভাবে যখন রাত পার হয়ে সকাল এল তখন ওরা দেখল বন্যার তাণ্ডবলীলা। ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে সমস্ত ঘরবাড়ি পানিতে ভাসছে।

ধীরে ধীরে বৃষ্টি আর বাতাস কমল। কিছুক্ষণ পরে পানি কমতে শুরু করল। সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেল। জয়াদের রান্নাঘর ভেঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শোবার ঘরগুলো পানিতে ভর্তি। ঘরের এককোণে চাকার মতো গর্ত হয়ে আছে যেন ঘূর্ণিপাকে পড়েছে। গোপাল আর ছায়া মিলে গামলা দিয়ে পানি সরাচ্ছে। জয়ার সেলফভর্তি সব বই ভিজে নিচে পড়ে আছে। শুধু নবম শ্রেণির নতুন বইগুলো ছাদে তোলা ছিল।

বাবার হাতের তৈরি আলমারিটাও পড়ে গেছে। সেখানে মায়ের তিনটা প্রিয় গল্পের বই ছিল— নন্দিনী, সংসার, অভিনয় নয়। যা জয়ারও খুব পছন্দের ছিল। আরও ছিল ঠাকুরমার ঝুলি। যে বইয়ের অরুণ বরুণ কিরণমালা, ডালিম কুমার, লাল কমল নীল কমল, রাক্ষস খোক্ষসের গল্পসহ আরও অনেক গল্প মা জয়াদের ঘুমানোর সময় শোনাত। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল জয়ার। অনেক দরকারি ও প্রিয় জিনিস নষ্ট হয়ে গেল।

ওদের রান্নাঘর পড়ে গেল। তবে ঘরের একটা বাসনপত্র কোথাও ভেসে যায়নি। চুলার জ্বালানিও নষ্ট হয়নি। ছায়া রান্নাঘরের সব বাসনপত্র নিয়ে ধুয়ে ফেলল। সে ওর দাদার সাথে মিলে সব পানি সরিয়ে ফেলল। তারপর দাদা ঘরে ইট বিছিয়ে দিল যাতে সবাই হাঁটাচলা করতে পারে।

ছায়া অনেক আম আর নারিকেল কুড়িয়ে আনল। বৃষ্টি যখন থামল ওদের দাদা বাজারে গিয়ে চড়া দামে একটি রান্নার জন্য স্টোভ, কেরোসিন তেল, ডিম ও কিছু কাঁচা বাজার কিনে আনল। মা দুপুরের জন্য ডিম আর ডাল রান্না করল। এর আগে ওরা ঘরে যা শুকনো খাবার ছিল তা খেয়েছিল। তবুও সারারাত জেগে থাকায় ওরা ভাতের জন্য আকুল হয়ে বসে রইল। সেদিন ভাত খেতে খেতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার কেউ কেউ স্টোভে আর কেউ চুলা বানিয়ে কোনো রকমে রান্না করে খেল।

দু’দিন পর ওদের আত্মীয়স্বজনরা দেখতে এল। ওরা নাকি শুনেছে এখানে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে। ঝুমার স্বামী এসে বলল, ঝুমা খুব কান্নাকাটি করছে। সে বলেছে ওদেরকে যেন তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসে। মা জামাইকে বলল সে যেন ঝুমাকে বোঝায়। তিনি তারপর ওদের রান্না করে খাওয়াল। জয়া ভিজে যাওয়া কিছু কিছু বই রান্নাঘরের চালে শুকাতে দিল। কিন্তু তা আর ফিরে পাওয়া গেল না।

এর মধ্যে বেশ কিছু রিলিফ পাওয়া গেল। ওরা কিছু শুকনো খাবার রেখে বাকিগুলো পাশের বাসায় দিয়ে দিল।

সপ্তাহখানেক পর ঘরে ঘরে সবার ডায়রিয়া, আমাশয় শুরু হলো। এর মধ্যে বেশি খারাপ অবস্থা হলো জয়ার আর ওর জ্যাঠিমার। আর হবেই-বা না কেন, তখন সবার যেভাবে আম আর নারকেল খাওয়া হলো। বন্যার পরে মাছ, মাংস সব বন্ধ। শুধু ডিম আর সবজি। বন্যার পরে বৃষ্টি প্রায় বন্ধ।

চারপাশের পুকুর থেকে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। কারেন্ট নাই। স্কুল বন্ধ। জয়া প্রায় বিছানায়। ওর মা আর ছায়া তখন খুব সেবা করেছে। ওকে ডাক্তার দেখানো হলো। ভালো ভালো খাবার, ওষুধ দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে জয়া সুস্থ হয়ে উঠল।

বন্যার প্রায় মাস খানেক পর জয়া খবর পেল সে ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। দুঃখের মাঝে এই বিরাট আনন্দের খবর। ওর বান্ধবীর ভাই সন্ধ্যায় এসে খবরটা দিল। প্রথমে ওর দাদা আর গৃহশিক্ষক বিশ্বাস করেনি। পরে ওদের স্কুলের এক শিক্ষক থেকে জেনে স্বস্তি পেল। খবরটা শুনে সবাই খুব খুশি হলো। সেই বছর ওদের স্কুল থেকে দুজন বৃত্তি পেয়েছে। এই প্রথম জয়ার ছবি পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে দেখে সে তো আনন্দে আটখানা। ওদের পাড়ার ক্লাবে, স্কুলের ক্লাবে এবং স্কুলে ওদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

এর দুই বছর পর ছায়ার বিয়ে হয়ে গেল। জয়া একা হয়ে গেছে। খাবার নিয়ে ঝগড়া, মায়ের পাশে ঘুমানো নিয়ে ঝগড়া, খুনসুটি করার মতো আর কেউ রইল না।

এখন জয়া লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। মাঝে মাঝে ও পড়া নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে মা ওকে খাইয়ে দেয়। ক্লাসে প্রতিবছর প্রথম হয় তাই ওর টেনশনও বেশি। মা সবসময় ওকে বোঝায়, বেশি চিন্তা করিস না। দেখবি তোর রেজাল্ট ভালো হবে।

জয়া যে স্যারের বাসায় ব্যাচে কোচিং পড়ত উনি একদিন চা পর্বের আয়োজন করে ওদের কলম উপহার দিয়ে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। ওদের সবাইকে পরীক্ষার নানা নির্দেশনা দিয়ে সবার জন্য শুভ কামনা করল।

স্কুলে যেদিন বিদায় অনুষ্ঠান হলো সেদিন সবার মন খুব ভারাক্রান্ত। জয়া শুধু বলে যাচ্ছে— ইস, স্কুলজীবনটা আমাদের কত মজার ছিল!

মুন বলল, ঠিক বলেছিস। কখনো ভুলতে পারব না। এক একজন ভিন্ন ভিন্ন কলেজে চলে যাব।

আঁখি বলল, আসলে আমাদের একই স্কুলে দশ বছর কাটানো, শিক্ষকদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা, শাসন এগুলো কখনোই ভোলা যায় না।

জয়া বলল, একদম। আমাদের ভাগ্য ভালো হলে হয়তো আবার একই কলেজে পড়তে পারব। ঠিক আছে চলি রে। সবাই ভালো ভাবে পরীক্ষা দিস। ভালো থাকিস।

জয়ার এসএসসি পরীক্ষার সময় ওর দাদা অফিস থেকে এসে ওর পরীক্ষার খবর নিয়ে আবার অফিসে চলে যেত। ওর স্যারও খবর নিত। এভাবে একসময় পরীক্ষা শেষ হলো।

ওর পরীক্ষা শেষে মহা ধুমধামে গোপালের বিয়ে সম্পন্ন হলো। ঝুমা তার দাদার বিয়েতে এসে অনেক দিন থেকে গেল। শ্বশুরবাড়ির কাজ থেকে কিছুটা রেহাই পেল। এর মধ্যে ওর একটা দেবরের বিয়ে হয়েছে। ননদের বিয়েও হয়েছে। বড় সংসার হওয়ায় কাজের চাপ বেশি। তাই বাপের বাড়িতে এলে সহজে সে যেতে চায় না।

ছায়াও এল তার পরিবার নিয়ে। আর জয়া তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে দাদার বিয়েতে খুব আনন্দ করল। এর মধ্যে ওর এস এস সির রেজাল্ট বের হলো। সবার আশা ছিল স্ট্যান্ড করবে কিন্তু অল্প কিছু নাম্বারের জন্য পেল না।

জয়ারা পাঁচ বন্ধু একসাথে ভর্তি হয়েছে একই কলেজে। দুই বছর আনন্দের মাঝে একসাথে স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া, মার্কেটে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া সবকিছুর মধ্যে দিয়ে এইচএসসি শেষ হলো।

ওরা এখন ভিন্ন ভিন্ন কলেজে একা ভর্তি হলো। পাড়ার বন্ধু যারা তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হলেও বাকিদের সাথে দেখা হয় না। জয়া মনে মনে ভাবে আবার যদি স্কুলজীবন ফিরে পেতাম কত মজাই না হতো। বৌদির সাথে ওর খুব ভালো সম্পর্ক। তাই মোটামুটি ভালোই সময় কাটছে। মাঝে মাঝে দিদিরা এলে ঘরে বেশ জমজমাট হয়। খাওয়া, বেড়ানো, ওদের সন্তান, দাদার সন্তান সব পিচ্চিকে নিয়ে সারাক্ষণ হৈচৈ পড়ে যায়।

এসবের মধ্যে জয়ার মা ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে। জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বউ বলে, আপনার মেয়েকে একটু না দেখলে আপনার টেনশন বেড়ে যায়। আচ্ছা কাকিমা, ওকে বিয়ে দিলে যদি দূরের গ্রামে বিয়ে হয় তাহলে আপনি কী করবেন।

জয়ার মা অমনি রেগে যায়। বলে— না না, আমি ওকে শহরে বিয়ে দেব, যাতে ওকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতে পারি।

একসময় জয়ার বিয়ে হয়ে যায়। ওর মায়ের ইচ্ছা পূরণ হলো। ওর শ্বশুরবাড়ি শহরে।

প্রতি বছর দুর্গাপূজা এলে জয়ার ওর মায়ের কথা মনে পড়ে। বিয়ের পর মায়ের সাথে আর পূজা কাটানো হয়নি তার। পূজার সময় মা নারকেল আর তিলের নাড়ু বানাত। সে মাকে বলত— মা, তোমার সব নাড়ু বানানো হয়ে গেলে আমার জন্য কড়াইটা রাখবে। আমি চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাব। তোমার বানানো নাড়ু খেতে কী যে মজা!

ঝুমা আর ছায়া ওর সাথে খুনসুটি করত।

মা হেসে বলত, আমি তো জানি তুই পছন্দ করিস, তাই তোর জন্য রেখে দিয়েছি।

ওর যত আবদার, বায়না সবকিছু মায়ের কাছে। যতক্ষণ সে স্কুল বা কলেজ থেকে আসত না ততক্ষণ মা পথ চেয়ে বসে থাকত। অনেক সময় কারেন্ট চলে গেলে মা মাথায় চুলের বিলি কেটে দিতে দিতে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেই যেত। যতক্ষণ না তার ঘুম আসছে। মাঝে মাঝে গল্পও শোনাত।

কোনো কিছু খেতে না চাইলে সাথে সাথে ওর পছন্দের খাবার তৈরি করে দিত। ওর দাদা মাঝে মাঝে মাকে বলত, তুমি ওর অভ্যাস খারাপ করে ফেলছ, মা। সবকিছু না খেলে হবে? খাবারে এত বাছবিচার ভালো না। মা তবুও মেয়ের আবদার পূরণ করেই যেত। মোটকথা ওর জীবন ছিল মায়ের স্নেহে পরিপূর্ণ যা কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেয় না।

বিয়ের পর জয়া বাপের বাড়িতে গেলেও মায়ের সাথে তেমন আগের মতো কথা বলার সুযোগ পেত না। কারণ তাকে সেখান থেকেও কলেজ, কোচিং এসব করতে হতো। বেশিদিন থাকতেও পারত না। তারপরও মা তার পেছন পেছন থাকত যাতে মেয়ের কোনো কিছু কষ্ট না হয়। আর একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো, জয়ার বিয়ের পর তিন/চারবারের মতো ওর মা ওদের বাসায় এসেছে। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে তার বাসায় ভাত খাওয়া হয়নি। কখনো ভোগের প্রসাদ, কখনো ফলমূল, কখনোবা চা-নাস্তা খেয়েছে।

একদিন জয়া ভাবছে, বিয়ের আগে বৌদি আর আমি মিলে মাকে ভাত কম খেতে বলতাম কারণ মায়ের সুগার, হাই প্রেসার ছিল। তাই মা যাতে সুস্থ থাকে সেই চেষ্টা করতাম। তখন মা বলত, একদিন খাওয়াতে চাইলেও খাওয়াতে পারবি না। তাই মনে হয় আমার বিয়ের প্রায় এক বছর হয়ে আসছে মা এখনো আমার বাসায় এসে ভাত খেতে পারেনি। একটা না একটা সমস্যা। হয় উপোস না হয় অসুস্থ থাকে।

সেদিন রোববার দুপুরে জয়া ওর ভাসুরের ছেলেকে কোলে বসিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সে দুষ্টুমি করছে। তখন ওর শ্বশুর অফিস থেকে এসে বললেন জয়ার বৌদির মা সিঁড়ি থেকে পড়ে মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছে সে দেখতে যাবে কিনা। জয়া যেতে চাইলে উনি তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে তৈরি হতে বললেন।

জয়ার জা যখন ছেলেকে ভাত খাওয়াচ্ছে তখন সে বলল— জানো দিদি, আমার মাকে গত মাসে অসুস্থ দেখে এসেছিলাম, কেমন আছে জানি না। মা সুস্থ হয়ে আমাদের বাসায় আসবে বলেছিল। মাসিকে ছাড়া তো মা আসবে না। এর মধ্যে আবার মাসির এই দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ওর জা মাথা নেড়ে শুধু হু হা করে গেল। তেমন কোনো উত্তর দিল না।

তখন রমজান মাস। ওরা তিনজন টেক্সিতে করে মেডিকেলে এল। ওখানে জয়া দেখল, মাসি বেডে বসে আছে আর মা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে। মায়ের শরীরে চারপাশে বিভিন্ন স্যালাইনের নল। মাথা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। ও দেখে বুঝল কেন ওর জা চুপ ছিল। জয়া চিৎকার করে কাঁদতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

মাসি জানাল আজ মাকে নিয়ে তার জয়াদের বাসায় আসার কথা। সকালে দাদা অফিসে যাওয়ার সময় মাকে বলে দিয়েছে বৌদি আর মাসি ব্যাংক থেকে আসার পর মা মাসির সাথে ওদের বাসায় আসবে। মা বলেছে ওর জন্য একটু মোয়া বানিয়ে নেবে। জয়া তখন প্রেগন্যান্ট ছিল। দাদা বলেছে কিনে নিয়ে যেতে কারণ কিছুদিন আগে মা অসুস্থ ছিল।

সবাই যখন চলে গেছে মা তখন জয়ার জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছোট মেয়েকে দিয়ে চিড়া গুড় কিনে এনে হিটারের চুলায় মোয়া বানাতে বসল। হঠাৎ মায়ের শাড়ির আঁচল চুলায় পড়ে সেখান থেকে আগুন শরীরে লেগে যায়। ঐ মেয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে আগুন দেখে দৌড়ে এসে সামনে চটের বস্তা পেয়ে সেটা দিয়ে চেপে ধরে আগুন নেভাল। ওর চিৎকার শুনে কাজ ফেলে ওর মা এসে জয়ার মায়ের এই অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল।

পরে পাড়ার কয়েকজন এসে ওর মাকে মেডিকেলে নিয়ে এল। মাকে অনেকবার মা মা করে ডাকল জয়া। কিন্তু মা সাড়া দিল না। সে মায়ের ডান হাতটা ধরল। বাম হাত অবশ। ওর মায়ের নাকে যে নল লাগানো ছিল ডান হাত সেখানে বারবার নিয়ে যাচ্ছে। ওকে বেশিক্ষণ থাকতে দিল না। ওর মায়ের শরীরের পোড়া অংশগুলো ওকে দেখতে দেয়নি। এরপর ওকে আর নিয়ে যায়নি। ঝুমা আর ছায়া ওর মায়ের সাথে ছিল। ঝুমা জয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তুই ভাবিস না, মা ভালো হয়ে যাবে। ছায়াও একই কথা বলে ওকে বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল।

জয়ার আড়ালে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই ওর মাকে নিয়ে কথা বলে। জয়া কলেজে, স্যারের বাসায় পড়তে যাচ্ছে। ওর শ্বশুরকে বলল ওকে একটু নিয়ে যেতে। উনি জানালেন এসময় ওর মেডিকেলে যাওয়া উচিত নয়। ওর মা ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যাচ্ছে। ওকে পরে নেবে। কিন্তু এটা শুধুই সান্ত্বনা।

আসলে জয়ার মায়ের সেন্স আর আসেনি, অবস্থা খারাপের দিকে। ওর স্বামী প্রতিদিন চাকরিতে যাওয়া আসার সময় দেখে আসে। জয়াকে বোঝায়, এত চিন্তা করো না। তোমাকে আমি নিয়ে যাব। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নাও।

বুধবার সকালে জয়া এগারোটার দিকে স্নানে যাচ্ছে। তখন পাশের বাসার রুমাদি ওর জা’কে বলল যে জয়ার ভাসুর ফোন করেছে ওদের ল্যান্ডফোনে। ওর জা গেল। কেন জানি জয়ার খটকা লাগল। সে চুপিচুপি গিয়ে উনার কথা শুনল। দেখল, ওর জা ফোনে মাথা নেড়ে বলছে— ইস্, নেই। জয়া আর দাঁড়াতে পারল না। দ্রুত গিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

ওর জা এসে অনেকবার দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল— মাসির কিছু হয়নি, তুমি দরজা খোল।

শেষে ওর স্বামী আসার পর খুলল। জয়া ওর জা’কে জড়িয়ে ধরে বলল— দিদি, মা তো আমার বাসায় আসতে পারল না, আমি রান্না করে মাকে খাওয়াতে পারলাম না।

ওর জা’ও কান্না করছে।

ওকে এই অবস্থায় মাকে দেখতে না দিতে সবাই বললেও ওর স্বামী ওকে নিয়ে গেল, জয়ার জা সাথে গেল। ওখানে ওর শ্বশুর, ভাসুরও ছিল। আত্মীয়স্বজন, বৌদি, ওর বোনেরা সবাই মাকে ঘিরে বসে কান্না করছে। জয়াকে কাছে যেতে দেয়নি। সে একটু দূরে মাটিতে বসে পড়ল। মায়ের মুখের কাপড় সরিয়ে দূর থেকে দেখাল। সে দেখল মায়ের মুখটা ফুলে হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে। ঐ একটুকুই দেখা, সাথে সাথে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল।

জয়াকে ওর স্বামী আর জা মিলে বাসায় নিয়ে এল। সেদিন আর কেউ কিছু খায়নি। সন্ধ্যায় কিছু ফল এনে জয়াকে জোড় করে ওর স্বামী খাওয়াল। জয়া মাকে হারিয়ে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে। তবে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই ওকে নানারকম গল্প করে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করে। ওর শ্বশুর শাশুড়ি ওকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে। জা ওর নিজের বড়দির মতো স্নেহ করে। তারপরও জয়ার চারপাশটা বড় শূন্য মনে হয়।

এরপর জয়ার মা চলে যাওয়ার দশ দিনের দিন ওর বড় ছেলে সময়ের প্রায় এক মাস আগে অনেক কষ্ট পাওয়ার পর পৃথিবীতে এল। ওর দাদা, বৌদি, মাসি সবাই দেখে গেল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব খুশি।

সেদিন রাতে মা একবার এসেছিল জয়ার স্বপ্নে। ওর পাশের বেডে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। সে বারবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন চলে গেলে মা? কিন্তু ওর মা শুধু হেসেই যাচ্ছে। প্রত্যেক মানুষের এমন কিছু দহন থাকে যা মনের গভীরে ক্ষত সৃষ্টি করে জায়গা দখল করে নেয়, যা কখনো ভোলা যায় না। জয়ার মায়ের মৃত্যুটা এমন যে সে কখনো ভুলতে পারবে না।

১০

একে তো জয়ার বাবা ছোটবেলায় মারা গেছেন, মা-ও হঠাৎ দুর্ঘটনায় ওকে এতিম করে চলে গেল। মাকে সব মনের কথা বলে জয়া শান্তি পেত। মায়ের গায়ের গন্ধ ওর খুব চেনা। এখন কোথায় হারিয়ে গেছে সবকিছু।

একদিন ওর শ্বশুর ওকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, দেখ বউমা, মা-বাবা কারও চিরকাল বেঁচে থাকে না। কিন্তু তবুও মানুষকে সব মেনে নিতে হয়। আমরা তো আছি। তুমি কিছু ভাববে না। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো আর দাদুভাইকে মানুষ করো। শুনেছি তুমি ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতে। এখন অবসর পেলে তুমি আবার লেখা শুরু করো, দেখবে সময় কেটে যাচ্ছে।

জয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

ওর শ্বশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কেঁদো না। যাও দাদুভাইয়ের কাছে যাও।

তারপর জয়া ঘরে এসে ওর ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করল। তারপর ভাবল, সত্যি আমার কপালটা ভালো নাকি খারাপ এখনো বুঝতে পারি না। পরিবারে সবার ছোট হওয়ায় আদর পেয়েছি অনেক। দিদিরা বিয়ের পর যখন বাপের বাড়িতে নাইয়র আসত তাদের দেখে ভাবতাম আমিও বিয়ের পর এভাবে এসে থাকব। কিন্তু লেখাপড়ার চাপ আর নানা অসুবিধার কারণে দুই তিন দিনের বেশি থাকতে পারতাম না। স্কুলে পড়ার সময় খুব গান শেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ভেবে দাদা বারণ করল। তারপরও আবৃত্তি, গান, অভিনয় যতটুকু পারতাম চালিয়ে যেতাম। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় কাজল স্যার একদিন সবাইকে জিজ্ঞেস করল আমরা ভবিষ্যতে কে কী হতে চাই। একজন এক এক রকম বলল। আমি বললাম শিক্ষক হব।

এর মধ্যে ওর ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল। ছেলেকে দোলনায় রেখে আবার বিছানায় বসে ভাবতে লাগল। বিয়ের পর শ্বশুরের কাছ থেকে বাবার আদর পেয়েছি। উনি আমাকে মোটরসাইকেলে করে কলেজে পৌঁছে দিতেন। উনার খাবার থেকে আমাকে খেতে দিতেন। কি বিচিত্র জীবন আমার! কারও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আবার না চাইতেই কারও স্নেহ-ভালোবাসা পাচ্ছি। আমার স্বামী, জা সবাই আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে না হলে বিয়ের পর আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।

তবে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, মেয়েদের জীবন যেখানে যেমন সেখানে তেমন করে গড়ে নিতে হয়। নিজের বলতে কিছুই থাকে না। জন্ম থেকে বাপের বাড়ি, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি, বৃদ্ধ বয়সে ছেলের বাড়িতে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। যখন যেমন তখন তেমন করে মানিয়ে নিতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে সেই ছোট বেলা থেকেই বড়দের কাছে জেনে আসছি মানিয়ে নিতে হবে।

বাবা ঠিক বলেছেন, আমাকে এখন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে তা নিয়তি জানে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে রান্নাঘরের দিকে গেল।

লেখক পরিচিতি

জোনাকী দত্ত

বিএসএস সম্মান, এমএসএস (অর্থনীতি)

চট্টগ্রাম কলেজ

পেশা : শিক্ষকতা

প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজ (প্রভাতী শাখা), চট্টগ্রাম

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *