অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ১৩, ২০২৫
২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ১৩, ২০২৫
২৯শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যাহিদ সুবহান -
ভাতঘুমের ইতিবৃত্ত

হঠাৎ খুপড়ি ঘরটার বাইরে শুয়োরের ঘোৎ ঘোৎ শব্দের মতো আওয়াজে ঘুম ভাঙে অতিজানের। শরীরটা বড় ক্লান্ত! এ ক্লান্তি দীর্ঘ ভ্রমণ কিংবা আতর আলীর মতো মাটির কাটা হাড়খাটুনির পরিশ্রমের জন্য নয়। ক্লান্তিটা ন্যূব্জ বয়সের ক্লান্তি। দুপুরের এই সময়টা সে ঘরেই থাকে, ঘুমায়। একমাত্র ছেলে বক্কার ভ্যান চালায়। সড়ক ও জনপথের রাস্তার পাশেই খাস জমির উপর চৌদ্দ হাত লম্বা ঘরটা। বেড়া চাটাই বাঁশের, চালটা টিনের। ওর ঘরে দুই বছরের একটা ছেলে আছে। ঘরের সিংহভাগ চাটাই দিয়ে আলাদা করে বউ আর দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকে বক্কার। আর একপাশে এককোনায় ছোট্ট খুপড়ি করে মায়ের জন্য কোনোমতে একটা ব্যবস্থা করেছে। এই খুপড়িতেই মুখ গুজে পড়ে থাকে অতিজান। শব্দগুলো ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।

অতিজান একা মানুষ। ছিয়াত্তর বছর বয়সের প্রৌঢ় জীবন তার। অচেনা শব্দে আতঙ্কে হৃদয় কেঁপে ওঠে। কী হলো আবার। পয়মালের পাল যাওয়ার সময় যেমন ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ শোনা যায় তেমন শব্দ। মাঝে মাঝে সদ্য নতুন টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া টিনের চালার উপর দড়াম দড়াম করে ইট পাটকেল এসে পড়ছে। ঘরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাইরে আসলে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে ওর ঘরে একটা ছেলে আছে। লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে উঠতে চায় কিন্তু শরীরটা সায় দেয় না। সে শুধু ভেতর থেকে ভাঙা গলায় হাঁক ডাকে, ‘ক্যারে বাপু, কারা তুরা, কী চাইস?’

বক্কার রিকশাটা বেচে দিয়েছে। যেটা সে চালাত। কী সুন্দর রিকশাটা, বলা চলে একদম নতুন, কুষ্টিয়ার বডি। অন্য রিকশাগুলোতে দুইজনের বেশি মানুষ উঠা কষ্টের। আর বক্কারের রিকশায় সিটের উপরে পা তুলে আরও দু’জন বসতে পারে। মানে মোট চারজন। অনেক টাকা দিয়ে অর্ডার দিয়ে বানানো গাড়িটা। ইচ্ছেমতো রং-করা। আর্টিস্ট দিয়ে নকশার কাজ করা। সমিতির কড়কড়া নগদ টাকায় কেনা রিকশাটা অর্ধেক দামে বেচার সময় একবারও ভাবল না বেচারা।

লোকটার নানা দোষ। বাপটা সেই ছোটবেলায় অকালে চলে যাওয়ার পর রিকশার প্যাডেলেই জীবনের যাত্রা শুরু। কামাই খুব কম। ওর মনে রাখা দরকার এই অল্প কামাইয়ে মা-বউ আর এক বাচ্চার ভরণ-পোষণ চলে। সঙ্গে সমিতির কিস্তি তো আছেই। প্রতি সপ্তাহে আটশত টাকা দিতে হয় সেখানে। বউয়ের নামে তোলা ঋণ। এ নিয়ে নিয়ে মাঝে-মধ্যেই বউয়ের সঙ্গে লাগে। যখন কিস্তি বাকি পড়ে কিংবা দিতে পারে না, সমিতির লোকজন বাড়িতে হানা দেয়। বিশেষ করে যখন সমিতির মহিলা কর্মী অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে তখন অসহ্য হয়ে যায় বক্কারের বউ। মহিলাদের কিছু করার উপায় না থাকলেও অকর্মা স্বামীটার উপর ক্ষেপে যায় সে। তখনই সংসার হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্র। একবার অসহ্য হয়ে গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল সে। সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিল কোনোভাবে।

ইদানীং খুব বখে গেছে লোকটা। কাম কাজ ছেড়ে যখন তখন বসে পড়ে জুয়া খেলতে। তিন তাস নিয়ে তো এখন আর খেলতে হয় না। পুরোনো জুয়াড়িরা এখনো তিন তাসেই পড়ে আছে। এখন সবচেয়ে বেশি চলছে অনলাইনে জুয়া। ক্রিকেট খেলা নিয়ে চলে এসব জুয়া। যদিও বড় বড় শহরে বড়লোকরা ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা। ওসব বক্কারদের জন্য নয়। ওখানে কোটি কোটি টাকার দান। বক্কাররা হাজার টাকা পার করতেই তো হাঁসফাঁস অবস্থা।

ঘরের বাইরের শুয়োরের বাচ্চার মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করা ছেলেপুলেগুলো একটা রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের সদস্য। এদের নেতা সুজন ত্যাড়া। হাঁটার সময় ঘাড় একটু ত্যাড়া করে হাঁটে বলে ওকে সবাই ওকে সুজন ত্যাড়া বলেই ডাকে। লেখাপড়ার দৌড় হাইস্কুল পর্যন্ত হলেও, কপাল জোরে উপরের নেতাদের বিশেষ আশীর্বাদে তার এখন খুব নামডাক। সুন্দর সাদা পাঞ্জাবি আর চামড়ার চটি পরে সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকে সে। এলাকায় তার বাইরে কথা বলার লোক খুব কম। সুজন ত্যাড়া আজ বক্কারের ওপর খুব ক্ষ্যাপা। তার নির্দেশেই তার চ্যালারা আজ বক্কারের বাড়ি ঘেরাও করেছে। ঠিক কী কারণে তারা বক্কারের বাড়িতে হানা দিয়েছে নেতা ভক্ত এই কর্মীরা সে কথা জানে কিনা সন্দেহ আছে!

সুজন ত্যাড়া পৌরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের এবারের নির্বাচনে কমিশনার প্রার্থী। নবগঠিত পৌরসভাটির ভোট আর কদিন পরই। লোকটা এ ওয়ার্ডের সংগঠনের সভাপতি খুব অল্প বয়সে। এবারের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বললেই চলে। এই ওয়ার্ডের ছেলে-বুড়ো আবালবৃদ্ধবনিতা সুজন ত্যাড়ার কথা ওঠে-বসে। এছাড়া উপায় কী। এই এলাকার শালিস দরবার সব তার আনুকূল্যেই রায় হয়। সে রায় কার পক্ষে গেল আর কার বা বিরুদ্ধে গেল সেসবে সুজন ত্যাড়ার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার হাতের অল্প-বিস্তর একটা-দুটো কচকচা টাকার বান্ডিল পৌঁছাতে পারলেই হলো। এই এলাকার সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে। মোড়ের সরকারির জায়গায় স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান-পাট, টুকটাক মাদকের কারবার, থানার ঝয়ঝামেলা সব তাকেই মেটাতে হয়। এমনকি এলাকায় সুদের ব্যবসা কিংবা চুরি-ছিনতাই, কার বউ কার সঙ্গে ভেগে গেল, গভীর রাতে কার মেয়ের ঘরে কার ছেলে ঢুকল এসবের বিচার তাকেই করতে হয়। এলাকার নেতা বলে কথা! সুজন ত্যাড়ার কাছ থেকেই সুদের টাকা নিয়ে রিকশাটা কিনেছিল বক্কার। মাসে মাসে সুদ দেয়, সঙ্গে কিছু কিছু করে আসল টাকা পরিশোধ করে। সুদের হিসাব চক্রবৃদ্ধি হারে হয়। বক্কার সরল আর অশিক্ষিত মানুষ। সে এসব বোঝে না। শুধু বোঝে টাকা দিতে হবে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে। সুজন ত্যাড়ার ছোটখাটো ফুটফরমাস খাটে সে আর মিছিল মিটিংয়ে যাওয়ার দরকার হলে যায়, লোকজন ডেকে জড়ো করে। নেতা তার প্রতি খুব খুশি!

পুরোনো কত কথা মনে পড়ে অতিজানের। কী সুন্দর দিন ছিল তাদের সময়। গাঁয়ের মানুষের হয়তো শিক্ষা-দীক্ষা ছিল কম। টাকার অভাব ছিল। না খেয়ে, অনাহারে-অর্ধাহারে থাকত সবাই। দু-চারটা পরিবার যাদের কিছু সয়সম্পত্তি ছিল তাদের মধ্যে কোনো হিংসা অহংকার ছিল না। এলাকার মানুষের সামান্য বিপদ-আপদে নিজে থেকেই খোঁজ নিত। মাঠের পর মাঠ ফসলে ভরা থাকত। গাছে গাছে নানা রকম ফল। উৎসব-পার্বণে নানা পদের ফল-ফলাদি-মিষ্টি।

গ্রামের মানুষের মধ্যে কী একতা! গ্রামের প্রধান যা বলত তাই। তিনি যা বলতেন, ভেবে বলতেন। পুরো গাঁয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিতেন। কেউ কোনোভাবেই তার সিদ্ধান্তের বাইরে যেত না, যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। গ্রামে বিচার শালিস হলে গ্রাম্যপ্রধান ন্যায় বিচার করতেন। কোনো পক্ষই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন। গ্রামের মুরব্বি আর জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে বিচার শালিসের রায় হতো। কখনও কখনও গ্রাম্য প্রধান নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে সমস্যার সমাধান করতেন। নিজেরা এলাকার শান্তি রক্ষার স্বার্থে নানা রকম ঝুঁকি নিতেন।

নিজের বিয়ের দিনের ঘটনাগুলো মনে পড়ে অতিজানের। সেসব সবুজ স্মৃতি মনে করে নিজেকে পুরোনো সে সময়ে হারিয়ে ফেলেন তিনি। গাঁয়ে কারও বিয়ে হলে সেদিন সারা গ্রাম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ যে গাঁয়ের রীতি, শত বছরের ঐতিহ্য। এক বাপের মেয়ে হলেও এ সারা গাঁয়ের সম্মানের বিষয়। ছেলে-বুড়ো সবার নিজেদের কাজ বন্ধ সেদিন। একটু না হয় নিজের ক্ষতি হলো, তাতে কী, গাঁয়ের প্রয়োজনে এতটুকু ছাড় তো দিতেই হবে। একদিন সেও হয়তো এমন প্রয়োজনরে মুখোমুখি হবে। তাই কী মাঠের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কৃষক সবেদ আলী, চায়ের দোকান্দার মতিয়ার, ছমু ঘরামি সবাই উঠে-পড়ে লাগে বিয়েবাড়ির কাজে। কেউ বাড়ি সাজায়, কেউ রান্নার কাজে হাত রাগায়, কেউবা বরপক্ষের সমাদরে ব্যস্ত থাকে।

আশপাশের দশ গ্রামে তখনও ডেকোরেটর পৌঁছেনি। সাজানো টেবিল, কড়ির থালা-বাসন কিংবা রঙচঙা লাইটের গেট তখনও গ্রামে ঢোকেনি। গ্রামের মানুষের ভরসা পাটের ছালা, কলা পাতার থালা নয়তো মাটির সানকিতে ভাত খাওয়া। সর্বোচ্চ হলে প্রাইমারি স্কুলের কাঠের জোড়া বেঞ্চ, টিনের জগ-গ্লাস এই তো। আর বিয়েবাড়ির গেট বলতে ঐ তো কলা গাছের তৈরি গেট, রঙিন কাগজ কেটে তিন কোনার ফ্ল্যাগ পাটের দড়িতে ঝুলিয়ে সারা বাড়ি সাজানো।

অতিজানের বিয়েতে বিরাট এক গোল বেঁধে গেল। বিয়ের কথাবার্তায় মেয়েকে সাজিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। ছেলেপক্ষের আর কোনো দাবি নেই। নাকফুল, দুই কানের দুল, গলার মালা আর হাতের চুড়িগুলো সোনার হলেই হবে। কিন্তু কী এক সমস্যায় পড়ে রেহেল বাণুর বাবা গলার হারটি জোগাড় করতে পারেননি। এ কথা ছেলেপক্ষের কানে গেলে নানা কথা উঠতে থাকে। একপ্রকার বরপক্ষ বিয়ে না করেই বিদায় নেওয়ার জো। গ্রামের প্রধান সোলেমান প্রামাণিক এ কথা শোনার পর বরপক্ষকে বলেন, তাদের কথার খেলাপ হবে না। বিয়ের কাজ চলতে থাকল। নিজের বউয়ের গয়না দিয়ে সেদিন অতিজানের বিয়ের কাজ শেষ করেছিলেন গ্রাম্যপ্রধান, গ্রামের ইজ্জত তিনি নষ্ট হতে দেননি!

এর মাত্র কয়েক বছর আগে একাত্তরের সেই অন্ধকার সময়েও আশ্রয়ের বটগাছ হয়ে পুরো গ্রামবাসীর নিরাপত্তা দিয়েছিলেন সোলেমান প্রামাণিক। বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হবে। একদল হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গাঁয়ের নিরীহ মানুষের উপর। ওরা পাকিস্তানি সেনা ছিল না; ছিল এদেশেরই স্বাধীনতাবিরোধী কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার। গ্রামের প্রায় সব ঘরেই আগুন দিয়েছিল। লুটপাট করেছিল সব। ওরা ক্ষতবিক্ষত করেছিল এ গ্রাম। খুব নির্মম ছিলো সেদিনের দুপুর। খুব হল্লা করে রাজাকাররা এই কাজে অংশ নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন ওদের উৎসব চলছে। সকলেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল আশপাশের বন-জঙ্গলে। প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা কেউ টুঁ শব্দও করতে পারেনি। সবাই ছিল অসহায় ও নিরুপায়। ওরা শুধু ঈশ্বরকে ডাকছিল আর তার কাছে বিচার দিয়েছিল। ঈশ্বর সেদিন ওদের আকুতিতে সাড়া দিয়েছিলো কিনা জানা যায়নি, তবে সোলেমান প্রামাণিক সকলের ত্রাতা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। প্রামাণিক বাড়ির এই মহান মানুষটা যেদিন মরে গেল গ্রামে কী যে শোক নেমে এল।

ঘরের বাইরের শুয়োরের বাচ্চার মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ অতিজানের বয়সী হৃদয়টাকে কাঁপিয়ে তুলছে। শব্দগুলো এমনভাবে কানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে যেন মনে হচ্ছে, কানের কাছে বিশাল বিশাল হাতুড়ি লোহাকে পেটাচ্ছে। বক্কার পালিয়েছে। রিকশা যে বেচে দিল জুয়ার ফাঁদে পড়ে, এখন সংসার চলবে কী করে? সুজন ত্যাড়ার সুদের টাকার কী হবে? সুজন ত্যাড়া কি ছেড়ে দেবে? আগে সুদের টাকা, তারপর অন্য সব। হোক সে বক্কারের মতো শ্রমজীবীর রিকশা কিংবা জীবন। কেউ কেউ বলছে একজন বিপদগ্রস্ত মানুষকে সংশোধনের সুযোগ তো দেওয়া যেতে পারে।

অতিজান নিজেকে মেলাতে পারে না। পৃথিবীটা কি বদলে গেল? মানুষ এত বদলে গেল কবে? সময় কি এতটা পরিবর্তন হয়ে গেল! জন্মভিটার আশপাশের দৃশ্য, বাতাস, গাছ-নদী সবই অপরিচিত লাগছে তার!

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *