
(দৃশ্যপট : গভীর রাত, দুই মাতাল ও এক ধার্মিক যুবক গ্রামের রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে কথোপকথনে লিপ্ত।)
ধার্মিক : ফাটিয়ে দিয়েছে মাইরি; বাহ বাহ!
মাতাল এক : ইশ! কে ফাটাল? কার ফাটাল? কপাল ফেটেছে বুঝি? তা আর নতুন কী; এই দেশের সব মানুষেরই কপাল ফাটা।
ধার্মিক : ধুৎ ধুৎ! কীসের মধ্যে কী পান্তা ভাতে ঘি।
মাতাল এক : ছি ছিহ! তুমি তো বাবু বড় বেরসিক! এত খাবার থাকতে পান্তা ভাতে ঘি মেশাতে গেলে কেন? গরম গরম ভাতের উপর একটু ঢেলে লবণ মেখে খেতে পারতে। বড়ই উপাদেয়। তাছাড়া পোলাও কোরমাইবা কী দোষ করল? তাদের অধিকারের ঘি পান্তা কেন নিয়া গেল?
ধার্মিক : দূর মশাই! কী যে আবোলতাবোল বকছেন না। কথার কোনো মাথামুণ্ডু নাই।
মাতাল এক : রক্তে কেনা মাতৃভাষায় কথা কই, মুণ্ডহীন হবে কেন কথা?
মাতাল দুই : এ মা! কী সাংঘাতিক! মাতৃভাষার গর্ব করছেন পণ্ডিত মহাশয়। এ ভাষার সে গৌরব কী আর আছে? কিছু বলতে গেলেই চৌদ্দ শিকে বন্দি হয়ে যায় ওই ভাষা। গর্ব করো না বাপু; কথা গেছে পরাধীনতায়।
মাতাল এক : সব ভাষার কথাই গেছে ওই দেশে সোনার বাংলায়। তা কেবল বাংলার দোষ কেন? বড় অন্যায় মশায়। তার চে বরং চৌদ্দ শিকের গল্প করুন। সে আঠারো শিক হলো না কেন? বিশ পঁচিশ কিংবা শ দুয়েক শিক হলেইবা তার দোষ কী হতো?
মাতাল দুই : এত কিছু জেনে করবেন কী? যাবেন চৌদ্দ শিকে? ভারি আমুদে জায়গা। বিনি পয়সায় খাবার মেলে।
মাতাল এক : এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে কে না যেতে চাইবে ওখানে? ভিসা পেলে স্বচ্ছন্দ্যে যেতে পারি।
ধার্মিক : ফাটিয়ে দিয়েছ মাইরি; বাহ বাহ!
মাতাল এক : ওহ আচ্ছা। কিছুক্ষণ আগে কে যেন ফাটিয়ে দিল বললে? ফাটানো কী বাপু তোমার স্বভাব?
মাতাল দুই : এ কথাটা তার প্রিয় বটে। তুমি হয়তো জানো না। তা যাই হোক। চল শোনা যাক তার ফাটিয়ে দেওয়ার গপ্প কাহিনী।
ধার্মিক : গপ্প কাহিনী কিংবা মশক বাহিনী নয়, এ সত্য কথা। এই কিছুক্ষণ আগেই তো ফাটিয়ে দিল।
মাতাল এক : ঠিক আছে বাপু! কে ফাটাল বল এবার। নয়তো তোমারও ফেটে যাবে।
ধার্মিক : আরে শায়েখে আলা।
মাতাল এক : এই উজবুক আবার কে?
ধার্মিক : তওবা! তওবা! তিনি বিশাল বড় মওলানা। তারে তুমি উজবুক কইলা। তওবা কর, নয়তো নরকে যাবা।
মাতাল এক : তা যাওয়া যাবে কিঞ্চিৎ অমৃত জল পেলে। কোন মওলানার কথা কইতেছ?
ধার্মিক : আহা! শায়েখে আলা আল্লামা হাফেজ ক্বারী মুফতি আলহাজ্ব মাওলানা কুরকুবুদ্দিন কাসেমী রফিকী আল মাদানী মা. দা. সাহেব। তারে চেনো না?
মাতাল এক : তুমি কি বাপু কুরআর তেলাওয়াত করছ নাকি হাদিসের পাক কথা শুনাইছ বুঝতে পারলাম না। একটু বাংলায় বল। মাতৃভাষাটাকে অতটা তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়।
ধার্মিক : ধেৎ। এটা তো শায়েখে আলার নাম।
মাতাল এক : কী বললে? কার শালা? কুত্তার? তা হতে পারে। শায়েখে আলা কুত্তার শালা। ছান্দসিক সম্পর্ক।
ধার্মিক : কানের ডাক্তার দেখাও। ইহা অপরিহার্য।
মাতাল এক : এক কলকে গঞ্জিকা যদি দাও ডাক্তার-ডাকাত সব দেখাতে পারি।
ধার্মিক : ওই নেশা করে করে তোমার এই অবস্থা। এগুলা ছাড়ো বাপু। মানুষ হও, দ্বীনের পথে এসো।
মাতাল এক : সূর্য উঠলেই দিনের পথে যাব। এবার ফাটা শায়েখে আলার কথা কও।
ধার্মিক : এইমাত্র ওয়াজ থেকে এলে আর এর মধ্যে ভুলে গেলে সব?
মাতাল এক : কী আশ্চর্য! ভুলব কেন? বিরিয়ানিটা বড় উপাদেয় ছিল। তাকে নির্দ্বিধায় শাহি তবারকের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। আমি দুবার নিয়েছি। তৃতীয়বার আর পেলাম না। বড় দুঃখ।
ধার্মিক : তবারক খাওয়া ছাড়া কি আর কিছুই শোনো নাই?
মাতাল দুই : শুনেছি তো। মশার কুচকাওয়াজ।
ধার্মিক : তুমিও তার পথে গেলে? দ্বীনের কথা না শুনে গঞ্জিকা খেলে?
মাতাল দুই : না তো! গঞ্জিকা পাব কই খাব? একটু বাংলা খেয়েছি।
ধার্মিক : বাহ বাহ! দেশের প্রতি খুব মমতা দেখছি।
মাতাল এক : আমার দেশ আমার স্বাধীনতা। বলব না তাদের কথা?
মাতাল দুই : তোমার-আমার দেশ কিনা সন্দেহ আছে ঢের। সে কথা বলছি না। স্বাধীনতা যে নেই তা নিশ্চিত। সাহস থাকে তো বলে দেখো উচ্চস্বরে সত্য কথা। দেখি তোমার দেশ তোমার স্বাধীনতা কই।
মাতাল এক : এক স্টিক গঞ্জিকা দাও তো চিৎকার করে বলতে পারি। এ ছাড়া সত্য বলা সত্যিই মহাপাপ।
ধার্মিক : আপনি আছেন গাঁজা নিয়ে। শায়েখে আলার গল্প শুনবেন না তাহলে।
মাতাল এক : তাকে গঞ্জিকা কোথা থেকে দেব ভাই? আমিই যে খেতে পাই নে। বড্ড দাম বেড়েছে কিনা।
ধার্মিক : দূর মশাই! বলবই না কোনো কথা।
মাতাল দুই : এই যে চুপ করলাম। ফাটা শায়েখের গল্প বল।
ধার্মিক : শায়েখ ফাটা না ভাই, তিনি ফাটিয়ে দিয়েছেন বলেছি।
মাতাল দুই : আহা! মন খারাপ করছো কেন? বাংলা মায়ের আরাধনা করলে একটু এদিক ওদিক হয়েই যায় কথাবার্তা। তুমি চালিয়ে যাও।
মাতাল এক : গাড়ি কই চালাবে? তুমি বড্ড মাতলামো করছো বন্ধু। এটা বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তানের দ্বারা আশা করা যায় না।
মাতাল দুই : চুপ কর তো! তাকে বলতে দাও।
মাতাল এক : বলুন মহান শাগরেদে শায়েখে আলা!
ধার্মিক : দারুণ কণ্ঠস্বর শায়েখে আলার। কী সুন্দর করেই না দ্বীনের কথাগুলো বললেন। আহা! এক্কেবারে হৃদয়ে গেথে গেছে।
মাতাল এক : ভয়ংকর গুণ্ডা তো শায়েখে আলা! এক্কেবারে হৃদয়ে গেথে ফেলেছেন? বিপদজনক! তার থেকে একশ’ হাত দূরে থাকবে।
ধার্মিক : দ্বীনের কথা গাথা খুবই উত্তম। আমি সন্তুষ্ট।
মাতাল এক : কথা গেঁথেছেন? তা মওলানা সাহেবের কণ্ঠ আছে বলতে পারো। জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে আজকাল হয় কী?
ধার্মিক : কণ্ঠের মতো তিনিও জ্ঞানী-গুণী পর্যায়ে আউলিয়া। কোরান হাদিস থেকে আলোচনা করেন। গল্পকেচ্চা করে কাটান না সময়।
মাতাল এক : অতি উত্তম! দুয়েকটা বাণী দাও শাযেখে আলার। ধর্মের পথে আসি।
ধার্মিক : এতক্ষণে জায়গায় এসেছো।
মাতাল এক : কার জায়গায় এলাম আবার। শায়েখে আলার? তা কী করে হয়? এটা তো রান্তা! সরকারের তৈরি জনতার সম্পদ। আমরাও জনতা। সুতরাং রাস্তা আমাদের। আমাদের জায়গা রেখে অন্যের জায়গায় যাওয়ার কোনো সাধ নেই বাপু। মিথ্যা বলো না।
ধার্মিক : আপনার জায়গাতেই আছেন। এবার আমার কথা শুনুন। শায়েখে আলা হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, …
মাতাল এক : তোমার কথা বল, শায়েখে আলার কথা শুনব না।
মাতাল দুই : ওকে বলতে দাও তো! একটু চুপ থাকো।
মাতাল এক : একটু গঞ্জিকা দাও, পুরোদমে চুপ হয়ে যাই। একটু-আধটু হলে ফায়দা নাই।
মাতাল দুই : অপেক্ষা কর বন্ধু! ব্যবস্থা হবে।
মাতাল এক : আশ্বাস দিলে যখন কিঞ্চিৎ চুপ করলাম। বলুক তার যা ইচ্ছে।
ধার্মিক : শায়েখে আলা তার সুমধুর কণ্ঠ দিয়ে কানতে কানতে বললেন, ‘সবচে বেশি জাহান্নামে যাবে নারীরা। সুতরাং তাদের থেকে সাবধান থাকো।’
মাতাল এক : তাহলে বরং নরকই ভালো। এত সুন্দর রমণীহীন জান্নাত আমার দরকার নেই।
মাতাল দুই : আমিও একমত বন্ধু।
ধার্মিক : জান্নাতে থাকবে ৭০ জন হুরপরী। সব তোমার।
(প্রথম মাতাল গান গাইতে শুরু করলেন।)
‘সত্তরটা হুর পরিতে বন্ধু
আমার তো কাম নাই আমি নরকে যাব
আমি দোজখে যাব।’
ধার্মিক : গান বন্ধ কর তো। নরকে যাবেন তিনি! জ্বলে পরে ছারখার হয়ে যাবেন। এতই সোজা ধর্মপথ কেয়ামত? আর আপনিও মশায় ওর গানে তাল দিচ্ছেন।
মাতাল দুই : গানটা বড় মধুর কিনা! লোভ সামলাতে পারলাম না।
ধার্মিক : এইসব গান-বাজনা ছাড়ান দেন। এগুলা পাপ।
মাতাল এক : কে বলেছে এ কথা?
ধার্মিক : শায়েখে আলা।
মাতাল এক : শালার শালা!
ধার্মিক : গালি দিয়া লাভ নাই ভাই। তেনার টেকাপয়সার অভাব নাই। প্রতিদিন দুইটা তিনটা প্রোগ্রাম করেন।
মাতাল এক : সারারাত তো তাহলে বাইরেই থাকেন। তার বউ বেচারি বড় অসুখী! স্বামীকে পায় না।
ধার্মিক : ভুল বললেন মশাই। হুজুরদের বউই সবচে বেশি সুখে থাকে।
মাতাল দুই : আরে থাকব না! সুখে থাকব না কেন? শায়েখে আলা সারাবছর প্রতিদিন তিনটা চারটা করে মাহফিল করে বেড়ান, তার বউও যান রসিক লালের বাসায় মাহফিল করতে। হা হা হা।
মাতাল এক : অতি উত্তম বলেছো! স্বামীর টাকা রসিক লালের সোহাগ। আহা পুণ্যবতী সরস্বতী শায়েখে আলার উত্তম স্ত্রী। উনার নাম্বার থাকলে আমাকে দিও তো ভাই। পায়ের ধুলো নিতে যাব। দেবি কিনা?
ধার্মিক : নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ। কী বলছেন মশাই। কী সাংঘাতিক কথা!
মাতাল এক : সত্য কথা সাংঘাতিক হয়ে থাকে বটে। তার সম্বন্ধে আর কী কী জানো বল। দেখি মুরিদ হইতে পারি কিনা।
ধার্মিক : উনি বললেন, ‘খেলাফতের আশায় আছি। উপরের নির্দেশনা এলেই আমার পীর মরহুম ছগির উদ্দিন বগীর কানা আমাকে খেলাফত দেবেন। তখন আপনাদের খেদমতে আমার জান কুরবান করব। আমার খানকায় আপনারা যাবেন, মুরিদ হবেন। খাবেন, ইবাদাত বন্দেগি করবেন।’
মাতাল এক : মরা কানার লগে কথা কইব কেমনে কুত্তার শালায়?
মাতাল দুই : আরে বুঝো না, তিনিও কিঞ্চিৎ গঞ্জিকা খেয়ে বক্তৃতা দিতে আসেন। এই জন্য যা খুশি বলেন আর সাধারণ জনতা তো ধর্মের নেশায় এমনিতেই মাতাল। বিশ্বাস করতে একফোঁটা চিন্তা করেন না।
মাতাল এক : তোমার ফিলোসফি রাখো তো মিয়া। নেশাটাই কেটে গেল। ধেৎ।
ধার্মিক : শুনেন মশাই! কামেল আদমি শায়েখে আলা। তেনার অসম্ভব কিছু নাই। কবর জিয়ারত করতে গেলে পীরের সাথে তার আত্মিক কথা হয়। সিনা টু সিনা। দিলসে দিল কথা হয়। মোলাকাত হয় স্বপ্নে। আপনারা আছেন গাঁজা নিয়ে। উঁচু স্তরের এসব কথা বুঝবেন কেমন করে?
মাতাল এক : উঁচুস্তরের গাঁজা খান শায়েখে আলা? এটা আবার কেমন গাঁজা? আমাদের পীর গঞ্জিকার চেয়েও মহান গাঁজা হয় নাকি পৃথিবীতে?
মাতাল দুই : জয় বাবা গঁঞ্জিকা!
ধার্মিক : আপনাদের আমি কী করে বোঝাতে পারি বলুন তো মশাই? আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ। সবই বোঝেন। তবুও কেন একজন কামেল আদমিকে নিয়ে এইসব ফায়েশা কথাবার্তা বলতেছেন? মহাপাপের ভয়ও নেই মনে কিঞ্চিত পরিমাণে?
মাতাল এক : একটু গঞ্জিকার ব্যবস্থা করো তো সবকিছু বুঝতে পারি। দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে পারি সমস্ত কিছু।
ধার্মিক : থাকেন আপনার গঞ্জিকা নিয়া। গেলাম আমি।
মাতাল এক : একী! রাগ করলে ভাই?
শুনল না সে এ কথা। হনহন করে হেঁটে চলে গেল। প্রথমে তওবা করবে এবং পরে শায়েখের কাছে গিয়ে তালিম নেবে ভাবতে ভাবতে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করকে করতে চলে গেল। তার ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনে দুই গেজেল সাপের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দৌড় লাগাল। এইবার তারা নরকে গিয়ে পৌঁছোবে নয়তো যাবে গঞ্জিকা বাবার দরবারে বাংলা মায়ের আরাধনা করতে। এবং তারপরই সরাসরি স্বর্গে প্রবেশ তাদের।
দক্ষিণপাড়া, বিষ্ণুরামপুর, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৩৪১৮ থেকে