অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১০, ২০২৫
২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১০, ২০২৫
২৭শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাইয়িদ রফিকুল হক -
মাল্টা-চোর

জীবনগড়ি হাই স্কুলের মাঠের একপাশে বেশ বড়সড় হয়ে বেড়ে উঠেছে চারটি মাল্টাগাছ।

এগুলোতে মাল্টা ধরতেও শুরু করেছে। কয়েক ডজন মাল্টা ইতোমধ্যে প্রায় খাওয়ারও উপযোগী হয়েছে। তা দেখে স্কুলের স্যাররা খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।

হেডস্যার অলোকবাবু ভীষণ খুশি হয়ে তো বলেই ফেললেন, ‘আরও কয়েকটি গাছ লাগিয়ে দিলে বেশ ভালো হবে। মাঝে মাঝে নিজেরা অন্তত গাছের মাল্টা খেতে পারব।’

কথাটা বলে তিনি সহকর্মীদের দিকে কয়েকবার তাকালেন। সবাই তার এ-কথায় একবাক্যে সায় জানাল। প্রস্তাবটা লোভনীয় আর মনঃপুত হয়েছে তাদের কাছেও।

হেডস্যারের কথা তাদের মনেও ধরেছে। এতে সবাই বেশ আশাবাদী হয়ে উঠল। স্কুলের বিরাট মাঠের চারকোনায় আরও কিছু মাল্টাগাছ লাগানো হবে। এই নিয়ে ছাত্রদের মধ্যেও দারুণ উৎসাহ বিরাজ করছে। তাছাড়া, যে কয়েকটি গাছ এখন বেশ বেড়ে উঠেছে তাতে মাল্টাও ধরেছে ঠেসে।

কিন্তু এর দুদিন পরেই ঘটে গেল একটা দুর্ঘটনা। ডজন দুয়েক মাল্টা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। আর দুই-একদিন পরে গাছ থেকে ছিঁড়ে খাওয়া যেত।

কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল, গাছে বড়-বড় একটা মাল্টাও আর নেই! সপ্তাহখানেক পরেও আবার একই কাণ্ড ঘটল। এবারও গাছ থেকে ডজন দুয়েক মাল্টা গায়েব! এতে সবাই যারপরনাই অবাক ও বিস্মিত!

স্কুলের বিশাল মাঠের চারপাশে দশ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনে আছে বিশাল লোহার গেট। এর ভেতর দিয়ে কে মাঠে ঢুকে মাল্টা চুরি করে খাবে?

কারও বিশ্বাস হতে চাইছিল না। তাই, হেডস্যার স্কুলের দারোয়ান, মালী আর নাইটগার্ডকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বলো তো ঘটনাটা কী? কারা আমাদের মুখের গ্রাস এভাবে বারবার কেড়ে খাচ্ছে?’

হেডস্যার অলোকবাবুর মুখে এমন একটা কথা শুনে তারা খুব মনখারাপ করল। আর একসঙ্গে কাঁদো-কাঁদো মুখে বারবার তাকাল হেডস্যারের দিকে। শেষে নাইটগার্ড মোসলেম বলল, ‘স্যার, আল্লাহ-রসুলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমরা এই কাজ করি নাই। বিশ্বাস করেন, স্যার। অন্য কেউ করতে পারে, স্যার। কিন্তু আমরা না, স্যার। একটু বিশ্বাস করেন, স্যার। আমরা মানুষ গরিব কিন্তু…।’

‘থাক-থাক। থামো এবার। আর বলতে হবে না।’ হেডস্যার ওদের থামিয়ে দিলেন।

ওদের মুখে এসব কথা শুনে হেডস্যার পড়লেন বিপদে। বিষয়টা সাধারণ হলেও ব্যাপারটা এখন তার জন্য প্রেস্টিজের একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়ে সবাই কানাঘুষাও কম করছে না। এমনকি অনেকে আড়ালে আবডালে হেডস্যারের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে কোনোরকম দ্বিধা করছে না। তারা রীতিমতো এই নিয়ে বিরাট গবেষণায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। চোর নিয়মিত চুরি করে যাচ্ছে।

সবকিছু দেখে হেডস্যার সিদ্ধান্ত নিলেন, চোর তিনি ধরবেনই। এজন্য তিনি সেদিন দুপুরে মাঠে টিফিন দেওয়ার সময় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা চোর ধরতে পারলে বড়সড় একটা পুরস্কার পাবে। সবাই চেষ্টা করে দেখো।’

হেডস্যারের কথায় সবাই নড়েচড়ে বসল। ভাবল, বিষয়টা তাহলে গুরুতর! এজন্য পুরস্কারও পাওয়া যাবে। চোর এবার ধরা পড়বেই!

কিন্তু পরদিনই আরও কয়েক ডজন মাল্টা চুরি হয়ে গেল! এবার আরও বেশি। সবার মুখে বিষাদের ছায়া। এতে হেডস্যার আরও নড়েচড়ে বসলেন। কেউ তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে! কিন্তু আর নয়। এবার এর একটা হেস্তনেস্ত তাকে করতেই হবে। তিনি আপনমনে ধীরে ধীরে চিন্তা-সাগরে ডুবে যেতে লাগলেন।

টিফিনের পর হেডস্যার তার আস্থাভাজন কয়েক শিক্ষককে ডেকে একটা পরামর্শ করতে বসলেন। এদের মধ্যে গণিতের শিক্ষক আলী রেজা সাহেব খুব তৎপর হলেন। তাকে সাপোর্ট দিতে লাগলেন ইংরেজির শিক্ষক সমির আইমার। অগত্যা, হেডস্যার নিজে আহ্বায়ক হয়ে তিন সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি করলেন। এই কমিটির প্রধান কাজ হলো যে কোনো মূল্যে স্কুলের মাল্টা-চোরকে ধরা এবং তাকে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো।

সেদিন টিফিন পিরিয়ডের পর থেকে আলী রেজা সাহেব প্রচণ্ড মনোবলসহকারে সমির সাহেবকে নিয়ে চোর ধরার কাজে আদাজল খেয়ে নেমে পড়লেন। প্রথমে তারা স্কুলের বাউন্ডারি-দেয়াল থেকে শুরু করে সবক’টা ভবন ভালোভাবে সার্ভে করলেন। তারপর চোর ধরতে আগ্রহী দশম শ্রেণির কয়েক ছাত্রের সঙ্গেও কথা বললেন মনোযোগ দিয়ে। বিশেষ করে, স্কুলের সকল ছাত্রের প্রিয়ভাজন দশম শ্রেণির ফার্স্ট-বয় বুরহান খলিফার সঙ্গে মাল্টা-চুরির বিষয়ে দীর্ঘসময় কথা বললেন।

ছাত্রদের সঙ্গে আলী রেজা সাহেবের সম্পর্ক ভালো। তিনি গণিতের শিক্ষক হলেও জোর করে কাউকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন না । এজন্য শিক্ষার্থীরা তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। এটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সিক্স-টু-টেন প্রতিটি ক্লাস থেকে তিনজন ছাত্রকে নিয়ে একটা তদারকি কমিটিও বানিয়ে ফেললেন। ছাত্ররাও লেগে পড়লো মাল্টা-চোরকে ধরার কাজে। তাদের সেই উৎসাহ দেখবার মতো! যেন এতদিনে তারা একটা কাজের মতো কাজ পেয়েছে। সবার মনে সে কী উত্তেজনা! একেকজন নিজেকে বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস মনে করতে লাগল।

পরদিন ছুটির পরে তদন্ত কমিটি টিফিন পিরিয়ডে সব ছাত্রকে ডেকে একটা জনসভার মতো করে ছাত্রসমাবেশ করলেন। সেখানে নবম-দশম শ্রেণির বাছা-বাছা কয়েক শিক্ষার্থীও নানারকম জ্বালাময়ী বক্তব্য দিল। কিন্তু দশম শ্রেণির ফার্স্ট-বয় বুরহান খলিফা সেখানে কোনো কথা বলল না। সে শুধু চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

সবশেষে বক্তব্য দিতে এল দশম শ্রেণির আলামীন শরীফ। সে একটু ধার্মিক-টাইপের। স্কুলের যাবতীয় অনুষ্ঠানে কুরআন তিলাওয়াত সে-ই করে থাকে। এজন্য তার সহপাঠীরা তাকে একটু বেশি খাতির-যত্ন করে। তাছাড়া, অন্যরাও তাকে বেশ সমীহ করে। শিক্ষকগণও তাকে স্নেহ করে অত্যধিক।

সে মাইক্রোফোনের কাছে এগিয়ে এসে খুব আবেগঘন ভাষায় বলতে লাগল⸺‘যারা এই কামটা করছে তারা মানুষ নয় খবিশ। এদের ইবলিশ বললেও ভুল হবে। এদের ধরতে পারলে পিটি-স্যারের কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে। তিনি ওদের জোড়া বেত দিয়ে আচ্ছামতো পেটাবেন। আর চোর ধরতে পারলে তাকে জোড়া বেতের একশ’ একটা বাড়ি দেওয়া হবে। তারপর সে বুঝবে চুরি করে খাওয়ার সুখ কত!’

সবাই খুশি হয়ে হাততালি দিল তার কথা শুনে। কিন্তু বুরহান খলিফা তার কথা শুনে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এমনকি তার কথার সমর্থনে একবারও হাততালি দিল না সে।

পিটি-স্যার আবু তালেব এমন একটা লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে তখনই প্রস্তুত হতে লাগলেন। তার হাতটা কেবলই নিশপিশ করতে লাগল। আসলে, বহুদিন যাবৎ তিনি এই বেআদবদের পেটাতে পারেন না। এমনিতে হেডস্যারের নির্দেশে ছাত্রদের মারপিট করাটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে এই স্কুলে। এ ব্যাপারে নাকি সরকারি একটা প্রজ্ঞাপন-নির্দেশনাও আছে। তবু তিনি আশার আলো দেখতে লাগলেন। এবার তাহলে একটা সুযোগ মিলবে। আহ, তিনি কতদিন পরে আবার একটু ছাত্র-পেটাতে পারবেন! এই সুখ তিনি কোথায় রাখবেন এখন! তিনি তৎক্ষণাৎ মনের আনন্দে সারামাঠ পায়চারী করে বেড়াতে লাগলেন।

ছাত্রসমাবেশ-শেষে সবাই যার-যার ক্লাসে ফিরে গেল। আবার পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রায় সবার মাথায়ই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে মাল্টা-চোর ধরার ব্যাপারটি।

ছাত্রদের প্রধান প্রতিনিধি বুরহান খলিফা ক্লাসে গেল না। তার এখন ক্লাসও নেই। সামনে তাদের এসএসসি পরীক্ষা। সে কী যেন ভাবতে-ভাবতে কতক্ষণ সারামাঠ একাকী পায়চারী করতে লাগল। আর কী যেন ভাবতে লাগল গভীরভাবে। তবে সে পিটি-স্যারের সঙ্গে কোনো কথা বলল না।

তাকে দেখে মাঠে প্রবেশ করলেন বাংলার স্যার শফিকুল বাহার। তিনি ছাত্রদের এই প্রধান প্রতিনিধির দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে স্নেহের সুরে বললেন, ‘তাহলে বুরহান, তোমরা এবার চোর ধরে ফেলবে?’

বুরহান তাকে দেখে বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার, ধরতে চাই। কিন্তু আমার একার পক্ষে তা কখনোই সম্ভব নয়।’

‘কেন? কেন? হেডস্যার তো তোমাদের জন্য পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া, চোর ধরার জন্য তিনি নিজে প্রধান হয়ে আরও দুজন শিক্ষককে নিয়ে তিনজনের একটা কমিটিও করেছেন।’ বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন শফিক মাস্টার।

‘তা করেছেন, স্যার। ঠিক আছে। কিন্তু স্যার আমাদের একার পক্ষে কিছুতেই তা সম্ভব নয়। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকলে আমরা বিরাট একটা শক্তি পাব।’ বুরহানও কথাটা স্যারকে দৃঢ়ভাবে বলল।

তারপর সে আবার বলে, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন, স্যার?’

বাহার সাহেব এবার হেসে বললেন, ‘থাকব। আমি এই বেআদবকে ধরতে ও চিনতে চাই।’

বুরহান খুব খুশি হয়ে বলল, ‘স্যার, মনে বড় সাহস পেলাম এবার।’

শফিক মাস্টার কী যেন একটু ভেবে বললেন, ‘কিন্তু আমার একটা কথা। আজ বিকালে তুমি একবার জিন্তার ভিটায় এসো। দুজনে শলাপরামর্শ করা যাবে। সাবধান, তুমি একাকী আসবে। আর এ-কথা কাউকে বলবে না।’

বুরহান দেখল, আজ তার হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। তাছাড়া, এটা স্যারের আদেশ। তাই সে বলল, ‘জি স্যার। সময়টা বলুন। আমি হাজির হয়ে যাব।’

শফিকুল বাহার সাহেব বললেন, ‘এই ধরো, সন্ধ্যার ঠিক একটু আগে-আগে। কিংবা শেষ বিকেলে।’

বুরহান একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো বলল, ‘জ্বি স্যার। আচ্ছা।’

সন্ধ্যার বেশ আগেই জিন্তার পরিত্যক্ত ভিটায় এসে উপস্থিত হলো বুরহান খলিফা। তার চোখে-মুখে দারুণ একটা আগ্রহের ভাব। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, সে শফিক মাস্টারের কথা শোনার জন্য খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে রয়েছে।

শফিক মাস্টার এলেন এর কয়েক মিনিট পরে।

বুরহানকে দেখে তিনি সামান্য হাসলেন। তারপর কোনোরকম ভনিতা না করে বললেন, ‘তুমি চোর ধরতে চাও? আর আমাদের স্কুলের ক্ষুদে শার্লক হোমস হয়ে যেতে চাও? তাহলে আমার কথা শুনতে হবে তোমাকে।’

বুরহান স্যারের এই কথা শুনে প্রচণ্ড আবেগে বলল, ‘জি স্যার। জি স্যার। আপনি আমাদের একটু সাহায্য করবেন। আমি আপনার সবকথা শুনব।’

জিন্তার ভিটার একপাশে বহুদিনের একটা পরিত্যক্ত পুকুর আছে। এর আবার শানবাঁধানো ঘাটও রয়েছে। অনেকদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখানকার সব নষ্ট হয়ে গেলেও এই ঘাটটি আজও অক্ষত। এর সবকিছু আগের মতো সুন্দর অবস্থায় রয়েছে। শেষ বিকেলের স্বল্প আলোতে ওরা সেই ঘাটে বসল মুখোমুখি।

বুরহান কথা বলছে খুব কম। কারণ, সে শফিক সাহেবের তুলনায় অনেক জুনিয়র। আর ছাত্রমাত্র।

প্রাসঙ্গিক কথা শুরু করার আগে শফিক সাহেব একটু হাসলেন। আর বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের হেডস্যার মানুষ একেবারে মন্দ নন। তবে তার বুদ্ধিতে ধার কম। তাই তো সামান্য একটা চোর ধরার জন্য তাকে তিন সদস্যের একটা কমিটি গঠন করতে হয়েছে। তারচেয়ে আমি আর তুমি একটা বুদ্ধি করি। আমরা দুজনে মিলে আজ রাতে চোর ধরে ফেলব।’

এ কথা শুনে বুরহান এবার লাফিয়ে ওঠে বলে, ‘স্যার, স্যার! কীভাবে?’

শফিক সাহেব এবার ঘাটের উপরে দুই পা তুলে খুব আয়েশ করে বসে বললেন, ‘খুব সহজভাবে। আর একেবারে অভিনব একটা কায়দায়!’

এতেও বিস্ময়ের ঘোর কাটে না বুরহানের।

সে বলে, ‘কিন্তু কীভাবে স্যার! কীভাবে স্যার? আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না!’

শফিক মাস্টার আগের মতো হেঁয়ালি করে বললেন, ‘সামান্য একটা যন্ত্রের সাহায্যে। যন্ত্রের যুগে তুমি যন্ত্র ভুলে গেলে চলবে! আর এত লোকের কমিটি দিয়ে কী করবে?’

বুরহান আগের মতো আবেগভরে বলে উঠলো, ‘স্যার, এবারও কিছুই বুঝিনি! যদি আমাকে একবার তা একটুখানি বুঝিয়ে বলতেন!’ তার কণ্ঠে যেন রাজ্যের বিনয়। আর চেহারায় বিরাট একটা বিস্ময়ভাব!

শফিক সাহেব এবার খোলাসা করে বলতে লাগলেন, ‘ছোট্ট একটা ক্যামেরা লাগাবো ঘটনাস্থলে। ওই গাছ চারটের সোজাসুজি উত্তরদিকের ভবনের এককোণে। তাহলে বিরাট কাজ হবে। সেখান থেকে গাছ চারটে একেবারে স্পষ্টভাবে ভিডিও হতে থাকবে ওই ক্যামেরার সাহায্যে। ওখানে যেই যাবে সেই আটকা পড়বে এই গোয়েন্দা-ক্যামেরার ফাঁদে! এবার বুঝলে কিছু?’

এ-কথা শুনে এবার আনন্দে লাফিয়ে ওঠে বুরহান। সে বলে, ‘স্যার, ওহ্ হো এই বুদ্ধি! এখনই হেডস্যারকে তাহলে একবার বলি?’

শফিক মাস্টার এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তাহলে, আর চোর ধরা হবে না। এ-কথা এখনই পাঁচ কান হয়ে চোরের কানে যাবে সবার আগে। আর চোর-ব্যাটা খুব সাবধান হয়ে যাবে।’

তিনি আবার একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘তুমি এত মাথামোটা কেন হে বাপু?’

এতে লজ্জা পেল বুরহান। বলল, ‘স্যরি স্যার, স্যরি। স্যরি।’

এরপর সে বলল, ‘কিন্তু স্যার, সিসি ক্যামেরা লাগানো তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরজন্য প্রস্তুতি লাগবে।’

শফিক সাহেব ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, ‘কোনো প্রস্তুতি লাগবে না। আমরা কাজ করব নীরবে। ছোট একটা চার্জেবল ক্যামেরা লাগাব। এটা চার্জ দিয়ে লাগালে আটঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করবে।’

বুরহান এবার খুশি হয়ে বলে, ‘কিন্তু স্যার, এমন একটা ক্যামেরা পাবেন কই?’

শফিক মাস্টার খুব আয়েশ করে একটু হেলান দিয়ে বসে বলতে লাগলেন, ‘আমার কাছেই আছে এরকম একটা ছোট্ট ক্যামেরা। আমার এক শ্যালক গত মাসে সিঙ্গাপুর থেকে পাঠিয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনে চোরটোর আসে কিনা তা জানার জন্য সে এটা পাঠিয়েছে। আশা করি, এটা দিয়ে এবার সত্যি-সত্যি চোর ধরতে পারব। মনে রাখবে, আজ রাত দশটার পরে আমি আর তুমি স্কুলে ঢুকে একটা কাজের বাহানায় খুব গোপনে ক্যামেরাটা লাগিয়ে আবার বেরিয়ে আসব স্কুল থেকে। কিন্তু কেউ যেন কিছু বুঝতে না-পারে।’

বুরহান ভেতরে-ভেতরে এবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পারলে সে এখনই চোরকে ধরে ফেলে!

সে বলে, ‘নাহ স্যার, কেউ জানবে না। উপরে আল্লাহ আর নিচে আমি আর আপনি। কথাটা একেবারে গোপন থাকবে। কাকপক্ষীটিও টের পাবে না আমাদের এই বুদ্ধির কথা!’

শফিক মাস্টার ওর এ কথা শুনে হেসে বললেন, ‘চলো তবে, এবার বাড়ি ফিরে যাই। রাতে খেয়ে-দেয়ে দুজনে ঠিক দশটার সময় স্কুল-গেটের কাছে চলে আসব। আর যা করার আমিই করব। তুমি কাউকে কিন্তু আবার কিছু বলে বোসো না যেন! তাহলে সব বরবাদ হয়ে যাবে!’

ভীষণ খুশি হয়ে বুরহান মাথা নেড়ে বারবার বলতে লাগলো, ‘না স্যার। না স্যার। কেউ কখনো জানবে না! কেউ কখনো জানবে না!’

রাতে স্কুল-গেটের কাছে গিয়ে শফিক মাস্টার দেখলেন, বুরহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। গেটে দারোয়ানও নেই। হয়তো খেতে গেছে। কিন্তু পকেট-গেটটা এখনো খোলা আছে। তিনি বুরহানকে দ্রুত মালি আর গার্ডদের থাকার জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। সে ওদের ব্যস্ত রাখবে। সেভাবেই তাকে আগে থেকে বলা আছে।

তারপর তিনি স্কুলের উত্তরদিকের ভবনের এমন একটা কোণে ক্যামেরাটা লাগালেন যাতে সহজেই মাল্টাগাছগুলো ও এর আশপাশের সবকিছু স্পষ্টভাবে ভিডিও হতে পারে। আর ক্যামেরাটাও যাতে কেউ দেখতে না-পারে।

এদিকে সারারাত দুটো হাই পাওয়ারের বাল্বও জ্বলে। আলোও থাকবে প্রচুর। হেডস্যারের নির্দেশে নতুন লাইট দুটো ভালোভাবে লাগানো হয়েছে। যাতে মাল্টা-চোরকে ধরা যায়। কিন্তু তারপরও মাল্টা চুরি হয়েছে! কিন্তু এবার?

কাজ শেষ করে শফিক মাস্টার একটা সংকেত দিলেন। তার আগে তিনি স্কুলের সীমানাও ত্যাগ করেছেন। তার আওয়াজ পেয়ে বুরহানও একসময় স্কুলের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে এল। তারপর তারা মিশে গেল অন্ধকারে!

সকালে অ্যাসেম্বলিতে হেডস্যার মন খারাপ করে বললেন, ‘চোর আজও মাল্টা চুরি করে নিয়ে গেছে! কী মুশকিলে পড়লাম রে, বাবা! চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী!’

এবার হাসিমুখে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন শফিক মাস্টার। এরপর তিনি বেশ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, চোর ধরা পড়বে এখনই। তার আগে আমাদের স্কুলের মেইন গেটটা বন্ধ করে দিতে বলুন দারোয়ানকে। যাতে কেউই আপনার নির্দেশ ছাড়া বাইরে যেতে না-পারে।’

তার এ-কথা শুনে হেডস্যার তখনই সেই আদেশ প্রদান করলেন।

তারপর তিনি শফিক সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চোর ধরা পড়বে, মানে?’

শফিক সাহেব বললেন, ‘বলছি স্যার। বলছি। জাস্ট এ মিনিট, স্যার।’

ততক্ষণে বুরহান বড়সড় একটা মনিটর নিয়ে এসেছে অ্যাসেম্বেলির গ্রাউন্ডে। সে তাতে সবরকমের সংযোগ দিয়ে শফিক মাস্টারের কাছে এসে বলল, ‘স্যার, সব একদম রেডি। এবার আপনার কাজ শুরু করতে পারেন।’

শফিক সাহেব এবার ক্যামেরার সংযোগ ভালোভাবে লাগালেন। আর হেডস্যারের দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললেন, ‘স্যার, মনিটরের দিকে আপনার চোখ রাখুন। এর ভেতরে এবার চোর দেখা যাবে। গতরাতে আমি আর বুরহান এই ক্যামেরা মাল্টাগাছের আশপাশে ফিট করে রেখেছিলাম। তাতেই কাজ হয়েছে।’

কিছুক্ষণ পরে সবাই দেখল, মাল্টা-চোর আর কেউ নয়। আলামীন শরীফ! সবাই চমকে উঠল তাকে দেখে! এই ছেলের এই কাজ!

আলামীন তবু পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সবাই মিলে তাকে ধরে ফেলল। চ্যাংদোলা করে ছাত্ররা তাকে নিয়ে এল হেডস্যারের সামনে আর পিটি-স্যারের কাছে।

পিটি-স্যার যেন আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন!

তিনি হাতের জোড়া বেত দিয়ে শপাং-শপাং শব্দে তাকে পেটাতে লাগলেন।

পনেরো-বিশটা বাড়ি জোরে-জোরে দেওয়ার পর হেডস্যার তাকে থামতে বললেন। আর তিনি জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, ‘থামুন। থামুন। আর নয়। চোর পেটালে আমাদের গৌরব বাড়বে না। তারচেয়ে আমরা স্কুলে কোনো চোর রাখব না। চোরের কোনো স্কুল নেই। ও-কে আমরা স্কুল থেকে বের করে দিলাম। আর ওর বাবাকে কাল ডেকে তার হাতে আমি টিসি দিয়ে দেব।’

তারপর তিনি বললেন, ‘শফিক সাহেব অনেক আগে থেকে ভেতরে-ভেতরে একজন বড়মাপের ডিটেকটিভ। কিন্তু আমি তাকে কখনোই বুঝতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা। তিনি ও আমাদের প্রিয় ছাত্র বুরহান খলিফা আজ যা করেছে—তা এককথায় তুলনাহীন। সবাই তাদের এই কাজকে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করো।’

ছাত্ররা তুমুল করতালিতে তাদের স্বাগত জানাতে লাগল।

আর আলামীন নীরবে বেরিয়ে গেল স্কুল থেকে। কারণ, হেডস্যার বলেছেন, চোরের কোনো স্কুল নেই!

Print Friendly, PDF & Email
সাইয়িদ রফিকুল হক

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *