অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৪, ২০২৫
২১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ৪, ২০২৫
২১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আবদুল মান্নান সরকার -
সং-এর বাড়ি

কারবারি তোমাকে একজন শিকারির বাড়িতে নিয়ে যায়। শিকারি লোকটি তার বাড়ির সামনের গাছতলায় বসে বাঁশ দিয়ে একটি তীর তৈরি করছিল। ঘষে ঘষে তীরের ফলাটা আরও ধারালো, আরও তীক্ষ্ন করে তুলছিল। কারবারি তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেয়। শিকারি লোকটি মধ্য বয়সী, নাম সং। সং তার কাজ রেখে তোমাদের ঘরে নিয়ে যায়। সং বিয়ে করেনি, তাই ঘরে তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই। সে বসার জন্য মেঝেতে একটি মাদুর বিছিয়ে দেয়। এরপর সে চা তৈরি করতে বসে। তুমি তার ঘরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখ। সং-এর ঘরটি যেন ছোট-খাট একটি সংগ্রহশালা। শিকারের নানা সরঞ্জাম দেখতে পাও তুমি, এ সব সরঞ্জাম পাহাড়িরা শিকার করতে ব্যবহার করে। তীর, ধনুক বর্শা, দা এছাড়াও নানা রকমের ফাঁদ আছে তার। ঘরের বাঁশের বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে তার নিজের শিকার করা নানা রকমের জীব-জন্তুর মাথার খুলি। একটি চওড়া খুলি দেখে তুমি জানতে চাও— এটা কীসের।

সং বলে, এটি পাহাড়ি গয়ালের। সে একাই শিকারটি করেছিল। পাহাড়ে এক সময় এ জাতের গরু ছিল। এখন আর অবশ্য এ জাতের গরু তুমি দেখতে পাবে না। তবে ভারতের পাহাড়গুলোতে এখনও কিছু কিছু টিকে আছে। মেছো বাঘ, হরিণ, বন্য শূকর, ছাগল আর খরগোসের খুলি আছে বেশ কয়েকটি। একটি ছাগলের খুলি হাতে তুলে নেয় সং। বলে, ছাগলটি সে কয়েক বছর আগে শিকার করেছিল। ছাগলটি ছিল বেশ বড় তা বোঝা যায় খুলির শিং দুটো দেখে। লম্বা শিং দুটো বাঁকা আর খাঁজকাটা। এমন পাহাড়ি ছাগল সব সময় দেখা যায় না বলে জানায় সং। এই খুলিটি তার বেশ প্রিয়। প্রতিদিন শিং দুটোতে তেল মাখায় বলে জানায় সং। এই বিশেষ জাতের ছাগল ভাগ্য বদলে দিতে পারে এমন বিশ্বাস সে করে। যদিও তার ভাগ্যের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। শিকারের সরঞ্জাম, জীব-জন্তুর মাথার খুলি একজন শিকারির বাড়িতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সং যে সৌখিন প্রকৃতির একজন মানুষ তা বোঝা যায় তার অন্যান্য সংগ্রহ দেখে। তার সংগ্রহে রয়েছে অনেকগুলো নাচের মুখোশ। উপজাতির সব সম্প্রদায়ের মানুষ মুখোশ পরে নাচে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মুখোশের ভিন্নতাও আছে। মানুষের মুখোশগুলো বেশ বড় বড় আর চোখ-মুখ যেন দৈত্যের মতো। নানা জীব-জন্তুর মুখোশও আছে, শেয়াল, গরু, বাঘ আর ধনেশ পাখির মুখোশ। এছাড়াও আছে দৈত্য আর ড্রাগনের মুখোশ। একটি মুখোশ দেখিয়ে তুমি জানতে চাও— এটা কীসের মুখোশ। মানুষ আর দৈত্যের মুখের একটি সমন্বিত রূপ, মুখোশটি বিশাল এবং ভারি। এটি পরে নাচতে পারবে খুব কম মানুষ।

সং জানায়, এটি দৈত্যের মুখোশ আর এই মুখোশটি পরে নাচা হয় কোনো মহামারি থেকে রক্ষা পেতে। সে একটি বাঁশি দেখিয়ে বলে, এই বাঁশির নাম প্লুং। এই বাঁশিটি ম্রোরা সাধারণত উৎসবের সময় বাজায়। এমনিতেও বাজায়। এই বাঁশি তৈরির কারণ বলে সে। অনেক আগে ম্রো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি রোগ মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আর প্রতিদিন মানুষ মারা যেতে থাকে। চেনাজানা সব রকমের চিকিৎসা করেও এই রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছিল না ম্রোরা। এক রাতে এক বৃদ্ধ স্বপ্ন দেখে দেবতা তাকে বাঁশি বাজাতে বলছে আর এই বাঁশির সুরেই রোগ মহামারি থেকে মুক্তি মিলবে। দেবতা তাকে বাঁশি তৈরির কৌশলও শিখিয়ে দেয়। লাউয়ের খোল আর বাঁশ দিয়ে এই প্লুং বাঁশি তৈরি করতে হবে। দেবতার কথা বৃদ্ধ তার সমাজের লোকদের জানালে প্রথমে কেউ তা বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু মহামারি যখন আরও কঠিন রূপ নেয় তখন লোকজন বৃদ্ধের কথা মেনে নেয় আর দেবতার শেখানো বাঁশিটিও তৈরি করে। এই প্লুং বাঁশির সুরেই ম্রোরা মহামারি থেকে রক্ষা পেয়েছিল বলেই তাদের বিশ্বাস। আর এ জন্যই ম্রোরা তাদের সকল উৎসবে সবাই মিলে এই বাঁশি বাজায়।

তুমি বিয়ে করোনি কেন? সংকে বলো। সং জানায় এক সময় সে ওঝা হতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে ওঝা হওয়ার সুযোগ ছিল না তার। আর এ জন্যই সে ভারতের অরুণাচলে গিয়েছিল। সেখানে একজন তান্ত্রিকের কাছে গুপ্তবিদ্যা শিখেছিল কিছুদিন। তান্ত্রিক তাকে প্রথমে দীক্ষা দিতে চায়নি পরে বিদেশি ভেবে দীক্ষা দিতে রাজি হয়েছিল। সং জানায় সেই তান্ত্রিক ছিল একজন সিদ্ধ পুরুষ। আর সে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিল একটি খুন করে। একজন মানুষকে খুন করে সে শব সাধনা করেছিল। মৃতের মাথার খুলিতে সে পানীয় পান করত বিশেষ করে মদ। তবে সাধু সিদ্ধি লাভ করলেও জীবন তার অনেকটাই ছিল অভিশপ্ত। আর সে বিশ্বাস করত খুলিটিই তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। সে মনে করত আসলে খুলিটিই অভিশপ্ত। সং সাধুকে বলেছিল, তুমি যদি মনে করো এই খুলি অভিশপ্ত তবে তা না রাখলেই তো পারো। ওটা আমাকেই দিয়ে দাও। সাধু প্রথমে খুলিটি দিতে চায়নি। পরে অবশ্য রাজি হয় আর বলে এই খুলি যার ঘরে থাকবে তার জীবনে কোনো শান্তি থাকবে না। তুমি এটা জেনেও যদি নিতে চাও তবে নিতে পারো। সং বলে, খুলিটি তার হাতে আসার পর থেকে তার জীবন থেকে শান্তি হারিয়ে গেছে। কিন্তু খুলিটি সে ত্যাগ করতেও পারে না। কী এক যাদু তাকে বেঁধে রেখেছে। আর এ জন্যই সে বিয়ে করে সংসারী হতে পারেনি। সং আর সব জুম চাষির মতো জুম চাষ করে না। শিকারই তার একমাত্র নেশা ও পেশা। সং বলে, আগের মতো আর শিকার পাওয়া যায় না আবার প্রতিদিন শিকার মেলেও না। এখন সাপ, গো-সাপ, খরগোস এ সবই পাওয়া যায়। বন্য শূকর, শেয়াল এ সবও আছে তবে এগুলো এখন খুব বেশি দেখা যায় না। ছোট কিছু শিকার করে আনন্দ নেই। সং অনেকটাই ছন্নছাড়া প্রকৃতির মানুষ। সংসারে থেকেও যেন নেই। তবে সমাজের সব রকমের কর্মকাণ্ডে সে অংশ নিয়ে থাকে। তোমার আয়-রোজগার কেমন সং-এর কাছে জানতে চাও তুমি। সং হেসে বলে, সপ্তাহে এক দুটো শিকার মেলে আর তাতেই তার চলে যায়। সং বলে, তার এর বেশি দরকারও নাই। একা মানুষ নিজে রেঁধে খায়। শিকারের মাংস সে বিক্রি করে আর তা দিয়েই চলে যায় তার।

শিকার ছাড়া আর যে নেশাটি তার আছে তা হলো বাঁশি। সং-এর ঘরে ম্রোদের সব রকমের বাদ্যযন্ত্রই আছে। ঢোল, প্লুং বাঁশি আর বাঁশের ফ্রেমে তৈরি সেতারের মতো একটি বাদ্যযন্ত্র দেখায় সে। যন্ত্রটি বাজিয়েও দেখায়। বেশ মিঠে সুর। সং জানায় কখনো মন খারাপ হলে গভীর রাতে সে এই যন্ত্র বাজায় আর এর সুর তার মনকেও ভালো করে দেয়। সং-এর পাহাড়ি লতাপাতা দিয়ে তৈরি চা খেতে ভালোই লাগে। সং চা খেতে খেতে অনেক কথাই বলে। সে বলে যে, পাহাড় তাদের মা আর পাহাড়ের আত্মা পাহাড়ি সব কিছুর মাঝেই আছে। আর পাহাড়ের অনেক গোপন বিষয় সে জেনেছে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে। সং বলে, তুমি যদি পাহাড়ের গোপন বিষয় জানতে চাও তবে তোমাকেও হতে হবে পাহাড়ের মতোই। রাতের অন্ধকারে তুমি দেখতে পাবে পাহাড়ের সেই রূপ। অফুরন্ত ঝিঁ ঝিঁর ডাক আর অন্ধকারে তোমাকে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে হবে। কেবল তখনই তোমার চোখজুড়ে লক্ষ ঝিঁ ঝিঁর ডাক আলো হয়ে নাচবে। এরপর তুমি দেখবে তোমার সামনে কেবল অন্ধকার আর আলোর খেলা আর কোনো কিছুই নেই। তুমি এক অনন্ত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে তখন আর কোনো শব্দ নেই। সে বলে যে, এক রাতে সে একটি গাছকে হেঁটে যেতে দেখেছিল, আর এভাবেই এক রাতে সে একটি গাছকে পাখি হয়ে উড়ে যেতে দেখেছিল। প্রথমে সে বিশ্বাস করতে পারেনি মনে হয়েছিল সে ভুল দেখছে। কিন্তু না তার চি তাকে তখন বলেছিল, চি কখনো বদলায় না আর সে নানা রূপ ধরতে পারে।

সং আরও বলে, তুমি যদি শিকারি হও তবে তোমার শিকারও একদিন তোমাকে শিকার করবে। আর এটাই হলো থুরাইয়ের নিয়ম। থুরাই পাহাড়িদের সৃষ্টি করেছে তারা শিকার করে খাবে। একজনকে বাঁচতে হলে আর একজনকে খেতেই হয়। থুরাই চায় না শুধু তুমিই একজনকে মেরে খাবে। তুমি যাকে খাও একদিন সেও তোমাকে খাবে। আর এভাবেই চি এক থেকে আর এক রূপে বদলে যায়। সং তার একদিনের শিকারের গল্প বলে, অনেক দূরের পাহাড়ে সে শিকার করতে গিয়েছিল। মেঘের আড়ালে একটি সাদা গয়ালকে সে দেখতে পায়। তার চোখ দুটো লাল আর তার দুটো শিং চকচক করছিল। নাক-মুখ দিয়ে নির্গত হচ্ছিল কুণ্ডুলি পাকানো ধুঁয়ো। জন্তুটি এতটাই শব্দ করছিল যে সে ভয় পেয়ে যায়। সে যখন জন্তুটির দিকে বিষ মাখানো তীর ছুড়তে যাবে তখন সে দেখতে পায় তার চি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সে ভয়ে কেঁপে ওঠে আর তার হাত থেকে তীর ধনুক খসে পড়ে। সং তোমাকে বলে, হ্যাঁ, চি আমাদের আত্মা এভাবেই খেলা করে। তবে তুমি এ খেলার উত্তর খুঁজে পাবে না কখনো। সং বলে, পাহাড়ি শেয়ালেরা হয় খুব ভয়ঙ্কর। সে তার ঘরের বেড়া থেকে একটি শেয়ালের খুলি নামিয়ে আনে। অনেক সময় নিয়ে খুলিটি সে চোখের সামনে নাড়াচাড়া করে। পাহাড়ি শেয়াল মারা খুব দুঃসাহসের কাজ। সং বলে, শূকরের চেয়েও হিংস্র এই শেয়াল। তাকে ফাঁদ পেতে ধরাও কঠিন। শেয়ালেরা দল বেঁধে থাকে আর এ জন্যই এদের শিকার করতে গেলে অনেক সময় বিপদ হয়। সে একটি ঘটনা বলে শেয়ালদের মানুষ চিনে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ। সাপও মানুষ চিনে রাখে। তুমি যদি কোনো সাপকে অকারণে আঘাত করো তবে সে তা মনে রাখবে আর ঠিকই সে একদিন তোমাকে খুঁজে বের করবে। একটি ঘটনা শোন, ঐ সামনের পাহাড়ের কয়েকটি পরিবার বাস করে। শেয়ালেরা নিয়মিত তাদের হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে যেত আর এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে দুজন মানুষ শেয়ালের গর্ত থেকে তাদের ছানাগুলোকে বের করে আনে আর মেরে ফেলে। দূরে থেকে শেয়াল দুটো এই দৃশ্য দেখেছিল। ছানা হারানোর শোকে শেয়াল দুটোকে প্রতি রাতেই কাঁদতে দেখা যেত। একদিন শেয়াল দুটো তাদের ছানা হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। লোক দুটোর একটি সন্তান হত্যা করে।

সং কাহিনী শেষ করে বলে, আসলে চি এসব তোমাকে দিয়ে করিয়ে বেড়ায়। তবে তুমি যদি তা না বুঝতে পারো তাহলে পাহাড়ের কোনো কিছুই তুমি বুঝতে পারবে না।

কয়দিন ধরেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কোথাও বের হওয়া যায় না। ম্রোরা কাজে বের হতে না পেরে ঘরে বসে আড্ডা জমায়। তারা লবণাক্ত পাহাড়ি মিষ্টি আলু খেতে খেতে গল্প করে আর তাদের বাঁশের তৈরি হুঁকোয় ধূমপান করে। নারী-পুরুষ সবাই এক সাথে বসে ধূমপান করে। সামনের বৃষ্টিস্নাত পাহাড়গুলো আরও সতেজ দেখায়। সারাদিন মেঘের আনাগোনা পাহাড়কে যেন আনন্দে মাতিয়ে রাখে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই নামে পাহাড়ি ঢল।

সং-এর গল্প শুনতে তার বাড়িতে যাও তুমি সে তোমাকে দেখে খুশি হয়। সং বলে পাহাড়িদের বলতে গেলে মেঘ বৃষ্টির সাথেই বসবাস করতে হয়। সে তোমাকে একদিন পাহাড়ে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলে কথা দেয়। সে বলে, পাহাড়ে প্রচুর পাখি আছে। ছোট-বড় নানা জাতের পাখি দেখতে পাবে তুমি। কিছু বিরল প্রজাতির পাখিও দেখতে পাবে। ভাগ্য ভালো হলে ধনেশ পাখিও দেখতে পারো। ধনেশ পাখিকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয় আর উপজাতির লোকেরা এই পাখিকে অতি পবিত্র বলেও মনে করে। পাহাড়িরা ধনেশ পাখিকে তাই মারে না। তবে কিছু অসাধু শিকারি পাখিটিকে শিকার করে ধনেশ পাখির ঠোঁটের কারণে। ধনেশ পাখির ঠোঁটের বাজার মূল্য অনেক। আর এর চাহিদাও আছে যথেষ্ট। ধনেশ পাখির বাঁকানো লম্বাটে ভারি এই ঠোঁট অনেকেই সংগ্রহ করে সৌখিনতার কারণে। আবার এর ওষুধি গুণও আছে বলে মনে করে অনেকে। ওঝারা এর সাহায্যে ঝাড়-ফুঁক করে থাকে আর কবিরাজেরা ওষুধ তৈরির কাজে লাগায়। ধনেশ পাখি এখন খুব বেশি দেখা যায় না। ভারতের পাহাড় থেকে এই পাখিগুলো আসে। এদিকে ঘুঘু আর ডাহুক পাওয়া যায় প্রচুর। সারাদিন ঘুঘুরা মাতিয়ে রাখে ম্রো-পাড়াকে। রাতভর শোনা যায় ডাহুকের ডাক।

সং পাখি শিকার করা পছন্দ করে না। সে বলে, দেখ না পাখি কত সুন্দর। কত রঙের ফুল পাখি দিয়ে থুরাই পাহাড়কে সাজিয়েছে। পাখি নাচে গান গায় দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। থুরাইকে তোমরা খুব ভালোবাসো সংকে কথাটা বললে সং উত্তর দেয় থুরাই আমাদের জীবন দিয়েছে, পাহাড় দিয়েছে আরও কতকিছু দিয়েছে তাকে তো ভালোবাসতেই হবে। তুমি সংকে চি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো। তুমি তোমার চিকে দেখেছিলে তাই তো! সং মাথা নেড়ে স্বীকার করে কথাটা। হ্যাঁ, তার চিকে সে এক রাতে দেখেছিল। আর চিকে দেখে ফেলা অসম্ভবও কিছু নয়। সং বলে, তুমি ইচ্ছে করলে তোমার চিকেও দেখতে পারবে। আর শুধু তোমার চি আমার চিকেই নয় সব কিছুর চি দেখা যায় কারণ থুরাই চায় তোমরা যেন তোমাদের চিকে চিনতে পারো। তুমি সংকে জিজ্ঞেস করো তান্ত্রিকের নিকট থেকে তুমি কী দীক্ষা নিয়েছিলে। সং জানায় দীক্ষার বিষয়ে সে তোমাকে কিছু বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, তান্ত্রিক তার চোখ খুলে দিয়েছিল। এই যে থুরাই সব কিছুকে আলাদা আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছে কারণ থুরাই চায় না সব কিছু এক রকমের হোক। তান্ত্রিক তাকে যে কথাটা বলেছিল, ব্যাটা, মেলা দেখেছিস তো, এই জগতও হলো ঈশ্বরের মেলা। মেলায় কত মানুষের সমাগম হয়, কত কিছুর সমাবেশ হয়, অনেক হৈ-চৈ, অনেক সুর, অনেক হাসি-কান্না, অনেক আনন্দ; হ্যাঁ, ঈশ্বর এভাবেই তার এই জগতের আনন্দ মেলা নিয়ে মেতে আছে। ঈশ্বর সব কিছুকে এক রকম করে, এক আদলে সৃষ্টি করলে কী হতো! ঈশ্বর নিজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত, ছোট হয়ে যেত, তার বৃহত্ত্ব থাকত না। সং তার সেতারের মতো বাদ্যযন্ত্রটা হাতে তুলে নেয় আর অনেক সময় নিয়ে তা বাজায়। বাইরের বৃষ্টির সাথে সে সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পাহাড়জুড়ে সুর আর রঙের মেলা এখন কে বলবে না জগতের এই মেলা তো আনন্দের কারণেই।

সং তার হাতের যন্ত্রটি রেখে দিয়ে বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকে। কিছু হয়তো ভাবে পরে খুব ধীর কণ্ঠে বলে, তান্ত্রিকের নিকট থেকে চলে আসার সময় তান্ত্রিক তাকে বলেছিল, ব্যাটা, কেউ অমর নয়, কোনো কিছুই অমর নয়। আর আত্মার অমরতা তাও আমাদের ধারণার বাইরে। বলতে পারিস তাহলে এত কষ্ট কেন, এত সাধনাই বা কেন। হ্যাঁ, এরও সুখ আছে। নিজেকে আমি কতটা চিনতে পেরেছি তা কি আর কারও কাছে বলা যায় রে! কিন্তু চিনবার চেষ্টা করেছি সেই তো অনেক পাওয়া। সং কথা শেষ করে বাইরে তাকায় তখন মেঘ ও বৃষ্টি ঢেকে ফেলেছে গোটা পাহাড়কে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন : ৭ম সংখ্যা (মার্চ-২০২৫ : বিশেষ ঈদ সংখ্যা)

Read Next

রোকে ডালটন-এর দুটি কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *