অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সন্তোষ কুমার শীল -
বামনের হিমালয় দর্শন

একজন দুইজন করে ক্রমশ কথাটা সকলের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। তার মধ্যে চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধরা পেছনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একধাপ এগিয়ে বলে⸺নান্টু নাকি হিমালয় দেখতে গিয়েছিল! জীবনটা ওর ধন্য হলো। আমাদেরও তো ধন্য করেছে। ওরে বাবা! চাট্টিখানি কথা, হিমালয়⸺পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে উঁচু পর্বত। দেখলেও পুণ্যি হয়। সবাই তো আর নান্টুর মতো এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না! তোরা তো আবার সবাই ওকে মিছেমিছি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিস। এখন দ্যাখ, কত্ত বড় কাজটা সে করে ফেলেছে! এখন তোদের উচিত সব্বাই মিলে নান্টুকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া।

অবশেষে ঠিক হলো নান্টুকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হবে। নানা রকম পরিকল্পনাও চলল কয়েক দিন ধরে। সবকিছু প্রস্তুত। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি বলে নির্জন তার এক সহপাঠী বন্ধু স্বাধীনকে নিয়ে গ্রামে এসে উপস্থিত। সবার কাছে সব শুনে, বিশেষ করে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা শুনে সে বৃদ্ধদের ডেকে বলে⸺সংবর্ধনা দেওয়ার আগে নান্টুর মুখে একবার গোটা ঘটনার বর্ণনা শুনে নিলে ভালো হতো না? আমরাও একটু হিমালয় ভ্রমণের সুখ পেতাম!

আর কেউ বললে হয়তো সবাই মিলে তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত। কিন্তু নির্জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে! তাছাড়া সংবাদপত্রে তার নাম ছাপা হয়⸺গপ্পোসপ্পো কীসব নাকি লেখে। রাজধানী শহরে থাকে। তার কথা তো একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না! তাই বৃদ্ধদের এবার টনক নড়ে⸺আরে তাই তো! এই কথাটা আগে আমাদের মনে পড়ল না কেন?

একজন বলে, আমার তো প্রথমেই একথা মনে হয়েছিল। তোমরা আবার কি বলো সেই ভয়ে চুপ করে গেছি।

⸺চুপ করে গেলি কেন? এত্তবড় পর্বতের মহিমা শুনলেও তো পাপমুক্তি হয়! সেটাই তো আগে শোনা উচিত! তা না শুনে সবাই সংবর্ধনা নিয়ে উঠেপড়ে লাগলি!

⸺বেশ তো, তাহলে এবার নান্টুকে ডেকে তার মুখে আমরা একটু হিমালয় পর্বতের কথা শুনি।

দিনক্ষণ ঠিক করে নান্টুকে উঁচু দেখে একটা আসনে তুলে দিয়ে চারপাশে সবাই গোল হয়ে বসে। সোয়া চার ফুট উচ্চতার নান্টু তার খোঁড়া পা-খানা অন্য পায়ের উপর তুলে আয়েস করে বক্তার আসনে বসে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাওয়া নষ্ট চোখটা রঙিন চশমায় ঢেকে বাকি চোখে সে চারপাশে জড়ো হওয়া কৌতূহলী মুখগুলো দেখে। সুস্থ-সবল লোকগুলো যারা অনায়াসেই স্বচক্ষে হিমালয় দর্শন করে আসতে পারে তাদেরকে ভিড় করে দাঁড়াতে দেখে তার মনে অভাবনীয় পুলক জাগে। খুশিতে তার ছোটাছুটি করতে ইচ্ছে করে। সে কিছুক্ষণের জন্য খেই হারিয়ে ফেলে। তারপর মাথাটা ঠিক হলে গলাটা ঝেড়ে-কেশে বলতে শুরু করে⸺

হঠাৎ করে এক পরিচিত লোকের অসুখ। দেশের ডাক্তার তার আশা ছেড়েই দিয়েছে। আমি পরামর্শ দিলাম যে ভেলোর কিবা চেন্নাই গিয়ে ডাক্তার দেখালে সে সুস্থ হয়ে যাবে। যদিও সে ভীষণ ভারত-বিদ্বেষী। কিন্তু বিপদে পড়া মানুষ তো! তাই মরার ভয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্বেষ ভুলে চিকিৎসায় যেতে রাজি হয়। আর আমি যেতে বলায় সে ভেবে নেয় আমি সেখানকার ডাক্তারদের সম্পর্কে অনেক জানি-শুনি। তাই আমাকে ধরে পড়ল সাথে যাওয়ার জন্য। দেখলাম, এই সুযোগ! যদি সদ্ব্যবহার করতে পারি তাহলে বিনে পয়সায় ভারত ভ্রমণটা হয়ে যায়। তাই দরকষাকষি করে হিমালয় দেখিয়ে আনার শর্তে তাকে রাজি করাই।

ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন বলে ওঠে⸺তুই কার দালালি করে হিমালয় দেখতে গেছিস তা আমাদের শোনার দরকার নেই। তুই হিমালয় পর্বত সম্পর্কে বল।

নান্টু কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বেশ একটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে⸺সে এক বিরাট কাণ্ড! এত তাড়াহুড়ো করলে কী হবে? তার আগে এক কাপ চা হলে বেশ হতো। ঠাণ্ডায় পা জমে যাচ্ছে।

⸺এই তো সেদিন কি প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জিরো ডিগ্রি তাপমাত্রায় এলি হিমালয় দেখে। আর সমুদ্র উপকূলে এসে এখন তোর ঠাণ্ডা লাগছে, না? তাহলে ওই বরফের রাজ্যে কে তোকে ঘনঘন চা দিয়েছে? নাকি ফাঁকতালে এককাপ চা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধা?

নান্টু মুখ বিকৃত করে একটু হাসার চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবে⸺আজকাল লোকজন বড্ড বুদ্ধিমান। কোনো কিছু করে এড়ানো দায়। সে বলতে শুরু করে⸺তোমরা হিমালয় সম্পর্কে যতখানি আদিখ্যেতা করো আসলে তেমন কিছু না। শুধু বরফ আর বরফ।

⸺পাহাড়টা কি অনেক বড়?

⸺না… তেমন আর কী? ওই যে ইটভাটায় মাটি স্তূপ করে রাখা থাকে ঠিক ওই রকম, অনেকটা আমাদের গ্রামের উঁইয়ের ঢিবির মতোই। তবে বরফে ঢাকা আর কী!

⸺তবে যে শুনি ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়?

⸺তেমন বড় আর কোথায়? তবে একেবারে ছোট নয়! বেশ খানিকটা বড়ই।

⸺তুই কী উপরে উঠেছিলি?

⸺তবে কি নিচে দাঁড়িয়ে দেখেছি? অনেক উপরে বসেই দেখেছি।

⸺শুনেছি সেখানে নাকি বিশেষ পোশাক পরে, অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে যেতে হয়?

⸺তোমরা তো সবই শুনে শুনে বলো! গিয়ে তো আর দেখোনি!

⸺রাখ ওদের কথা। তুই-ই বল, কীভাবে দেখলি?

⸺কেন আমরা তো এক্কবারে কাছেই, বলতে গেলে পাহাড়ের উপর একটা হোটেলে ছিলাম। সেখান থেকে সব দেখা যায়। আমার ফোনে ছবিও তোলা আছে। চাইলে তোমাদের দেখাতে পারি। কিন্তু ফোনটা যে বাড়িতে রেখে এসেছি!

⸺শুধুই হোটেলে বসে দেখেছ, পাহাড়ে তাহলে ওঠোনি?

⸺উঠেছি তো! মানে গাড়িতে চড়ে যতদূর ওঠা যায়। তাতেই হয়। সব জায়গাই তো একই রকম! চূড়ায় ওঠার দরকার কী? হোটেলে বসে যা দেখা যায়, উপরে উঠেও তাই? মিছেমিছি কষ্ট করে উপরে চড়ার দরকার কী? মোট কথা, ওটা শুধুই একটা পাহাড়। আর কিছু নয়। এখানে সেখানে জঙ্গল, খাদ। ভালো কিছুই নেই। ভেবে দেখো, এই পাহাড়টা কতখানি জায়গা দখল করে আছে! এক্কেবারে শুধু শুধু! তাতে আমাদের মানে এই মানব সভ্যতার লাভটা কি হচ্ছে? তার চেয়ে যদি জায়গাটা খালি থাকত তাহলে প্রচুর ফসল ফলানো যেত! অথবা যদি জলাশয় হতো মাছ চাষ করে কত মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো! মরুভূমি হলেও দোষ ছিল না, উট চরানো যেত। কিন্তু বিরাট একটা পাহাড়, না আছে মাথামুণ্ডু, না আছে কিছু। অথচ তোমরা ওটাকে নিয়ে এমন মাতামাতি করো যেন খুব ভালো একটা কিছু! নিজের চোখে দেখে তো এলাম! না দেখলে অন্য কথা ছিল।

উপস্থিত সবার মাথা নিচু হয়ে যায়⸺তাই তো! নান্টু তো ঠিকই বলছে! ওটা তো শুধুই একটা পাহাড়, অন্য কিছু তো নয়! শুধু একটু বড়⸺এই যা!

নির্জন এক পলকে জনমত জরিপ করে নেয়। মনে মনে ভাবে, এভাবেই তো জনমত গড়ে ওঠে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! সে এই মূর্খতা সইতে না পেরে কথার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করে⸺সবই তো দেখে ফেলেছ, বুঝে ফেলেছ⸺অবশ্য এক চোখে। আমাদের আর কী বলার থাকতে পারে? আচ্ছা, ওখানে গিয়ে তোমার হিমালয় দেখে কী মনে হতো?

নান্টু যেন এতক্ষণে বলার মতো একটা কথা পেয়েছে এমনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ভাবে গদগদ হয়ে বলে, ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর যখনই পাহাড়টাকে দেখতাম একটা করে ঢিল ছুড়ে মারতাম!

⸺সে কী? কেন?

⸺কেন আবার? পাহাড়টা আমাদের বাড়িতে কিবা গ্রামে হতে পারত না? তাহলে আমাদের কত গৌরব বাড়ত বল? তাই রাগ-ক্ষোভ-কষ্ট থেকে একটু আরাম পেতে!

⸺তাতে অত্ত বড় হিমালয়ের কী হয়েছে?

⸺তার কিছু না হোক, আমি তো সুখ পেতাম!

নির্জনের কানে কানে স্বাধীন বলে⸺ঠিক আমাদের রবি ঠাকুর বিদ্বেষী বুদ্ধিজীবীরা যেমন নানা কুৎসা আর মিথ্যে কথা বলে সুখ খোঁজে।

নির্জন ফিক করে হেসে দিয়ে বলে⸺আস্তে বল, কে আবার শুনে ফেলে তোকেও রবীন্দ্র-ভক্ত বলে সমালোচনা করবে!

 

Print Friendly, PDF & Email
সন্তোষ কুমার শীল

সন্তোষ কুমার শীল ১৯৭৩ সালের ১৫ অক্টোবর (সার্টিফিকেট অনুসারে) পিরোজপুর জেলার বাটনাতলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন এবং একই পেশায় বর্তমান আছেন। রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত এ নিভৃতচারী ঔপন্যাসিক মূলতঃ একজন সর্বগ্রাসী পাঠক। বই পড়া, গান শোনা এবং সাহিত্য সাধনায় সময় যাপন তাঁর একান্ত প্রিয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি ছোট গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ এবং রম্য রচনার চর্চা করেন। এ পর্যন্ত তাঁর আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। “একাত্তরের কথকতা” তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস।

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন : ৭ম সংখ্যা (মার্চ-২০২৫ : বিশেষ ঈদ সংখ্যা)

Read Next

রোকে ডালটন-এর দুটি কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *