
প্রযুক্তি উন্নয়নের এ যুগে শারীরিক শ্রম বিবর্জিত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং নগরজীবনের কৃত্রিমতা মানুষের জন্য উপকার বয়ে এনেছে নাকি ক্ষতির কারণ হয়েছে তা ভাবার দরকার আছে। আমার কাছে মনে হয় এ বিষয়টাতে সচেতন নাগরিক মাত্রই দৃষ্টি দেওয়া উচিত। কিন্তু তার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। উল্টো রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, আইন ও বিচারব্যবস্থা সংস্কার, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, সংবিধান সংশোধন এসব নিয়ে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। হলোইবা এসব সংস্কার। তাতে কি দুর্নীতি কমে যাবে? রাজনীতিবিদরা সবাই সাধু সন্ত হয়ে যাবে? আমলারা সবাই চাকুরের বদলে সেবক হয়ে যাবে? ব্যবসায়ীরা নির্লোভ ও ত্যাগী হয়ে যাবে?
প্রশ্নটা রেখে আমি নিজামের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আশা করছিলাম। কিন্তু নিজাম কোনো উত্তর দিল না। কেবল মাথা দোলাল। তাতে প্রসঙ্গটির সঙ্গে একমত নাকি দ্বিমত কিছুই বোঝা গেল না। উত্তর না পেয়ে আমি সরাসরি আমার মতামত ব্যক্ত করলাম।
আমার তো মনে হয় না এসবের কোনো পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশ কি গ্লোবাল সিস্টেমের বাইরে? আমাদের কি গ্লোবাল সিস্টেমের বাইরে যাওয়া সম্ভব? আজকের পুরো বিশ্বব্যবস্থাটা দাঁড়িয়ে আছে সীমাহীন বৈষম্যের ওপর। আমরা বৈষম্যবিরোধী বলে নিজেদের তুলে ধরছি। সেটা বলাই যায়, রাজনীতিতে ভালো কথার ফুলঝুড়ি থাকে। সব রাজনৈতিক দলের ম্যানোফেস্টো পড়লে মনে হবে হ্যাঁ এটাই তো ভালো। কোনোটাই খারাপ মনে হবে না। শুধু রাজনৈতিক দল কেন? আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের কথায় বলি, সেখানে নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে যেসব কথা বলা আছে তা মানলে এটা তো বেহেস্ত মনে হবে। কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি, হয় না। পৃথিবীতে মানুষ কর্তৃক মানুষ নিগ্রহের বিরুদ্ধে সব ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। বলেছেন শুধু নয়, অপকর্ম না করার জন্য বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন, স্রষ্টার ভয় দেখিয়েছেন। পরকালে চরম শাস্তি ও জান্নাত লাভ করার কথা বলেছেন। তাতে কী হয়েছে? মানুষ তা মেনেছে? যদি মানত তাহলে তো পৃথিবীতে মানুষ কর্তৃক মানুষ নিগ্রহের এই প্রথা কয়েক হাজার বছর আগে উঠে গিয়ে এক সৌভ্রাতৃত্বের স্বর্গ রচনা হতো। তা হয়নি বরং শোষণ নিপীড়ন পূর্বের তুলনায় আরও বেড়েছে। প্রত্যক্ষ শোষণ-নিপীড়নের বিপরীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে সীমাহীনভাবে। এখনকার সময়ে যুদ্ধ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও মারণাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে।
আমি আরও বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, এসব কেন হচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন?
তোমাকে ধন্যবাদ প্রশ্নটি করার জন্যে। অন্যরা হয়তো এর অনেক রাজনৈতিক ব্যাখা দেবে। আমি বিষয়টা ভিন্ন দিক থেকে দেখি। অনেকেই আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারে।
অসুবিধা নেই। আমি আপনার মতামতটা শুনতে চাচ্ছি।
ঠিক আছে, তবে শোনো। আমি মনে করি, রাজনীতি বাইরের ব্যাপার ভেতরের ব্যাপার হলো মানুষের জৈবিক দাস্যবৃত্তি। অর্থাৎ আমরা তো প্রাণী; প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীর মতোই। সব প্রাণীরই জৈব প্রবৃত্তি রয়েছে। আমাদেরও আছে। যেগুলোকে আমরা চিহ্নিত করেছি ষড়ঋপু নামে। যেমন⸺কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। মানুষ এসব রিপু দ্বারা তাড়িত এবং এসবের দাস। অনেক সমাজ ব্যবস্থা এসেছে ধ্বংস হয়েছে তবু মানুষ তার ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মানবসমাজের অগ্রগতির এক পর্যায়ে প্রাচীন কৌম সমাজ ভেঙে গেছে। যৌথতাকে নষ্ট করে দিয়েছে আজকের উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা। প্রযুক্তি যতই দুর্বল ছিল ততই যৌথতা দৃঢ় ছিল। মানুষ বেশি বেশি প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট ছিল। সাধারণের মাঝে লোভ ও আত্মস্বার্থপরতার প্রবণতা কম ছিল।
নিজাম আমার এই সাধারণের মাঝে কথাটায় আপত্তি জানাল। আপনি সাধারণ বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন? এতক্ষণ বলছিলেন মানুষ। মানুষকে তো ভাগ করে ফেললেন জহির ভাই।
হ্যাঁ। মানুষ এটা সামগ্রিক অর্থে। কিন্তু মানুষের শ্রেণি বা পেশাগত বিভাজন আছে। তার মধ্যে শাসক ও শাসিতের বিষয় আছে।
তাহলে আপনি বলতে চান লোভ বা স্বার্থপরতা শাসকদের আছে শাসিতের নাই? নিজাম পাল্টা প্রশ্ন করল।
না। আমি তা বলছি না। এসব সব মানুষের আছে। কিন্তু তোমার আমার লোভ থাকলেও তোমার যেহেতু রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই, তাতে তুমি অন্যের ওপর জোর বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অন্যের দেশ দখল করতে পারবে না। যদি তোমাকে ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তোমার লোভ ও স্বার্থপরতা অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
নিজাম পাল্টা প্রশ্ন রাখে, তাহলে আপনার বক্তব্যে দাঁড়াচ্ছে; রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকবে তাদের স্বার্থপরতা আর লোভ থাকতে পারবে না?
না। পারবে না। যদি থাকে তাহলে তার দ্বারা মানুষের কল্যাণ হবে না। সে হয়ে উঠবে মানুষের ক্ষতির কারণ।
আপনার বক্তব্যে তো আমি আরেক ধরনের বৈষম্যের গন্ধ পাচ্ছি। নিজাম চেয়ার ছেড়ে উঠে ফ্লোরে এসে বসল। আমিও তার মুখোমুখি হয়ে নিচে এসে বসলাম। আবহাওয়াটা বেশ স্যাঁতসেঁতে। ঘাম হচ্ছে। ভাদ্রমাসের গরম। যদিও এবার বন্যা হয়ে গেল ফেনী নোয়াখালি কুমিল্লায়। প্রচুর মানুষ পানিবন্দি এখনো। বৃষ্টি মনে হচ্ছে আরও বেশ কয়দিন হবে। বৃষ্টিটা না হোক সেটাই চাচ্ছি। এর মধ্যে আমার স্ত্রী শিউলী আমাদের জন্য চা-নাস্তা নিয়ে এল।
এখানে নিচেই রাখো। তুমিও বসো। আমি শিউলিকে বসতে বললাম।
বসছি। পানিটা নিয়ে আসি।
নিজাম উঠে গিয়ে ওয়াশরুমে গেল। তার সঙ্গে আমার পরিচয় লেখালেখি সূত্রে। ও মূলত কবি। ভালো লেখে। পড়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। রাজনীতি ও সমাজসচেতন লেখক। এডওয়ার্থ সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্ব দ্বারা বেশ প্রভাবিত। ফলে ঔপনিবেশিক আর্থ-রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিষয়ে তার শ্যেন দৃষ্টি ও সমালোচনা আছে। যেকোনো ভাবনা তার সঙ্গে শেয়ার করে আমি আত্মোপলব্ধির সুযোগ পাই। প্রায় আড্ডা হয় আমাদের। নিজাম একটা উন্নয়ন সংস্থায় আইটি অফিসার হিসেবে কাজ করে। বাংলার ছাত্র আইটি জব কীভাবে জানতে চাইলে হেসে উত্তর দেয়⸺ভাই দেশে সাহিত্যের বেল নাই। পেট চালানোর জন্য কত কী করতে হয়।
আমি আইটির ওপর ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তার সরল স্বীকারোক্তি মানুষকে কাছে টানে। আমিও সেই টানে তার নিকটজন হয়ে উঠি। খুবই সাদামাটা স্বাস্থ্য চেহারা। উচ্চতা মাঝারি। মাথায় ত্রিশ না পেরোতেই টাক পড়ে গেছে। এখন এই চল্লিশে এসে চুলের আর অবশিষ্ট নেই। তাই একটা মাও ক্যাপ সর্বক্ষণ তার মাথায় থাকে। এটা তার ব্রান্ডিং হয়ে গেছে বলা যায়। ইদানীং ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখায় একটু ম্যাচিউর দেখায়। জিঞ্জ আর শার্টই তার পোশাক। কাঁধে একটা অফিস ব্যাগ। একসময় সাইকেল চালাত। এখন হাঁটার প্রয়োজনে সাইকেলটা বাদ করেছে। দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার। থাকে আদাবরে ছয়তলা বাড়ির চারতলায়। সংসার আর সৃষ্টিশীলতার দোটানায় জীবনটা এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে। মার্জিনালাইড করতে না পারার আক্ষেপ তার রয়েই গেল। সৃজনশীলতায় একাগ্র হওয়ার উদগ্র বাসনা থাকলেও তা হয়ে উঠছে না। তাই আড্ডায় যেন তার স্বস্তি ও প্রশান্তি। আমি তার অংশী।
নিজাম ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল। শিউলিও পানির একটি বোতল ও তিনটি গ্লাস নিয়ে এসে যোগ দিল। নাস্তার আয়োজন দেখে নিজাম উচ্চকিত। বাহ্, এত চমৎকার সব খাবার। ভাবি, আমি পায়েশটা আগে নেব।
নাও নাও। শিউলি বাটিতে তুলে দিল। নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে নিজাম কথাটায় আবার ফিরে গেল। ভাবি, আপনি তো এতক্ষণ ছিলেন না। অনেককিছুই আপনি শোনেন নাই।
না। না। আমি সব শুনেছি।
না শোনার কথাও নয়। ড্রয়িং-ডাইনিং লাগোয়া আর কিচেন পাশাপাশি হওয়ায় সবই শোনা যায়। মাত্র আটশ স্কয়ারের দুই বেডের ফ্ল্যাট। ভাড়া আছি প্রায় এক যুগ হলো। এক ফ্লোরে পাশাপাশি চারটি ফ্ল্যাট। চার ভাড়াটিয়া পাশাপাশি থাকলেও কারও সঙ্গে কারও পরিচয় কিংবা যাওয়া-আসা নেই। বাইরে সিঁড়িতে দেখা হলে কখনো সখনো কেমন আছেন? এরকম বাক্য বিনিময়ে সীমাবদ্ধ। বাড়িওয়ালার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে নাই। বাড়িওয়ালারা চায়ও না কারণ তাতে তার ভেতরের মানবিক মানুষটা নড়ে যেতে পারে। যেটা শোষণকে না বলে। তার সঙ্গে শুধু ভাড়া দেওয়ার সময় দু-চার কথা হয়। বাইরে বাজারে দোকানে লোকজনের সঙ্গে প্রয়োজনে কথাবার্তা হয়। এরকম চেনাজানা প্রয়োজন মেপেই আমাদের শহুরে সমাজ অথচ গ্রামে যখন বড় হয়েছি চিত্রটা ঠিক উল্টো। তারা ছিল আমাদের আত্মীয়। বিচ্ছিন্নতাই কি সভ্যতার নাম?
আপনি কিছু ভাবছেন মনে হয়? নিজাম আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন রাখল।
হ্যাঁ। ভাবছি, বিচ্ছিন্নতাই কি সভ্যতার নাম?
হঠাৎ আপনার এ প্রশ্ন মাথায় এল কেন?
হঠাৎ নয়, প্রায় সময় এ প্রশ্নটা আমার মধ্যে আসে। তোমরা তো সত্তরের দশক দেখোনি। আমরা সত্তরের দশকে কিশোর ছিলাম। তখন আজকের যে নাগরিক সমাজ দেখছ তা ছিল না। শহরগুলোতেও ছিল গ্রামীণ জীবনের প্রভাব। মানুষ ছিল কম। এখন তো গ্রামের ইউনিয়ন কিংবা থানা পর্যায়ে পৌরসভা তৈরি হয়েছে। নগরসভ্যতা গ্রামীণ জীবনে ঢুকে গেছে। সেখানেও কারও সঙ্গে কারও সখ্য নেই। একটা জটিল বিন্যাস লক্ষ করা যাচ্ছে। মানুষের খাওয়া-পরার সংস্থান হচ্ছে। কেউ না খেয়ে নেই। সবাই কাজ করছে। কিছু না কিছু করে অর্থ উপার্জন করছে। সবাই শহরমুখী হয়েছে। বেশির ভাগ পরিবারের কেউ না কেউ শহরে থাকছে। সেখান থেকে আয় করে গ্রামে পাঠাচ্ছে। কৃষি কাজ এখন মধ্যবিত্তরা পুরোপুরি ত্যাগ করেছে। শুধু তাই নয়, শ্রমজীবীরাও কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে এসে শ্রমিক হচ্ছে। এটাকে অনেকে ভালো বলবে। আমি তা বলতে পারছি না।
তার মানে আপনি চাইছেন মানুষ গ্রামেই থাকুক। যুগ যুগ তো মানুষ গ্রামেই ছিল। আপনি কি বলবেন তারা ভালো ছিল? আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নেওয়া তার একটা অভ্যেস। আমারও আপত্তি নেই তাতে।
বললাম, এটা এক কথায় উত্তর দেওয়ার বিষয় নয়। সে সমাজটা তো সুদীর্ঘকাল টিকেছিল। কেন টিকেছিল তার ভেতরের ভালো দিকগুলোর ওপর আমাদের দৃষ্টি ফেলতে হবে। এখন সেই মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হওয়ার পেছনের কারণগুলো কী সেটাও ভাবতে হবে। শহরে এসে সে যে খুব সুখে থাকছে তাও তো নয়। উল্টো খাটুনির বাধ্যবাধকতার ভেতর এমন ভাবে আটকে যাচ্ছে যা থেকে মুক্ত হতে চাইলেও সে মুক্ত হতে পারছে না। আবার গ্রামেও ফিরে যেতে পারছে না। এক অদৃশ্য শিকলের ভেতর সে আটকা পড়ে যাচ্ছে। তোমার আমার কথাই ধরো। আমরা ঢাকা ছাড়তে চাই কিন্তু পারছি না। আমরা যে কাজটা জানি বা পারি সেটার প্রয়োজন ওখানে নেই। ফলে আমরাও সিস্টেমের দাসে পরিণত হয়ে গেছি।
এটা তো মেনে নিতে হবে। এটা হচ্ছে সময়ের সঙ্গে আপস। আপনি চাইলেও পেছনে যেতে পারবেন না। আপনাকে সামনের দিকেই এগুতে হবে।
তোমার ভাই কী চাচ্ছে? তার বক্তব্যটা কী? পৃথিবীটা চলে একদিকে তোমার ভাই চলতে চায় ঠিক উল্টো দিকে। তুমি তো একটু পরে চলে যাবে। তার মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরঘুর করবে। আমাকে প্রশ্ন করবে। ঘুমাতে দেবে না। দুনিয়ার সব দায় যেন তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। কিছুদিন পর দেখবা তোমার ভাইকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে। লেখকদের সঙ্গে সংসার করার যে কী প্যারা এটা কাউকে বোঝানো যাবে না। শিউলি কথাটা বলে যেন স্বস্তি পেল। কাউকে আমার সম্পর্কে বলতে পারলে একটু আরাম বোধ করে। আমি চুপ রইলাম।
নিজাম মুচকি হেসে উত্তর দেয়⸺ভালো তো। আপনি তো শোনেন, আমার বউয়ের সঙ্গে তো এসব প্রশ্ন করতেই পারব না। এসবের উত্তর দূরে থাক বুঝবেই না। আমার মাথায় কিছু ঘুরপাক করলেই জহির ভাইকে ফোন করি নতুবা আপনাদের বাসায় সরাসরি এসে আড্ডা দিয়ে যাই। আজও অফিস থেকে বের হয়ে চলে আসছি। আজ অবশ্য ভাই ফোন দিছে।
আচ্ছা ভাবি যেটা বলছিলেন, ভাই আমি ঐ প্রশ্নটার উত্তর চাচ্ছি?
কোনটা?
শিউলী উত্তর দেয়। তুমি কী চাচ্ছ সেটা।
ও। আমি একটু নড়েচড়ে বসে বলতে শুরু করলাম⸺আমার ভাবনাটা খুব পরিষ্কার তা বলব না। আরও গভীরভাবে ভাবার আছে। অর্থাৎ যে কারণে তারা জন্মস্থান ছেড়ে, স্বজনদের ছেড়ে, প্রকৃতি ও পরিবেশের মায়া ছেড়ে শহরে আসছে⸺সে উপায়গুলো যদি গ্রামীণ ব্যবস্থাপনায় স্থাপন করা যায় তাহলে তো তার আর শহরে এসে থাকতে হয় না। নাগরিক সুবিধাগুলো গ্রামীণ পরিবেশকে টিকিয়ে রেখে আরও সুন্দর করে তোলা যায়।
ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা চীন-জাপানকে অনুসরণ করার তো দরকার নাই। কারণ সেখানের মানবিক বিপর্যয়টা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেখানে মানুষের জন্য মানুষ এগিয়ে আসে না, রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। আমরা রাষ্ট্রকে কেন মানুষের সবকিছুর ব্যাপারে খবরদারি করার অধিকার দেব? আমাদের তো গ্রামীণ সমাজ ছিল। সেখানে একজনের বিপদে দশজন এগিয়ে আসত। রাষ্ট্রের দরকার হতো না। যেখানে রাষ্ট্র যত বেশি শক্তিশালী হয়েছে সেখানেই রাষ্ট্রের মাধ্যমে শাসক শ্রেণি তত বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এবং সেই মানুষগুলো দানবে পরিণত হয়েছে। তারা পররাজ্য গ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সমরাস্ত্র উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। যুদ্ধই হয়ে উঠেছে তাদের অহং, গৌরব ও আত্মমর্যাদার বিষয়। এটাকে আমরা সাপোর্ট করব কেন? তাদের অনুসরণ করা মানে তো আমরাও তাদের মতো দানবে পরিণত হওয়া। আমরা তো তা চাই না।
আমরা চাই না, পারিবারিক কাঠামো ভেঙে যাক। যৌথতা ভেঙে যাক। মা-বাবা থেকে সন্তানরা আলাদা হয়ে যাক। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশির সঙ্গে সম্পর্কগুলো ভেঙে যাক। গ্রামীণ উৎসব পার্বণগুলোয় সবার সঙ্গে সবার যে আত্মিক মেলামেশা এসব না থাকুক। এগুলোর সুরক্ষা করার মতো ব্যবস্থাপনায় আমি চাই। এটা কি অসম্ভব?
হা হা করে হেসে উঠলো নিজাম। আপনার এ প্রশ্নের উত্তরও এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। আরেকদিন হবে। আজ উঠতে হবে। বউ অলরেডি দুইবার কল দিয়েছে। আমিও একটু ভাবি, ভাবি আপনিও চিন্তা করেন। কারণ ভাই যে সমাজ চিন্তা করছে তা করতে গেলে একটা রূপান্তর দরকার আপাত এটা বুঝতে পারছি। সেটা সহজ হবে না।
সেদিনের মতো নিজাম চলে গেছে, কিন্তু ভাবনাটা আমার মাথা থেকে নিভছিল না। না নেভার কারণটা হলো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের ’২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনার দ্বারটা উন্মোচন করে দিয়েছে। কী হবে কতটুকু হবে সেটা বিষয় নয়। মানুষ যে তার দেশ নিয়ে ভাবতে পারছে, কথা বলছে এটাকে আমি অনেক ইতিবাচক মনে করছি। একটা সমাজে যদি প্রত্যেক নাগরিক তার দেশকে নিয়ে ভাবে অবশ্যই সে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি কেউ থামিয়ে দিতে পারবে না। সমাজের মূল শক্তিই হলো জনসাধারণ। তারা যদি রাজনীতি ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিছু মানুষের কাঁধে তুলে দিয়ে নাকে শর্ষে তেল দিয়ে ঘুমায়; সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত অন্ধকারেই থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জাতির দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।
২
কালরাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়েছিলাম। যতক্ষণ হাঁটি ততক্ষণ মাথায় নানা ভাবনা ও ঘটনা মনের পর্দায় স্ক্রল হতে থাকে। বুঝি না, অন্য মানুষের এমনটি হয় কিনা। তাজমহল রোডের বাসা থেকে বের হয়ে রেসিডেন্সিয়ালের পাশ দিয়ে আওরঙ্গজেব রোডের ওই দিকটার বড় ফুটপাতটায় প্রতিদিন হাঁটা আমার রুটিন ওয়ার্ক। আজ একটু আগেই বের হয়ে পড়েছি অস্থিরতা কাটানোর জন্য। একটু পরেই এখানে কাঁচাবাজার বসে যাবে। হাঁটার সুযোগ থাকবে না। বাজার বসার আগেই আমি চলে যাব।
কয়েকদিন যাবত প্রেসারটা ওঠানামা করছে। অস্থিরতা কাটছে না। তারকিছু সুনির্দিষ্ট কারণও আছে। রিটায়ার করেছি বছর দুয়েক হলো। সারাজীবন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছি। আমি ছিলাম মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার দায়িত্ব আমার নিতে হয়নি। আমি স্কুলে থাকতেই তিনি গত হন, মা বেঁচেছিলেন। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মা-ই আমাকে বিয়ে করান, নিজে পছন্দ করে বউ ঘরে তোলেন। মার অবাধ্য কখনো হইনি। চাকরি পাওয়ার পর মাকে আর কোনো কষ্ট করতে হয়নি। মাও চলে গেলেন এক সময়। আমি এতিম হলাম। আমার একমাত্র বোন সেও বেশিদিন আয়ু পেল না।
নিজের পরিবারকে ঘিরেই আমি মহাবিশ্বের কূলকিনারাহীন রহস্যের মধ্যে সাঁতার কেটে চলেছি। কূল-কিনারা পাচ্ছি না জীবনের। যদিও একটা উত্তরের মধ্যে সব রহস্য সন্নিবেশিত দেখতে ইচ্ছে হয়। মানুষ যে সব উত্তর দাঁড় করিয়েছে তাতে আমি সন্দিহান। আমার এই সন্দেহের দায় কি অপরাধ! মানুষ তো তার গড়া ভাবাদর্শকে সন্দেহ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে। দ্বিধাগ্রস্ত মানুষকেই হত্যা করার অনুমোদন দেয়। আমি এসবকে মানতে পারি না। ঘৃণা করি। আল্লাহতালার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন মানুষকে হেদায়েত দান করেন, মানুষ যেন মানুষকে মর্যাদা দেয়। মানুষ যেন মানুষকে সম্মান করে।
সন্তানদের আমি এই শিক্ষায় দিয়েছি। সৎ জীবন-যাপনের পরামর্শ দিয়েছি। মানুষকে ভালোবাসার কথাই বলেছি। আমার এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করার পর বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। তারা এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। তাদের এক সন্তান। মাঝে মাঝে ফোন করে। বছরে একবার দেশে আসে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থেকে যায়। মেয়ে জামাই আমাদের খুব খেয়াল রাখে। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়। মেয়েকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ না থাকলেও ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ছেলে ইতোমধ্যে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি সম্পন্ন করেছে। এখন ইন্টার্নশিপ করছে। মনের অজান্তেই ছেলেকে ঘিরে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে একটা স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল। কিন্তু ছেলের আচার আচরণে আমাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা লক্ষ করছি। মনে হচ্ছে আজকের সমাজের দুষ্ট চক্রে আমার ছেলে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আত্মপ্রতিষ্ঠার দৌড়ে সে অনেককে ছাড়িয়ে যেতে চাই। আমার সাধারণভাবে বাঁচার ধারণাকে সে আমার অযোগ্যতায় মনে করে। আমাকে এড়িয়ে চলতে দেখছি। কোনোকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতে চাই না খুব একটা। কিন্তু কয়দিন আগে ছেলের কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকায় নিয়মিত ইনস্যুলিন নিই। নিয়ম করে দুবেলা হাঁটি। সন্ধ্যায় হাঁটা শেষ করে বাসায় এলাম। ফ্যানের বাতাসে কিছুক্ষণ বসে শরীরটা জুড়িয়ে নিয়ে জামাটা খুলে গামছা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকি। শিউলি আমার জন্য খাবার রেডি করে টেবিলে সাজাচ্ছে। আমি সাধারণত আটটার মধ্যেই খাওয়া সেরে ফেলি। তারপর ঘণ্টা দুয়েক লেখালেখি করে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ি। ছেলে কোনোদিন দশটায় ফেরে কোনোদিন এগারোটায়। আমার সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয় কোনোদিন হয় না। আজ দেখলাম আমি বাসায় ফিরার আগেই সে বাসায় ফিরেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি ছেলে ড্রয়িংয়ে বসা। জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার? তুমি এসেছ কখন?
এই তো সাড়ে সাতটার দিকে।
কী, শরীর খারাপ নাকি?
না। এমনি।
আমি আর কথা না বলে খেতে বসলাম। শিউলি খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, ছেলে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
আমি তার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। আন্দাজ করতে চেষ্টা করি কী বিষয় হতে পারে? নিশ্চয় মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।
জরুরি কিছু?
শুনে দেখো।
আমি খাওয়া শুরু করলাম। দেখলাম ছেলে নিজে থেকেই খাবার টেবিলে এসে বসল। তার মা খাবার দিতে চাইল।
না। আমি এখন খাব না। আমি নাস্তা করছি বেশিক্ষণ হয় নাই। পরে খাব। বাবা। তোমাকে যেটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হলো আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। ও আমার সঙ্গেই পড়ত। এখন আমরা একসঙ্গে ইন্টার্ন করছি। আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বিরতি না দিয়ে নিঃসঙ্কোচে সে কথাগুলো বলে গেল। আমার মুখে গ্রাস তোলাটা থেমে গেল। তার দিকে চেয়ে রইলাম। বলে কী ছেলে! নিজেকে আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। শান্ত গলায় বললাম, তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তো ভালোই। তো আমার সঙ্গে কীসের আলাপ করতে চাচ্ছ?
তোমাকে জানাব না?
এই তো জানালে। আমি জানলাম। বেশ। তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে আমার তো কোনো মতামতের কিছু থাকে না। আমি আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করলাম।
না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো। একটা সামাজিকতার বিষয় আছে না। অনুষ্ঠান করার বিষয় আছে। আত্মীয়স্বজনদের জানানোর বিষয় আছে। সেটা তো তোমার দেখতে হবে।
বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তোমরা যখন নিয়েছ নিশ্চয় বিয়ের প্রস্তুতিও তোমাদের আছে?
আমাদের কোত্থেকে থাকবে? আমরা এখনো ইন্টার্নশিপ করছি। আয়োজন তোমাকেই করতে হবে।
শোনো সাফিন, তুমি যদি পরিবার বা সমাজের প্রতি কমিটেড থাকো তখন পরিবার বা সমাজের দায়-দায়িত্বের কথা বলতে পারো। যদি তা না থাকো তবে পরিবার বা সমাজের কাছে কোনো প্রত্যাশা রাখতে পারো না। এটা বোঝার মতো শিক্ষা নিশ্চয় তুমি পেয়েছ?
তার মানে আমি পছন্দ করেছি বলে তুমি কোনো দায়িত্ব নিতে চাচ্ছ না?
না। নিশ্চয় না। তুমি মেয়েটির সঙ্গে মেলামেশা করছ নিশ্চয় বিগত পাঁচ বছর ধরে। তোমাদের মধ্যে সখ্য বা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাও বেশ সময় হয়েছে। তুমি তো কখনো আমাদের জানাওনি একবারের জন্য। আমরা যদি আগে থেকেই মেয়েটাকে জানতাম, অবাক হতাম না। তোমাকে যদি না জানিয়ে আমাদের পছন্দ করা কাউকে বিয়ে করায় বাধ্য করতাম তুমি কি সেটা মেনে নিতে?
যাক, এসব প্রশ্নের প্রতিউত্তর চাচ্ছি না। নিজেরা সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছ তার প্রস্তুতিও নিশ্চয় তোমরা নিতে পারবে। আমার কিছু করার নেই। তুমি ভালো করেই জানো আমার অবস্থা। গত মাসে মোটরসাইকেলের জন্য তোমাকে আমি আড়াই লাখ টাকা দিয়েছি। আজ এসে যদি আরও দশ লাখ টাকা খরচ করতে বলো, তা তো আমি পারব না। আমি তো সরকারি চাকরি করিনি। প্রাইভেট জব করেছি। আমার কোনো সঞ্চয় নেই। আমার যা কিছু তোমাদের পেছনে খরচ করেছি।
আমি আর কোনোকিছু শুনতে চাইনি নিজের রুমে চলে গেলাম। পরে শুনলাম মাকে অনেক কিছুই বলেছে। বাপের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তার। অপ্রাপ্তির অনেক আক্ষেপ নাকি জমা আছে তার মধ্যে। কিছুদিন পর দেখি এক সন্ধ্যায় বউ নিয়ে হাজির। যা আমাদের চিন্তারও বাইরে। কিন্তু তখন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় রইলো না। ছোট বাসা। তার মধ্যে আঁটোসাঁটো করে থাকা কঠিন। ছেলে ছিল কোনো সমস্যা না। একটা মেয়ে তারও তো স্পেস দরকার স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করার জন্য। একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার সামর্থ্য নেই যে এই মুহূর্তে বড় বাসা নিই। ভেবেছিলাম ছেলে রোজগার শুরু করলে বিয়ের আগে আগে এ বাসা ছেড়ে দেব। বড় বাসা নেব যাতে সবাই একসঙ্গে থাকতে পারি। ছেলে কোনো প্রস্তুতিরই সুযোগ দিল না। মেয়েকে জানানোর সুযোগ হয়নি। পরে অবশ্য খবরটা জানিয়েছি। মেয়ে, মেয়েজামাই ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারল না। মেয়ে তো বলেই বসল⸺বাবা, তোমার এই ছেলে তোমাদের দায়িত্ব নেবে না। তোমরা তো তাকে বুঝতে দাওনি তোমাদের দায় তাকে নিতে হবে। ওইবা বুঝবে কী করে। সে বুঝ-জ্ঞান ওর হয়নি। বরং সবসময় সে তোমাদের সাপোর্ট পেয়ে এসেছে। এবার সাপোর্ট করোনি এটা ও সহজভাবে নেবে না। ওর বউও না।
তারপরও আমরা মেনে নিয়েছি, বউমাকে মনে করে নিলাম আমাদের আরেকটি সন্তান। দু জনেই বেশ যত্ন-আত্তি শুরু করে দিলাম। তাদের সকালে অফিস যাওয়ার আগে নাস্তা রেডি করে দেওয়া সন্ধ্যায় আসার আগে খাবার রান্না করে রাখা। শিউলির পরিশ্রম বেড়ে গেল। আমি তাকে সহযোগিতা করতে লাগলাম। তাদের এত ব্যস্ততা যে তারা কোনোভাবেই বাসায় সময় দেয় না। আমরাও ধরে নিয়েছি তারা সময় পায় না। কিন্তু বছর না যেতেই ছেলে দাবি করল বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য দুজনই যাবে। আমাকে পনেরো লাখ টাকা দিতে হবে। মেয়ের বাবা পনেরো দেবে। মাথায় হাত। কী করি। শেষমেশ পৈতৃক কিছু জমি ছিল সেসব বিক্রি করে দিলাম। তা থেকে বারো লাখ টাকা তার একাউন্টে জমা করলাম। সামান্য কিছু আমার একাউন্টে রাখলাম। শেষ সম্বল। আমরা দুজন অসুস্থ হলে চিকিৎসাটা তো করাতে হবে। কেন বারো দিলাম পনেরো নয় কেন? এ নিয়ে তুলকালাম বাসায়। দেখলাম বউও ছেলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমরা স্বার্থপর, আমরা তাদের ভালো চাই না। এরকম মা-বাবা তারা কখনো দেখেনি। আরও অনুল্লেখ্য বহু প্রসঙ্গ তারা টেনে আনল। আমি হতভম্ব। বলে কী! এই জন্য ছেলেকে লেখাপড়া করলাম। সর্বস্ব তার পিছে ব্যয় করলাম? আমরা কি তাহলে সত্যিই খারাপ বাবা-মা? আমরা স্বার্থপর? হ্যাঁ। এক অর্থে আমরা স্বার্থপর। সেটা হলো আমার যেটুকু তার মধ্যে তাদের মানুষ করতে যেয়ে আত্মীয়-স্বজনকে এড়িয়ে গেছি। মেইনটেইন করিনি। আজ আমি কোনো অসুবিধায় পড়লে কেউ এগিয়ে আসার নেই। অথচ যেই সন্তানের জন্য তা করলাম সেই সন্তানই বলছে আমি স্বার্থপর! আমি কথাটা নিতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিল।
৩
সাফিন আর তার স্ত্রী মায়েশা অফিস থেকে ফিরছে। সাফিনের মোটরসাইকেল মিরপুর ১০ এসে সিগনালে আটকাল। পেছন থেকে মায়েশা বলল, এই শোনো, আমরা বাইরে খেয়ে ফিরব?
বাসায় তো জানাইনি।
তাতে কী? এখন ফোন করে দাও।
সাফিন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তার মাকে কল দিল⸺মা শোনো, আমাদের দেরি হবে। বাইরে খেয়ে নেব। তোমরা অপেক্ষা করো না।
কেন? বাইরে খাবি কেন? আমি তো রান্না করলাম। খাবি না সেটা আগে জানাতে পারতি না!
শোনো কাজের মধ্যে থাকি, কখন ছাড়া পাব না পাব সেটা কি আগে থাকতে বলা যায়। ফোনটা কেটে দিল সাফিন।
মায়েশা জানতে চাইল, তোমার মা কী বলল?
কিছু না। ট্রাফিক সিগনাল ছেড়েছে। সাফিন গাড়ি টান দিল।
শোনো, আমরা ধানমন্ডি যাই, ওখানে কোনো একটা হোটেলে খেয়ে নেব। মায়েশা প্রস্তাব করে।
না। আমরা তার চেয়ে শ্যামলী রিং রোডে যাই। ওখানে নবাব রেস্তোরাঁয় অথবা প্রিন্সে খেয়ে নেব। সাফিন গোল চত্বর পেরিয়ে সোজা টানল, রাস্তাটা কাজীপাড়ার দিকে কিছুটা ফ্রি আছে। আইডিবির আগে আগারগাঁওয়ের ঐদিকে সংগীত কলেজের পাশ দিয়ে এসে বেতার ভবন হয়ে শ্যমলী শিশুমেলা পেরিয়ে রিং রোডে এসে পড়ল তারা। ঠিক করল নবাব রেস্তোরাঁয় খাবে। নিচে গাড়ি রেখে ওরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। মেন্যু লিস্ট দিয়ে খাবার অর্ডার করে দুজন মুখোমুখি বসল।
খাবার আসতে সময় লাগবে এ ফাঁকে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। আমি বাবা-মাকে রাজি করিয়েছি, তারা বিশ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছে। অতএব টাকার সমস্যা নিয়ে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। আইএলটিএস-টা শেষ হোক। এর মধ্যে আমাদের অন্যান্য প্রস্তুতি শেষ হয়ে যাবে। তবে থাকার ব্যাপারে আমার বাবা-মায়ের একটা প্রস্তাব আছে। তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে আমাদের বাসায় উঠতে বলেছে। তুমি কী বলো? প্রশ্নটি করে মায়েশা সাফিনের মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
সাফিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না। আমরা বাসা নিয়ে নেব। অফিসের কাছেই নেব এবং সেটা আগামী মাস থেকেই। সাফিনের প্রস্তাবে খুশি হলেও মায়েশা উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে জানতে চাইল, তোমার বাবা-মা কি বিষয়টা ভালোভাবে নেবেন?
মায়েশার কথায় মা-বাবার প্রতি তার অসন্তোষ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল⸺শোনো, যে বাবা-মা সন্তানের আত্মসম্মানের কথা ভাবে না। সে বাবা-মা কী ভাবল তা ভাবার দরকারটা কী? আমি তো মদ খাওয়ার জন্য তো টাকা চাইনি। বাবার তো উল্টো দায়িত্ব ছিল তোমার খরচটা দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে বলা। বউয়ের টাকাটা এখন ওর বাবা-মা দেবে কেন? সেটা তো তোর দায়িত্ব। বিয়ে করেছিস তুই এখন তার খরচ দেবে বাবা-মা এটা কেমন? তা না করে উনি আমারটাই পুরো দিলেন না।
থাকলে তো দিতেন। উনার নেই বলেই তো দিতে পারেন নাই। উনি কি তোমার ভালো চান না। না চাইলে এখনো তো তোমার খরচ দেন কী করে? তুমি উনার ওপর রাগ রেখো না। আর আমার বাবা-মা দিচ্ছে বলে তুমি আবার নিজেকে হেয় ভেবো না।
না। সেটা ভাবছি না। আমি বুঝতে পারছি না বাবা কি জমি নিয়ে বেহেস্তে যাবে। উনার যা জমি আছে গ্রামের বাড়িতে আমি যতদূর জানি আরও তিনবিঘা জমি আছে। যার বাজার মূল্য অনেক। আমি কয় টাকা চেয়েছি? মাত্র পনেরো লাখ। শোনো, উনার কলজে ছোট। সারা জীবন একা চলা অভ্যাস। স্বার্থপর একটা। আরে ওই মরলে তো এই সম্পদ আমিই পাব? আমি কি কখনো গ্রামে যাব! তাহলে?
শোনো, জমির সঙ্গে মানুষের অনেক ইমোশন জড়িত থাকে। উনার পৈতৃক জমি। এটা তুমি বুঝবে না। আচ্ছা রাখ তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ বাসা নেবে তাহলে আর উনাদের সঙ্গে লাগতে যেয়ো না। তুমি বাসা ছাড়ছ জানিয়ে দাও। আসলেই আমাদের যাওয়া-আসায় অনেক হেপা হচ্ছে। সময় নষ্ট হচ্ছে এটা বুঝিয়ে বলো।
আগে বাসা কনফার্ম করে নিই। তারপর জানাব। এখন জানালে বাড়তি তাদের আরও অনেক ইমোশনাল কথাবার্তা শুনতে হবে। আমার দিকটা যারা বোঝে না। তাদের কাঁদুনি শোনার ইচ্ছে আমার নেই।
দেখো, উনারা আবার বাসা চেঞ্জের ব্যাপারে আমাকে দায়ী করতে পারে। তুমি এটা পরিষ্কার করো যে আমি এ বাসায় থাকতে চাচ্ছি বরং তুমি যাচ্ছ। তোমার জন্য আমাকে যেতে হচ্ছে। বুঝলে কিছু?
সাফিন মায়েশার কথায় হেসে উঠল। নিজের পিঠ বাঁচাতে চাচ্ছ। বেশ তাই বলব।
আরে না না। তুমি ওভাবে দেখছ কেন? সমাজ তো আগে মেয়েদের দায়ী করে। উনারাও তাই করবেন। তোমার ওপর তো উনারা রাগ রাখতে পারবেন না। তুমি সন্তান। এক সময় না এক সময় তোমাকে মাফ করে দেবেন কিন্তু আমাকে তো ক্ষমা করতে পারবেন না, ধরে নেবেন আমার কারণেই তাদের হীরের টুকরো ছেলে তাদের ভুল বুঝেছে। আমি তাদের কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছি। আমি এই ভার বহন করতে পারব না। আমার বাবা-মা সারা জীবন আমার ভাবিকে দায়ী করে আসছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।
সাফিন মায়েশার থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করে দিল। এ জন্যেই তোমাকে আমার ভালো লাগে। যাক বাব্বা, একটা বুদ্ধিমতী বউ পেয়েছি।
স্বীকার করছ তাহলে!
না করে উপায় আছে? দুজনেই হেসে উঠল। অন্যান্য টেবিল থেকে লোকজন তাদের দিকে তাকাল। বয় এসে খাবার সাজিয়ে দিল। তারা খেতে খেতে আবার আলাপে ফিরল। সাফিনই কথা শুরু করল।
শোনো, আমার দিক থেকে আমি পরিষ্কার, বিয়ের বিষয়টায় বাবা দায়িত্ব নেয় নাই আমি নিজে করে ফেলেছি। একদিক থেকে তার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছি। বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য টাকা চেয়েছি তাও পুরো দেয়নি। গ্রামের ধানি জমিগুলোর বাজার মূল্য এখন কোটি টাকা। আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, ওসব বিক্রি করে ব্যাংকে রাখলে মাসে অন্তত আশি পঁচাশি হাজার টাকা আসবে। যা দিয়ে সংসার খরচ চলে যাবে। টাকাটাও নিরাপদ থাকবে। আমার কথা শোনে নাই। তুমি বলো, আমি কি গ্রামে যাব? সেসব সম্পদ বাবা মারা গেলে মানুষই দখল করে নেবে। কী ভাবে কে জানে?
যাক, ওসব নিয়ে আর মাথা গরম করো না। খাওয়াটা শেষ করো। আমার তো শেষ।
তোমার শেষ হলে উঠে পড়ো। হাত ধুয়ে এসে বসো। দুটো কফির অর্ডার দাও।
তারা খাবার শেষ করে তাজমহল রোডের বাসার দিকে রওনা করল। রাত তখন এগারোটা। রাস্তায় মানুষজন গাড়ি কমে এসেছে। কৃত্রিম আলোয় রাতের গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না। যেমন বোঝা যায় না সেজেগুজে থাকা মানুষের ভেতরকার সত্যিকার রূপ।
৪
শিউলি ঘুম থেকে উঠার আগেই আমি হেঁটে এসে বারান্দায় রোদে বসেছি। মাস দুয়েক যাবত কোমরের ব্যথা বেড়েছে। ডাক্তার ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি বলেছে। নানারকম ওষুধ দিয়েছে। প্রতিদিন রোদে বসতে বলেছে বিশ মিনিট করে। সেই থেকে রোজ হেঁটে এসে বারান্দায় বসি পেপারটা নিয়ে। পত্রিকায় চোখ বোলাতেই অপরাধ দুর্নীতির খবর। স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আমলাদের ধরপাকড় সাজা বিভিন্ন জনের রাষ্ট্র সংস্কারের ফতোয়া। বিএনপির মাঠদখলে মারামারি খুনোখুনির সংবাদ বেশ কয়দিন যাবত এসবে বিরক্তি ধরে গেছে। শিরোনামগুলোয় চোখ বুলিয়ে আমি পত্রিকাটি পাশে রেখে সামনের মেহগনি গাছটার সবুজ পাতায় চোখ রাখলাম। দেখি একটি কাক একা বসে আছে। দুটো বুলবুলি উড়ে এসে আরেকটি ডালে এসে বসল। চড়ুইগুলো দোতলা বাড়িটির ছাদে বসে খাবার খুঁটছে। কাকটির এতক্ষণ নড়াচড়া ছিল না। তার সাথী এসে পাশে বসতেই সে গাছের ডালে মুখটা ঘষে নিল। তারপর দুজন উড়ে গেল দূরে আমি আর দেখতে পেলাম না। আকাশ বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে রোদ উঠেছে। দূরে একখণ্ড মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে যেকোনো সময় এসে সূর্যকে ঢেকে দিতে পারে। তার না আসা অবধি আমি বারান্দায় থাকব ভাবছি এমন সময় শিউলি উঁকি দেয়।
তুমি উঠেছ কখন?
অনেকক্ষণ।
কেন ঘুম হয়নি?
না। ঘুম আসছিল না।
তোমার শরীর খারাপ করবে তো। আমি এখুনি নাস্তা দিচ্ছি। খেয়ে ঘুমাবে। ইনস্যুলিন নিয়েছ?
না।
না কেন? এক্ষুনি আসো। প্রেসারটা মাপো। টেবিলে আসো।
ও তাড়াহুড়ো করে চোখে-মুখে পানি দিয়ে কিচেনে ঢুকল। আমি ইনস্যুলিন নিলাম, প্রেসার মাপলাম। দেখলাম ১০০:১৪০। শিউলিকে জানালাম, প্রেসারটা বেশি আছে। ও অস্থির হয়ে পড়ল। ওর টকমিষ্টি বকুনি শুনতে শুনতে নাস্তা শেষ করলাম। তখনো ছেলে, ছেলে বউ ঘুমে। আজ নাকি তাদের ছুটি। সন্ধ্যায় তারা বাইরে ঘুরতে চলে গেল রাত নয়টার দিকে এসে জানালো আগামী মাসে তারা বাসা নেবে। এখান থেকে অফিস করা কষ্টকর হচ্ছে। অফিসের কাছাকাছি বাসা ঠিক করেছে। হায় আল্লাহ্! এতদিন সন্তান ডাক্তার হচ্ছে একটা আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছি। আমার সোসাইটিতে সবাইকে বলতাম, ছেলে আমার ডাক্তার হচ্ছে। বিয়ে করার পরও যাদের সঙ্গে বলেছি আমার ছেলে-ছেলেবউ দুজনই ডাক্তার। তারা সমীহের চোখে দেখত। আমার সফলতা হিসেবে তারা দেখত। অনেকে বলত, আপনি তো সফল মানুষ। ছেলেমেয়েকে ভালোভাবেই মানুষ করেছেন। আপনার ভাবনা কী?
আমি আমার কষ্টের কথা তাদের বলতে পারছি না। পারছি না বলতে আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। সন্তানকে সত্যি মানুষ করতে পারিনি।
হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে গেলাম। সোফায় ঢলে পড়েছিলাম কিছুই বলতে পারিনি। বউ ছেলে মিলে হাসপাতাল ভর্তি করেছে। স্ট্রোক। অপারেশন করতে হবে। অপারেশনও হলো। রেসট্রিক্টেড লাইফ লিড শুরু হলো।
নিজামের সঙ্গে ঐদিনের আলোচনায় আমার জীবনের পরিণতির কথা ভেবেই আমার মধ্যে এ ভাবনা কাজ করছে আমরা কোন পথে চলেছি? আমরা যা করছি তার পরিণতি তো এই যে, সন্তানরাও দায়িত্ব নেবে না। মানুষ হয়ে যাবে একা। রাষ্ট্র হয়ে যাবে অভিভাবক। আমরা কি সেরকম সমাজ চাই? আমাদের শক্তি তো সমাজ। যা পাশ্চাত্যে নেই। আমরা সেই শক্তির জায়গাটা নিজেরাই ওদের অনুসরণ অনুকরণ করতে গিয়ে ছেড়ে দেব? এটা কি বারবার ভাবা দরকার নয়?
আমার জন্য চরম সময়টা অপেক্ষা করছিল। আমি ভেবে নিয়েছিলাম যাক, আমার অসুস্থতা হয়তো ছেলের সিদ্ধান্তকে নাকচ করবে। না। সত্যি একদিন সকালে সেদিন ছুটির দিন ছিল। দেখলাম বাসার সামনে একটা পিকআপ দাঁড়ানো। ছেলে সেটাকে সাইড করে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। দু-তিনজন লোক নিয়ে উপরে উঠে িএল। তারা ধরাধরি করে জিনিস-পত্র নামিয়ে গাড়িতে তুলছে। যাওয়ার সময় বউ কিছু বলল না ছেলে বলে গেল আমরা যাচ্ছি। গিয়ে বাসা গোছাতে হবে। বাইরে খেয়ে নেব।
আমার কান্না চলে আসছিল। ছেলের মা তো হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ নিজেকে সামলে নিতে হলো। অনেকক্ষণ যাবত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, কেঁদো না, যা হওয়ার হয়েছে। আমি তো এখনো বেঁচে আছি। আমরা অন্যভাবে বাঁচব। আমরা এখন অন্যভাবে চিন্তা করি। জীবন তো শেষ করে দেওয়ার জিনিস না। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের খেলাই জীবন। তুমি শান্ত হও। বিকালে নিজামকে ফোন করলাম⸺তুমি বাসায় আছ? আমরা আসব।
ও খুশি হয়ে গেল। আপনারা আসবেন সে তো আমাদের আনন্দের বিষয়। এখুনি চলে আসেন।
না। বিকালে আসব। মনটা ভালো হয়ে গেল। আমাদের উপস্থিতি যাদের আনন্দের কারণ হয় তারাই তো আত্মীয়। এই আত্মীয়তা যেদিন সমাজে থাকবে না। সে সমাজ যতই মেশিনপত্রে ভারি হোক অর্থাৎ তথাকথিত উন্নতি! সে সমাজে যারা থাকবে তারা কি মানুষ? নাকি মানুষ নামের অন্য কোনো প্রাণী? সেই প্রাণীদের সঙ্গে আজকের আমাদের কোনো মিল পাওয়া যাবে না।
শিউলি শেষপর্যন্ত বের হলো না। ও খুব ভেঙে পড়েছে। আমাকে অনুরোধ করল, তুমি যাও। তুমি একটু ওর সঙ্গে কথা বলে আসো তোমার ভালো লাগবে।
নিজাম আদাবরে থাকে। আমি একটা রিকশায় চেপে তার বাসায় গেলাম। তার সঙ্গে অনেক কথা হলো জীবনের এই তাজা অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। ও বলল, আমি আপনার অভিজ্ঞতাটা নিলাম। আমার সন্তানদের ব্যাপারে আমি সচেতন থাকব। আপনার ওই দিনের স্বপ্নের সমাজের ভাবনাটি আমাকেও ভাবিয়েছে। এটা সম্ভব। তবে এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা আমাদের নেই। সেই রাজনীতি আমাদের নেই। আপাত এটা স্বপ্ন হিসেবে থাক। আপনার মতো স্বপ্নবানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটা আমরা করে যেতে পারি। কী বলেন? আমি না হেসে পারলাম না। মুচকি হাসলাম।
বাসায় এসে দেখি শিউলি ঘুমিয়ে গেছে। দরজা খুলছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। সারাদিন তার অনেক ধকল গেছে। আমি আধাঘণ্টা আবার বাইরে হেঁটে আসলাম। তখন বেল দিতেই ও দরজা খুলে দিল।
আমি তো একবার এসে ফেরত গেছি। একবারে হাঁটার কাজটা সেরে এলাম।
ভালো করছ। আমি ছেলেকে ফোন দিছিলাম কয়েকবার, ছেলে ফোন ধরেনি। তারপর কখন যে ঘুমায়ে গেলাম টের পাইনি।
তুমি খেয়েছ? জানতে চাইলাম।
না। খেতে ইচ্ছা করল না।
ঠিক আছে। আমি তোমাকে খাবার রেডি করে দিচ্ছি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসো। দুজন এক সঙ্গে রাতের খাবার সেরে নিলাম। অনেক কথা হলো সেদিন দুজনের মধ্যে। সিদ্ধান্তে এলাম আমরা আর এ শহরে থাকব না। আমাদের গ্রামের বাড়িতেই চলে যাব। সেখানে গিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াব। তাদের মাঝে আমরা আমাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারা কেমন সমাজ চায়। প্রতিটি ভাঙনের মাঝেই যে তারুণ্যের বীজ প্রোথিত থাকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে তা উপলব্ধি করলাম। পরস্পরকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলাম। বয়স অনেককিছুই পাল্টিয়ে দিলেও রতিসুখের অনুভূতিটুকু যেন একই রকম রয়ে যায়। যার কোনো বয়স নেই।
আজ বারবার মনে পড়ছে যেদিন প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম লেখাপড়া করতে সেদিনের কথা। মনে পড়ছে যেদিন শিউলিকে নিয়ে ঢাকায় পা রেখেছিলাম সেদিনের কথা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর এই শহরে থেকেছি এর বেড়ে ওঠা দেখেছি। কত মানুষের সঙ্গে চলেছি, কতো জায়গায় বাস করেছি কোনোকিছুই আপন হলো না। এখন যেই গ্রামে যাওয়ার কথা ভাবছি সে গ্রামের পরিবেশ আর নেই। পাল্টে গেছে অনেককিছুই। তারপরও সেখানে আছে আমার চেনাজানা স্বজনেরা যারা অন্তত একবার হলেও উঁকি দেবে জানতে চাইবে কেমন আছ? ভাবছি জীবনের একটা অধ্যায়ের শেষে গ্রামে ফেরার সুন্দর দৃশ্যপট…।