অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুন ২৮, ২০২৫
১৪ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুন ২৮, ২০২৫
১৪ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রণিত ভৌমিক -
সমুদা সিরিজের কাহিনী – ড. ওয়াটসনের ঘড়ি

পুরী থেকে ফেরার পর, বাবার জরুরি তলবে সমুদাকে আসানসোলে ছুটতে হলো। তবে, এখানে বনবিহারীবাবুর বিষয় বলে রাখা ভালো, ওনার সময়টা এখন বেশ খারাপ যাচ্ছে। সেবার ফেরার পথে, চলন্ত ট্রেন থেকে বনবিহারীবাবুর বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দি করার পরিকল্পনাটাই ওনাকে পুরোপুরি ডুবিয়েছিল। সমুদার হাজার বারণ করা সত্ত্বেও, উনি সেই দুঃসাহসটি দেখালেন এবং ফলে যা হওয়ার তাই হলো।

বনবিহারীবাবুর ওই প্রিয় ক্যামেরা গেল ট্রেন থেকে পরে এবং সেই শোক উনি কাটিয়ে ওঠার আগেই ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। ওনার বাড়ির পোষা বিড়ালটা হঠাৎ গেল মরে সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে বনবিহারীবাবুর শোক এখন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা আজও উনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর এর ফলে ওনার সঙ্গে আমাদের বেশ কিছুদিন হলো কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ওনার সঙ্গে আমাদের এই দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ার কারণে, জীবনের রঙিন ক্যানভাসটা কিছুটা হলেও যেন এখন ফিকে হয়ে গেছে। আসলে বনবিহারীবাবু শুধু একজন বিখ্যাত আলোকচিত্রকরই নন, উনি হলেন সেই মানুষ যার উপস্থিতি বা স্পর্শ মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রাণবন্ত করে তোলে।

প্রায় দু-সপ্তাহ আসানসোলে কাটিয়ে সমুদা বাড়ি ফিরল। আর তার ফেরার কিছুদিনের মধ্যে বনবিহারীবাবুও আমাদের বাড়ি এসে হাজির হলেন এবং বসবার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আমাদের উদ্দেশ্যে ওনার উক্তি, ‘Today আপনাদের একটা surprise visit দিতে চলে এলাম। তা কেমন আছেন আপনরা?’

বনবিহারীবাবুর কথার উত্তরে সমুদাকে বলতে শুনলাম, ‘আমাদের ওই চলে যাচ্ছে। তবে, আপনি ভালোই করেছেন আজ এসে। অনেকদিন আপনার এই আধা বাংলা আর আধা ইংরাজি শোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছি। তারপর, আপনি নতুন কী ক্যামেরা কিনলেন?’

‘আরে মশাই! আপনি কি এই কদিনে astrology-টাও রপ্ত করে ফেলেছেন? ব্যাপারটা know করলেন কীভাবে?’ বেশ উত্তেজিত হয়ে বনবিহারীবাবু বললেন এবং কথাটা শেষ করেই বনবিহারীবাবু ওনার ব্যাগ থেকে সেই নতুন ক্যামেরাটা বের করে টেবিলের উপর রেখে সমুদার উদ্দেশ্যে ফের বললেন, ‘এবার আপনি একটু ভালোভাবে see করে say করুন তো, এটার সঙ্গে previous ক্যামেরার difference কোথায়?’

সমুদা ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর বলল, ‘আপনার এই ক্যামেরাটা digital single lens reflex, অর্থাৎ DSLR তো?’

বনবিহারীবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘একদম right! কিন্তু সমুবাবু, আপনি নিশ্চয়ই think করছেন এই দামি ক্যামেরা আমি buy করলাম কীভাবে?’

সমুদা ক্যামেরাটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘এই মন্দার বাজারে আপনি যে Canon EOS 80D কিনে আরেকটা দুঃসাহসী কাজ করবেন না, তা আমি ভালো করেই জানি। তা এই দামি ক্যামেরা আপনি পেলেন কোথায়?’

উত্তর দেওয়ার আগেই বনবিহারীবাবু হেসে উঠলেন এবং তারপর বললেন, ‘আপনার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সত্যিই খুব tough। ওই যে বিলেতে সেবার go করেছিলাম, সেখানকার organiser-রাই আমার work-এ satisfy হয়ে আমাকে সম্মান জানাতেই এই ক্যামেরা এত days পর আমায় gift করেছেন। ওনারা আবার এটাও tell করেছেন, যাতে আমি আবারও বিলেতে গিয়ে ওনাদের সংস্থার জন্য আরেকটা exhibition করি।’

সমুদা মৃদু হাসির সঙ্গে বলল, ‘তাহলে, আপনার পরবর্তী প্রদর্শনীটা কী বিলেতে হতে চলেছে?’

কথাটা শুনেই বনবিহারীবাবু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আরে, না না মশাই! এখন আমি বিলেতে not going…। এবার আমার চারধাম নিয়ে একটা exhibition করার ইচ্ছা রয়েছে। তাই think করছি, আপনারা agree থাকলে আবার altogether বেরিয়ে পড়া যাবে।’

ওনার কথা শেষ হতে না হতেই কলিং বেলটা বেজে উঠল আর আমি গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি এক ভদ্রলোক সদর দরজা পেরিয়ে খানিকটা ভেতরে ধুকে এসে নিজের নামসহ বললেন, ‘নমস্কার! আমি সঞ্জীব সরকার। সমরেশ দত্তর সঙ্গে কী একটু দেখা করা যাবে?’

আমি তাকে বসবার ঘরে নিয়ে এলাম এবং সমুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘সমরেশবাবু, আজ আমি আমার বাবার একটা বিষয় নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’

সমুদাকে লক্ষ করলাম, কথাটা শোনা মাত্রই সে তাকে প্রশ্ন করল, ‘বিষয় বলতে, কী ধরনের বিষয়?’

সঞ্জীববাবু তারপর খুলে বললেন, ‘আমার বাবা অর্থাৎ বিশ্বনাথ সরকার আগে কলকাতাতেই থাকতেন, ওনার তখন বড়বাজার চত্বরে ঘড়ির দোকান ছিল এবং সেখানে নানান বিদেশি কোম্পানির ঘড়ির বেচা-কেনা হতো। সেইসঙ্গে অনেক পুরোনো ঐতিহাসিক ঘড়ির কালেকশনও রাখা থাকত দোকানে। বারো বছর আগে দোকানে আগুন লাগায়, সব জিনিস পুরে ছাই হয়ে যায় এবং ব্যবসাটাও ওই ঘটনার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে, ওর মধ্যেও বেশ অনেকগুলো ঘড়ি বাবা বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। খবরটা সেই সময় নানান কাগজেও বেরিয়েছিল। ওই দুর্ঘটনার কারণে বাবার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়।’

সঞ্জীববাবুর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, তবে আমি চুপ করেই ছিলাম এবং তার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম।

সঞ্জীববাবু কিছুটা থেমে ফের বললেন, ‘সেই দুর্ঘটনার পর আমরা দেবীপুরে, ঠাকুরদার ভিটেতে ফিরে যাই এবং তারপর আমাকে খুব অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়তে হলো। আমি হোমিওপ্যাথি ওষুধদের ব্যবসা শুরু করি এবং সেই ব্যবসার জন্য আমাদের পরিবারটা সেবারের মতো টিকে গিয়েছিল। কিছু বছরের মধ্যে অবশ্য ব্যবসাটা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে এখন কলকাতার অনেক নামী দোকানেই আমাদের তৈরি করা ওষুধ পাওয়া যায়। তবে, এই এক বছর যাবত কলকাতার ‘সুপ্রভাত’ নামক পত্রিকায় বাবার সংগ্রহ করে রাখা, ওই বহুমূল্য ঘড়িগুলোর আর্টিকেল প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। আর সমস্যাটা তৈরি হয়েছে ঠিক এটাকে কেন্দ্র করে।’

বনবিহারীবাবু তাকে থামিয়ে বলে উঠলেন, ‘আর্টিকেলের সঙ্গে problem-টা ঠিক কী মশাই?’

জবাবে সঞ্জীববাবু বললেন, ‘একটি নির্দিষ্ট আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই, প্রত্যেক মাসের শেষ দিকে একটি করে চিঠি বাবার নামে আসছে আর সব চিঠিতেই বরাবর একই কথা লেখা থাকে।’

‘কী লেখা থাকে?’ সমুদা তাকে প্রশ্ন করল।

সঞ্জীববাবুর জবাব, ‘লেখা থাকে যে যদি সেই ঘড়ি বাবা তাকে ফেরত না দেয়, তাহলে বাবার মৃত্যু অনিবার্য।’

আমি মৃত্যুর কথাটা শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, ‘এ তো খুনের হুমকি দিচ্ছে!’

সমুদা আমার দিকে একবার তাকিয়ে পরের মুহূর্তেই সঞ্জীববাবুর দিকে চেয়ে তাকে বলল, ‘সেই নির্দিষ্ট আর্টিকেল বা ওই ঘড়ির বিষয় আপনি কিছু জানেন?’

সঞ্জীববাবু একটু গলা ঝেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ! জানি আমি। সেই আর্টিকেল ছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়কার Waltham কোম্পানির একটি পকেট ঘড়ির বিষয়।’

সমুদাকে সঞ্জীববাবুর কথা শুনে তাকে তখনকার মতো আর কিছু জিজ্ঞেস করে বিব্রত করল না। বরং তার উদ্দেশ্যে সমুদাকে শুধু বলতে শুনলাম, ‘আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। ফিরে গিয়ে আপনার বাবাকে বলবেন বিষয়টা আমি দেখছি।’

সমুদার কথা শেষ হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে সঞ্জীববাবু বললেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সমরেশবাবু। বুঝতেই পারছেন অন্ধ বাবাকে নিয়ে থাকি, তাই দুশ্চিন্তা একটা থেকেই যায়।’

সমুদা তাকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করল এবং এটাও জানিয়ে দিল যে সে দু-তিন দিনের মধ্যে দেবীপুরে গিয়ে, তার বাবার সঙ্গে দেখা করে বাকি কথা বলবে। সেই আশ্বাস নিয়ে সঞ্জীববাবু ফিরে গেলেন দেবীপুরে।

তার প্রস্থানের পর আমি সমুদাকে বললাম, ‘তুমি কেসটা ঠিক বুঝলে?’

উত্তরে সমুদা বলল, ‘সবকিছু কি একবারে বোঝা সম্ভব, বঙ্কু? তবে, পুরোটা না বুঝলেও কিছুটা তো বুঝেছি।’

এর মাঝেই বনবিহারীবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আমিও little little বুঝতে পেরেছি, সমুবাবু। এই কেসটা কিন্তু ওই letter আর Waltham watch নিয়েই।’

ওনার কথার সঙ্গে সমুদাকে একমত হতে দেখলাম, সেইসঙ্গে বনবিহারীবাবুর উদ্দেশ্যে তাকে বলতে শুনলাম, ‘Letter’-ই হক বা ‘Waltham’ ঘড়ি, আপনার চারধাম ঘোরা কিন্তু এখন বেশ কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে গেল।’

বনবিহারীবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, ‘আরে মশাই! কী যে আপনি মাঝে-মধ্যে say করেন। চারধাম নয় কেস complete করেই go করা যাবে। কিন্তু আমি think করছি অন্য বিষয়।’

‘কী বিষয় চিন্তা করছেন?’ ওনাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

উনি তখন ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘বঙ্কু, আমার যত tension সব ওই আমার face নিয়েই। আমি ভীষণ confuse হয়ে আছি, কিছুতেই understand করতে পারছি না যে আমি দেবীপুরে গোঁফ লাগিয়ে go করব নাকি গোঁফ ছাড়া?’

আমি আর সমুদা ওনার কথা শুনে হেসে ফেললাম। সেদিন বনবিহারীবাবু আমাদের বাড়িতেই দুপুরের খাওয়া সেরে সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে গেলেন নিজের বাড়ি গড়িয়ায়।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি লক্ষ করলাম, সমুদা অনেকক্ষণ ধরে পড়ার টেবিলের নিচে রাখা জমানো কাগজগুলোকে এলোমেলো করে কী যেন খুঁজে চলেছে।

তাকে সেই বিষয় জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘অনেক খুঁজলাম রে, কিন্তু সেই আর্টিকেলগুলোর মধ্যে একটাও খুঁজে পেলাম না।’

আমি বললাম, ‘তাহলে এবার কী করবে?’

সমুদা একটু হেসে বলল, ‘সমস্যায় পড়লে যার কাছে বরাবর ছুটে যাই, তার কাছেই আবার যেতে হবে।’

আমি বুঝলাম সমুদা এখানে শিবুদাদুর কথা বলতে চাইছে সুতরাং আমি তার দিকে চেয়ে বললাম, ‘শিবুদাদুর কাছে কবে যাবে তাহলে?’

সমুদার উত্তর, ‘আগামীকালই যেতে হবে, তাই এখন যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি বনবিহারীবাবুকে একটা ফোন করে আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে বেহালা চৌরাস্তায় পৌঁছে যেতে বলে দিচ্ছি।’

সমুদার কথামতো আমি চলে গেলাম ঘুমাতে এবং আবারও এক নতুন উত্তেজনার সম্মুখীন হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগলাম।

পরদিন সকালে আমরা শিবুদাদুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম এবং কথামতো বনবিহারীবাবু, বেহালা চৌরাস্তায় এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

আমরা ওনার নিকট যেতেই উনি সমুদার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা! আপনি yesterday আমায় ফোন করে why এখানে meet করতে বললেন?’

সমুদার হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর আমিই ওনাকে দিলাম, ‘আসলে সমুদার কোনো ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়ার হলে, সে শিবুদাদুর কাছে ছুটে আসে।’

বনবিহারীবাবুর মুখ দেখে বুঝলাম উনি কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি, ফলে রাস্তায় যেতে যেতে শিবুদাদুর বিষয় ওনাকে বিস্তরভাবে জানালাম।

সব শুনে উনি সমুদাকে বললেন, ‘তা মশাই, আপনার যে এরকম একজন advisor আছে, কৈ আগে তো কখনো hear করিনি। সত্যি, আপনাকে understand করা is very very impossible।’

শিবদাদু আমাদের দেখে বরাবরই আনন্দিত হন, তবে এবার একটু অবাকও হলেন বটে কারণ ওনার বাড়ির সদর দরজার সামনে তখন আমার দুজন নয়, ছিলাম তিনজন।

হ্যাঁ! শিবুদাদু, বনবিহারীবাবুকে দেখে একটু অবাক হয়েছিলেন কিন্তু সমুদার মুখে ওনার পরিচয় শোনার পর উনি হাসতে হাসতে ওনাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তা একজন আলোকচিত্রকরের কাছে রহস্যে বা রোমাঞ্চের অর্থ ঠিক কী দাঁড়ায়, মি. গুপ্তপতি?’

বনবিহারীবাবুকে একটু চিন্তা করে বলতে শুনলাম, ‘রহস্য equals to সমুবাবু আর সমুবাবু equals to রোমাঞ্চ।’

সেখানে উপস্থিত আমরা কেউই ওনার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না দেখে বনবিহারীবাবু ফের নিজেই আমাদের বুঝিয়ে বললেন, ‘সমুবাবু আমার কাছে পুরোটাই রহস্য, উনি কখন কি do করেন, তা উনি ছাড়া কেউই understand করতে পারে না এবং উনি পাশে থাকা মানেই always রোমাঞ্চ, কারণ সমুবাবু যেখানে রোমাঞ্চও ঠিক সেই place-এ।’

বনবিহারীবাবুর কথা শুনে, আমরা সত্যি আর কেউ না হেসে থাকতে পারলাম না। তবে, ওনার কথায় যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। তাই হাসির ছলে হলেও আমরা সেই অর্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম।

আবার ফেরা যাক মূল গল্পে, আমাদের আসার কারণ জানার পর শিবুদাদু ওনার বইয়ের শেলফ খানিক্ষণ ঘেঁটে দেখার পর ওখান থেকে একটা কাগজ বের করে এনে সমুদার হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখ সমু, এতে আশা করি তোর নতুন কেসের কোনো না কোনো সূত্র পেয়ে যাবি।’

সমুদা কাগজটি এক ঝলক দেখে বলল, ‘কাকা, লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তাই তুমি কি এই বিষয় কিছু বলতে পারবে?’

শিবুদাদু বললেন, ‘আমেরিকার সিভিল ওয়ারের ব্যাপারে আগে তো শুনেছিস। এই পকেট ঘড়ি, সেই সময়কার বিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি Waltham-এর তৈরি। তবে, এটির বিষয় ইতিহাসে খুব বেশি উল্লেখ করা নেই। এই কোম্পানির পক্ষ থেকে, ঠিক একই রকমের একটি Waltham William Ellery মডেলের পকেট ঘড়ি তখনকার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য সেই ঘড়ি Smithsonian Museum-এ সংগ্রহ করে রাখা।’

শিবুদাদুর কথা শুনতে শুনতে সমুদার প্রশ্ন, ‘এই ঘড়ি তাহলে কার?’

শিবুদাদুর উত্তর, ‘রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের যে নয়, সেটা আশা করি তুই বুঝতেই পারছিস। এই ঘড়ি আসলে ড. ওয়াটসনের, যিনি ইউনিয়ন বা লিংকনের পক্ষ থেকে সেই যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। পত্রিকায় দেওয়া আর্টিকেলে ওনার সম্বন্ধে এইটুকুই লেখা রয়েছে এবং ঘড়ির বিবরণসহ বাকি যা রয়েছে, তা তুই বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি গেলেই জেনে যাবি। ফলে, এর জন্য আর কোনো ইতিহাস জানতে হবে না। তবে, তুই চাইলে, আমি ড. ওয়াটসনের বিষয় আরেকটু তথ্য দিতে পারি।’

সমুদা সেই শুনে শিবুদাদুকে বলল, ‘তোমার থেকে পুরো তথ্য না নিয়ে যে ফিরব না, তা তুমি ভালোই জানো কাকা।’

সমুদার কথা শেষ হতেই শিবু দাদু হেসে উঠলেন, ‘হা-হা-হা! এরকম কথা একমাত্র তোর কাছেই আশা করা যায়, সমু। কিন্তু এখন খেতে চলো সবাই, খাওয়ার পর নয় বাকি কথা হবে।’

শিবুদাদুর আজ্ঞা পালন করতে, আমরা সকলে আগে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম এবং তারপর ওনার থেকে বাকি কথা জানলাম।

মুখের ভেতর পান চিবাতে চিবাতে শিবুদাদু বললেন, ‘যুদ্ধের পর ড. ওয়াটসনের সাধ হয় লিংকনের মতো একই রকমের একটি পকেট ঘড়ি উনি কিনবেন কিন্তু আর্থিকভাবে সেরকম সক্ষম না হওয়ায়, উনি তখনকার মতো সেই আশা ত্যাগ করেন। তবে, কিছু বছরের মধ্যেই উনি অবসর নেন এবং তখন এককালীন যে টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়েই উনি ওই একই মডেলের ঘড়ি কিনে ফেললেন। পরে অবশ্য অভাবে পরে উনি সেই ঘড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

শিবুদাদুর কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘তাহলে ওই ঘড়ি আমেরিকা থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এল কীভাবে?’

এর উত্তর অবশ্য শিবুদাদুর কাছে ছিল এবং সেটা আমাদের জানাতে উনি দ্বিধাবোধ করলেন না।

ওনার বিশ্লেষণ, ‘এক ফরাসি ব্যবসাদার ড. ওয়াটসনের থেকে ওই ঘড়ি কিনেছিলেন এবং পরে উনি ভারতে এসে সেটিকে অনেক চড়া দামে বিক্রি করে দেন। তারপর, নিলামের পর নিলাম এবং অনেক হাত বদলের পর অবশেষে সেই ঐতিহাসিক যুগের ঘড়ি এসে পৌঁছায় বিশ্বনাথবাবুর হাতে।’

সেদিন শিবুদাদুর বাড়িতে বনবিহারীবাবু সারাক্ষণ চুপ করেই ছিলেন, ওনাকে দেখে মনে হলো উনি পুরো বিষয়টা খুবই মন দিয়ে শুনছিলেন। ফলে, সেদিন ওনার দিক থেকে আর কোনো প্রশ্নের বান, সমুদা বা অন্য কারওর উদ্দেশ্যে ছুটে আসতে দেখিনি। শিবুদাদুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলাম।

বাড়ি ফিরে আমি সমুদাকে এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করে বিব্রত করলাম না। রাতে শুতে যাওয়ার আগে তাকে শুধু বললাম, ‘আজ এত ইতিহাস যে আমরা জানলাম, তা কোনটা তোমার মনে হয় এই কেসে দরকার লাগবে সমুদা?’

টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটা সমুদা হাতে নিয়ে বলল, ‘যে কোনো ঐতিহাসিক জিনিসের বিষয় তদন্ত করতে গেলে তার ইতিহাসটা জানা খুবই দরকার রে, বঙ্কু। কিন্তু আমার মাথায় এখন শুধু একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খাচ্ছে।’

‘কী ব্যাপার বলো তো?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

গ্লাসের সমস্ত জলটা সে ফুলের টবে ঢেলে দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে উত্তর দিল, ‘ওই যে শিবুকাকা তখন বলল শুনলি না? এই ঘড়ি অনেক হাত বদলের পর বিশ্বনাথবাবুর হাতে এসেছে। তাই আমার অনুমান, এই হাত বদলা-বদলির মধ্যেই অনেক কিছু লুকিয়ে রয়েছে সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে আজ থেকেই ভাবনা শুরু করে দিতে হচ্ছে রে, বঙ্কু।’

সমুদার কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, ফলে তাকে আর বিরক্ত না করে আমি গিয়ে শুয়ে পড়লাম এবং ভেবে ফেললাম এই গল্পের নাম দেওয়া যেতেই পারে, সমুদার এবারের তদন্ত ‘ড. ওয়াটসনের ঘড়ি’।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, কোনোরকমে মুখে কিছু গুঁজেই সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম দেবীপুরের উদ্দেশ্যে। সেদিন হঠাৎ বনবিহারীবাবুর এক বিশেষ কাজ পরে যাওয়ায়, উনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না।

আমরা দেবীপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা সবে ১২টা ছুঁয়েছে। সেখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমরা বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি এসে পৌঁছালাম।

ওনার বাড়িতে ঢোকার মুখে লক্ষ করলাম আমাদের দূর থেকে দেখে একজন মাঝবয়সী যুবক বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে উচ্চ স্বরে বলে উঠল, ‘সঞ্জীবদা বাড়িতে নেই, খবরের কাগজের লোক হলে পরে আসবেন।’

সমুদা তার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমরা খবরের কাগজের লোক নই। সঞ্জীববাবু কখন ফিরবেন কিছু জানো?’

ওই যুবক কিছু বলার আগেই সমুদার গলা শুনে সঞ্জীববাবু দেখি স্বয়ং নিজে বারান্দায় এসে হাজির। তারপর তিনি নিচে নেমে এসে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

ভেতরে ঢোকার মুহূর্তে সঞ্জীববাবু বললেন, ‘সমরেশবাবু, কিছু মনে করবেন না। আসলে পত্রিকার লোকেদের আমি ঠিক এখন বাবার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছি না। ওনার শরীরটাও সেরকম ভালো যাচ্ছে না আর ওই চিঠির টেনশন তো আছেই। এইসব কারণের জন্যই আমি নিখিলেশকে বলেছিলাম, যদি পত্রিকার লোক আসে তাহলে ও যেন আমি নেই বলে তাদের ফিরিয়ে দেয়।’

সেই শুনে সমুদা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করা যাবে তো?’

উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! নিশ্চয়ই। আপনি এসেছেন আমাদের দরকারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবার স্বার্থে সুতরাং বাকিদের সঙ্গে আপনার ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেললে চলবে না।’

কথা বলতে বলতে আমরা এসে ঢুকলাম বিশ্বনাথবাবুর ঘরে। সঞ্জীববাবু ওনাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, সমরেশবাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

বিশ্বনাথবাবু সেই শুনে উঠে বসলেন, তবে লক্ষ করলাম উনি কী যেন হাত বাড়িয়ে ক্রমাগত খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সমুদা বুঝতে পেরে, পাশের টেবিলের উপর রাখা একটা কালো চশমা ওনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনার চশমাটা।’

সমুদার হাত থেকে নিয়ে চশমাটা পরে উনি বললেন, ‘ধন্যবাদ, মি. দত্ত। আপনি হয়তো সবই আমার ছেলের মুখে শুনেছেন এবং আশা করি এই কদিনে আপনি নিশ্চয়ই ওই আর্টিকেলটাও পড়ে ফেলেছেন সুতরাং নতুন করে আর সেই সব কথা বলছি না। এখন আপনি কী জানতে চান সেটা বলুন।’

সমুদা খাটের এক পাশে বসে ওনাকে বলল, ‘হ্যাঁ! শুনেছি এবং ঘড়ির বিষয়টা পড়েছিও বটে। কিন্তু এই তদন্তে এগোবার আগে আমি ওই ঘড়িটা একবার নিজের চোখে দেখতে চাই।’

সমুদার কথা শেষ হতেই উনি বালিশের তলা থেকে দেরাজের চাবিটা বের করে সঞ্জীববাবুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘চাবিটা দিয়ে দেরাজটা খুলে, তার দ্বিতীয় তাক থেকে কালো রঙের বড় বাক্সটা বের করে আমার হাতে দে তো।’

সঞ্জীববাবু তার বাবার নির্দেশ অনুযায়ী সেই দেরাজ খুলে ওই বাক্সটা বের করে ওনার হাতে তুলে দিলেন।

বিশ্বনাথবাবু বাক্সটা খুলে সেই অমূল্য সম্পদটি বের করে সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মি. দত্ত, এটাই সেই ড. ওয়াটসনের Waltham William Ellery মডেলের পকেট ঘড়ি।’

সমুদা ওনার হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে, নিজেও দেখল এবং আমাকেও দিল দেখতে। সেই ঘড়ির বিষয় বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ঘড়ির ডায়ালের কথা। বেশ বড় সাদা রঙের ডায়াল যার মধ্যে রয়েছে সেকেন্ড দেখার জন্য ঠিক ৬-এর ঘরের জায়গায়, আলাদা করে আরেকটি ছোট ডায়াল। ১২ ঘরের নিচে অবশ্য স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে American Waltham…। ঘড়ির বাইরের দিকটা পিতলের মতো রঙ হলেও, এখন সেটা কালচে হয়ে গেছে। ঘড়িটায় এখনও দম দিলে বেশ ভালো মতোই চলে। তবে, পকেটঘড়ি হলেও সেটার সরু চেইনটা আর নেই। এই বিষয় বিশ্বনাথবাবুও ঠিকঠাকভাবে উত্তর দিতে পারলেন না। বর্তমান সময় এই ঐতিহাসিক ঘড়ির মূল্য প্রায় অনেকই বলা যেতে পারে। কিন্তু এমন অমূল্য সম্পদের মূল্য কি কেবল টাকায় করা সম্ভব?

সমুদা ওই ঘড়ি ফেরত দেওয়ার সময় ওনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার এই ঘড়ি আর চিঠির ব্যাপারে কাউকে কি সন্দেহ হয়?’

‘সন্দেহ তালিকায় যে শুধু একজনের নাম রয়েছে, তা বললে ভুল হবে মি. দত্ত। তিনজনকে আমার সন্দেহ হয়।’ উত্তর দিলেন বিশ্বনাথবাবু।

তিনজন কথাটা শুনে সমুদা ওনাকে প্রশ্ন করল, ‘এই ঘড়ির সঙ্গে সেই তিনজন কীভাবে যুক্ত?’

ওনাকে লক্ষ করলাম প্রশ্নটা শুনে ঘড়িটা বাক্সে ঢুকিয়ে রাখার মুহূর্তে সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই তিনজনের গল্পই বেশ পুরোনো। বহুবছর আগে কাজের সূত্রে একবার দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলাম আর সেখান থেকে ফেরার পথে, শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট ঘুরতে গিয়ে আমার আলাপ হয় প্রথমজন অর্থাৎ রাজেন গুহর সঙ্গে। রাজেন ছিল বিদেশি ঘড়ির ডিলার। ওর হঠাৎ টাকার দরকার হয়ে পড়ায়, নিজের বাবার অমূল্য সম্পদ এই Waltham ঘড়িটা আমায় কিনে নিতে সে অনুরোধ করল। আমি দেখলাম কম অর্থে এই ঐতিহাসিক ঘড়ি যদি কেনা যায়, তাহলে খুব একটা লোকসান হবে না। ফলে, আমিও রাজি হয়ে কিনে ফেললাম এবং কিছু মাস পর কোথা থেকে আমার কলকাতার বাড়ির ঠিকানা জেনে রাজেন আমার বাড়ি এসে হাজির হলো। সে তখন ঘড়িটা ফের আমার কাছ থেকে কিনে নিতে চাইল কিন্তু আমি রাজি না হওয়ায়, ওর সঙ্গে আমার এক প্রকার ঝগড়ার সৃষ্টি হলো এবং চলে যাওয়ার আগে রাজেন আমাকে খুনের হুমকিও দিয়ে যায়। তারপর ওর সম্বন্ধে আর কোনো খবরই পাইনি সুতরাং আর্টিকেল পড়ে ও যে ফের আমার কাছে এখানে আসবে না, সেটা কিন্তু খুব জোর গলায় বলা যাচ্ছে না। তাই সন্দেহ তালিকায় ওকে রাখতে হচ্ছে।’

সমুদা প্রথমজনের ঘটনা শোনার পর বাকি দুজনের বিষয় জানার আগ্রহ প্রকাশ করল এবং বিশ্বনাথবাবুও ফের বললেন, ‘বাকি দুজনেই কলকাতায় থাকত। কিন্তু তাদেরও এখন খোঁজ নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়জন, আমার এক সময়ের বন্ধু ড. সান্যাল। সে ডাক্তার হলেও, এই পকেটঘড়ির উপর তার একটা বরাবরই ইন্টারেস্ট ছিল। আমাকে সান্যাল অনেকবারই অনুরোধ করেছিল ঘড়িটা তাকে বিক্রি করে দিতে কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা নেই দেখে, সে আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। একদিন আমার বাড়িতে সে ঘড়িটা চুরি করতে এসে ধরাও পড়ল। সেদিন আমি সান্যালকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতাম কিন্তু তা না করে আমি ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন পর, সে আবারও ওই একই কাজ করল। ফলে, দ্বিতীয়বার আর আমি ওকে ক্ষমা না করে, সোজা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। পরে শুনেছি ওই ঘটনার পর, সান্যালের ডাক্তারি জীবনে ইতি পড়ে যায় এবং ওর বউ সঙ্গে ছোট ছেলেকে নিয়ে লজ্জায় বাধ্য হয় আত্মহত্যা করতে। এখন তাই আমার ধারণা, এত বছর পর আমার আর্টিকেলগুলো পড়ে সে হয়তো ফিরে এসেছে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে। তাই ওকেও সন্দেহ না করে থাকা যাচ্ছে না, মি. দত্ত।’

সমুদার মুখ চোখ দেখে মনে হলো, সে খুব গভীরভাবে এই সকল বিষয়গুলোকে শুনছে এবং আমার অনুমান যদি সঠিক হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই এই কেসের স্বার্থে সকল বিষয়কে একত্র করে নিজের মস্তিষ্কে একটা চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে।

ফেরা যাক বিশ্বনাথবাবুর শেষ সন্দেহজনক ব্যক্তিটির কথায়। উনি বললেন, ‘মি. দত্ত, আমার সন্দেহ যার উপর সবচেয়ে বেশি, সে হলো জগু। এই জগুর ভালো নাম একটা রয়েছে ঠিকই, তবে সেটা আর আমার মনে নেই। সোজা কথায়, ও একজন গুণ্ডা। কলকাতার বড়বাজার চত্বরে নানা দোকানদারকে নানাভাবে বিরক্ত করত সে। জগুর মনে আমার এই ঘড়িকে কেন্দ্র করে বহুদিনের একটা বাসনা রয়েছে। সে মনে করত, আমি ওর কথায় রাজি হয়ে এমন একজনকে এই ঘড়ি বিক্রি করব যার থেকে ওর একটা মোটা অঙ্কের অর্থ দালালি হিসাবে লাভ হবে। এলাকার অনেক ছেলেই ওর কথায় উঠত আর বসত। একজন গুণ্ডার মধ্যে যা যা স্বভাব থাকা দরকার, তা সবই ছিল ওর মধ্যে। আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেকের মুখেই শুনেছি, আমার দোকানে আগুন লাগার পেছনে নাকি জগুর ভূমিকা যথেষ্টভাবে ছিল। হতে পারে সেই বাসনা এখন পূরণ করতেই সে ওই আর্টিকেল পড়ে, আমার সন্ধান পেয়ে আবারও ফিরে এসেছে। তবে, শেষ খবর যা পেয়েছি ওর বিষয় তা হলো, সে নাকি এখন অনেকটাই নিজেকে বদলে ফেলেছে এবং একটা ব্যবসাও শুরু করেছে কিন্তু তবুও আমার মনে ওকে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’

সমুদা ওনার কথা শেষ হতেই ফের ওনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিশ্বনাথবাবু, এই তিনজন ছাড়া আর কাউকে কি আপনি বা আপনার ছেলে সন্দেহ করেন?’

উত্তরে উনি বললেন, ‘না! আর কাউকে করি না। আমি জানি এদের মধ্যেই আসল লোকটা লুকিয়ে রয়েছে। এখন তাই আপনাকেই সেই লোকটাকে, এদের মধ্যে থেকে টেনে বের করতে হবে।’

সমুদা আবার কিছু বলার আগেই, সঞ্জীববাবু আমাদের দুপুরের খাওয়ার জন্য নিচের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং খাওয়ার পর আমরা আবার বিশ্বনাথবাবুর ঘরে ফিরে এলাম। সমুদা এবারে ওনাকে বলল, ‘আমি একটা উপায় ভেবেছি, তবে সঞ্জীববাবু আর আপনাকে এই ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।’

কথাটা শুনে সঞ্জীববাবু বলে উঠলেন, ‘আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন?’

উত্তর দিল সমুদা, ‘পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে, সঞ্জীববাবু। বিজ্ঞাপনটা হবে বিশ্বনাথবাবুর নামে এবং আসল অপরাধীকে ধরতে এটাকেই আমি টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই।’

সমুদার কথা বুঝতে না পেরে বিশ্বনাথবাবু বললেন, ‘মি. দত্ত, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন দয়া করে খুলে বলবেন?’

সমুদা ওনার সামনে গিয়ে বলল, ‘বিজ্ঞাপনে লেখা থাকবে যে আপনি আপনার এই Waltham ঘড়ি বিক্রি করতে চান এবং যারা ইচ্ছুক তারা যেন আপনার এই ঠিকানায় এসে যোগাযোগ করেন। এই ঘড়ির উপযুক্ত দাম যিনি দিতে পারবেন, তাকেই এই ঘড়ি দেওয়া হবে।’

সমুদার কথা শুনে বিশ্বনাথবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘আমি কিন্তু ওই ঘড়ি কাউকে দিতে পারব না, মি. দত্ত। এখনই আপনাকে তাই কথাটা সরাসরি জানিয়ে রাখছি।’

সমুদা ওনাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘না! না! আপনাকে এই ঘড়ি কাউকেই দিতে হবে না, এটা তো শুধু একটা টোপ মাত্র। আমার বিশ্বাস ওই তিনজনের মধ্যে যদি কেউ আসল অপরাধী হয়ে থাকে অথবা অন্য কেউ, তাহলে সে লোভে পরে নিশ্চয়ই এখানে আসবে এবং আমাদের জালে সে নিজেই ধরা দেবে।’

সমুদার কথা সেই ঘরে উপস্থিত আমরা সবাই খুব মন দিয়ে শুনছিলাম। ওনাদের দুজনকে খুব সজাগ থাকতে পরামর্শ দিল সমুদা, যাতে এই প্ল্যানের বিষয় কাকপক্ষীতেও টের না পায়। কারণ ব্যাপারটা মুখে সহজ লাগলেও, বাস্তবে একেবারেই তা নয়। এতে অনেক বিপদের আশঙ্কাও রয়েছে।

এই ব্যাপারে আরও কিছু কথাবার্তা সেরে আমরা বিশ্বনাথবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম এবং নিচে নামার সময়, আবারও ওই মাঝবয়সী যুবকটির সঙ্গে আমাদের দেখা হলো।

সমুদা তাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত সঞ্জীববাবু সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সমরেশবাবু, ও হলো নিখিলেশ। পাঁচ মাস হলো ওকে ব্যবসার কাজে রেখেছি। বাবাকে ছেড়ে সবসময় কলকাতায় যাওয়া হয় না, তাই ওইদিকের পুরো ব্যাপারটাই ও দেখাশোনা করে।’

সমুদা তার কথা শুনে নিখিলেশদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আগে কোথাও কাজ করতে?’

উত্তরে সে বলল, ‘হ্যাঁ! আমি কলকাতার বরানগরে এক ওষুধ কারখানায় দেখাশোনার কাজ করতাম।’

সমুদা তাকে আরও জিজ্ঞেস করল, ‘কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ এই দেবীপুরে চলে এলে কেন?’

এবার একটু ঘাবড়ে গিয়ে নিখিলেশদাকে বলতে শুনলাম, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর, একদিন বরানগরেই সঞ্জীবদার সঙ্গে আলাপ হয় এবং তিনিই আমায় এই কাজের ব্যাপারে তখন বলেন আর আমিও দেখলাম ওই কারখানায় কাজ করে সেরকম কিছুই উন্নতি হচ্ছে না, ফলে এখানে সঞ্জীবদার সঙ্গে চলে এলাম।’

নিখিলেশদার কথা শেষ হওয়া মাত্রই সঞ্জীববাবুর দিকে চেয়ে সমুদা বলল, ‘আপনার কপাল ভালো, এখনকার দিনে এইরকম অল্প বয়সী ছেলে পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার! আজকাল কেউই কলকাতা ছেড়ে এতদূরে এসে গ্রামে কাজ করতে চায় না আর সেখানে ও নিজে থেকেই রাজি হয়ে এখানে এসেছে। সুতরাং ওকে কুর্নিশ জানাতেই হচ্ছে।’

সমুদার কথা শুনে আমি তো অবাক! বুঝতে পারছিলাম না তার হঠাৎ কী হলো, কারণ যেই মানুষ সহজে কারওর সুখ্যাতি করতে চায় না, সে কিনা আজ একবার কথা বলেই নিখিলেশদার সুখ্যাতি করছে! এটা আমার কাছে প্রায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা।

আমাদের সঙ্গে স্টেশন অবধি সঞ্জীববাবু এলেন এবং রাস্তায় যেতে যেতে সমুদা তার সঙ্গে পুরো প্লানটা আরেকবার ঝালিয়ে নিল। সেই প্ল্যানমাফিক আমরাও কিন্তু দেবীপুর আসব বাকিদের মতো ওই ঘড়ির নিলামে অংশগ্রহণ করতে। তবে, সেটা অবশ্যই ছদ্মবেশে কারণ আমাদের মূল উপলক্ষ থাকবে আসল অপরাধীকে ধরা।

কিন্তু সবকিছু কি এত সহজ হবে? না! এটা কখনই মনে করা উচিত নয়। তাই এখন সমুদার অনেক দায়িত্ব, এই ঘটনাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং এবারে সমুদার মস্তিষ্কের লড়াই হতেই পারে একই জায়গায় থাকা একাধিক অপরাধীর সঙ্গে বা সেই মূল অপরাধী, যাকে খুঁজে বের করাই হলো সমুদার একমাত্র লক্ষ সুতরাং এইসব চিন্তা মাথায় নিয়েই, ফিরে এলাম কলকাতায়।

সেদিন বাড়ি ফিরে আমি সমুদাকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি কি নিশ্চিত, ঘড়ির লোভে ওই তিনজনই বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি আসবে? তোমার কি মনে হয়, ওরা এসে নিজেদের আসল পরিচয় দেবে? যদি এই সাজানো ব্যাপারটা ওরা আন্দাজ করে না আসে, তাহলে কী করবে সমুদা?’

এই সকল প্রশ্নের উত্তরে সমুদা শুধু বলেছিল, ‘এতদিন গোয়েন্দাগিরি করে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার উপর জোর দিয়েই বলছি। যদি এই পরিকল্পনা কাজে না দেয়। তাহলে ধরে নে, আমার গোয়েন্দাগিরি এখানেই শেষ।’

সমুদার এই আত্মবিশ্বাস দেখে আমার মনে জোর এল এবং আবারও তার উপর বিশ্বাস রেখে আমি গেলাম ঘুমাতে।

পরদিন সকালেই বনবিহারীবাবু আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। ওনাকে আমি পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম এবং সব শুনে উনি সমুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সমুবাবু, আপনারা কি ছদ্মবেশ নেবেন?’

এর উত্তরে সমুদা মুচকি হেসে বলল, ‘ছদ্মবেশটা ঠিক আমাদের নয়। ওটা আপনার জন্যই প্রযোজ্য। আপনিই তো যাচ্ছেন ওই নিলামে ঘড়ি কিনতে, আমরা দুজন তো স্রেফ আপনার সাথী মাত্র।’

কিছু বুঝতে না পেরে উনি সমুদাকে ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী tell করতে চাইছেন মশাই? একটু clear-ভাবে say করুন তো।’

সমুদা তারপর গুছিয়ে বলল, ‘আপনি দেবীপুরে যাবেন ছদ্মনাম নিয়ে এবং ওই একই ঘড়ি কেনার আরেকজন দাবিদার হয়ে এবং আমরা যাব আপনারই সঙ্গে। তবে, আমি কোনো গোয়েন্দা হিসেবে নয়, একজন দালাল হয়েই যাব ওখানে।’

সমুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘দালাল হলেই কি ওরা তোমায় চিনতে পারবে না ভাবছ?’

এর উত্তরে সে বলল, ‘না! সেটা কখনোই আমি ভাবছি না। তবে, একজন গোয়েন্দা হলে কি দালাল হওয়া যায় না? আমি সরাসরি গোয়েন্দা হয়ে গেলে, সেখানে উপস্থিত অনেকের মনে তখন প্রশ্ন জাগতে পারে সুতরাং এই ছলের আশ্রয় আমাকে নিতেই হবে।’

কথা শেষ হতেই বনবিহারীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘সবকিছুই তো understanding কিন্তু what is my ছদ্মনাম?’

সমুদা আবারও মুচকি হেসে উত্তর দিল, ‘আপনার নাম আপনিই ঠিক করুন, তবে দেখবেন সেটা যেন আপনার দেবীপুরে গিয়েও মনে থাকে।’

বনবিহারীবাবু গালে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বললেন, ‘সমুবাবু, my name is going to be মনোহর গুপ্ত। আমার মাসি think করেছিল, কোনোদিন যদি তার own son হয়, তাহলে তার নাম রাখবে মনোহর। কিন্তু মাসির no child হওয়ায়, এই নাম তাই আমিই নিজের ছদ্মনাম হিসাবে রাখলাম।’

ওনার কথা শুনে সমুদা বলে উঠল, ‘বাহ! আপনার সত্যি কোনো তুলনা নেই বনবিহারীবাবু, আপনি যে মনের দিক দিয়ে কত বড় মাপের মানুষ, তা আপনার সংস্পর্শে না এলে কখনোই বোঝা যেত না।’

সত্যি! ওনার মতো মানুষ আর কজনই বা হতে পারে। নিজের মাসির সন্তান না হওয়ার যে কষ্ট, তা উনি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আজ একটা সুযোগ পেয়ে, বনবিহারীবাবু নিজের স্বর্গীয় মাসির প্রতি ভালোবাসা থেকেই ওনার ছদ্মনাম হিসেবে বেঁচে নিলেন সেই নাম। ওনার কথা অনুযায়ী তাই বলতেই হচ্ছে, ‘Bravo! bravo! আপনার no তুলনা মি. গুতপতি।’

আবার ফেরা যাক গল্পে, আমাদের মুখ দেখে এবং পরিবেশটা একটু মজাদার করতে বনবিহারীবাবু বলে উঠলেন, ‘আপনি যাই say করুন সমুবাবু, এটা আপনাকে এখন agree করতেই হবে যে আমার put করা false গোঁফ এবার আপনার কাজে লাগবে।’

সমুদা হেসে ওনাকে বলল, ‘এটা আপনি মন্দ বলেননি। আগামী বেশ কিছুদিন, আপনার ওই গোঁফ লাগানো ছদ্মবেশটা আমায় অনেকটা সাহায্য করবে।’

আমাদের মধ্যে কথাবার্তা যেন ঘড়ির কাটাকেও হার মানায়। রাতে আমাদের বাড়ি থেকে একেবারে খেয়েই বনবিহারীবাবু বাড়িতে গেলেন।

এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর একদিন হঠাৎ সকালের খবরের কাগজ খুলতেই সেই বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল। সমুদা সেই বিজ্ঞাপন দেখা মাত্রই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বঙ্কু, কোনো ফোন এসেছে সকাল থেকে?’

উত্তরে বললাম, ‘না! কোনো ফোন আসেনি।’

সমুদাকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলতে শুনলাম, ‘আমার মন বলছে, আগামীকালের মধ্যেই ফোন আসবে এবং পরশুর মধ্যেই হয়তো আমাদের ছুটতে হবে দেবীপুরে।’

সমুদার কথা শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি কিছু অনুমান করছ?’

সমুদার উত্তর, ‘অনুমান করে সবসময় সফল হওয়া যায় না, বঙ্কু। জীবনে কোনো কাজ করতে গেলে, আগে কিছু প্ল্যানিং করা দরকার। একটা ছক না থাকলে, কোনো পথেই বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়।’

সমুদার কথা আমি পুরোটা না বুঝলেও যতটুকু বুঝেছি তা হলো এই যে, আমাদের খুব শীঘ্রই হয়তো দেবীপুরে যেতে হবে।

ওই রাতেই সঞ্জীববাবু ফোন করে সমুদাকে জানালেন যে দুজন ব্যক্তি সেই বিজ্ঞাপন দেখে নিলামে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং তারা নিলামের জন্য আগামী শুক্রবারই দেবীপুরে আসছেন।

সমুদাও তাকে তখনই জানিয়ে দিল যে আমরাও শুক্রবার সকালে দেবীপুর পৌঁছে যাব। তবে, ঘড়ির নিলাম সেদিন হবে না। নিলামের জন্য তাদের আরেকদিন অপেক্ষা করতে হবে অর্থাৎ সমুদার কথা অনুযায়ী, আগামী শনিবারই হবে ঘড়ির নিলাম এবং এই রহস্য উদ্ঘাটনের দিন।

সমুদার এই একদিন ওখানে থাকার বিষয়টা নিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কীসের জন্য দেবীপুরে রাত কাটাতে চাও?’

সমুদার উত্তর, ‘ওদের সঙ্গে সময় না কাটালে আসল অপরাধীকে ধরব কীভাবে! মনে রাখিস, সবাই কিন্তু অপরাধী নাও হতে পারে, আবার একসঙ্গে মিলিতও হতে পারে সুতরাং ওই দু-দিন আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে।’

সমুদার কথা শুনে আমি শুধু মাথা নাড়লাম এবং নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সমুদা ফোন করে বনবিহারীবাবুকে ওনার পুরো দায়িত্বটা ভালো করে বুঝিয়ে দিল এবং অবশ্যই ওনাকে সবসময় সজাগ থাকার পরামর্শ দিল, যাতে কেউ ওনার আসল পরিচয় সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র টের না পায়।

অবশেষে শুক্রবার সকলে আমরা রওনা দিলাম দেবীপুরের উদ্দেশ্যে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, গত রাতে সঞ্জীববাবু সমুদাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে তাকে ওইদিনই আরেক ব্যক্তি ফোন করে জানায় যে তিনিও ওই ঘড়ি কিনতে ইচ্ছুক, ফলে তিনিও দেবীপুর আসছেন। আগে ছিল দুই, এখন হলো তিন সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে এই কেস ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে এবং এই তিনজন হতেই পারে বিশ্বনাথবাবুর সন্দেহ তালিকার সেই তিনজন অভিযুক্ত। তাই এই গল্পের পরিণাম কী হতে চলেছে, তা জানতে গেলে আমাদের একটু ধৈর্য রাখতেই হচ্ছে।

বিশ্বনাথবাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি, সঞ্জীববাবু স্বয়ং আমাদের স্বাগত জানাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং আমাদের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সময় বনবিহারীবাবুকে দেখে তিনি সমুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সমরেশবাবু, ওনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না? উনি কি আপনার নিকট কোনো আত্মীয়?’

সমুদা বলল, ‘উনি আমার পরিচিত, মনোহর গুপ্ত। আমার তরফ থেকে উনি এই ঘড়ি কেনার নাটকে সামিল হতে এসেছেন।’

সমুদার কথা শেষ হতেই সঞ্জীববাবু জানালেন, ‘সমরেশবাবু, একটু আগেই দুজন ব্যক্তি বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। তবে, তাদের নাম কিন্তু বাবার উল্লেখ করা সেই নামগুলোর মধ্যে একটিও নয়।’

সমুদাকে একটু ভুরু কুঁচকে বলতে শুনলাম, ‘তা কী নাম বলেছে তারা?’

সঞ্জীববাবু বললেন, ‘একজনের নাম বিপিন ভদ্র আর অপরজনের নাম দুলাল বিশ্বাস।’

আমরা সেই কথাবার্তার মাঝেই এসে ঢুকলাম তাদের বসবার ঘরে এবং লক্ষ করলাম তারা দুজনেই সেখানে বসে। সমুদাকে দেখে তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘আপনি সমরেশ দত্ত, ডিটেকটিভ না?’

সমুদা বলল, ‘হ্যাঁ! তবে, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’

এই কথার উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি দুলাল বিশ্বাস। পেশায়, একজন ব্যবসাদার। বিগত কুড়ি বছর ধরে এই ঘড়ির ব্যবসা করে আসছি।’

সমুদা কিছু বলার আগেই অপরজন বলে উঠলেন, ‘গোয়েন্দা হয়ে ঘড়ির শখ হলো কেন জানতে পারি?’

সমুদা হেসেই উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ! অবশ্যই জানতে পারেন। আমি গোয়েন্দা হলেও প্রকৃত একজন সাধারণ মানুষ সুতরাং আমার এই বন্ধু, মি. গুপ্তর জন্যই আজ এখানে ছুটে আসা। উনি আবার পুরোনো ঐতিহাসিক জিনিস সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন। খবরটা তাই ওনাকে জানাতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন এখানে আসতে আর আমিও এক নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চলে এলাম ওনার সঙ্গে।’

সমুদার কথা শেষ হতেই তিনি একটু ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘গোয়েন্দা হয়ে আজকাল দালালিটাও শুরু করে দিলেন মি. দত্ত? তা ভালোই করেছেন, এখন গোয়েন্দাগিরি করে আর সেরকম লাভ নেই। এর থেকে দালালি করুন, বাজারে এটা এখন খুব চলছে।’

সমুদাকে দেখলাম ব্যাপাটা সে হালকার ছলেই নিল এবং আবারও তাকে হাসি মুখে বলল, ‘আপনার পরিচয়টা পেলে ভালো লাগত মি…?’

‘আমার নাম বিপিন ভদ্র, রিটায়ার্ড ফরেস্ট অফিসার।’ বললেন তিনি।

ফরেস্ট অফিসার শুনেই বনবিহারীবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘Which forestএ ছিলেন আপনি?’

বিপিনবাবু-কে লক্ষ করলাম উনি বুক ফুলিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি অনেক ফরেস্টেই ছিলাম, যেমন ধরুন সুন্দরবন, গরুমারা, জলদাপাড়া। তবে, আমার বেশি রোমাঞ্চকর লেগেছে গরুমারা, সেখানকার পরিবেশটাই আলাদা।’

ওই দুজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সেই ঘরে এসে ঢুকলো আরেক ব্যক্তি, অর্থাৎ সেই তৃতীয় জন। সঞ্জীববাবু আমাদের সকলের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিলেন। আলাপ করে জানতে পারলাম, তার নাম যোগেশ্বর সমাদ্দার। তিনি প্রবাসী বাঙালী, দিল্লি থেকে কিছুদিন আগেই এখানে এসেছেন এবং ঘড়ির বিজ্ঞাপনটা দেখে তার ঘড়ি কেনার শখ হয় সুতরাং আর দেরি না করে, গতকাল রাতেই তিনি সঞ্জীববাবুকে একটা ফোন করে আজ সরাসরি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন।

যোগেশ্বরবাবুর বিষয় আরও কিছু জানার আগে, সঞ্জীববাবু আমাদের সকলকে নিয়ে গেলেন বিশ্বনাথবাবুর ঘরে।

এখানে বলে রাখা ভালো, বিশ্বনাথবাবুকে সমুদা আগে থেকেই সব জানিয়ে রেখেছিল সুতরাং উনি সমুদার শেখানো কথাগুলো শুধু আওড়ালেন, ‘আপনাদের সকলকে এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ। তবে জানিয়ে রাখি, ঘড়ির নিলাম আগামীকাল সকালেই হবে তার আগে নয়।’

ওনার কথা শেষ হওয়ার আগেই যোগেশ্বরবাবু বলে উঠলেন, ‘আগামীকালই যদি হবে, তাহলে আজ ডেকে আনার মানে?’

এর উত্তর অবশ্য বিশ্বনাথবাবুই দিলেন, ‘আসলে আগামীকাল আমার ছেলে, সঞ্জীবের জন্মদিন সুতরাং এরকম ঐতিহাসিক ঘড়ি নিলামের জন্য এর থেকে ভালো দিন আর হয়তো আমি পাব না। তাই আজ আপনারা সবাই এখানেই থাকবেন এবং আগামীকাল সকালে নিলামের পর একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরে, তারপর নয় যে যার মতো করে ফিরে যাবেন।’

দুলালবাবু এবং বিপিনবাবু দুজনকেই দেখলাম ওনার কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নেড়ে বলতে, ‘ভালো প্রস্তাব। একদিন নয় শহরের বাইরে, এইরকম গ্রামে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হবে।’

বনবিহারীবাবুও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তবে, লক্ষ করার মতো বিষয় হলো এই যে যোগেশ্বরবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, ‘আপনার কথাই নয় থাকল বিশ্বনাথবাবু কিন্তু ঘড়িটা কি আজই দেখাবেন নাকি সেটাও আগামীকালই হবে?’

‘না! না! ঘড়িটা আজই আপনাদের সবাইকে দেখাব। এখনই দেখাচ্ছি।’ এই বলে বিশ্বনাথবাবু নিজের বালিশের তলা থেকে চাবি বের করে সঞ্জীববাবুকে দিলেন এবং তিনি একইভাবে আবারও ওই কালো বাক্সটি বের করে তার বাবার হাতে তুলে দিলেন।

বাক্স খুলে সেই ঘড়ি বের করে উনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এটাই সেই Waltham পকেটঘড়ি।’

কথা শেষ করে বিশ্বনাথবাবু ঘড়িটা সঞ্জীববাবুর হাতে তুলে দিয়ে তাকে সবাইকে সেটা দেখানোর আদেশ দিলেন। সঞ্জীববাবুও তার বাবার আজ্ঞা মতো কাজ করলেন।

তিনি প্রথমে এগিয়ে এলেন বনবিহারীবাবুর দিকে এবং ওনাকে দেখলাম, ঘড়িটা হাতে নিয়ে উনি কিছুক্ষণ দেখার পর সমুদার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘সমুবাবু, এই watchটা নিয়ে এত fight কীসের? এর থেকে তো আমার হাতের watchটা অনেক better, আপনি কি say করেন?’

সমুদা ওই সময় ওনাকে শুধু বলল, ‘আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আমি নয় একটু পরে দিচ্ছি, তার আগে আপনি সঞ্জীববাবুর হাতে ঘড়িটা দিয়ে বাকিদের দেখার সুযোগ করে দিন, নাহলে বাকিরা আপনাকে সন্দেহ করতে পারে।’

সমুদার কথামতো উনি তাড়াতাড়ি ঘড়িটা সঞ্জীববাবুর হাতে ফিরিয়ে দিলেন এবং সঞ্জীববাবু বাকি তিনজনকে ওই ঘড়ি দেখানোর জন্য এগিয়ে গেলেন। বিপিনবাবুকে দেখলাম, ঘড়িটা একবার সাময়িক দেখেই ফেরত দিয়ে দিলেন। দুলালবাবু আবার ঘড়ির এইদিক ওইদিক করে পুরো নাড়িনক্ষত্র দেখলেন, এমকি ডায়ালের উপর একটা কালো দাগ কেন লেগেছে তার কৈফিয়ত নিতেও ছাড়লেন না। শেষে বলি যোগেশ্বরবাবুর কথা, তিনি শুধু ঘড়ির নিচের অংশটুকু দেখেই ছেড়ে দিলেন।

সমুদাকে সবার উপর সমানভাবে নজর রাখতে দেখে মনে হচ্ছিল, রহস্য যেন এখন ক্রমশই জমে উঠছে।

ঘড়ি দেখার পালা শেষ হওয়ার পর আমরা সকলে খেতে গেলাম এবং খাওয়া পর বিপিনবাবু আর দুলালবাবু দুজনেই গেলেন সঞ্জীববাবুর সঙ্গে গ্রাম ঘুরতে। তবে, যোগেশ্বরবাবু গ্রাম ঘুরতে গেলেন না, তিনি ওই আমাদের মতোই তাকে দেওয়া ঘরে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিলেন।

আমারা ঘরে ঢোকা মাত্রই বনবিহারীবাবু সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এবার আপনি say করুন তো মশাই, আমার হাতের watchটা better নাকি that old watch?’

সমুদা জানালার কাছে গিয়ে বাড়ির চারপাশটা একবার দেখে তারপর ওনার কথার জবাব দিল, ‘আপনার ঘড়িটা খুবই ভালো বনবিহারীবাবু, তবে ওটার সঙ্গে তফাত শুধু একটাই। ওই ঘড়ির আর্টিকেল বেরিয়েছে আর আপনারটার হয়তো পরে বেরোবে।’

সমুদার কথা শুনে উনি বললেন, ‘আপনি মশাই কেস solve করতে এসেও মশকরা করতে ছাড়েন না। তা কিছু কি understand করতে পারলেন?’

সমুদার উত্তর, ‘এখানে আসার পর থেকে অনেক কিছুই লক্ষ করেছি এবং বুঝেছিও বটে, তবে সব সমীকরণ কি এত তাড়াতাড়ি মিলে যায়?’

বনবিহারীবাবু কিছু বলতে যাবেন এমন সময় ঘরে এসে উপস্থিত হলেন যোগেশ্বরবাবু। তিনি সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি কি এই আড্ডায় সামিল হতে পারি মি. দত্ত?’

সমুদা বলল, ‘হ্যাঁ! অবশ্যই। আসুন।’

যোগেশ্বরবাবু ঘরের ভেতর ঢুকে আমার পাশে এসে বসলেন এবং আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘তোমাকে দেখে খুব ইনটেলিজেন্ট মনে হয়। কোন ক্লাসে পড়ো ইয়াং ম্যান?’

আমি বললাম, ‘স্কুলে নয়, আমি কলেজে পড়ি। সেকেন্ড ইয়ার হিস্ট্রি অনার্স।’

শুনে যোগেশ্বরবাবু বলে উঠলেন, ‘বাহ! ভেরি গুড।’

‘আপনার দিল্লিতে ঠিক কী করা হয় মি. সমাদ্দার?’ এবার তাকে প্রশ্ন করল সমুদা।

যার উত্তরে তিনি বললেন, ‘ফরেন গুডসের ইমপোর্ট আর এক্সপোর্টের ব্যবসা। In the year of 1986, সেবার আন্দামান থেকে ফিরে দিল্লিতেই পাকাপাকিভাবে রয়ে গেলাম। কলকাতায় কোনো ফিউচার নেই মি. দত্ত সুতরাং কলকাতায় থাকার সেরকম কোনো বাসনাও নেই। মাঝে মধ্যে ওই ব্যবসার কাজেই এখানে আসি আর কাজ শেষ হলে ফিরে যাই দিল্লিতে।’

যোগেশ্বরবাবুর কথার সঙ্গে একমত হতে পারল না সমুদা। সুতরাং সে বলল, ‘ফিউচার নেই, এই কথাটা ঠিক মানতে পারলাম না, মি. সমাদ্দার। প্রত্যেকের জীবনে, এই ফিউচার কথাটার ব্যাখ্যা কিন্তু আলাদা।’

সমুদার সঙ্গে যোগেশ্বরবাবুর তর্ক বেশ জমে উঠেছিল, দু-পক্ষই সমানভাবে নিজের যুক্তি দিয়ে একে-অপরকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। আর এর মাঝে আমি ও বনবিহারীবাবু, চুপ করে তাদের তর্কের লড়াই বেশ উপভোগ করছিলাম।

তর্কে কে জিতল বা কে হারল সেটা বড় কথা নয়। সেদিন দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়ে গেল, তার বিন্দুমাত্র টের পেলাম না। গ্রাম দেখে ফিরে, বাকিরাও ওই আড্ডায় আমাদের সঙ্গে সামিল হলেন এবং সন্ধ্যাবেলা চায়ে গলা ভিজিয়ে আমরা সবাই গেলাম সামনের মন্দিরে আরতি দেখতে।

ফিরে এসে দেখি বাড়ির ফিউস গেছে উড়ে, ফলে সারা বাড়ি তখন অন্ধকার। সঞ্জীববাবু ও নিখিলেশদা অবশ্য তড়িঘড়ি কিছু মোমবাতি ও হ্যারিকেনের ব্যবস্থা করল আর সেই দিয়েই আমাদের সময় কেটে গেল। ওনাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম বটে কিন্তু কারও চোখে ঘুম এল না।

সমুদা আমার আর বনবিহারীবাবুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘ঘুম না এলে সামনের বাগানে কি যাওয়া যেতে পারে?’

বনবিহারীবাবু বললেন, ‘Yes! নিশ্চয়ই। But সমুবাবু, আপনি ওই manটার সঙ্গে ওরকম হুট করে argument শুরু করে দিলেন why?’

সমুদা বলল, ‘আসলে আমি মি. সমাদ্দারকে একটু মেপে নিতে চাইছিলাম। তিনি যতটা দেখাতে চাইছিলেন, বাস্তবে তিনি ঠিক ততটা নন।’

আমরা কিছু বুঝতে পারছি না দেখে সুমদা আমাদের বুঝিয়ে বলল, ‘মি. সমাদ্দার, যদি প্রবাসী হন তাহলে তার কথা বলার ধরনে এরকম মুখোশধারী ভাব কখনো থাকত না। তিনি আদৌ কিছু করুন বা না করুন, তবে মাঝে মধ্যে ওই দু-একটা ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করে নিজেকে একজন প্রবাসী হিসাবে মেলে ধরতে চাইছেন।’

সমুদার কথা শেষ হওয়ার আগে আমি তাকে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘তুমি কি যোগেশ্বরবাবুকে সন্দেহ করছ?’

সমুদার উত্তর, ‘হ্যাঁ! সকালে সবার সামনে ঘড়ি দেখানোর সময় থেকেই আমার সন্দেহ তার উপর কারণ তিনিই একমাত্র লোক যিনি শুধু নিচের অংশটুকু দেখেই ছেড়ে দিলেন। ভালো করে যদি লক্ষ করা হয় তাহলে বোঝা যাবে, ঘড়ির নিচের অংশে যে চিহ্নটি রয়েছে সেটাই হলো এই ঘড়ির অন্যতম চিহ্ন, যা দেখে সহজেই বলা সম্ভব কোনটা আসল Waltham আর কোনটা নকল।’

‘আপনি signটা when see করলেন?’ সমুদাকে জিজ্ঞেস করলেন বনবিহারীবাবু।

সমুদা বলল, ‘আগেরবার এসেই আমি ওটা লক্ষ করেছিলাম এবং আমার বিশ্বাস যোগেশ্বরবাবুও এই ঘড়ির বিষয় অনেক কিছু জানেন। কারণ সামান্য ওই বিজ্ঞাপন পরে একজনের পক্ষে ঘড়ির খুঁটিনাটি জানা কখনোই সম্ভব নয়। এটা শুধু বিশ্বনাথবাবু আর যাদের এই ঘড়ির বিষয় জ্ঞান রয়েছে, তাদের পক্ষেই একমাত্র জানা সম্ভব। সুতরাং যোগেশ্বরবাবু কিছু করার আগেই তার আসল পরিচয় সমেত তাকে ধরতে হবে।’

তারপর আমরা বাগানে হাঁটতে নিচে নেমে এলাম এবং সেখানে ওই ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া চারিদিক একেবারে শুনশান। আমাদের বাগানে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে হাজির হলেন বিপিনবাবু।

বিপিনবাবুর আবার ধূমপানের একটা নেশা ছিল। তিনি মুখে সিগারেট নিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে এবং সমুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত রাতে এখানে কী করছেন মি. দত্ত?’

সমুদা তার দিকে ফিরে বলল, ‘গরমে ঘুম আসছে না, তাই বাগানে একটু হাঁটতে এলাম। আপনিও কি ঠিক একই কারণে এখানে?’

সিগারেটে এক টান দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার গভীর রাত না হলে ঘুম আসে না। তাই বাগানের দিকে এলাম কিন্তু আপনাদের এখানে আসা কি শুধুই নিলামে অংশগ্রহণ করতে নাকি বিষয়টা গোয়েন্দাগিরি?’

আমি আর বনবিহারীবাবু দুজনেই চমকে উঠলাম, বুঝতে পারছিলাম না তিনি কীভাবে আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা জানতে পারলেন। তবে, সমুদাকে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলাতে দেখলাম।

সে বলল, ‘গোয়েন্দাগিরি করার কি কোনো লক্ষণ আপনার চোখে পড়েছে?’

এবারে তিনি হেসে বললেন, ‘না! সেরকম কিছু চোখে পড়েনি ঠিকই, তবে একজন গোয়েন্দা যে এখানে দালাল হয়ে এসেছে, এই ব্যাপারটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না, মি. দত্ত। তার উপর আবার আপনার এই মক্কেল মানে মনোহরবাবু যেইভাবে ওই ঘড়ির সঙ্গে নিজের হাতের ঘড়ির পার্থক্য খুঁজছিলেন, তা দেখে এটা বলতেই হচ্ছে, একজন ঐতিহাসিক জিনিস সংগ্রহকারীর পক্ষে এই রকম আচরণ একেবারেই কাম্য নয়। সুতরাং আরও ভালো অভিনয় জানা এমন কাউকে আপনার আনা উচিত ছিল।’

সমুদার তখন তার কথা শুনে বলল, ‘আপনি যখন এতটাই সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের মতো করে বলতে পারলেন, তখন বাকিটাও বলে দিন।’

‘বাকি মানে গোয়েন্দাগিরির কারণ? হা-হা-হা।’ এই কথা বলে বিপিনবাবু হেসে উঠলেন এবং সিগারেটটা ফেলে ফিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বলে গেলেন, ‘এখানে সকলের আসার কারণ একটাই মি. দত্ত, Waltham ঘড়ি। সেই Waltham ঘড়ি।’

সেখানে রয়ে যাওয়া তিন ব্যক্তি অর্থাৎ আমরা তার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঘরে ফিরে এসে আমরা যে যার মতো শুয়ে পড়লাম।

রাত তখন প্রায় দুটো, বিশ্বনাথবাবুর ঘর থেকে ক্রমাগত আওয়াজ কানে আসছিল এবং সেই শুনে সমুদাকে দেখলাম একটা চাদর মুড়ি দিয়ে সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একবার ভাবলাম তাকে পিছু করি কিন্তু পরের মুহূর্তেই নিজের এই ভাবনাকে বদলে ফেললাম। সেটার কারণ অবশ্য একটাই, বনবিহারীবাবু তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন এবং ওনাকে সেই সময় ডেকে তোলা মানে সমুদার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা সুতরাং আমি আর বনবিহারীবাবু ঘরের মধ্যেই রয়ে গেলাম।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর সমুদা ফিরে এল এবং আমাকে জেগে থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখনও জেগে?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ! তোমার বেরোনোর পর থেকেই আমি জেগে রয়েছি। তুমি কোথায় গিয়েছিলে সমুদা?’

সমুদা গায়ের উপর থেকে ওই চাদরটা সরিয়ে বলল, ‘বিশ্বনাথবাবুর ঘরে অনেক কিছুই ঘটে গেছে রে বঙ্কু, তবে সব কিছু এখনই বলব না। একটু ধৈর্য ধর, আগামীকাল সকালেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

আমি উত্তেজনার বশে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সব পরিষ্কার মানে? তুমি কী বলতে চাইছ?’

এর উত্তরে সমুদা শুধু বলল, ‘সকালটা হতে দে সব উত্তর পেয়ে যাবি, এখন ঘুমা।’

সমুদার কথা মেনে আমি বনবিহারীবাবুর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম এবং সকাল হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

পরদিন সকাল হতেই আমরা নিচে নেমে এসে সঞ্জীববাবুকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম এবং একইসঙ্গে আমরা সবাই এসে উপস্থিত হলাম বিশ্বনাথবাবুর ঘরে।

বিশ্বনাথবাবু সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার কথা মেনে এই বাড়িতে একটা রাত কাটানোর জন্য আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ। আশা করি কারও অসুবিধা হয়নি। তবে আমি দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, এই ঘড়ি আমি কোনোদিনও বিক্রি করব না। এটা সম্পূর্ণ সমরেশবাবুর একটা প্ল্যান যার মারফত উনি আসল অপরাধীকে ধরতে চাইছিলেন, যিনি চিঠির মাধ্যমে আমায় বিগত কিছু মাস ধরে খুনের হুমকি দিয়ে আসছে আর সেটা ওই ঘড়ির জন্যই।’

ওনার কথা শুনে সেই তিনজন খুব রেগে গেলেন এবং তাদের মধ্যে থেকে দুলালবাবু তো বলেই বসলেন, ‘আপনার কাছে এই ছলনাটা আমরা আশা করিনি, বিশ্বনাথবাবু। আমরা অত দূর থেকে ছুটে এসেছি শুধু এই নিলামে অংশগ্রহণ করতে, কোনো নাটকে অংশ নিতে নয়।’

তার দেখাদেখি যোগেশ্বরবাবু, যিনি জামার বদলে গায়ে চাদর চাপিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও বলে উঠলেন, ‘আসল অপরাধী কি আমরা নাকি? এইভাবে আমাদের সময় নষ্ট করার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। ইউ অল আর জাস্ট চিট।’

এখানে বলতেই হচ্ছে বিপিনবাবুর কথা, তিনি এতকিছু ঘটছে দেখেও মুখ থেকে একটা টু শব্দও করলেন না। তার হাবভাব যেন বড়ই সন্দেহজনক ঠেকল আমার।

তবে, সমুদা ওই দুজনের কথার উত্তর দেওয়ার আগে নিখিলেশদা-কে ওই ঘরে ডেকে পাঠাল।

নিখিলেশদা ঘরে আসতেই সমুদা তার উদ্দেশ্যে বলল, ‘নিখিলেশ, তুমি কাল রাতে এই ঘরে কেন ঢুকেছিল বলতে পারবে?’

সে কী বলবে বুঝতে না পেরে সমুদার দিকে একবার চেয়ে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সেখানে উপস্থিত সবাই তখন সমুদার কাছে পুরো বিষয়টা জানার ইচ্ছা প্রকাশ করল আর সমুদাও সকলকে জানাল যে নিখিলেশদা গতকাল রাতে এই ঘরে ঘড়িটা চুরি করতে ঢুকেছিল।

বিশ্বনাথবাবু সেই কথা শোনা মাত্রই বলে উঠলেন, ‘কিন্তু কেন ও এই কাজ করবে মি. দত্ত?’

সমুদা ওনার কাছে গিয়ে বলল, ‘আপনার সেই সন্দেহ তালিকার প্রথমজন অর্থাৎ রাজেন গুহর ছেলে হলো এই নিখিলেশ ওরফে নিখিলেশ গুহ। সে এখানে এসেছিল তার বাবার হয়ে, এই Waltham ঘড়িটা আপনার থেকে নিয়ে যেতে আর সেই জন্য নিখিলেশ কিছু মাস আগে সঞ্জীববাবুর সঙ্গে দেখা করে তার মন জয় করে এখানে চলে আসে। কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়। নিখিলেশ, ওর পরিকল্পনা বদলায় যখন সে বুঝল যে আপনি ওর বাবাকে ঠকিয়ে এই ঘড়ি কেনেননি। ও বরাবর জেনে এসেছিল যে আপনি রাজেনবাবুকে ঠকিয়ে এই ঘড়ি হাতিয়ে ছিলেন। তবে, আমাকে দেখে এবং আমাদের এই প্ল্যানটার কিছুটা আভাস পেয়ে, নিখিলেশ ঠিক করে ঘড়িটা চুরি করে সে পালিয়ে যাবে, যাতে ওই ঘড়ি অন্য কারও হাতে না যেতে পারে। গতকাল রাতে তাই নিখিলেশ আপনার ঘরে ঢোকে।’

সমুদার কথা শেষ হতেই নিখিলেশদা বলে উঠল, ‘সমরেশবাবু, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি নিজের সব দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি। বাবার মৃত্যুর পর আমি কলকাতায় এসে ওষুধের কারখানায় কাজ নিই এবং সেখানে থাকাকালীন খবরের কাগজে ওই আর্টিকেলটা দেখার পর, এই পরিবারের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে শুরু করি। তারপর একদিন সঞ্জীবদার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় আর তার দেওয়া প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে এখানে চলে আসি। হতে পারে ঘড়ির টানে কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারলাম জেঠুর কোনো অন্যায় ছিল না। তবে, নিলামের কথা শুনে আমি ঘড়িটা নিয়ে পালাতে চেয়েছিলাম আর তাই জেঠুর ঘরে গতকাল রাতে চুরি করতে এসেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন সমরেশবাবু, ওই ঘড়ি আমি নিইনি। গতকাল রাতে ওই সময় আরও দুজন লোক এই ঘরে ঢুকেছিল।’

নিখিলেশদার কথা শুনে সঞ্জীববাবু ওই দেরাজের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন, তখনও দেরাজে চাবি ঝুলছে এবং কালো বাক্সটা মাটিতে পড়ে। তিনি ওই বাক্স খুলতেই দেখলেন ঘড়িটা আর তাতে নেই।

সঞ্জীববাবু তৎক্ষণাৎ তার বাবাকে সেই ব্যাপারে জানালেন এবং সেই শুনে বিশ্বনাথবাবু বললেন, ‘সকাল থেকে দেরাজ খোলা আর ঘরে এত লোক থাকতেও কারও চোখে পড়ল না? মি. দত্ত, আপনি থাকতেও এমনটা ঘটল? সবই আমার দোষ, কেন যে কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেলাম! এর জন্যই আজ এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল।’

সমুদা ওনাকে বুঝিয়ে শান্ত করল ঠিকই কিন্তু এর মাঝেই যোগেশ্বরবাবু বলে উঠলেন, ‘আপনাদের এই নাটক আর কতক্ষণ চলবে মি. দত্ত? বিশ্বনাথবাবু, আপনি আপনার অপরাধীকে বাড়ির মধ্যেই খুঁজে পেলেন সুতরাং আমাদের আর সময় নষ্ট না করে এবার ফিরে যেতে দিন।’

যোগেশ্বরবাবুর দিকে তাকিয়ে এবার সমুদা বলল, ‘এত ফিরে যাওয়ার তাড়া কেন আপনার? আগে এই গরমে চাদর গায়ে দেওয়ার আসল কারণটা সবাইকে জানান, তারপর নয় ফিরে যাবেন।’

সমুদার অপর চটে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন মি. দত্ত?’

সমুদা একটু হেসে বলল, ‘ওই আপনি যেটা গোপন করতে চাইছেন, সেটাই আমি বলতে চাইছি। এবার চাদরটা সরিয়ে সবাইকে বলুন, কেন আপনি বিশ্বনাথবাবুর ঘরে গতকাল রাতে এসেছিলেন আর কেনইবা অন্য আরেকজনের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে নিজের পিঠ ঘায়েল করলেন। আঘাত লাগা জায়গাটা গোপন করতেই আপনার নিশ্চয়ই এই চাদর ব্যবহার করা?’

সমুদার কথা শুনে বিশ্বনাথবাবু অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মি. দত্ত, যোগেশ্বরবাবুও কি চুরি করতে এসেছিলেন?’

এর উত্তরে সমুদা যা বলল তা আমাদের সকলকে আরও চমকে দিল। সমুদা বলল, ‘বিশ্বনাথবাবু, আপনার সেই জগু গুণ্ডাই হলো এই যোগেশ্বর সমাদ্দার। নিজের ভোল পালটালেও, তার স্বভাব তিনি একেবারেই পরিবর্তন করতে পারেননি। মি. সমাদ্দার ওরফে জগু ভেবেছিলেন দু-চার লাইন ইংরাজি বলে নিজেকে প্রবাসী দেখাতে সহজ হবে কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার চোখ এড়াতে পারেনি আর তাই আজ সে আমার কাছে ধরা পড়েই গেল।’

বিশ্বনাথবাবুসহ আমরা এই পুরো ঘটনাটা ভালো করে জানতে চাওয়ায়, সমুদা পুরো ঘটনাটা বিস্তরভাবে বলল, ‘মি. সমাদ্দার, হয়তো ফরেন গুডসের ইমপোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা করেন ঠিকই। তবে, সেটা দিল্লি নয় আমাদের কলকাতাতেই করেন এবং সেই আর্টিকেল পড়ে তিনি ঠিক করেন বিশ্বনাথবাবুকে চিঠির দ্বারা খুনের ভয় দেখিয়ে ওই ঘড়ি হাতাবেন। পরে অবশ্য বিজ্ঞাপন পড়ে তিনি এখানে ছদ্মবেশে চলে এলেন কিন্তু এটা যে একটা ফাঁদ, তা তিনি একদমই বুঝতে পারেননি। পরে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে, গতরাতে তিনি এই ঘরে চলে এলেন ঘড়িটা চুরি করতে আর ঠিক তখনই আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে তার আঘাত লাগে আর তাই তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান।’

এবার দেখলাম এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকা বিপিনবাবু নিজের মুখ খোলেন। তিনি সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি তখন থেকে যে আরেকজন আরেকজন করছেন, তা সেই আরেকজন কে, মি. দত্ত?’

সমুদা কিছু বলার আগে যোগেশ্বরবাবু অর্থাৎ জগু গুণ্ডা বলে উঠল, ‘আমি নিজের সব দোষ মেনে নিচ্ছি মি. দত্ত কিন্তু বিশ্বাস করুন সেই ঘড়ি আমার কাছেও নেই। ওই তৃতীয়জন যে ঘরে ঢুকেছিল তার কাছেই ওই ঘড়ি আছে।’

‘সেই তৃতীয়জন কে, মি. দত্ত?’ দুলালবাবুও সমুদাকে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।

সমুদা সঞ্জীববাবুর দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনি বলবেন নাকি আমি বলব?’

‘আমিই বলছি, সমরেশবাবু।’ এই বলে সঞ্জীববাবু তখন আরেক ঘটনার কথা বলে সবাইকে আবারও অবাক করে দিলেন।

তিনি বললেন, ‘সমরেশবাবু, আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে রাতের অন্ধকারে ঘড়ি চুরি করার ঘটনা ঘটতে পারে সুতরাং তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন বাবার ঘরে সর্বদা নজর রাখতে। একইসঙ্গে তিনি এটাও বলেছিলেন যদি আমি কাউকে তার ঘরে ঢুকতে দেখি, তাহলে আমিও যেন তাদের মধ্যে সামিল হয়ে যাই এবং ওই একই কাজ করার নাটক করি যাতে তারা ধন্দে পড়ে যায়। আমি সমরেশবাবুর কথা মতোই কাজ করলাম। প্রথমে দেখি, যোগেশ্বরবাবু চাদর মুড়ি দিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে তার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করে দেরাজ খোলার চেষ্টা করছেন। ওই মুহূর্তে আমি সেখানে চলে আসায়, আমাদের দুজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় এবং সামনে রাখা একটা লাঠি দিয়ে আমি তার পিঠে দু-তিনবার আঘাত করতেই তিনি চেঁচাতে না পেরে দৌড়ে পালিয়ে যান। তবে, এর মাঝেই নিখিলেশ ঘরে এসে ঢুকেছিল কিন্তু আমাদের ধাক্কাধাক্কি করতে দেখে, সে ঘড়ি নেওয়ার আর সাহস দেখায়নি। ও সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।’

একটু থেমে সঞ্জীববাবু তার বাবার কাছে গিয়ে ওই ঘড়ি ওনার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘বাবা তারপর সমরেশবাবু এসে যাওয়ায়, আমরা দেরাজ থেকে ঘড়িটা বের করে দেরাজটা ওইভাবেই রেখে দিই এবং যে যার ঘরে ফিরে যাই।’

সঞ্জীববাবুর কথা শুনে আমি আর বনবিহারীবাবু দুজনেই সমুদার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমাদের মুখ থেকে তখন একটা বাক্যও বের হলো না। আমি শুধু ভাবছিলাম এতকিছু ঘটে গেল আর আমরা বিন্দুমাত্র তার টের পেলাম না। সত্যি বলতে, ওই সময় সমুদার ঘর থেকে বেরোনোর পেছনে যে এইরূপ পরিকল্পনা থাকবে তা আমার বোঝার সাধ্যি ছিল না। সেটা ছিল না বলেই হয়তো আমি তার মতো কোনোদিনই হতে পারব না। এই সাধ্যি একমাত্র তারই রয়েছে, তাই সে গোয়েন্দা সমরেশ দত্ত।

সেখানে উপস্থিত সকলের সামনে বিশ্বনাথবাবু সমুদাকে বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আপনার কাজকে ছোট করব না মি. দত্ত। তাই ঈশ্বরের কাছে এইটুকুই প্রার্থনা করি যাতে আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান এবং সাহসী গোয়েন্দা, এইভাবে সফলতার সঙ্গে জীবনে যেন আরও এগিয়ে যেতে পারে।’

সমুদা একটু হাসলেন বটে, তবে তার ওই হাসির মধ্যে আমি খুঁজে পেলাম সেই আনন্দ, যেটা আর কেউ লক্ষ করল না। সেই আনন্দ ছিল নিজের উপর থাকা অগাধ আস্থা এবং ভরসার, যার যে সঠিক মর্যাদা দিতে পেরেছিল। সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে সমুদা আবারও নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হলো।

সেদিন ওই ঘটনার পর বিশ্বনাথবাবু ওই দুজন অপরাধীদেকে পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে বরং ছেড়ে দিলেন। উনি যোগেশ্বরবাবুকে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললেন এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়েও গেলেন মাথা নিচু করে। তবে, নিখিলেশদার ক্ষেত্রে বিশ্বনাথবাবু ওই একই কথা বললেও, সমুদা এবং সঞ্জীববাবুর অনুরোধে উনি শেষমেশ নিজের মত পালটাতে বাধ্য হলেন।

আমরা তারপর সবাই মিলে সঞ্জীববাবুর জন্মদিন পালন করলাম। বিপিনবাবু ও দুলালবাবু দুজনেই আমাদের সঙ্গে সেখানে রয়ে গেলেন এবং দুপুরে খেয়ে উঠে, আমরা যে যার মতো বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ওইদিন ফেরার পথে বনবিহারীবাবু সমুদাকে নিখিলেশদার বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা! সমুবাবু, আপনি how understand করলেন যে নিখিলেশই রাজেন গুহর son?’

উত্তরে সমুদা বলেছিল, ‘রাতে বিশ্বনাথবুর ঘরে ঢোকার মুহূর্তে, দরজার বাইরের মেঝেতে পড়ে থাকা একটা কার্ডের ওপর আমার চোখ পড়েছিল। সেই কার্ডটা হাতে তুলতেই বুঝতে পারলাম ওটা একটা ভোটার কার্ড এবং সেটা অবশ্যই নিখিলেশ গুহর। আমার অনুমান, গত রাতে অন্ধকারের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে বিশ্বনাথবাবুর ঘরে ঢুকতে গিয়ে ওই কার্ড ওর ব্যাগ থেকে পড়ে যায়। আর সেই ভোটার কার্ডে পিতার নামের জায়গায় রাজেন গুহর নাম দেখার পর, আমার কাছে পুরো বিষয়টা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ওর আসল উদ্দেশ্যটা জানতে আর আমার বেশি সময় লাগল না, খুব সহজেই ব্যাপারটা ধরে ফেললাম।’

‘তাহলে বিপিনবাবু কি ভালো লোক ছিল?’ সমুদাকে আমি প্রশ্ন করলাম।

সেই উত্তরে সমুদা বলল, ‘খারাপ লোক তাকে বলা যাবে না কিন্তু তিনি খুবই চতুর। কম কথা বললেও তিনি সর্বদা আমাদের উপর নজর রাখছিলেন, তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে দুলালবাবু আর তিনি এসেছিলেন শুধু নিলামে অংশগ্রহণ করতে।’

সমুদার কথা শেষ হতেই বনবিহারীবাবু বললেন, ‘Very clever man ওই বিপিন ভদ্র। সকলের মধ্যে only সে আমায় recognise করতে পেরেছিল। নাহলে আমার acting-এ তো বাকিরা পুরো মাত হয়ে গিয়েছিল।’

আমি আর সমুদা ওনার কথা শুনে আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না, হেসেই ফেললাম দুজনে। আর এর সঙ্গেই সমুদার আরেক রোমাঞ্চকর তদন্তের সমাপ্তি ঘটল। আমরা বাড়ি ফিরে এলাম ঠিকই কিন্তু আগামীদিনে আরও নতুন কোনো রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করলাম।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নূতন প্রেমে ভোর

Read Next

জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *