অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কামরুন নাহার -
ছিনতাই

আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হব। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে মস্ত ডাক্তার হব।  কিন্তু আমি এগুলার কিছুই হইতে পারি নাই। বড় হয়ে আমি হইলাম সিঁদেল চোর। সিঁদেল চোর মানে বোঝেন তো? মানে সিঁদ কাটা চোর। আমি মানুষের বাড়িতে সিঁদ কেটে চুরি করি। চুরির আগে গায়ে আচ্ছামতো সরিষার তেল মাখায় নিতে হয়। যাতে কেউ ধরতে এলে মাছের মতো পিছলায় বের হয়ে যাইতে পারি। চুরি করতে যাইতে হয় খালি গায়ে। লুঙ্গি কাছা মাইরা। তবে আমি নিচে একটা হাফপ্যান্ট অবশ্যই পইরা নিই। নিরাপত্তাজনিত কারণে। কোনো কোনো ত্যান্দর গৃহস্থ টের পাইলে শরীরে ধরে না, লুঙ্গি টাইনা ধরে। জানে শরীরে আইচ্ছা মতো তেল দেওয়া। ধরলেও পিছলায় বাইর হইয়া যাব ঠিকই।  এরকম হইলে অনেক সময় লুঙ্গি ফালায় পলায় আসতে হয়। তখন লুঙ্গির নিচের হাফ প্যান্ট মান-ইজ্জত বাঁচায়।

বাবা মায়ের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পায়ে ঠেলে চোর হইছিলাম। কিন্তু এই পেশায় আর থাকা যাইতেছে না।  এলাকায় কাজ নেই বলে এলাকার পোলাপান সব মিডল-ইস্টে চাকরি নিয়ে পারি জমাল। তাদের পাঠানো কড়কড়ে রেমিটেন্সে নতুন নতুন ঝকঝকে পাকা বাড়ি-ঘর উঠল গ্রামে। আমার চুরির ব্যবসা লাটে উঠল। পাকা বাড়ির মেঝেতে গর্ত করে ঘরে ঢোকা যায় না। পাকা মেঝে রাত-বিরেতে ভাঙতে গেলে যেমন ধামধুম শব্দ হবে তাতে গৃহস্থ তো বটেই, পুরো পাড়ার লোক জেগে  যাবে। তারপর চোর ধরে রামধোলাই দেবে। প্রবাদ আছে ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পরো ধরা’— ছোটবেলায় পড়ছিলাম।  কাজেই আমাকে চুরির কাজ ছাড়তে হলো। ছেড়ে অন্য ধান্দায় যেতে হলো। আমি গ্রাম ছেড়ে  ঢাকা চলে গেলাম।

ঢাকায় কমলাপুর রেলস্টেশনে কিছুদিন ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলাম। সুবিধা হলো না। রেলস্টেশনে লোকজন বেশি।  আমি সিঁদেল চোর। ছিনতাইয়ের অভ্যাসও নাই।   একদিন ধরা পরে হাইরে মাইর খাইলাম। সাতদিন হাসপাতালে ছিলাম। সরকারি হাসপাতাল। সেবার মান সুবিধার না। ওই হাসপাতালে থাকাকালীন এক কর্মচারীর সাথে আলাপ। ও আমাকে নতুন ব্যবসার খোঁজ দিল। ড্রাগ ব্যবসা। হাসপাতালের স্টোর থেকে ওরা  বিভিন্ন ড্রাগ পাচার করে। সেগুলো নিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করলে সহজেই কাঁচা টাকা হাতে আসে। লেগে গেলাম কাজে। দুয়েক মাস করলামও।  কিন্তু অন্য আরেকটা চক্রের সাথে বিক্রির বাজার নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হওয়ায়, এই কাজ ছেড়ে আবার ছিনতাই শুরু করলাম। চলতে তো হবে।  জানের রিস্ক নিয়ে লাভ নেই।

এবার আর স্টেশনে না। এবার শুরু করলাম গভীর রাতে নির্জন রাস্তায়।
পুরুষগুলার মাথা গরম। ওরা থাকলে সেই সব রিকশা ঘাটাই না। মহিলা মানুষ থাকলে রিকশা থামায় সামনে একটা ছুরি ধরলেই কওয়ার আগে সব টাকাপয়সা গয়নাগাটি বাইর করে দেয় ওরা। নারীরা ভীষণই কিউট। শিকার হিসেবে সবচেয়ে ভালো মাঝবয়সী নারীরা। এদের কাছে টাকা পয়সা, গয়নাগাটি মোটামুটি ভালো পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রতি রাতে একটা দুইটা খ্যাপ মারতে পারলে দিন ভালোই চলে। টাকার অভাব হয় না। সবচেয়ে খারাপ শিকার হইল কম বয়সী মেয়েগুলা। এদের কাছে রিকশা ভাড়াটা ছাড়া আর কিছু থাকে না। কম বয়সী মেয়েগুলা আবার ভয়ও পায় বেশি। একবার না বুঝে এক রিকশা থামাইছি। দেখি স্কুলপড়ুয়া এক মাইয়া। মাইয়া ছুরি দেইখাই ঢলে রিকশা থেকে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। আমি আর রিকশাওয়ালা দুজনেই ভয় পাইয়া গেলাম। নারীঘটিত মামলায় না ফেঁসে যাই। আসলে আমার ওইসব মেয়েলোকি দোষ নাই। অল্প বয়সী মেয়েগুলো ভীতুর ডিব্বা। বিরক্ত লাগে। আরে তোর কাছে কিছু না থাকলে মিষ্টি একটা হাসি দিয়া বলবি— ভাইয়া, রিকশা ভাড়া ছাড়া আর কোনো টাকা নেই আমার কাছে। আমি কি অত খারাপ যে তাতে হালুম করে ভয় দেখাব? নেহাত সময় নষ্ট হলো ভেবে বিরক্ত মনে রিকশা ছেড়ে দেব। ছিনতাই করতে একদম ভালো লাগে না। মানুষ কেমন ভীত চোখে তাকায়। তার চেয়ে চুরি ভালো। আক্রান্ত ব্যক্তির অভিব্যক্তির মুখোমুখি হতে হয় না। ছিনতাই ব্যাপারটা আমার মতো নরম মনের মানুষের জন্য না। ছিনতাই করতে গেলে ছিনতাইকারীর এ্যাটিচিউড খুব জরুরি একটা বিষয়।  শুরুতেই  হুমকি-ধামকি দিয়ে ভিকটিমের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু ত্যাঁদড় কাস্টমার পড়ে এরা হাজার হুমকিধামকিতেও ভয় পায় না। এগুলার এড্রিনালিন হরমন মনে হয় তেমন কাজ করে না। একবার এক অফিসফেরত নারীকে আটকালাম। আমি কীভাবে জানব সে মেয়ে ক্যারাটে জানে। সে  ভয় তো পেলই না, উল্টা আমার ছুরি ধরা হাত বরাবর এমন কিক মারল হাত থেকে ছুরি উড়ে গিয়ে ড্রেনে পড়ল নাকি বিনে পড়ল কিছুতেই ঠাহর করতে পারলাম না। তারপর ওই ডাকাত মেয়েমানুষ আমাকে এমন পেটাল যে এইবার দুই সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হলো।

আপনাদের চুপিচুপি একটা খবর দিই, ওই মেয়ে মানুষটা না হাসপাতালে থাকার কদিন রোজ বিকালে স্যুপ রান্না করে আমার জন্য নিয়ে এসেছে।  আমাকে বলেছে, ভালো মানুষ হয়ে যেতে। আমি বুঝলাম না জগতে এত এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেন তার ভালো মানুষ করতে উঠেপড়ে লাগতে হলো। লাগল তো লাগল একেবারে আঠার মতো লাগল। ছাড়াছাড়ি নাই।

 

Print Friendly, PDF & Email
কামরুন নাহার

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন : ৭ম সংখ্যা (মার্চ-২০২৫ : বিশেষ ঈদ সংখ্যা)

Read Next

রোকে ডালটন-এর দুটি কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *