অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৯, ২০২৫
২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কুমার দীপ -
সত্যিকার ভূতের কাহিনী

নানু, ভূতের গল্প তো অনেক বলেছ, কিন্তু তুমি নিজে কি কখনও ভূত দেখেছ?

তার মানে, সত্যিকার ভূতের কথা বলছিস, রুকু?

হ্যাঁ, নানু।

রোকেয়ার কথায় বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন নানু। এতদিন ধরে কত ভূতের গল্প করেছেন নাতনিটার সঙ্গে! গেছো ভূত, মেছো ভূত, দাঁতাল ভূত, মাতাল ভূত, ভালো ভূত, মন্দ ভূত, সাদা ভূত, কালো ভূত, চোখা ভূত, কানা ভূত… কিন্তু সবই তো অন্যদের নিকট থেকে শোনা। দু-চারটি নিজের বানানো। সেগুলোর কোনোটাই তো সত্যিকার ভূত নয়। কিন্তু রোকেয়া যে আজ সত্যিকারের ভূতের গল্প শুনতে চাইছে! নানুর দেখা ভূত! নাতনিটা খুব জেদি। নানুর কাছে যা-আবদার করে, তা আদায় করে ছাড়ে। আবার লক্ষ্মীও। নানু যা বলে, তা-ও খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। নানু তার প্রিয় নাতনির দাবি পূরণের চেষ্টা করেছেন সবসময়। কিন্তু আজ? মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকেন আনোয়ার কামাল।

কী ব্যাপার, মাথা চুলকাচ্ছ যে! তুমি কখনও ভূত দেখনি, নানু?

মাথা চুলকাতে চুলকাতে চোখে-মুখে হাসির আলো ফুটিয়ে কামাল বলেন— দেখেছি দেখেছি, ভয়ঙ্কর রক্তখেকো সেই ভূত! নতুন কিছু আবিষ্কারের মতো খানিকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি।

রক্তখেকো ভূত! তবে তো খুবই ভয়ঙ্কর। রোকেয়াও যেন কেমন শিউরে উঠলো। চোখ বড় বড় করে নানুর দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, খুবই ভয়ঙ্কর। শোনো তবে সেই সত্যি ভূতের কাহিনী… এই বলে নানু বলতে শুরু করেন।

তখন আমার বয়স সাত বা সাড়ে সাত। চৈত্র মাসের এক রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা ঘুমিয়েছি। অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কানে আসতে লাগল ভয়ঙ্কর দুম্-দাম্, দুম্-দাম্ শব্দ। ভয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মু কিন্তু আগে থেকেই জেগে আছে। আমার মুখে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বলল— চুপ্ চুপ্, ভূত এসেছে!

আমি বললাম— ভূ-উ-ত!… সত্যি সত্যি ভূত! কথা আমার মুখ থেকে কথা বের হলো কিনা বলতে পারিনে। আম্মু আমাকে কোলের ভেতর টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে বলল— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যি সত্যি ভূত, একদম কথা বলিস না।

কথা বলব কী, আমি তো ভয়ে জড়সড়। এমনিতেই আমাদের তখন ভূত-পেত্নি দৈত্য-দানবের ভয় খুব। সন্ধ্যা হলেই আম্মুর আঁচল ছাড়তে চাইতাম না। তার উপর অমন সত্যিকারের ভূত! একেবারে দু-চোখ বন্ধ করে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম।

তারপর?

চোখ বন্ধ থাকলেও কান তো খাড়া। বাইরে দুম-দাম্ দুম-দাম্ শব্দ। যেন ভাঙচুর হচ্ছে। মনে হলো ঘরের উপরে ভূতেরা বাজি ফোটাচ্ছে! আগুন জ্বালাচ্ছে!

ধুর, ভূতেরা আবার বাজি ফোটায় নাকি? অবাক চোখে নানুর দিকে হা-করে তাকায় রোকেয়া।

এ-তো সত্যিকার ভূত। ফোটাতেও পারে। আমারও তখন তোর মতোই মনে হচ্ছিল, কিন্তু সে-কথা জিজ্ঞাসা করব কী, আব্বুও তখন খুব ভয় পেয়ে গেছে। একবার দরজায় কান পাতে, আরেকবার জানালার ফাঁকে চোখ দেয়। আমাদের কাছে এসে খুব আস্তে আস্তে বলে— কোনো কথা নয়। নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা না যায়।

জানালার ফাঁকা দিয়ে ভূত দেখতে পেয়েছিল, বড় নানু?

তা জানি না। তবে একদিন পরে খুব ভোরে আমরা সবাই একসঙ্গে ভূত দেখতে পাই।

সবাই! শিহরিত রোকেয়া চোখ বড় বড় করে তাকায়।

হ্যাঁ, সবাই। প্রথম রাতের পর সকালে আব্বু অফিসে গিয়ে জানতে পারলো ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাল ভূত নেমেছিল, সারারাত ভূতেরা অত্যাচার করেছে, অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। আম্মু খবর পেল আমাদের পাশের বাসার এক সাংবাদিককে মেরে রেখে গেছে। আমি স্কুলে যেতে চাইলে আম্মু বলল— আজ তোমার স্কুলে যেতে হবে না, তোমাদের এক স্যারকে নাকি ধরে নিয়ে গেছে ওরা। আরও কিছু কিছু খবর আমাদের কানে এলো সারাদিনে। পরের রাতে আব্বু-আম্মু কেউ ঘুমোতে পারল না। ভোরে উঠে দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলেই চমকে উঠলো আম্মু। আব্বুকে ডেকে নিল জানালায়। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু সেই মুহূর্তে আমারও ঘুম ভেঙে গেল। তখনও দিনের আলো পরিষ্কার হয়নি। আব্বু-আম্মু দুজনকে জানালার কাছে ফিসফাস করে কথা বলতে দেখে আমিও আস্তে আস্তে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের বাসার পাশের রাস্তায় কালো মতো একটি গাড়ি। গাড়ির পাশে কালো কালো কয়েকজন লোক। তাদের হাতে লম্বা কালো কালো বন্দুকের মতো কী যেন।

আমি বললাম— ওরা কারা?

আমাকে দেখে আম্মু যেন আরও ভয় পেল। আব্বু আমাকে কোলে নিয়ে কানে কানে বলল— চুপ্ চুপ্, ভূত।

ভূতের আবার গাড়ি থাকে নাকি? আবার হাতে বন্দুকও আছে! এসব কী বলছ নানু? রুকুর চোখ পেঁচার মতো বড় বড় হয়।

তুই ঠিক বলেছিস রুকু, গল্পের ভূতের এসব থাকে না। কিন্তু এ-যে সত্যিকারের ভূত, সত্যিকারের ভূতের আরও অনেক কিছু থাকতে পারে। আর হ্যাঁ, ওরাই যে রাতের সেই ভূত, সেকথা আম্মু আমাকে ফিসফিস করে বুঝিয়ে দিল। ভূতেরা তখন চলে যাচ্ছে।

আব্বু বলল— এখন যাচ্ছে, কিন্তু রাতে আবার আসবে।

আবার! তাহলে তো আজকে ওরা আমাদের ঘরে ঢুকবে। আমি বললাম।

আমার কথায় আতঙ্কের আঁচ পেয়ে আম্মু আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল— না, আব্বু, ওরকম অমঙ্গলের কথা বলতে হয় না। ওরা আমাদের ঘরে ঢুকতে পারবে না।

কিন্তু আম্মু, তুমিই তো একদিন বলেছিলে, আমাদের ঘরের দরজাটা বেশি শক্ত না। আর পেছন দিকের জানালাটা তো একদিন আমিই বল খেলতে গিয়ে খানিকটা ভেঙে ফেলেছি! এখন কী হবে?

আব্বু বলল— তুই অত চিন্তা করিস না তো বাবা, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।

সেদিন অফিস থেকে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসে আম্মুকে বলল— সালমা, রাতটা কেটে গেলে কালই তোমাদেরকে গ্রামে রেখে আসব।

ভূতের ভয়ে শহর থেকে গ্রামে! গ্রামেই তো ভূত বেশি থাকে, তাই না, নানু! অবাক রোকেয়া জানতে চায়।

আমিও তো তাই জানতাম, কিন্তু এই ভূতের অত্যাচার শুরুই হয়েছিল শহর থেকে। এজন্যে সবাই শহর থেকে গ্রামে যেতে চেয়েছিল। তো, শোনো। আব্বুর কথা শুনে আম্মু কিছুটা অবাক হলো। এর আগে আম্মু অনেকবার আমাকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যেতে চেয়েছে, কিন্তু আব্বু যেতে দেয়নি। বলেছে, অফিস ছুটি হলে সবাই একসঙ্গে যাব। এখন আব্বুই আমাদের গ্রামে পাঠাতে চাচ্ছে!

কালই! কেন? শহরে খুব খারাপ অবস্থা না কি? আম্মুর কথায় আতঙ্কের সুর।

ভয়ঙ্কর খারাপ। ভূতেরা ঢাকা শহরকে কারবালা বানিয়ে ছাড়বে। গতকাল আমাদের অফিসের কাছাকাছি কোনো এক বাড়িতে ঢুকেছিল। ওই বাড়িতে এক নারী কবি ছিলেন। সঙ্গে তার মা ও দুই ভাই থাকত। ভূতেরা তাঁর মা ও ভাই দুটোকে খুন করে। বড় দা’য়ের এক কোপে ওই কবির গলা কেটে দেয়। এরপর কবির কাটা মাথার চুল সিলিং ফ্যানের সাথে বেঁধে ফ্যানের সুইচ অন করে দিয়ে কাঁচা রক্ত ছিটিয়ে বীভৎস উল্লাস করেছে। আর…

আর বলবে কী, এটুকু শুনেই আম্মু মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আব্বু কাছেই ছিল। আম্মুকে ধরে বিছানার উপরে শুইয়ে দিল। পানি-টানি দিল মাথায় ও চোখেমুখে। কিছুক্ষণ পরে আম্মু আস্তে আস্তে বলল— আমাদের নিরাপদে রেখে তুমি এই ভূতের শহরে একা থাকবে! তা হবে না। তার চেয়ে চলো আমরা সকলে মিলে কিছুদিন গ্রামে থেকে আসি।

আব্বু বলল— আর আমার অফিস?

বেঁচে থাকলে অফিস-টফিস সব পরে দেখা যাবে। আম্মু বলে।

আব্বু বলল— তুমি হয়তো ঠিক বলছ, কিন্তু চাকরি না থাকলে আমরা খাব কী? বাবুসোনার পড়ালেখা হবে কী করে?

আব্বু আর আম্মু যখন এসব কথা বলছে, তখন আমি কিন্তু কাউকে না-বলে ব্যাগ-ট্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছি। আমার স্কুল ব্যাগটা বই-খাতা ছাড়াই ইয়া পেট মোটা হয়ে গেল।

তোমার সব খেলনা-টেলনা ভরলে বুঝি? রোকেয়া বলল।

সব না, দুটো কি তিনটে। আমার একটা মাউথ অর্গান ছিল, সেটা নিলাম। আর নিলাম কিছু জামা-কাপড়।

আমার ব্যাগ গোছানো দেখে আব্বু বলল— ওই দ্যাখো, তোমার ছেলে এখনই ব্যাগ ভরে ফেলেছে। খুব জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে তুমিও তৈরি হও।

রাতটা খুব ভয়ে ভয়ে কাটল। তবে আমার খুব ঘুম হয়েছিল বলে ওই রাতে ভূতটুতের কোনো খবর আমি জানি না। সকালে খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। এর আগে যখন গ্রামে যেতাম, আম্মু-আব্বুর মধ্যে অনেক আনন্দ দেখতাম। আমি তো নাচতে নাচতে বের হতাম। বাড়ির লোকজনের জন্য এটা-ওটা কিনে ব্যাগ ভরে ফেলতো আব্বু। আম্মুও কতকিছু নিত! কিন্তু এবার ঘরের জিনিসপত্রে ব্যাগ ভরে গেল। মনে হলো আমরা একেবারেই ছেড়ে যাচ্ছি আমাদের বাসা, চেনা শহর। আগে গ্রামের বাড়ি থেকে আসার সময় আব্বু-আম্মুর মন খারাপ দেখতাম। আমারও মন খারাপ হতো। এবার শহরের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমাদের সবার মন খারাপ হলো। আম্মু চোখ মুছতে মুছতে আমার হাত ধরে বাইরে বের হলো। আব্বু দু-হাতে ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে একটা ঠেলাগাড়ি ডাকল। তারপর কখনও নৌকায়, কখনও পায়ে হেঁটে অনেক কষ্ট করে আমরা গ্রামে বাড়িতে পৌঁছালাম।

দাদা-দাদি আমাদের দেখে খুশি হলো। গ্রামে ফিরে আমি শহরের ভয়ের কথা প্রায় ভুলে গেলাম। আব্বুও আমাদের সাথে থাকল কয়েকদিন। তারপর যেদিন ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকলো, সেদিন শুধু আম্মুর না, বাড়ির সকলেরই মন খুব খারাপ। দাদা একটা গরুর গাড়ি ডেকে এনে চালককে কী যেন বলছে। দাদি বারবার চোখ মুছছে আর আব্বুর জন্য এটা-ওটা দিচ্ছে। প্রতিবেশিদেরও কেমন অন্যরকম দেখলাম। আমি বললাম— আব্বু, তুমি শহরে গেলেও কিন্তু অফিসে যেতে পারবে না।

হাসিমুখে আব্বু বলল— কেন, বাবু?

আমি তোমার অফিসের জামা-প্যান্ট আমার স্কুল ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম।

আব্বু বলল— তাই! কোথায় সেই জামা-প্যান্ট? নিয়ে এসো তো বাবা!

আমি তো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বুকে অনেক ভয় পেতাম। খুব অল্পতেই আব্বু ধমক দিত। কিন্তু এদিন আব্বুর কথায় নরম সুর। আবারও বলল— আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, জামা-প্যান্টগুলো এনে দাও, বাবা।

তুমি জামা-প্যান্ট দিয়ে দিলে? রোকেয়া বলে।

না। আমি তবুও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। সেই মুহূর্তে আম্মু চোখ মুছতে মুছতে বলল— আব্বুর জামা-প্যান্টগুলো দাও, কামাল। মাসের শেষদিক তো, দু-একদিন অফিস করে বেতনটা নিয়েই আবার চলে আসবে আব্বু। বেতন না-হলে আমাদের চলবে কী করে, বাবা?

এবার আমিও কেঁদে ফেললাম। অপরাধীর মতো বললাম— আম্মু, জামা-প্যান্টগুলো আমি যে ফেলে দিয়েছি!

ফেলে দিয়েছ! কোথায়? আম্মু এবার রেগে গেল।

নদীতে।

নদীতে! তার মানে আসার সময় তুমি নদীতে বাবার জামা-কাপড় ফেলে দিয়ে এসেছ! খুব রেগে গিয়ে আমাকে চড় মারল আম্মু। আরও হয়তো মারত, কিন্তু সাথে-সাথেই দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে আম্মুকে বাধা দিয়ে বলল— ওরে মাইরো না। ও-তো তোমাগো চাকরি-বাকরি বোঝে না, বোঝে বাবাকে। বাবা যাতে ওরে রেখে না-যাতি পারে, সেই জন্যি ওর ছোট্ট মাথায় যা আইছে তাই করেছে। বলে, আমার গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে থাকলো দাদি। উপায় না দেখে বাবা বলল— ঠিক আছে বাবা, তোমাদের রেখে এখন আর আমি ঢাকায় যাব না।…

আব্বুর গলার স্বরেও কেমন কান্নার মতো শোনাল শেষদিকে। আমি বললাম— কিন্তু আব্বু, আমাদের চলবে কী করে?

এবার দাদা ছুটে এসে আমাকে বুকে নিয়ে মুখটা ধরে বলল— তুই কী বলতিছিস, দাদু? আমি মরে গেছি নাকি? তোমার আব্বুকে তো আমিই বড় করেছি, দাদু। লেখাপড়া শেখানোর জন্য কত কষ্ট করেছি! এখনও আমার গায়ে শক্তি আছে। বাড়িতে যখন আছ তোমরা, কী করে চলবে, সে চিন্তা আমার।

আমাকে আদর করতে করতে দাদি বলল— আমার দাদা কত্তো বড় হইয়ে গেচে। আর আমার চিন্তা নি।

আব্বু হাসি মুখে বলল— ঠিক আছে, তুমি এখন খেলতে যাও, বাবা। আম্মুর মুখেও হাসি ফুটল। আমার খুব আনন্দ হলো। আমি খেলতে গেলাম।

গ্রামে কয়েকদিন খুব ভালো কাটলো আমাদের। আমি খেলাধুলা করে বেড়াতাম। আব্বু প্রায় সারাদিন বাইরে থাকত। রাতে এসে ভূতের অত্যাচারের নতুন নতুন গল্প বলত।

গ্রামেও ভূত এসে গেল তখন? হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল রোকেয়া।

হ্যাঁ গ্রামেও তখন ভূতেরা আসতে শুরু করেছে দলে দলে। আর তখনই আব্বু এই খবরটাও দিল, দেশের বাইরের থেকে নতুন নতুন ভূত আসছে। এবং এই ভূতগুলো আগের আসা ভূতগুলোর চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর।

তারা গ্রামে এসে কী করছে? রোকেয়া জানতে চায়।

রাস্তা-ঘাটে যাকে যেখানে পাচ্ছে, মারছে না-হয় ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাজারে ঢুকে দোকান-পাট পুড়িয়ে দিচ্ছে। আর বেছে বেছে কিছু বাড়িতে ঢুকে ওই বাড়ির লোকদের উপরে অত্যাচার করছে, মা ও মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলছে। আর গ্রামের কিছু খারাপ লোক ওদেরকে সাহায্য করছে।

গ্রামের লোকেরা ভূতকে সাহায্য করছে! অবাক হয় রোকেয়া।

ওরা তো খারাপ লোক। দেশের মানুষ ও দেশকে ওরা ভালোবাসে না। ওরা ভালোবাসে ওই ভয়ঙ্কর ভূতদের। বিনিময়ে ভূতেরাও ওদেরকে পছন্দ করে। মারে না। তবে এরইমধ্যে ভূতদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যেও অনেক মানুষ রেডি হতে শুরু করেছে।

ভূতদের সাথে লড়াই!

হ্যাঁ, রুকু।

তারপর? রোকেয়ার কৌতূহল বেড়ে যায়।

তারপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, আম্মু কাঁদছে।

কেন?

আমি কাছে গিয়ে দেখলাম, একটা ছোট্ট সাদা কাগজ আম্মুর হাতে। সেই কাগজে লেখা— তোমাকে বললে যেতে দেবে না জানি। তাই না-বলেই চলে গেলাম। এই যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। বাবুসোনাকে দেখো। যদি ফিরে আসি, বিজয়ীর বেশেই ফিরব।

তোমার আব্বুও কি ভূতের সাথে লড়াই করতে গেল? রোকেয়া জানতে চায়।

হ্যাঁ। শুধু আব্বু না, গ্রাম থেকে সেই রাতে আরও কয়েকজন গিয়েছিল। তার মধ্যে দিলিপের বাবাও ছিল।

দিলিপটা কে? রোকেয়া বলে।

দিলিপ আমাদের গ্রামের দীনেশ কাকার ছেলে। দীনেশ কাকা আব্বুর বন্ধু ছিল। গ্রামে এসে আমি দিলিপের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। সেবার গ্রামে এসে ওর সঙ্গে কদিনেই আমাদের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। আব্বু চলে যাওয়ার কারণে আমার খুব মন খারাপ। কিন্তু দিলিপ আমাকে বলল— তুই চিন্তা করিস না, দেখবি আমাদের বাবারা ওই ভূতদের মেরে তাড়িয়ে দেবে। এই ভয়ঙ্কর ভূতদের তাড়াতে না পারলে এই দেশ একসময় ভূতের রাজ্য হয়ে যাবে।

দিলিপও তো ছোট। অতো কথা জানল কী করে?

তুই ঠিক বলেছিস, রুকু। দিলিপও ছোট ছিল, তবে আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়। আর ওর বাবার সাথে ওর বেশ ভাব ছিল। তাছাড়া ওদের বাড়িতে গ্রামের আরও কিছু লোক আসত। সেখানে দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হতো। ওরা রেডিওতে খবর শুনত। এজন্যে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানত দিলিপ।

রেডিও কী, নানু? রুকু জিজ্ঞাসা করে।

তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা সময় নিলেন নানু। তারপর সহজ করে বললেন— রেডিও হলো একটি যন্ত্র। যা দিয়ে খবর, গান, গল্প, নাটক ইত্যাদি শোনা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। তখনকার দিনের মানুষ মূলত রেডিওর সাহায্যেই দেশ-বিদেশের খবর জানার সুযোগ পেত।

রোকেয়া বলে— তার মানে, রেডিও হলো তোমার আব্বুর ওই নষ্ট টেলিভিশনটার মতো, সবার কথা শোনা যায়, কিন্তু কারও ছবি দেখা যায় না।

রুকুর কথায় হো হো করে হেসে ওঠেন নানু। তার হাসির শব্দে ঘরের পাশের পেয়ারা গাছটি থেকে দুটো টুনটুনি উড়ে গেল। হাসি থামিয়ে নানু বললেন— ভাগ্যিস আমার আব্বুর ভাঙাচোরা টিভিটা ছিল, না-হলে তোকে তো বোঝানোই মুশকিল হতো। তবে কী জানিস, রেডিওটা টেলিভিশনের মতো অতো বড় না, আবার এ-যুগের স্মার্টফোনের মতো এত ছোটোও না। এখন যেমন হাতে হাতে মোবাইল ফোন, তখন কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতে রেডিওটাও ছিল না। বিবিসিভয়েস অফ আমেরিকার খবর শোনার জন্যে একটা রেডিও’র পাশে অনেক লোকের ভিড় লেগে যেত। অনেকেই চুরি করে খবর শুনত।

বিবিসিভয়েস অফ আমেরিকা… এসব কী?

তুমি কী বুঝবে? বিবিসি মানে হলো ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। ইংল্যান্ড নামে দূরের একটা দেশ আছে। ওই ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে এই রেডিও স্টেশন অবস্থিত। আর ভয়েস অফ আমেরিকা হলো আরও অনেক দূরের দেশ আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত রেডিও সেন্টার।

বলো কী, নানু? ইংল্যান্ড, আমেরিকার রেডিও থেকে বাংলাদেশের ভূতের খবর শোনা যেত! বিস্ময়ে হা-করে তাকায় রোকেয়া।

হ্যাঁ। তখন ভূতের অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ ভূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছে। সাধারণ মানুষ ভূতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, অনেকেই পালিয়ে পালিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।

দেশ ছেড়ে কোথায় যাচ্ছে, নানু? রোকেয়া জিজ্ঞাসা করে।

আমাদের পাশের দেশ ভারতে। ঘর-বাড়ি, জিনিস-পত্র সবকিছু ফেলে রেখে শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যে এক কোটির উপরে লোক ভারতে গিয়েছিল। শুধু জীবন বাঁচানোর জন্যে নয়, ভূতের বিরুদ্ধে লড়াই করার ট্রেনিং নিতেও অনেক মানুষ ভারতে গিয়েছিল। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং করে তারা দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে নেমে পড়ত তারা। আমার আব্বু, দিলিপের বাবা, ওরা সবাই ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে তারপর ভূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল।

আচ্ছা নানু, ভূতেরা কোন দেশ থেকে এসেছিল?

ভূতেরা এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

পাকিস্তান কি ভূতের দেশ? রোকেয়া জিজ্ঞাসা করে।

না, পাকিস্তান ভূতের দেশ নয়, পাকিস্তানেও ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের তখনকার রাজা ও তার সঙ্গে থাকা কিছু মানুষ তখন ভয়ঙ্কর ভূত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশকেও তারা ভূতের রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। তবে যিনি তখন বাংলাদেশের মানুষের রাজা ছিলেন, তিনি ছিলেন বিরাট দুঃসাহসী মানুষ। পাকিস্তানি ভূতদের তিনি একটুও ভয় পেতেন না। আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও বেশ কিছু সাহসী মানুষ। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। তাঁর জন্য জীবন দিতে পারত। তিনিও বাংলার মানুষের জন্যে সবকিছু পারতেন। তিনিই দেশের মানুষকে ভূতের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানান। এদেশের মানুষের কাছে তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু তিনি যখন বললেন— ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’, তখন সবাই লাফিয়ে পড়ল যুদ্ধে। ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, লেখক-শিল্পী-ডাক্তার, সাধারণ কৃষক-শ্রমিক এমনকি বয়স্ক মানুষও ঘরে বসে থাকল না। নারী ও তোমাদের মতো শিশুরাও ভূতের বিরদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ভূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শিশুরাও! কীভাবে? বিস্মিত হয় রোকেয়া।

শিশুরা সরাসরি পাকিস্তানি ভূতের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করেনি, কিন্তু যারা সরাসরি যুদ্ধ করছিল তাদেরকে সাহায্য করেছিল। শিশুদের তো ওরা বেশি সন্দেহ করত না, তাই শিশুরা রাস্তা-ঘাটে চলতে চলতেই অনেক গোপন খবর জেনে যেত। এবং সেই খবর আমাদের যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিত। এমনকি তারা লুকিয়ে লুকিয়ে গোলাবারুদও পৌঁছে দিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

মুক্তিযোদ্ধা কারা?

যারা অত্যাচারী ভূতদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। এই মুক্তিযোদ্ধারা বিরাট শক্তিশালী ভূতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শিশুদের নিকট থেকেও সাহায্য পেয়েছিল। ওই যে দিলিপের কথা বলেছি একটু আগে, সে-ও ছিল শিশু মুক্তিযোদ্ধা।

দিলিপ!

হ্যাঁ, দিলিপ। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল— কামাল, আজ রাতে হারুন রাজাকারকে খতম করা হবে। আমি বললাম— তুই কীভাবে জানলি? সে বলল— মিজান চাচা বলেছে। আমিই মিজান চাচাকে খবর দিয়েছিলাম যে, হারুন রাজাকার আর তার লোকেরা আমাদের পাড়ার নিত্যানন্দ দাদুকে ধরে নিয়ে গেছে আর তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

নানু, দাঁড়াও দাঁড়াও, রাজাকার কী? রাজাকার কারা? আর তারা কেন নিত্যানন্দ দাদুদের বাড়িতে আগুন লাগাতে গেল? রোকেয়া জিজ্ঞাসা করে।

রাজাকার মানে যারা মানুষের সেবা করে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজাকার মানে হয়ে গেছে— খারাপ লোক। ওইসময় পাকিস্তানি ভূতদের সাহায্য করত যে-সব বাংলাদেশি ভূত, তাদেরকে রাজাকার বলা হতো। পাকিস্তানি ভূতেরা গ্রামের রাস্তা-ঘাট চিনত না। কারা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদেরও চিনত না। রাজাকাররাই তাদেরকে এসব চিনিয়ে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে দিত। এমনকি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মা-বোনকেও ধরে নিয়ে পাকিস্তানি ভূতদের হাতে তুলে দিত। নিত্যানন্দ দাদু ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, গান গাইতেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন। আমিও তাঁর কণ্ঠে কয়েকটি গান শুনেছি। একদিন দিলিপ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। দাদু তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে গাইছিলেন— ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার…।’ এরপর আরও দু-তিনটি গান গাইলেন। শেষে সকলে দাঁড়িয়ে উঠে গাইলেন ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি…’।

‘আমার সোনার বাংলা’ তো আমরা স্কুলে গাই, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।’ নানুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রুকু বলে।

হ্যাঁ, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। ভূতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার পরই এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের মাঠেও আমাদের যোদ্ধারা এই গান এবং আরও অনেক দেশপ্রেমের গান গাইতেন। তো শোনো, এই নিত্যানন্দ দাদু কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। তিনি দেশের মানুষকে ভূতের বিরুদ্ধে এক হওয়ার কথা বলতেন। আর তাঁর এক ছেলে ভূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিল। তাঁকে এলাকার প্রায় সবাই খুব ভালোবাসত। তাই তাঁর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হারুন রাজাকারকেও মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

নানু, ভাষা আন্দোলন কী?

এই ঘটনার আগেও আমাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর আচরণ করেছিল পাকিস্তানি ভূতেরা। ওরা আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষাকে ওরা রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা হলো কোনো দেশের প্রধান ভাষা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজকর্মে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। বাঙালিরা উর্দু জানে না, তারা জানে বাংলা ভাষা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বাঙালিরা। পাকিস্তানি ভূতেরা সেই আন্দোলন থামাতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় এবং বেশ কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে। তবে শেষপর্যন্ত বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। এই আন্দোলনকে বলা হয় ভাষা আন্দোলন।

সেই ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা নিত্যানন্দ দাদুর হত্যার প্রতিশোধ কি নিতে পেরেছিল তোমার মিজান চাচারা? রুকুর কণ্ঠে যেন রাগের ছোঁয়া।

সেই রাতে দিলিপ তার প্যান্টের পকেটে দুটো ছোট্ট বোমা নিয়ে চুপি চুপি হারুন রাজাকারদের গোপন আস্তানায় যায়। রাজাকারেরা ছিল সংখ্যায় কম এবং ভীতু স্বভাবের। একটা বোমা ছুড়ে দিতেই তারা দৌড়ে এদিক-সেদিক পালাতে শুরু করে। এরইমধ্যে হারুন রাজাকারকে একলা পেয়ে গুলি চালিয়ে দেয় মিজান চাচা। পরের দিন ভোরে আমাদের ঘরের জানালায় এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দুর্দান্ত সেই কাহিনী বলে দিলিপ। তার চোখে-মুখে আনন্দের আলো খেলা করতে থাকে। ওর আনন্দ দেখে আমারও মনে খুব ইচ্ছে হয় কিছু একটা করতে। ওকে বলি— আমাকে নিবি তোর সঙ্গে?

দিলিপ হেসে ওঠে। —তোকে? তুই তো একটা ভীতুর রাজা, ভূতের নাম শুনলেই ভয়ে জড়োসড়ো। তুই আর কী করবি!

তুই যা বলবি, আমি তা-ই করব। আমি বলি।

নিজের মুখের কাছে হাত নিয়ে দিলিপ আস্তে আস্তে বলল, থাম থাম, কাকি শুনতে পেলে আমাকে আর আসতে দেবে না তোর কাছে। এখন থাক, বিকেলে খেলার মাঠে কথা হবে।

বিকেল বেলা খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য আমার আর তর সইছিল না। সেদিন সন্ধ্যায় মাঠে বসে ওদের কথা শুনলাম। ওরা মানে দিলিপ ছাড়াও আরও দুটো ছেলে ছিল, আর ছিল জব্বার চাচা। জব্বার চাচাকে সেদিনই প্রথম দেখি। ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো ভূতের বিরুদ্ধে নতুন একটি অপারেশনের জন্য রেডি হচ্ছে ওরা। আমার দিকে তাকিয়ে দিলিপ বলল— পারবি?

ভয়ের কথা মনে এলো না। বললাম— পারব, কী করতে হবে তাই বল।

আমাদের এবারের অভিযান তালতলা স্কুল। ওখানে পাকিস্তানি ভূতেরা ক্যাম্প বানিয়েছে। আগামীকাল তুই আর আমি যাব সেখানে।— দিলিপের কথা শুনে আমার কেমন যেন ভয় হলো। বললাম, তুই আর আমি! পাগল নাকি?

দিলিপ সাহস দিয়ে বলল, আরে আমরা তো যুদ্ধ করতে যাব না, দেখতে যাব। ওরা কতজন, কীরকম অস্ত্র-টস্ত্র আছে ওদের কাছে… এইসব দেখতে যাব।

ওরা যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে?— আমার কিন্তু তখনও ভয় কাটছে না।

ফেললে আর কী, ভূত তাড়াতে গিয়ে মরে যাব। কিন্তু আমরা তো ছোট্ট বাচ্চা, ওরা আমাদেরকে সন্দেহ করতে পারবে না। আমরা ওই তালতলায় গিয়ে মারবেল খেলব। মারবেল খেলতে খেলতে স্কুলের গেট, গেটে দাঁড়ানো ভূত, গেটের ভেতরে কারা ঢুকছে বের হচ্ছে, কয়টা গাড়ি-টাড়ি আছে এসব দেখে নেব। যদি খারাপ কিছু বুঝি, দ্রুত ফিরে আসব।— এক দমে বলে গেল সে।

পরের দিন সকালে পান্তা খেয়ে আমরা দুজন বের হয়ে পড়লাম। পথে জরিনা ফুপুর সঙ্গে দেখা হলো। জরিনা ফুপু বলল— দিলিপ, কামালকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? দিলিপ বলে— এই তো একটু মারবেল খেলতে। ফুপু বলে— দেখিস, ওকে আবার ওসবের মধ্যে নিস না কিন্তু। একটু পরে দিলিপের কাছ থেকে জানতে পারলাম— জরিনা ফুপুও অনেক কথা জানে। জরিনা ফুপুদের বাড়িতে মাঝে-মধ্যে মিজান চাচাদের মিটিং বসে। ফুপু দু-একবার রান্না করেও খেতে দিয়েছে ওদের। আমরা দুজন তালতলায় গিয়ে মারবেল খেলতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু মারবেল খেলা নামেই শুধু, আমাদের মন ছিল ভূতের দিকে, আর চোখ ছিল ওই ক্যাম্পের দিকে। দিলিপ অনেককিছুই পারত। খেলতে খেলতে একবার তালগাছে উঠল। সেখান থেকে ভালো করে দেখে নিলো ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থা। দিলিপ যখন গাছে, আমার তখন ভয়ে কাহিল অবস্থা। যদি কোনো ভূত এসে যায়! একটু পরেই সত্যি সত্যি একটা ভূত এসে দাঁড়াল। হাতে বন্দুক। আমার দিকেই তাক করা। দিলিপ তখন খুব দ্রুত, প্রায় লাফিয়ে গাছ থেমে নেমে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। দুই হাত উপরে তুলে বলল— স্যার, হামে মাফ কর দো।

দিলিপের দেখাদেখি আমিও হাত দুটো মাথার উপরে তুললাম।

ভূত এসে বলল— ওই বাচ্চে, ইঁহা কিয়া র্ক রাঁহিহে?

দিলিপ কীভাবে যে দু-একটা উর্দু শিখেছিল! সে বলল— মার্বেল খেল্ রাঁহাহে।

আমি তখন ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছি। মা’র কথা মনে পড়ছে খুব। দিলিপও খুব ভয় পেয়ে গেছে। কিন্তু ওই ভূতটা বোধহয় একটু দয়ালু ছিল। বলল— এ জাগা আচ্চে নেই হ্যাঁয়, তুম চোলি যাইয়ে।

আমরা দৌড় শুরু করলাম। দেখি, দিলিপ এঁকে-বেঁকে দৌড়াচ্ছে। সোজা রাস্তা দিয়ে না-গিয়ে গ্রামের বাগানের ভেতরে ঢুকে আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির কাছের চালতে তলায় এসে থামলাম। ওখানেই জরিনা ফুপুদের বাড়ি। আমাদেরকে হাঁপাতে দেখে ফুপু জিজ্ঞেস করল— কী রে, তোরা কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছিস কেন?

আমি বললাম— ফুপু, পানি খাব।

ফুপু পানি আনতে গেলে দিলিপ বলল, তোকে কিছু বলতে হবে না, আমি যা বলব, তাতে হ্যাঁ বলবি।

ফুপু এলে পানি খেতে খেতে দিলিপ বলল— তোমাদের ওই বড় বাগানের গাব গাছে উঠেছিলাম পাখির বাসা দেখতে। দেখি ইয়া বড় এক সাপ, লাফিয়ে পড়ে দৌড় দিছি।

দিলিপ তো খুব বুদ্ধিমান! —চোখ বড় বড় করে বলে রোকেয়া।

হ্যাঁ, বুদ্ধিমান তো বটেই। ফুপু কিন্তু বেশ বকল। ওই বাগানে আর কখনও না-যাওয়ার জন্য আমাদের বলল। ফুপুর কাছ থেকে মুড়ি আর গুড়ের পাটালি খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। এর দু-দিন পরের এক রাতে মিজান চাচারা বিরাট একটি দল নিয়ে ওই ক্যাম্প আক্রমণ করল। সেই যুদ্ধে বেশ কয়েকটি ভূতকে খতম করে দিল তারা। কিন্তু মিজান চাচাসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে ফেলল ওরা। পরের দিন দুপুরে সারা গ্রামে দলে দলে ঢুকে পড়ে ভূতেরা। অনেক সাধারণ মানুষকে তারা গুলি করে মেরে ফেলে। দিলিপদের বাড়িতেও যায়। কাকি আগেই বুঝতে পেরেছিল। দিলিপ আর দিলিপের বোনকে নিয়ে বাগানের মধ্যে পালিয়ে থাকে। কিন্তু দিলিপের দাদুকে ওরা মেরে ফেলে যায়। রাজাকাররা আগুন জ্বালিয়ে দেয় ওদের বাড়িতে। কাকি অনেক কষ্টে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে চলে যায়।

কোথায়?

ইন্ডিয়ায়। আরও অনেক লোক তখন ইন্ডিয়ায় যায়। যাওয়ার সময় দিলিপ কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলে— কামাল, যুদ্ধের পর বাবা ফিরে এলে বলিস, আমরা ইন্ডিয়ায় গেছি। বাবা গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবে। আবার আমাদের দেখা হবে। সাবধানে থাকিস, বন্ধু।

দিলিপ দাদুর সাথে আবার দেখা হয়েছিল তোমার?

নানু ডানে-বাঁয়ে মাথা ঘোরায়। —যুদ্ধশেষে আব্বু এবং আরও কয়েকজন ফিরে এল। আব্বুর নিকট থেকে জানলাম, দীনেশ কাকা শহিদ হয়েছেন। দিলিপেরাও আর ফেরেনি এদেশে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে নানু চোখ মুছলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন— ৯ মাস ধরে চলা সেই যুদ্ধে শুধু দীনেশ কাকা নয়, মারা গেল ৩০ লক্ষ মানুষ। আহত হলো অগণিত। কয়েক লক্ষ মা ও বোনকে লাঞ্ছিত করলো ওরা। তারপর একদিন পরাজয় স্বীকার করে নিল। মাথা নিচু করে চলে গেল আমাদের দেশ থেকে। বাংলাদেশ হলো— ভূতমুক্ত স্বাধীন দেশ।

নানু, এটা কিন্তু সত্যিকার ভূতেরই গল্প হলো। আমার শোনা সেরা গল্প।

হ্যাঁ, রুকু। এরকম ভয়ঙ্কর ভূত আমিও আর কখনও দেখিনি। মানুষের রূপে হিংস্র জানোয়ার। এবার একটা গান শুনবি? আমার খুব গাইতে ইচ্ছে করছে।

গান! তুমি শোনাবে! তাহলে তো খুব ভালো হবে, নানু। —রোকেয়ার চোখে-মুখে আনন্দের আলো ফুটে ওঠে।

উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে অধ্যাপক আনোয়ার কামাল শুরু করেন—

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না

আমরা তোমাদের ভুলব না।

দুঃসহ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে

শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না

আমরা তোমাদের ভুলব না…

রোকেয়াও নানুর সাথে কণ্ঠ মেলানোর চেষ্টা করে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন : ৭ম সংখ্যা (মার্চ-২০২৫ : বিশেষ ঈদ সংখ্যা)

Read Next

রোকে ডালটন-এর দুটি কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *